ডিয়ার পিএমকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তবে রয়ে গিয়েছে রক্তের দাগ। পিএমর হাতে তো বটেই, সারা দেশের দেওয়ালে দেওয়ালেও। সে দেওয়াল আরও ভয়াবহ। সে দেওয়ালকে মোকাবিলা সহজ নয়। তাই এখন সুশীল-প্রমিত-মার্জিত ভাষা, প্রতিষ্ঠান প্রসূত স্কিল দিয়ে সে দেওয়াল, দেওয়ালের ক্ষোভ-চিৎকার ঢাকা শুরু হয়ে গেছে। সত্বর সব দেওয়ালই পুরোপুরি আবার ভদ্র হয়ে যাবে হয়তো, কিন্তু ভাই-বন্ধু-বোন হারানো, সন্তান হারানো বুকের ক্ষতকে মনে রেখে দেবে এই দেওয়ালগুলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে যে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, তার পাশে লম্বা এক দেওয়ালচিত্র। লাল দেওয়ালে সাদা হরফে লেখা: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি; আমি কি ভুলিতে পারি! প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে এ-দেওয়ালে নতুন করে ম্যুরাল করা হয়, দেশের নামকরা-খ্যাতিমান শিল্পীদের উদ্যোগে। এ-বছরও ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু ফেব্রুয়ারি পার হয়ে জুলাই আসতে না আসতেই শুরু হয়ে গেল কোটাবিরোধী আন্দোলন। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল সে আন্দোলন। ন্যায্য দাবি ছাত্রদের। সে ন্যায্য দাবির মিছিলে গুলি চালাল পুলিশ। শহিদ হলেন আবু সাঈদ।
আন্দোলনে যেন আগুন লেগে গেল। মূহূর্তে সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে। শহিদের সংখ্যা বাড়তে লাগল। আন্দোলনও জোরদার হতে লাগল। ডাকা হল সমাবেশ, শহিদ মিনারে। জনারণ্য হয়ে গেল পুরো শহিদ মিনার। আর শহিদ মিনারের আশপাশের দেওয়ালগুলো, যেগুলো ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত নানা ছবি-লেখায় ভর্তি ছিল, তা ভরে উঠল এবার ক্ষোভে, আরও চিৎকারে। জড়ো হওয়া জনতার সমস্ত রাগ-ক্ষোভ, স্বজন হারানো যন্ত্রণার ভাষা হয়ে উঠল দেওয়ালগুলো। বোবা থাকতে থাকতে ভাষা পেল যেন। আদতে এটাই তো একুশ। একুশের চেতনা। রক্তাক্ত সে ভাষা, আপাত অশ্লীল-গালিতে ভরা বটে। কিন্তু তার বিকল্প ছিল না। একটা ফ্যাসিস্ট সরকারের বন্দুকের বিপরীতে যাঁরা, যাঁদের একের পর এক বন্ধু-ভাই-বোন-সন্তানের খুনে রাস্তা লাল হয়ে উঠছে, তাঁদের কাছে তো নিরাপদে থাকা সুশীল সমাজের পলিটিকাল কারেক্টনেসের দাঁড়িপাল্লার কোনও মূল্যই নেই। নেই বলেই সে নামকরা প্রতিষ্ঠানের নামকরা শিল্পীর ড্রয়িংয়ের ওপর নির্দ্বিধায় লিখে দিচ্ছে– ‘স্বৈরাচার ** না’।
