ভারতীয় সময়ে আজ সকাল প্রায় সাড়ে-আটটা। মরদ কো দরদ হুয়া। কোপা-আমেরিকা ফাইনালে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়লেন লিওনেল মেসি। ফুটবল জীবনের শেষ কোপা ফাইনালে রিজার্ভ বেঞ্চে এসে বসলেন আর্জেন্টিনার অতিমানব। কাঁদলেন অঝোরে। শিশুর মতো। আমরা যখন ঠিক পুরুষের মতো পুরুষ হয়ে উঠিনি, বিকেলে মাঠে নামতে না-পারায়; আমরা যেভাবে ইশকুল-ব্যাগ ছুড়ে ফেলে কেঁদেছি। মেসি কাঁদলেন সেইভাবে, আমাদের স্কুলবয়সের দুঃখে, প্রকাশ্যে।
‘আমেরিকান মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশন’-এর একটা রিপোর্ট হইচই ফেলে দিয়েছিল দিনকতক আগে। ‘আলফা মেল’ নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে এত চর্চা, তার মূল উদ্দেশ্য নাকি পুরুষরা যেসব পণ্য ব্যবহার করে, তারই বিপণন করা। বিশাল পুঁজি নিয়ে পণ্য প্রস্তুতকারীরা এই বিপণনে পয়সা ঢালছে যাতে; দুনিয়ার পুরুষরা নিজেদের আরও বেশি পুরুষ করে তুলতে ঝটপট কিনে ফেলে এইসব সামগ্রী। ভারতের বাজারে ‘অ্যানিমাল’, ‘কবীর সিং’ বা ‘পুষ্পা’ জাতীয় মেল-ইগোয় সুড়সুড়ি দেওয়া সব ছবিও আদতে এই বিশাল পুঁজিতন্ত্রেরই ফসল। ‘মর্দ কো দর্দ নহি হোতা’ যে আম-জনতার পালস– সে ব্যাপারে, বুঝতে আর বাকি নেই পণ্য বিক্রেতাদের।
ভারতীয় সময়ে আজ সকাল প্রায় সাড়ে-আটটা। মর্দ কো দর্দ হুয়া। কোপা-আমেরিকা ফাইনালে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়লেন লিওনেল মেসি। ফুটবল জীবনের শেষ কোপা ফাইনালে রিজার্ভ বেঞ্চে এসে বসলেন আর্জেন্টিনার অতিমানব। কাঁদলেন অঝোরে। শিশুর মতো। আমরা যখন ঠিক পুরুষের মতো পুরুষ হয়ে উঠিনি, বিকেলে মাঠে নামতে না-পারায়; আমরা যেভাবে ইশকুল-ব্যাগ ছুড়ে ফেলে কেঁদেছি। মেসি কাঁদলেন সেইভাবে, আমাদের স্কুলবয়সের দুঃখে, প্রকাশ্যে।
মুম্বইয়ের রাস্তায় তখন বৃষ্টি। রেনকোটের ভিতর লুকিয়ে পড়েছে ‘আলফা মেল’। বাসে-অটোয় যাদের হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাব, তাদের অনেকেই দেখছেন এই দৃশ্য। প্রভাবিত হচ্ছেন কি? ফুটবলের বাইরেও মেসির প্রভাব তো কম নয়!
………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন সোহম দাসের লেখা: লা মাসিয়ার গুরুত্ব বোঝাচ্ছে ‘বিস্ময়’ ইয়ামালের উত্থান
………………………………………………………………………………………………
গত সপ্তাহে, বক্সার লাউতারো দেল কাম্পো ওরফে ‘লা কোবরা’ মাদ্রিদের ‘সান্তিয়াগো বার্নাব্যু’তে বক্সিং ম্যাচ জেতার পর গ্যালারির দিকে তুলে ধরেছিলেন মেসির বার্সেলোনার দশ নম্বর জার্সি। রিয়াল মাদ্রিদের ঘরের মাঠ, মেসির বার্সেলোনার ডার্বি রাইভালদের মাঠ। খোদ সেই মাঠেই। মনে করাতে চাইলেন ২০১৭ সালের সেই রাত। ডার্বি ম্যাচ তখন ২-২। সারা ম্যাচে প্রচুর মার খেয়েছেন মেসি। মুখ ফেটে রক্ত বেরিয়েছে। ব্যান্ডেজ বেঁধে আবার নেমেছেন। গোলও করেছেন একটা। নব্বই মিনিট পেরিয়ে খেলা ঢলে পড়েছে ইঞ্জুরি টাইমে। ডার্বি শেষ হতে চলেছে ড্র দিয়ে। রেফারি বাঁশিতে ফুঁ দেবেন, হঠাৎ, রিয়ালের বক্সের বাইরে ঝলকে উঠলেন মেসি। তাঁকে বক্সের আশপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। আচমকা যেন মাটি ফুঁড়ে উঠলেন। আর বলটা তার বাঁ-পা ছুঁয়ে, একটা বাঁক খেল। তারপর শান্ত হয়ে পড়ল মাদ্রিদের জাল জড়িয়ে।
