প্রতিবন্ধকতার পথ পেরিয়ে লক্ষ্যের এত কাছে এসেও শূন্য হাতে ফিরে যাওয়ার মধ্যে এক তীব্র হতাশা, গ্লানি মিশে থাকে। জুড়ে থাকে নিন্দুকদের কঠোর বাক্যের শক্তিশেল। যা সময়ের পর সময় ধরে ক্ষতবিক্ষত করবে বিনেশকে। ঠেলে দেবে আফসোসের দুনিয়ায়। কিন্তু সেই ঘৃণার পৃথিবী প্রাপ্য নয় বিনেশের। তিনি দেশকে গর্বিত করেছেন। দহনদানে নিজেকে অগ্নিশুদ্ধ করেছেন।
শোকের ঢেউগুলো পাথর হয়ে বিঁধছে গায়ে। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে ততই অনুরণিত হচ্ছে গানের সেই চেনা কলিটুকু– ‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার’। সত্যি তো প্যারিসের বুকে বয়ে যাচ্ছে বিষাদসিন্ধু। প্রতিটি ভারতীয় ক্রীড়া অনুরাগীর হৃদয় শোকসন্তপ্ত। এ ব্যথা অতলস্পর্শী।
বিনেশ ফোগত হয়তো সেই যন্ত্রণার অনেক ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছেন। সোশাল মিডিয়ায় ভাসতে থাকা তাঁর উদাসী, শূন্য দৃষ্টি কিংবা বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়া মনে করিয়ে দিচ্ছে, হার মেনে নিয়েছেন দঙ্গলকন্যা। এই হার কোনও প্রতিপক্ষের কাছে নয়, নিজের নিয়তির কাছে। যা অলিম্পিকের মঞ্চে বারবার ধোঁকা দিয়েছে বিনেশকে। ২০১৬-র রিও, ২০২১-র টোকিও, এবার প্যারিস, ব্যর্থতার বিধিলিপি খণ্ডন করতে পারলেন না বিনেশ, নিজের সবটুকু দিয়েও।
অথচ কয়েক প্রহর আগেও স্বপ্নের আলো জ্বেলেছিলেন বিনেশ, কে জানত মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এমন ঘোর অমাবস্যার ছায়া নেমে আসবে তাঁর জীবনে। কাকে দোষ দেবেন বিনেশ? নিজের ভাগ্যকে? দেহমন্দিরে রক্তবীজের মতো বেড়ে ওঠা ওই ‘অভিশপ্ত’ ১০০ গ্রামকে? তাঁর চোখের শূন্যতায় সেই ভাষা পড়ে ফেলা মুশকিল।
প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে প্যারিস অলিম্পিক্সে পা রেখেছিলেন বিনেশ। মল্লযুদ্ধে তাঁকে শুধু ম্যাট নয়, লড়তে হয়েছে ম্যাটের বাইরেও, ঘৃণ্য রাজনীতির বিরুদ্ধে। যৌন হেনস্তার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের অপসারণ চেয়ে ধর্নায় বসেছিলেন দিল্লির রাজপথে, যন্তর মন্তরের সামনে। ফলাফল হয়েছিল বীভৎস। স্বৈরাচারের কঠোর আঘাত নেমে এসেছিল বিনেশদের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদীদের উৎখাত করতে করা হয়েছিল পুলিশি-বলপ্রয়োগ। সেই আঘাত সহ্য করেছিলেন বিনেশ, অক্লেশে।
৪০ দিনের ধর্না, ১৮ মাসের লড়াই দিয়েও বিনেশরা ন্যায্য বিচার পাননি। সেই প্রহসনকে উপেক্ষা করেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন কুস্তির কাছে। কিন্তু ভাগ্য বিনেশের সঙ্গে সবসময় ছলনাই করেছে। ভারতীয় ক্রীড়ার ট্র্যাজিক চরিত্র হিসেবে তাঁর যেন আসন বাঁধা। নয়তো যে ৫৩ কেজি ফ্রি-স্টাইলে তিনি সড়গড়, সেখানে অলিম্পিকে ‘অটোমেটিক চয়েস’ হয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন অন্তিম পাঙ্গাল। এ কি স্রেফ ফেডারেশনের চক্রান্ত, ভাগ্যের বিড়ম্বনা নয়?