এভাবেই ভেঙে যাচ্ছে তথাকথিত হাই আর্ট-লো আর্টের মেকি দেওয়াল। সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে ‘গ্রাফিতি’। হ্যাঁ গ্রাফিতিই, নিরুপদ্রব-নিরীহ দেওয়াল লিখন নয়। যা মূলত ’৫২-র একুশের সেই রক্তস্রোত, যা এই ২০২৪ পর্যন্ত প্রবাহিত; দেওয়ালে দেওয়ালে। তখন দেওয়াল রাঙিয়ে ছিল তৎকালীন চারু ও কারুকলা কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, তাঁদের ‘ভদ্র-মার্জিত-শিক্ষিত’ তুলিতে; এবার আপামর জনতা। তবে ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন ভাবে।
মাত্র ১৫-১৬ বছর আগেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেওয়াল নানারকম ‘চিকা’য় ভরা থাকত। ‘চিকা’ শব্দটা বাংলাদেশের দেওয়ালচিত্রের রাজনৈতিক পরিভাষা। এটাও স্বৈরাচারের গর্ভজাত। তখন এরশাদ সরকার ক্ষমতায়। রাস্তায় সশস্ত্র বাহিনী। গণগ্রেফতার চলছে। একদল ছাত্র নেমেছে দেওয়াল লিখতে। পুলিশ আটকাল। ছাত্ররা পুলিশকে বলল, তারা চিকা (সুঁচো) মারার লোক। চিকা মারতে বেরিয়েছে। পুলিশ ছেড়ে দিল। সেই থেকে চিকা মারা মানে দেওয়াল লেখা। এখন যাদের জেন-জি বলা হচ্ছে, অনেকের কাছেই শব্দটা অপরিচিত। কারণ, তাদের বেড়ে ওঠার সময়ে তারা চিকা মারতে দেখেনি। রাজনৈতিক দাবি লেখা মুখর দেওয়াল তাদের সামনে কখনও পড়েনি। তার মানে দেওয়াল ফাঁকা ছিল? ফাঁকা ছিল না! তাতে ছিল সরকার দলীয় সংগঠনের নেতা-নেত্রীর মুখ। নানা কোম্পানির বাহারি বিজ্ঞাপন। তার মানে এটাও নয়, জনগণের কোনও দাবি ছিল না, বক্তব্য ছিল না। মূলত জনগণের স্লোগান তোলার যে মুখ, তা বাঁধা ছিল। বিরোধী দল যারা ছিল, তাদের যে লোকজন, তারা হয় জেলের ভিতর, অথবা ‘সহমত ভাই’। ফলে বাকরুদ্ধ একটা সময়ে এসে, এই জেন-জি-কেই গলা তুলতে হল, নিরাপদ সড়কের জন্য। এই জেন-জি-রা যাদেরকে অটো পাশ জেনারেশনও বলা হত, বলা হত মোস্ট অ্যাপলিটিকাল জেনারেশন, তারা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণঅভ্যুত্থানটা ঘটাল।
এই জেন-জি জেনারেশনের আন্দোলনের ভাষা হয়ে উঠল ‘গ্রাফিতি’। ‘চিকা’র জায়গাটা নিয়ে নিল এই গ্রাফিতি। যাত্রী ছাউনির শেড, দোকানের শাটার, এটিএম বুথ, গাড়ির কাচ সব যেন তাদের লেখার জায়গা। তাদের লেখার তুলিও ‘স্প্রে ক্যান’, হ্যাশট্যাগ সহযোগে। বলা বাহুল্য, এ আন্দোলনের সঙ্গে ইন্টারনেটের লিংক আছে। এজন্যই হ্যাশট্যাগ। যাতে এটা বেয়ে এ আন্দোলনের আরও বিস্তৃত রূপ সকলের সামনে হাজির হয়। ইন্টারনেট জমানার আন্দোলনের এ এক অন্যতম বৈশিষ্ট।
তবে ২০১৩ সালের শাহবাগের আন্দোলনের সঙ্গে এর বিস্তর ফারাক আছে। প্রথমত, এ আন্দোলন নির্দিষ্ট কোনও জায়গা-কেন্দ্রিক ছিল না, নেতা-কেন্দ্রিকও না এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, এর ভাষাই আলাদা। ভদ্র-কাব্যিক ভাষা, যেটা এতদিন চর্চিত, যেটার মূলত ধারক ও বাহক ছিল এখানকার বাম সংগঠন, এবার দেখা গেল তা পুরাটাই বদলে গিয়েছে। ইংরেজির পাশাপাশি এবার প্রতিবাদের ভাষা গালিও। বাংলা-ইংরেজি দু’ভাষাতেই। তথাকথিত ভদ্র-মার্জিত হওয়ার দায় যেন তাদের নেই। না থাকার কারণও আছে। কারণ, এরা পুরাপুরি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগঠিত। রাজনৈতিক লেগ্যাসি থেকে নয় কিংবা বিপ্লব সংগঠিত করার সযত্নে লালিত কোনও স্বপ্ন থেকেও না। তাই দায় নেই। হারানোর ভয়ও নেই। এ-কারণে, প্রায় স্থবির একটা সময়ে যখনই তারা পথে নেমেছে, জান দিয়ে লড়েছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থেকেছে।
বয়সের কারণেও এটা সহজতর হয়েছে। এটা ছিল সূচনা। এরপর এই তরুণতর অংশ দ্বারা যত আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, সবগুলোরই ভাষা ছিল এই স্প্রে-পেইন্টের ক্যানের নিঃশ্বাসে লেখা ভাষা। এই ক্যানের কিছু বস্তুগত সুবিধা আছে। সহজে বহনযোগ্য তো বটেই, দ্রুতও শুকায়। লিখে দ্রুত সরে পড়তে আপনাকে বেগ পেতে হবে না। আগে যারা চিকা লিখত, যারা মূলত বাম সংগঠন, তাদের লেখার মাধ্যম ছিল প্লাস্টিক পেইন্ট, কখনও গুলানো রঙ। এই রঙের কৌটো বয়ে বয়ে লেখা, সঙ্গে ব্রাশ, যেখানে লেখা হবে, সেই জায়গার প্রস্তুতি, সব মিলিয়ে কম ঝক্কির ছিল না! লেখাও হত (হত বলছি এ কারণে, চিকার অভ্যাস তাদের এখন অনেক কমে গেছে) দলবদ্ধভাবে, আয়োজন করে, সময় নিয়ে। বিশেষ করে রাতে। কিন্তু এই স্প্রে-ক্যানের কেরামতি এটা ইনস্ট্যান্ট। একজন ব্যক্তিও এর খরচ বইতে পারে। আয়োজনেরও কিছু নেই। তাই চেতনাগত পরিবর্তনের পাশাপাশি, মাধ্যমগত পরিবর্তনও ঘটে গেল বাংলাদেশের চিকা ইতিহাসে। তবে কোটা রিফর্ম মুভমেন্ট, নো ভ্যাট মুভমেন্ট, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের যাবতীয় দেওয়াল লিখন, মোটা দাগে, চিকার চেয়ে গ্রাফিতিই বেশি। কারণ, চিকার যে সাংগঠনিক লেগ্যাসি, মূল বক্তব্যের পাশাপাশি, সংগঠনকেও বহন করার দায়, তা এর নেই। তাদের শুধু দাবিটাই লিখে দিলে হল। বাড়তি কিছু নয়। দৃষ্টিনন্দন তো নয়-ই।
আমরা পাড়ায় পাড়ায় এতদিন যে ট্যাগিংয়ের সংস্কৃতি দেখেছি, এ যেন তারই বিস্তৃতি। মূলত, ওরাও তো সামিল এ মেহফিলে। তাই তাদের হাত ধরেও যদি এ ট্যাগিং থেকে জনমুখী গ্রাফিতি সংস্কৃতির অভ্যুত্থান ঘটে, তা অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। তাই ট্যাগিং জাতীয় গ্রাফিতির যে নিয়ম, তা বহাল রেখে এই আন্দোলনের গ্রাফিতিও তাদের লেখার জায়গা নির্ধারণে সাধারণই থেকে গেছে। ভাষার বেলাতেও ভদ্র-পরিমিত হওয়ার দায় নেয়নি। একটা নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে মারার মধ্যে যে বীভৎসতা, তাকে যে ভাষায় আক্রমণ করে প্রতিবাদে নামতে হবে, সে ভাষাতেই প্রতিবাদ হয়েছে। শ্লীল-অশ্লীলের চেয়ে বড় বিষয়, এ ভাষায় রুখে দেওয়া যাচ্ছে কি না, সেটাই বিচার্য।
বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালে হলেও তার ভ্রূণ তৈরি হচ্ছে ১৯৫২ থেকে। বাংলাদেশের দেওয়াল লেখার ইতিহাসও তখন থেকেই। কিন্তু গ্রাফিতির ইতিহাস দেখতে গেলে, আমাদের সমন্বিত স্মৃতির ইতিহাস বলে, এখানকার প্রথম আলোচিত গ্রাফিতি: ‘কষ্টে আছি আইজুদ্দিন’। আশির দশকের জনৈক আইজুদ্দিন, বলা হয় তিনি ছিলেন রিকশাওয়ালা, রিকশা নিয়ে কোথাও গেলে, খালি দেওয়াল পেলে লিখে দিতেন। তার রিকশার সিটের নিচে বক্সে থাকত লেখার সরঞ্জাম। শিক্ষিত লোকের ‘ফরমাল’ গ্রাফিতি হয়তো তা নয়। কিন্তু তাও গ্রাফিতিই। টাকার গায়ে, গাছে ভুল বানানে লেখা ‘আসমা, তোমারে ভালোবসি’ যেমন গ্রাফিতি, তেমনি টয়লেটের দেওয়ালে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতার মা তুলে লেখা গালিও গ্রাফিতি। গ্রাফিতি কারণ দুয়ের মধ্যে ক্রমশ নিষ্পেষিত হতে থাকা, একলা মানুষের চাপা চিৎকারের প্রতিধ্বনি। যার জায়গা সমাজে নেই। এই একলা মানুষটাই আরও পরে শিক্ষিত হয়ে ‘সুবোধ’ হয়ে ফিরে এসেছে। ‘ফরমাল’ গ্রাফিতি হয়ে। ফরমাল কারণ, বিদেশ থেকে আমদানি করা এই ‘গ্রাফিতি’ শব্দটা দিয়ে আমরা যা বুঝি সচরাচর, যেরকম গ্রাফিতি আমরা দেখতে চাই, তার আদর্শ রূপ ছিল এই সুবোধ। ফলে তা দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বলা যায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে পপুলার গ্রাফিতিও সম্ভবত এ সুবোধ।
এই সুবোধ আইজুদ্দিনের মতো ‘অশিক্ষিত’ না অতটা। ততদিনে দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। সুবোধ বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও কথা বলেছে। আরও কাব্যিক, আরও মার্জিত ভাষাতে; ‘হবে কি’ ট্যাগলাইনে। সুবোধ সর্বদা পলায়নপর বলেই কি, মাঝে তাকে পতাকা আঁকড়ে ধরতে হয়েছে, বোঝাতে হয়েছে সেও দেশকে ভালোবাসে; বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছে? কী জানি! তবে এটা স্পষ্ট, লাইভ সাইজ এবং কাব্য আক্রান্ত বক্তব্যের কারণে সুবোধের সুবিধা হয়েছে সবার আবেগকে ছুঁতে। আর সুবোধের যে বেশ, পড়নে প্যান্ট, লম্বা আউলা-ঝাউলা চুল, হাতে খাঁচা, খাঁচার সূর্য, সবটাই বাঙালি মধ্যবিত্ত চিত্তের পালে ভালোই হাওয়া দিয়েছে। এরকম ‘পাগল’ চরিত্র (যারা ‘বিবেক’ও), যাত্রাপালা থেকে রবীন্দ্রনাথের নাটক, নানা সময়ে নানা জায়গায় বিচরণ করে গেছে। সম্ভবত তারই শেষ চিত্রায়িত রূপ এই ‘সুবোধ’।
সূর্যও অতি ব্যবহৃত সিম্বল। বাংলাদেশের প্রধান একটা দৈনিকের নামের সঙ্গে তো আছেই, ছয়ের দশক থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বামপন্থী ঘরানার বিভিন্ন পোস্টার-প্রচ্ছদসহ নানা প্রচারেও সূর্য একটি অতি ব্যবহৃত প্রতীক, আশার-নতুন দিন, সম্ভাবনার। তাই সুবোধেও যখন সেই একই সূর্য দেখি, তখন তা নতুন মাত্রা তো যোগ করেই না, বরং চোখকে ক্লান্ত করে। ‘সুবোধ কবে হবে ভোর’ জাতীয় বক্তব্যও আমাদের বাংলাদেশের ট্র্যাডিশনাল বামপন্থীদের যে চিকার বক্তব্য তার থেকে বেশি দূরে আমাদের নিতে পারে না। তারপরও সুবোধ যখন নানা প্রতিবাদে প্রতীক হিসাবে হাজির হয়, কখনও বাংলাদেশে, কখনও কলকাতায় বা শান্তিনিকেতনে, তা যতই সীমিত পরিসরেই হোক না কেন, সুবোধের যে প্রাণ আছে, এবং তা এখনও স্পন্দিত হচ্ছে, তা-ই প্রমাণিত হয়। এই স্পন্দনের মূল্য কম না। লক্ষণীয় বিষয়, দেওয়াল লিখন বা চিকা থেকে বাংলাদেশের এই উত্তরণ মোটা দাগে বা পুরোটাই সম্প্রতি পতন হওয়া একটা ফ্যাসিস্ট সময়ের গর্ভজাত। জনগণের কথা বলার অধিকার বন্ধ না হয়ে গেলে, চিকা লিখার যে দেয়াল তাও দখলে চলে না গেলে দেওয়াল লিখন থেকে গ্রাফিতির যে বিবর্তন, তা ঘটত না। যে কারণে এ সরকারের শাসনকালে মেয়র কুকুর মারার নির্দেশ দিলে তার প্রতিবাদে যেমন গ্রাফিতি হয়েছে: ‘জালিমতন্ত্র নিপাত যাক’ বলে বা ‘কুকুর মারা মেয়র, মানুষ মারা সরকার বলে; তেমনই সম্প্রতি হদিস মেলা মাইকেল চাকমা কিডন্যাপ হওয়ার পর দেওয়ালে দেওয়ালে স্টেনসিলে লেখা হয়েছিল, মাইকেল চাকমা কোথায়? বা শরীয়ত বয়াতির মুক্তি চাই।
এরকম আরও নানা বক্তব্য-ইমেজে গ্রাফিতির চোরাগোপ্তা আক্রমণ জারি ছিল নানা ভাবে, নানা জায়গায়। হয়তো তা অনেক ছোট পরিসরে। খুব বেশি দর্শকের সঙ্গে হয়তো তা যোগাযোগ করতে পারেনি, কিন্তু গলা খোলা ছিল বরাবরই। এই খোলা গলার চিৎকারই শোনা গেল এই ২০২৪-এ এসে। তখন সেটা একটা গলার স্লোগান হয়ে থাকেনি। হয়ে উঠেছে সমবেত চিৎকার। চিৎকারের প্রতিধ্বনি। মিছিল। এ মিছিল স্রোতের মতো যেখানে যেখানে প্রবাহিত হয়েছে, দুই কূলে তার ছাপ রেখে গেছে। রাস্তার দুই পাশের যত খালি জায়গা ছিল ভরে উঠেছে নানা ক্ষোভ-যন্ত্রণা-চিৎকারে। একজন মৃত শহিদের মায়ের ‘হামার ব্যাটাক মারলু ক্যানে’ প্রশ্নটা যখন পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে, দেওয়ালে দেওয়ালে, নানা রঙে, তখন তার শক্তি ভয়াবহ। অথবা যখন লেখা হচ্ছে, ‘আমার টাকায় কেনা গুলি, কাইড়া নিল ভাইয়ের খুলি’ তখন এটা নিছক শোকের বয়ান থাকে না। শোক শক্তিতে পরিণত হয়। সে শক্তিকে আমাদের আশপাশের যে নিরাপত্তার স্মারক সুসভ্য দেওয়াল, তা বেশিদিন আর বইতে পারে না। ফাটল ধরতে থাকে। সে ফাটল যখন ‘জাতির পিতা’র ছবি পেরিয়ে যখন ভারী-ধাতব মূর্তিতেও চির ধরিয়ে দেয়, তখন ভারত তো বটেই, বাংলাদেশের একটা অংশ এই গণঅভ্যুত্থানের চরিত্রের দিকে আঙুল তুলেছে, ‘ইতিহাস বিচ্যুতি’র অভিযোগে।
…………………………………………………………………
আরও পড়ুন পবিত্র সরকার-এর লেখা: বাংলাদেশে আর কি কখনও মুজিবের মূর্তি গড়ে উঠবে?
