শিল্প আসলে বৈভব দিয়ে হয় না। বৈভব দিয়ে শিল্পের সরঞ্জাম কেনা যায় প্রচুর। কিন্তু খুব সাধারণ সরঞ্জামেও চিরকালীন শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। সাধারণ থাকাটাই শিল্পের বড় কথা। সত্যজিৎ রায় যখন ‘পরশপাথর’ বানিয়েছিলেন, তাতে কিন্তু কোনও নায়ক-নায়িকা ছিল না। ছিলেন এক সাধারণ মানুষ। পরশপাথর খুঁজে পেয়েছিলেন তিনিই। সাধারণ মানুষের কাছে আসলে ওই শিল্পের পরশপাথর রয়েছে।
১৭.
বিজ্ঞান এবং ধর্ম নিয়ে নানা সময় নানা পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়েছে। তা নিয়ে এই বাংলা ভাষাতেও লেখালিখি যথেষ্টই। আমার মনে হয়, বিজ্ঞান আজকে মানবিকতার উল্টোপথে দাঁড়িয়ে রয়েছে কি না, সে কথাটাই বারবার করে পরখ করা উচিত। এআই-এর চ্যালেঞ্জ আর হাতে-কলমে কাজ করার পথ দুটো আলাদা। দুর্গাপুজোর কথা ভাবুন। যাঁরা প্যান্ডেলঅলা, তাঁরা যা করতেন, নিয়ে গিয়ে বসানো হত পুজোর জায়গায়। এখন সেটার দায়িত্ব পুরোটাই এসে পড়েছে শিল্পীদের ঘাড়ে। এআই-এর নেপথ্যে যে, সে-ও তো একরকমের শিল্পী। কৃত্রিমতার মধ্যে এই চিন্তাবিশ্ব ঢুকিয়ে দেওয়ার যে ধারণা, তা শিল্পীমন ছাড়া সম্ভব। আজকের পুজোয় যদি এআই না আসে, তাহলে তো সময়-বিচ্ছিন্ন একটা প্রোডাক্ট তৈরি হবে। এতে পুজোর ঐতিহ্যের কোনও ক্ষতি হবে না। ঐতিহ্য কোনও থেমে থাকা, জড় পদার্থ নয়। তা তৈরি করে যেতে হয়।
এআই নিয়ে এক পর্বে লিখেছিলাম আমি, যে, কোনওভাবেই তা শিল্পের প্রতিস্পর্ধী নয়। আগে যেমন মানুষ মারা গেলে পোর্ট্রেট করে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা হত। তারপর তো ফোটোগ্রাফ চলে এল। তাতে কি যাঁরা পোর্ট্রেট করতেন, তাঁরা হারিয়ে গেলেন? তাঁদের কাজ চলে গেল? বরং এই নিঁখুত পোর্ট্রেট থেকে সরে গিয়েই ছবির একরকমের মুক্তি ঘটল। ড্রয়িং হত খাতায়-কলমে, এখন ট্যাবেও হয়। আমিই যখন আর্ট স্কুলে পড়েছি, রাস্তাঘাটে বসে আউটডোর করেছি– এখন তো ছবি তুলে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে আঁকছে সেইসব। এইসবই কিন্তু বিজ্ঞানের বদল। আজ এআই এসে সব বদলে দিচ্ছে, হাহাকার চলছে সে নিয়ে, কিন্তু ব্যাপারটা প্রথমবার হয়নি। আইনস্টাইন কি কখনও ভেবেছিলেন ওঁর গবেষণা, কাজ, অ্যাটমিক ফোর্সের আইডিয়া ব্যবহার করে একদিন বোম পড়বে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে? আইনস্টাইনের দায় ছিল শুধু অ্যাটমিক এনার্জিটাকে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি এই কাজটার অপব্যবহার করার কথা ভাবেননি। এখন বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানবসভ্যতা ধ্বংস করার জন্যই ব্যবহার করা হচ্ছে। মনে করে দেখুন, সত্যজিৎ রায় ‘আগন্তুক’ ছবিতে কী দেখাচ্ছেন? কেন আধুনিকতা বলতে উৎপল দত্ত ফিরে যাচ্ছেন সাঁওতালদের গ্রামে? কেন মনে করছেন তাঁরাই সভ্য?
বিজ্ঞান নিজের মতো করে এগোবে। শিল্পও নিজের মতো করে এগোবে। কিন্তু বিজ্ঞান যতটা বাতিল করার কথা বলবে, শিল্প বলবে না, শিল্প মনে রাখবে। বলে দেবে, মনে করিয়ে দেবে ইতিহাসগুলো। কিছুই মুছে ফেলা যাবে না। শিল্প তো ডকুমেন্টেশনের মতোই। মনে রাখতে হবে আমাদের মগজ এআই তৈরি করতে পারবে না। এআই আরেকটা এআই তৈরি করতে পারবে হয়তো কোনও দিন। কিন্তু এআই কোনও দিন মানবসভ্যতা গড়ে দিতে পারবে না। গড়ে দিতে পারবে না কোনও মানবিকতার স্বচ্ছ অনুভূতি। বিজ্ঞান একটা পিঁপড়েও তৈরি করতে পারেনি। ভাগ্যিস আমরা এখনও সম্পূর্ণ শিল্পবিহীন হয়ে পড়িনি। ভাগ্যিস আমরা শার্ল বোলদেয়ার পড়েছি। তাই ‘নরকে পাপের ফুল’ এই বিশেষণ দেখে এখনও চমকাই।
শিল্প আসলে বৈভব দিয়ে হয় না। বৈভব দিয়ে শিল্পের সরঞ্জাম কেনা যায় প্রচুর। কিন্তু খুব সাধারণ সরঞ্জামেও চিরকালীন শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। সাধারণ থাকাটাই শিল্পের বড় কথা। সত্যজিৎ রায় যখন ‘পরশপাথর’ বানিয়েছিলেন, তাতে কিন্তু কোনও নায়ক-নায়িকা ছিল না। ছিলেন এক সাধারণ মানুষ। পরশপাথর খুঁজে পেয়েছিলেন তিনিই। সাধারণ মানুষের কাছে আসলে ওই শিল্পের পরশপাথর রয়েছে। যা আমি বারবার খুঁজে চলেছি। আমিই সেই খ্যাপা, আপনাদের সনাতন দিন্দা।
……………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………….
(চলবে)
লেখায় সঙ্গে ব্যবহৃত প্রতিটি ছবিই সনাতন দিন্দার।
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ১৫: রাষ্ট্র যদি রামের কথা বলে, শিল্পীর দায় সীতার কথাও বলা
পর্ব ১৪: মানচিত্র মোছার ইরেজার শিল্পীর কাছে আছে
পর্ব ১৩: তৃতীয় নয়নকে গুরুত্ব দিই, তৃতীয় লিঙ্গকেও
পর্ব ১২: লাখ লাখ টাকা কামানোর জন্য দুর্গাপুজো করিনি, করব না
পর্ব ১১: বাদল সরকারের থিয়েটার পথে নেমেছিল, আমার শিল্পও তাই
পর্ব ১০: যে কারণে এখন দুর্গাপুজো শিল্প করছি না
পর্ব ৯: এদেশে শিল্প সেক্যুলার হবে না
পর্ব ৮: শুধু শিল্প নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তারা যেন বাঁচতে পারে
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত