এই সাক্ষাৎকারে উঠে আসা মণিকা দেবীর অভিনেত্রী জীবন আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক জরুরি দিক। বিশ্ব জুড়েই লিঙ্গরাজনীতি সচেতন ইতিহাস লেখকরা সাম্প্রতিক কালে আগ্রহী হয়েছেন এক বিকল্প ইতিহাসের খোঁজে-উইমেন’স হিস্ট্রি (women’s history)। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে খুব দরকারি উইমেন’স হিস্ট্রির পাঠ। আর মণিকা দেবীর মতো অভিনেত্রীদের অবদান মনে রেখে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস লেখার প্রচেষ্টা হলে বাংলা চলচ্চিত্রের একটা অন্য দিকের (women’s film history) হদিশ পাব আমরা। এই ইতিহাস সামনে নিয়ে আসে বিশ শতকের গোড়ার দিকে মহিলাদের ঘিরে আবর্তিত হওয়া কর্মক্ষেত্র ও পেশাদারিত্বের ধারণা, শ্রেণি ও বর্ণের বিন্যাস এবং লিঙ্গ রাজনীতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপট।
সময়টা গত শতকের দুইয়ের দশকের শেষ। বাংলার চলচ্চিত্র জগতের পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃত ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (ডিজি) হন্যে হয়ে নায়িকা খুঁজছেন তাঁর ছবি ‘ফ্লেমস অফ ফ্লেশ’-এর জন্যে। তাঁর অধ্যাপক বন্ধুর স্ত্রী-কে প্রস্তাব দেওয়ায় বন্ধু বলে উঠলেন, নিজের ঘরে এমন গুণী স্ত্রী আছে। আমার কাছে এসেছেন কেন? স্ত্রী প্রেমিকা দেবী ঠাকুর পরিবারের মেয়ে, ছবির জগতে প্রবেশ সহজ ছিল না মোটেই। কিন্তু রাজি হলেন স্বামীর অনুরোধে। প্রথম অভিনয়েই সবার নজর কাড়লেন। ধীরেন্দ্রনাথ-প্রেমিকার সন্তান মণিকা গুহ ঠাকুরতার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, বারবার উঠে আসছিল সেই সময়ের চলচ্চিত্রের প্রযুক্তি, কলাকুশলী ও আরও নানা দিক। মণিকা দেবী অভিনয় করেছেন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে, ‘দাবী’ (১৯৪৩) ও ‘পথিক’ (১৯৫৩) যাদের মধ্যে অন্যতম। কথা শুরু হল তাঁর বাবা ডিজি-কে নিয়ে…
চলচ্চিত্রের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা একটুআধটু খবর রাখেন, তাঁরা জানেন বাংলা সিনেমায় ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (ডিজি)-এর অবদান কতখানি। যেটা আমরা অনেকেই অতটা জানি না, তা হল চলচ্চিত্রকার ছাড়াও উনি খুব গুণী একজন মেকআপ শিল্পীও ছিলেন।
হ্যাঁ, বাবার মেকআপ নিয়ে অনেক মজার মজার গল্প রয়েছে। বাবার তখন ৩০ বছর বয়স। একদিন উনি দেবকী বাবু (বসু)-কে বলেন যে, মেকআপ এমন হতে পারে যে, কেউ অভিনেতাকে চিনতে পারবে না। দেবকী বাবু বলেন, এতটাও ভালো মেকআপ আমাদের দেশে সম্ভব নয়। এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে বাবা একদিন ভিখিরি সেজে নিউ থিয়েটার্সের গেটে চলে যান। দেবকী বাবু তো বটেই, স্টুডিওর কেউ-ই বাবাকে চিনতে পারেননি সেদিন। সে এক কাণ্ড!
উনি বেশ কিছু ফোটো অ্যালবাম বের করেছিলেন, যেগুলো খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘ভাবের অভিব্যক্তি’, ‘রং বেরং’, আরও কিছু…
৮টা কাজ করেছিলেন এরকম। বাবা এই ফোটো অ্যালবামগুলো করেছিলেন হায়দরাবাদে থাকতে। হায়দরাবাদে থাকতে উনি কলেজে পড়াতেন আর হায়দরাবাদের বাড়ির ওপরে একটা ঘর ছিল, সেটা ছিল বাবার স্টুডিও। বাবা নানারকম পেশা, বয়স ইত্যাদি ভূমিকায় সেজে ছবি তুলতেন নিজের। যেমন চোর ও পুলিশ, স্বামী ও স্ত্রী– এরকম সব চরিত্রেই বিভিন্ন রকম মেকআপ নিয়ে বাবা। তারপর সেগুলোর প্রিন্ট একসঙ্গে করে বইয়ের আকারে বেরত। হায়দরাবাদে থাকতে উনি কিছু ছবিও পরিচালনা করেন। একটি ছবির কাজ চলার সময় নিজাম অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। বাবা কলকাতা চলে আসেন তারপর।
আপনার মায়েরও অভিনেত্রী জীবনের শুরু এ সময়ই?
হ্যাঁ।
একথা অনেকেই জানি বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা চলচ্চিত্রের একটি বড় সংখ্যক অভিনেত্রী এসেছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায় থেকে। পরিস্থিতি বদলায় তিনের দশকে ছবিতে শব্দ আসায়– ছবির জগতে আসেন বাঙালি পরিবারের মেয়েরা আর সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে চলে নিন্দা–সমালোচনা। একদিক থেকে দেখলে এই নায়িকারা বিপ্লব নিয়ে আসছেন, ঘরের চার দেওয়ালের বাইরেও মহিলাদের এক নতুন কর্মজগতের ধারণা নির্মাণ করে। চলচ্চিত্রের সংগঠিত কাজের দুনিয়ায় এই ওয়ার্কিং উওম্যানের পরিচিতি আরও স্পষ্ট। নায়িকার ভূমিকায় এভাবেও ঘরে–বাইরে ছক ভাঙছেন মেয়েরা। আপনি যদি এই প্রসঙ্গে আপনার মায়ের অভিনেত্রী জীবনের কথা কিছু বলেন।
আমার মা ছিলেন ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। বিয়ের পর বাবার অনুরোধে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। মায়ের বাড়ি থেকে আপত্তি ছিল খুব। কিন্তু বাবার আগ্রহে মা উৎসাহী হয়ে দুটো ছবিতে কাজ করেন। ছবিতে অভিনয়ের জন্য ঘোড়ায় চড়াও শিখেছিলেন। ‘পঞ্চশর’ (১৯৩০) ছবিতে হিরো ছিলেন দেবকী কুমার বসু। ছবির প্রয়োজনে ঘোড়ায় চড়া, পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ার মতো কঠিন দৃশ্যে অভিনয় করে মা সমাপ্ত করলেন ছবির কাজ। কিন্তু তাঁর অভিনয় জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কঠিন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগে যখন মা চলে গেলেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২। আমার বয়স তখন দেড় বছর।
প্রসঙ্গত প্রেমিকা দেবীর মৃত্যুর পর ফিল্ম পত্রিকা চিত্রলেখা-য় (২০ ডিসেম্বর, ১৯৩০) প্রতিবেদন বেরিয়েছিল– ‘দুঃসাহসিকা ছাড়া আমাদের দেশের ভদ্রমহিলারা এখনও চলচ্চিত্র শিল্পে যোগদান করতে নারাজ। অথচ শিক্ষিত কৃষ্টি সম্পন্ন মহিলা অভিনেত্রী বিনা কোন চলচ্চিত্রই সফল হইবার কথা নয়। প্রেমিকা দেবী এই নিতান্ত দুঃসাহসিকাদের অন্যতম ছিলেন। তাহার অকাল মৃত্যুতে চলচ্চিত্র জগতের যে ক্ষতি হইল তাহা শীঘ্রই পূরণ হইবার নহে।’
হ্যাঁ, বড়-ছোট সব কাগজেই মা-কে নিয়ে লেখা বেরিয়েছিল তখন। ‘পঞ্চশর’-এর শুটিং চলার সময়েও প্রতিবেদন বেরত নিয়মিত।
আমার মনে হয় এ প্রসঙ্গে আপনার বাবার ভূমিকাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কালীশ মুখোপাধ্যায়র লেখায় পেয়েছি, তৎকালীন ধর্মতলা স্ট্রিটে একদিন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় মটর চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ভিড়ের মাঝে বই হাতে নেওয়া একটি মেয়েকে তিনি লক্ষ করেন। জানা যায় সে মেয়েটির নাম আইরিশ গ্যাসপার। ডিজি-র কাছে ওঁর মা শ্রীমতী ইসমে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব শুনেই ঘাবড়ে যান খুব। না করে দেন তৎক্ষণাৎ। ধীরেন্দ্রনাথ খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন ইসমে দেবী ইংলিশ ম্যান পত্রিকার ফোটোগ্রাফার। ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে ব্রিটিশ ডোমিনিয়ান ফিল্মসে স্টিল ক্যামেরা বিভাগের প্রধান শিল্পী হিসেবে নিয়োগ করেন। ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এরপর একদিন আইরিশকে অভিনেত্রী করার প্রস্তাব রাখেন। সবিতা দেবী নাম নিয়ে আইরিশ গ্যাসপার পা রাখেন চলচ্চিত্রের দুনিয়ায়।
হ্যাঁ, বিদেশি অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অনেকেই কাজ করতেন তখন। বাঙালি পরিবারের মেয়েদের মধ্যে ছবিতে অভিনয় করা নিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। এমনকী, ‘দাবী’তে অভিনয় করার সময় আমার পরিবারের অনেকেরই আপত্তি ছিল।
‘দাবী’ ছবিতে আপনার অভিনয় খুব প্রশংসিত হয়। ওই সময়ের পত্রপত্রিকায় আমি অনেক লেখা দেখেছি আপনার অভিনয় নিয়ে।
প্রেমেন বাবু (প্রেমেন্দ্র মিত্র) বলেছিলেন আমি গল্প লিখব মণিকা ওই চরিত্রে অভিনয় করে। বাবার উৎসাহ ছিল খুবই, কিন্তু দিদির শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে নানা আপত্তি ছিল। তাও আমি করি। সবার ভালো লেগেছিল ‘দাবী’। ‘Best actress’-এর অ্যাওয়ার্ড পাই ‘দাবী’তে অভিনয় করে। এই পুরস্কার আর সম্মান অত ছোট বয়সে আর কেউ পায়নি তখন। পরপর ছবির প্রস্তাব আসতে থাকে তাই। কিন্তু একটার পর একটা ছবি আমি করতে চাইনি।
‘দাবী’র পর তাই আপনি সেভাবে নিয়মিত কাজ করেননি?
হ্যাঁ, বাড়িতে কয়েকজন খুব আপত্তি করছিল। আমিও চাইছিলাম ক’দিন ব্রেক নিতে। আমি তখন হায়দরাবাদ চলে যাই। আমার সেজজ্যাঠা ছিলেন নিজাম স্টেটের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। তারপর ১৯৪৬-এ বিয়ে হল। কলকাতা ফিরে এসে কলেজে ভর্তি হলাম। ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব আসছিল কিন্তু খুব হাতে গোনা কিছু ছবিতেই কাজ করেছি। কাননদি (দেবী) মজা করে বলতেন, মণিকার কাছে যাবেন না, ও করবে না ছবি। (হাসি)
পরে তো ‘আশা’ (১৯৫৬) ছবিতে কানন দেবীর সঙ্গে কাজ করেছিলেন আপনি।
হ্যাঁ কাননদি খুব স্নেহ করতেন। এত প্রোটেক্ট করতেন যে প্রডাকশনকে বলে রাখতেন মণিকার জন্যে আলাদা গাড়ি যাবে। একদিন উনি বাড়িতে এলেন ‘আশা’ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে। এসেছেন কিন্তু বাড়ির বাইরে বসে আছেন ওঁর স্বামী হরিদাস বাবুকে নিয়ে। জেঠু বাড়ি ফিরে দেখছেন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বাইরে, উনি দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কৌন আয়া হ্যায়?’, দারোয়ান বলছেন, কানন দেবী। জেঠু তখুনি আমায় ডাকলেন। আমি বললাম, কাননদি তুমি এসেছ আর কোনও কথা নয়। আমি কাজ করব এই ছবিতে। হরিদাস বাবুর (ভট্টাচার্য) পরিচালনায় ছবির কাজ শুরু হল। শুটিংয়ের সময় ও তার আগে-পরে সবসময় খুব ভালো ব্যাবহার পেয়েছি কাননদির থেকে।
আপনি ছায়াদেবীর সঙ্গেও কাজ করেছিলেন তো…
হ্যাঁ, ছায়া দেবী বাবার খুব পছন্দের অভিনেত্রী ছিলেন। বাবার অনেক ছবিতে উনি কাজ করেছেন। আমি একটি ছবিতে কাজ করেছি ওঁর সঙ্গে। ‘বন্দিতা’।
‘রিভার’ ছবিতে কাজ করার প্রস্তাব নিয়ে জঁ রেনোয়া এসেছিলেন আপনার বাড়িতে?
জঁ রেনোয়া এসেছিলেন বাড়িতে। হরিসাধন দাশগুপ্ত নিয়ে এসেছিলেন। ১৯৫০ সাল সেটা। তখন আমার বড় মেয়ের বয়স ৬ মাস। জঁ রেনোয়া বললেন, উনি চান ওঁর ছবিতে আমি অভিনয় করি। কিন্তু ছবির কাজের জন্যে পুরো ইউনিট গঙ্গার ধারে থাকবে ও টানা কাজ করবে, আমাকেও ব্যারাকপুরে ৬ মাস থাকতে হবে। এটা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। তাই রেনোয়ার সঙ্গে কাজ করা হয়নি আর।
যেদেশে ক্রিকেট ধর্ম, সেই ক্ষেত্রয় শুধুমাত্র একজন বাঁহাতি ও বাঙালি প্লেয়ার হয়ে সৌরভ গাঙ্গুলির আবির্ভাব ঘটেছিল বলে কত শুচিবাই, কত ট্যাবু, কত অসূয়া, কত সংস্কার ও তার জগঝম্পের ইতি না ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা নিয়ে গবেষণা করলে ক্রিকেটের এক অন্যতর সামাজিক বীক্ষণ কি উঠে আসবে না?