প্রয়াত হলেন পরিচালক উৎপলেন্দু চক্রবর্তী। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল সেনের পর যে-চারজন জরুরি পরিচালক উঠে এসেছেন বাংলায়, তাঁদের মধ্যে উৎপলেন্দু চক্রবর্তী ছিলেন অন্যতম। বাকিরা– গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এবং বিপ্লব রায়চৌধুরী। ‘চোখ’ সিনেমার শুটিং, উৎপলেন্দুর সঙ্গে সখ্য, সব মিলিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন অভিনেতা নিমাই ঘোষ।
উৎপলেন্দুর প্রথম ছবি ‘ময়নাতদন্ত’ (১৯৮০)। ওর নিজেরই লেখা গল্প নিয়ে। সেই ছবি করতে গিয়েই প্রথম আলাপ। গল্পে অনেককালই হাত পাকিয়েছিল উৎপলেন্দু। পরে একটা গল্পসংগ্রহও বের হয়েছিল। তবে স্বনামে না, ছদ্মনামে। সেই ছদ্মনাম– স্বর্ণ মিত্র।
আমি তখন রিহার্সাল করছিলাম একটা টিভি নাটকের জন্য। আন্তন চেকভের ‘দ্য বিয়ার’ অবলম্বনে সেই নাটক, রূপান্তর করেছিলেন সত্যেন মিত্র। বিকেল ৪টে-৫টা হবে, অরুণ মুখোপাধ্যায় ঘরে ঢুকে আমাকে বললেন, ‘আপনার নামে একটা চিঠি আছে।’ দেখলাম ঠিক চিঠি না, ছোট্ট চিরকুট! কী ব্যাপার? অরুণদা বললেন, উৎপলেন্দু আপনাকে খুঁজছে, ও ছবি করছে ‘ময়নাতদন্ত’ নামে। প্রথমে ধার-দেনা করে শুরু, পরে সরকারি সাহায্য পায়। আমি তখন তেড়ে গ্রুপ থিয়েটার করছি। উৎপলেন্দুর বহু বন্ধুই ছিল গ্রুপ থিয়েটারে। সেই সূত্রেই বোধহয় জেনেছিল আমার কথা। চিরকুটে লেখা ছিল, ময়নাতদন্তে অনেক গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেতা রয়েছেন, আপনি যদি এই ছবিতে কাজ করেন– অনুরোধ। এই চিরকুটে দেওয়া ছিল বাড়ির ঠিকানা। পাইকপাড়া, ইন্দ্র বিশ্বাস লেন। একতলার বাড়ি, যা মনে পড়ছে। কোণের দিকের একটা ঘরে থাকত ও।
চমৎকার গান গাইত ও। আমার থেকে কম করে বছর পাঁচেকের ছোট। কিন্তু মজা করে তুই-তোকারিও চলত। আমি বলতাম, ‘কী রে উৎপলেন্দু?’ উৎপলেন্দুও বলত, ‘কী রে নিমাই?’ উৎপলেন্দু আড্ডা মারতে মারতে একদিন বলেছিল ওর নকশাল জীবনের কথা। কোথায় কীভাবে লুকিয়েছিল, কী কাজ করছিল, কার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল– সেইসব।
‘ময়নাতদন্ত’-এ আমি ছিলাম রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর কাকার ভূমিকায়। সিনেমা তো সিনেমার মতো হয়ে গেল, কিন্তু পরিচালক হয়ে উঠল বন্ধু। কাজে-অকাজে ওর বাড়িতে জমে উঠতে লাগল আমাদের আড্ডা। একদিন ও জানাল, ‘চোখ’ নামে একটা ছবি করতে চায়, ওরই গল্প নিয়ে। লিড করবেন ওম পুরী। ‘আক্রোশ’ তখন সদ্য বেরিয়েছে। ওম পুরীকে নিয়ে রীতিমতো হইচই পড়ে গিয়েছে চারিদিকে! আমাকে বলল, তোমার চরিত্রটা দারুণ, তুমিই ওম পুরীর একমাত্র বন্ধু এই ছবিতে। জেলে যখন ওম পুরী বন্দি থাকবেন, তখন তুমিই ওঁর কাছে যাবে। শক্তি ব্যানার্জি ক্যামেরা করেছিলেন এই ছবির।
‘চোখ’ কাস্ট স্ট্রাগলকে মাথায় রেখে তৈরি। চোখ যেন ঠিক লোককেই দেওয়া হয়। কিন্তু যার পাওয়ার কথা সে পেল না, পেল মালিক শ্রেণির লোকেরা। পরে মালিক শ্রেণি জানতে পারে, এ তো শ্রমিকের চোখ– ফলে সে চোখ বাতিল হল। চোখ পেল না কেউ। এই ছিল চোখের গল্প। উৎপলেন্দুর গল্প এইরকমই শ্রেণিসচেতন এবং রাজনৈতিক।