তবু হাল ছাড়েননি বিনেশ। অমানুষিক পরিশ্রমে, অধ্যবসায়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন ৫০ কেজি ফ্রি-স্টাইল বিভাগে নামার জন্য। কিন্তু কে জানত, সেই নিখুঁত পরিকল্পনায় সূক্ষ্ম ছিদ্র থেকে যাবে। থেকে যাবে অশনিসংকেতের চোরাস্রোত। যা প্যারিসের বুকে বিপর্যয়ের কালো মেঘ ঘনিয়ে তুলবে বিনেশের কপালে। হাতে অল্প সময়, সেই অপর্যাপ্ত সময়ে নিজেকে অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুত করা সহজসাধ্য নয়। বিনেশ সেই অসাধ্যসাধনও করেছিলেন।
………………………………………………
অপ্রতিরোধ্য সুসাকি থেকে গুজম্যান, তাঁদের পরাস্ত করলেও নিজের ভাগ্যের কাছেই হার মানলেন বিনেশ। অতীত সাক্ষী, কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়াড কিংবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সাফল্য পেলেও অলিম্পিক বরাবর অধরা মাধুরী বিনেশের কাছে। জীবনের শেষ অলিম্পিকে সেই আক্ষেপ মিটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন দঙ্গলকন্যা। পদক জয়ের সৌরভে ফেডারেশন কর্তাদের অনাচারের জবাব ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
………………………………………………
যদিও শেষরক্ষা হল না। অপ্রতিরোধ্য সুসাকি থেকে গুজম্যান, তাঁদের পরাস্ত করলেও নিজের ভাগ্যের কাছেই হার মানলেন বিনেশ। অতীত সাক্ষী, কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়াড কিংবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সাফল্য পেলেও অলিম্পিক বরাবর অধরা মাধুরী বিনেশের কাছে। জীবনের শেষ অলিম্পিকে সেই আক্ষেপ মিটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন দঙ্গলকন্যা। পদক জয়ের সৌরভে ফেডারেশন কর্তাদের অনাচারের জবাব ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই যে নির্মম ভাগ্য। তা ওপর তো কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই বিনেশের। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, ওই ১০০ গ্রাম বাড়তি ওজন হ্রাস করার। রাত জেগে উন্মাদগ্রস্তের মতো করে গিয়েছেন স্ক্রিপিং, নির্জলা শরীরে অমানসিক সেই পরিশ্রম, তবু শেষরক্ষা হয়নি। তাই বুধ-সকালে যে বিপর্যয় নামল বিনেশের জীবনে, যা কাম্য ছিল না।
………………………………………………..
আরও পড়ুন অরিঞ্জয় বোস-এর লেখা: ব্যর্থতার ইতিহাস বাতিল করে এক ধন্যি মেয়ের সফল লক্ষ্যভেদ
………………………………………………..
প্রতিবন্ধকতার পথ পেরিয়ে লক্ষ্যের এত কাছে এসেও শূন্য হাতে ফিরে যাওয়ার মধ্যে এক তীব্র হতাশা, গ্লানি মিশে থাকে। জুড়ে থাকে নিন্দুকদের কঠোর বাক্যের শক্তিশেল। যা সময়ের পর সময় ধরে ক্ষতবিক্ষত করবে বিনেশকে। ঠেলে দেবে আফসোসের দুনিয়ায়। কিন্তু সেই ঘৃণার পৃথিবী প্রাপ্য নয় বিনেশের। তিনি দেশকে গর্বিত করেছেন। দহনদানে নিজেকে অগ্নিশুদ্ধ করেছেন। কর্ণের মতো বিনেশ আজ ট্র্যাজিক। ইন্দ্রজিৎ-এর মতো বিনেশ এখন ট্র্যাজিক। কিন্তু তাঁদের মতোই ঘৃণার পৃথিবীতে ভালোবাসাকে জয় করেছেন বিনেশ। চিরকালের মতো।
হে ভারতলক্ষ্ণী, পদকের জৌলুস নয়, আপনি হৃদয় জিতেছেন। ভারত-আত্মার সিংহ-হৃদয়।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………
বাংলা ভাষা সেই পাঁচের দশকে যদি বারীন ঘোষের ‘ছিন্নমূল’, সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’, ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’-এর (যেহেতু ‘নাগরিক’-এর মুক্তি পরে) জন্ম দিয়ে থাকে, তাহলে ১৯৬৯ সালে মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ ভারতীয় নববসন্তের অস্তিত্ব জানান দিল।