যাঁরা স্বচক্ষে ওই খেলা দেখেছেন তাঁরা জানেন, ওই এক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল ঘড়ির কাঁটা। বিস্মিত ধারাভাষ্যকার রব পালমার, ‘ইজ হি দ্য সুপার হিউম্যান?’ এতক্ষণ কত চেষ্টাই হয়েছে মেসিকে মাঠ থেকে বের করে দেওয়ার। ফাউলের পর ফাউল। আঘাতের পর আঘাত। অথচ রক্ত মুছে বড়-পর্দার নায়কের মতো, ফিরে এসেছেন মেসি। বাকিদের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করেছেন। হতচকিত হয়ে বার্নাব্যু দেখছে বারবার পাথরে আঘাত করলে, তা থেকে বেরিয়ে আসে স্ফূলিঙ্গ। আর মেসি, সেই ৯২ মিনিটের গোলের পর তাঁর ১০ নম্বর জার্সি তুলে ধরেছিলেন বার্নাব্যুর গ্যালারির দিকে। শত্রুর ডেরায় ঢুকে, তার ওপর নিজের প্রভাব কায়েম করছেন। ঠিক যেন সিলভার স্ক্রিনের ‘আলফা মেল’।
মেসির প্রভাব ফুটবল পেরিয়ে জনজীবনে এসে পড়ে এখানেই। বড়দিনের রাতে সান্টা ক্লজ আসবেন এমনই বিশ্বাস সারা বিশ্বের শিশুদের। আর বার্সেলোনার শিশুরা বিশ্বাস করে একদিন মেসি আসবেন ন্যু-ক্যাম্পে। মেসি যেদিন আমেরিকার লিগে প্রথম নামেন, সেদিন কানায়-কানায় ভর্তি স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন হলিউডের অভিনেতা, পপ তারকা, শিল্পপতি আর ক্রীড়াবিদরা। মেসি আমেরিকায় পা রাখার পর, স্পনসরশিপের ব্যবসা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। যা অতীতে কখনও ঘটেনি। মেসির বর্তমান ক্লাব ইন্টার মায়ামির অন্যতম কর্ণধার ডেভিড বেকহ্যাম এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি রোজ ক্লাবের প্র্যাকটিস দেখতে আসি। কারণ আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, লিও সত্যিই এখানে এসেছে। কোনও স্বপ্ন নয়।’
……………………………………………………………………………………….
রোদ্দুর মিত্র-র লেখা: বিপক্ষের ডিফেন্স কিংবা বর্ণবাদ ছিঁড়ে ফুটবল শাসন করছেন নিকো উইলিয়ামস
……………………………………………………………………………………….
এ তো গেল বাণিজ্যের কথা। ব্যক্তিগত জীবনেও এর ব্যতিক্রম নেই। মেসিরই সতীর্থ নিকোলাস ওটামেন্ডি যার ডাকনাম ‘জেনারেল’, তাঁর শরীরে রয়েছে একটা ট্যাটু, মেসির বিশ্বকাপ স্পর্শ করার ছবি। মেসির সঙ্গে বিশ্বকাপ জেতার স্মৃতি। আবার, মেসি যখন ইউরোপ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তখন তাঁর আরেক সতীর্থ এমি মার্টিনেজ বলেন, ‘মেসি যদি অ্যাস্টন ভিলায় আসতে চায় তাহলে, আমি আমার পারিশ্রমিক কমিয়ে দেব।’ এমনকী, আজ দলকে কোপা ফাইনালে জিতিয়ে, গোল্ডেন বুট নেওয়ার সময়, লাউতারো মার্টিনেজ বলে গেলেন, ‘আমি মেসিকে এই কাপটা দিতে চেয়েছি। মেসিই আমার নেতা।’ আর্জেন্টিনার জনগণ সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল করে ফেলেছিল, মেসিকে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে দেখার দাবিতে। আসলে আর্জেন্টিনার সাধারণ মানুষের মনে জাতীয় নেতার প্রতিচ্ছবি তৈরি করে ফেলেছেন লিও। শুধু ফুটবল দিয়ে তাকে আর মাপা যাবে না।
প্রতিপক্ষের জীবনেও কি মেসির প্রভাব কম! ফুটবলের সব শিরোপা জেতার পরেও তাকে বলা হয় ‘মাফিয়া’। সত্যি তো মাফিয়া না হলে কি আর সবকিছু জেতা যায়? এতটা আধিপত্য দেখানো যায় জন-মানসে? অলিম্পিক, চাম্পিয়ন্স লিগ, বিশ্বকাপ, কোপা সবই আছে ঝুলিতে। ৯০ মিনিটের খেলায়, ৬৬ মিনিটে যখন তাকে তুলে নিলেন কোচ, মাত্র আধঘণ্টা খেলতে না পারার তিনি দুঃখে কাঁদলেন। চোখের জল ফেললেন ফুটবলের ‘মাফিয়া’, ‘ডন’, ‘আলফা মেল’। অনেক দূরের আমাদের এই শহরে, সামাজিক ভাবে কাঁদতে ভয় পাওয়া পুরুষদের শহরে, অধিকতর পুরুষ হওয়ার প্রতিযোগিতার শহরে তখন বৃষ্টিপাত কয়েক সেন্টিমিটার। প্রকাশ্যে।