…………………………………………………………………
কিন্তু ইতিহাস বিচ্যুত আদৌ নয়, বরং তারা আগেই দেওয়ালে লিখে গেছে স্বৈরাচারের প্রতি হুঁশিয়ার: ‘রক্তের দাগ শুকায় নাই’ বা ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’। যে হুশিয়ারি পাকিস্তানিদের মুজিব ৭ মার্চ শুনিয়েছিলেন। ছাত্ররা, যারা এ অভ্যুত্থানের নায়ক, যারা ইতিহাস পাশ করেছে বেশিদিন হয়নি, দেওয়ালে লিখেছে: ‘ডিয়ার পিএম, ডোন্ট রিপিট সেভেন্টি ওয়ান।’ কিন্তু আমরা জানি, ইতিহাসের বড় স্যাটায়ার, আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না। আমাদের এক্স ডিয়ার পিএমও নেননি। আর তার দাম চুকোতে হয়েছে শত শত ছাত্রদের প্রাণের বিনিময়ে।
ডিয়ার পিএমকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তবে রয়ে গিয়েছে রক্তের দাগ। পিএমর হাতে তো বটেই, সারা দেশের দেওয়ালে দেওয়ালেও। সে দেওয়াল আরও ভয়াবহ। সে দেওয়ালকে মোকাবিলা সহজ নয়। তাই এখন সুশীল-প্রমিত-মার্জিত ভাষা, প্রতিষ্ঠান প্রসূত স্কিল দিয়ে সে দেওয়াল, দেওয়ালের ক্ষোভ-চিৎকার ঢাকা শুরু হয়ে গেছে। সত্বর সব দেওয়ালই পুরোপুরি আবার ভদ্র হয়ে যাবে হয়তো, কিন্তু ভাই-বন্ধু-বোন হারানো, সন্তান হারানো বুকের ক্ষতকে মনে রেখে দেবে এই দেওয়ালগুলো।
তবে এ অভ্যুত্থানের যে গ্রাফিতি তার অন্য একটা উজ্জ্বল দিক আছে। সেই দিক হচ্ছে তার বৈচিত্রময় উপস্থিতি। দাবির বৈচিত্র। আন্দোলন যতই অভ্যুত্থানের দিকে এগিয়েছে, ততই সে সমাজের সবার দাবিকেই ধারণ করতে করতেই এগোনোর চেষ্টা করেছে। ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা যেমন উঠেছে, তেমনই জাতিগত নিপীড়নের কথাও তুলে ধরেছে। গলা উঠেছে পাহাড়ে আদিবাসী নির্যাতনের বিরুদ্ধেও। ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক অপহৃত নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা, ২৮ বছরেও রাষ্ট্র যার হদিশ দেয়নি, বরং অপহরণের বিরুদ্ধে যে মামলাটি করা হয়, তার নিষ্পত্তিও ঘোষণা করেছে সম্প্রতি। এ গণআন্দোলন সেই কিংবা কল্পনা চাকমাকে ভোলেনি। একটা গ্রাফিতিতে বাংলায় লেখা হয়েছে কল্পনা চাকমা কোথায়? নিচে চাকমা ভাষায়ও একই প্রশ্ন। সম্ভবত ঢাকা শহরে এ প্রথম চাকমা ভাষায় প্রশ্নটা তোলা হয়! আরেকটা গ্রাফিতি এমন, কোনও একটা বন্ধ দরজায় তালা (সত্যিকারের), সে তালার পাশে জেলের গ্রিল এঁকে দেওয়া। পিছনে কল্পনা চাকমা; বন্দি!
গ্রাফিতিতেও কল্পনা চাকমা নতুন। ঢাকা শহরে তো বটেই। সম্ভবত এ সমতলেও। হয়তো কোনও আদিবাসী আন্দোলন কর্মীই একেঁছেন, নাও হতে পারে। তারপরও নজির হয়ে রইল। আন্দোলন পরবর্তী সময়েও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আদিবাসীদের অধিকারকে বিষয় করে ছবি আঁকা হয়েছে। পাহাড়েও হয়েছে। পাহাড়ে একজনকে গ্রেফতারের খবরও পড়লাম, এ লেখা লিখতে, লিখতে। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক এ আন্দোলনের গ্রাফিতির; নারীদের অংশগ্রহণ। ফোন ক্যামেরার যুগ হওয়াতে, বিভিন্ন গ্রাফিতি লেখার সময়কার ছবিও সোশাল মাধ্যমে পোস্ট হয়েছে। তাতে একটা দিক থেকে অন্তত নিশ্চিত হতে পারি আমরা, যে অভ্যুত্থান এত এত নারীর উপস্থিতিতে সরব, তাকে পেছনে ঠেলে দেওয়া সহজ হবে না। তা যে অপশক্তিই আসুক।
ছবি: রাজীব দত্ত-র সংগ্রহ থেকে