সেই চরিত্র পেয়ে আমরা, অভিনেতারা ফুটছি। শ্রমিক শ্রেণির নেতা আমি। আমিই যোগাযোগ করছি। বন্দি ওম পুরীর স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া, নিজে খোঁজখবর নেওয়া– এইসব করতে হবে। তিন পর্বের শুটিং। প্রথম পর্বে আলিপুর জেলের ভেতরের একটা ঘরে স্পেশাল পারমিশন নিয়ে চারদিনের শুটিং হয়েছিল। সেই শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা সাংঘাতিক! দুপুরের দিকে যেতাম, শুটিং শেষ হতে হতে রাত। কড়া পাহারা। আর রাতের দিকে ফাঁসির আসামিদের দেখতে দেখতে বেরিয়ে আসতাম। পাশের সেলেই একজন ছিল। শুটিং দেখবে বলে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াত। তখনই বলেছিল যে, সে পুলিশকে খুন করেছে। আরেকজনও জানিয়েছিল সে খুন করেছে তার স্ত্রীকে। মাঝে মাঝেই তাদের সেলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা।
ওম পুরীকে দেখেছিলাম, এই আসামিদের মধ্যে, এই আবহে একটু একটু করে কীভাবে আসামি হয়ে উঠেছিলেন। যে আদৌ আসামি নন। আমরা ডুবে গিয়েছিলাম সেই অভিনয়ে। উৎপলেন্দুর ছোট্টখাট্টো চেহারাটা ওই ক’দিনে বদলে গিয়েছিল কীরকম। উত্তেজিত হয়ে বারবার বলছিল, চমৎকার হচ্ছে! ফ্যান্টাস্টিক!
কারখানার সামনেও একটা দৃশ্য ছিল। বহু শ্রমিক একজোট হয়েছিল। সেই ভিড়, সেই খেটে খাওয়া মানুষের ভিড়ে মিশে যেতে পেরেছিল উৎপলেন্দু ও তার টিম। আমি তখন সদ্য কাজ করতে এসেছিলাম। আর এইরকম একটা সিনেমায় কাজ করা আমাকে বদলে দিয়েছিল। ‘দেবশিশু’, ‘রং’ করেছিল পরে। অভিনয়ও করেছিলাম এই দুটো ছবিতে।
‘চোখ’ যখন কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গেল, তখন জানা যায়, কান-এ ‘চোখ’ নিয়ে নানা কথা হয়েছিল। উৎপলেন্দু ফিরে এসে নানা জনকে জানিয়েছিল, পার্শ্বচরিত্রর ব্যাপারে অনেকেই আমার কথা জানতে চেয়েছে। যদিও আমাকে জানায়নি। জানাত। হয়তো জানাত। আমাকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র তৈরি হচ্ছে। সেখানে উৎপলেন্দু বলেছিল, আমাকে নিয়ে বলবে। কিন্তু তা হল কই? উল্টে আমাকেই বলতে হচ্ছে ওর কথা।
…………………………………………..
পড়ুন অমিতাভ মালাকার-এর লেখা: অমরিশ পুরি আদতে রোজকার ভয়গুলিকেই রংচং মাখিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন
…………………………………………..
সেই সময় বলা হত, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল সেনের পর যে-চারজন পরিচালক উঠে এসেছেন, তাঁরা উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এবং বিপ্লব রায়চৌধুরী।
ক’দিন আগে শ্রীলা মজুমদারের স্মরণসভায় গিয়েছিলাম। আশায় ছিলাম, উৎপলেন্দু আসবে। কিন্তু এল না। ইদানীংকালে ও নাকি আসতে চাইত না কোথাও। আমাকে ওর ফোন নাম্বার দিয়েছিল সেই স্মরণসভার আয়োজক কমিটি। বলেও দিল ওরা, ফোনও ধরেন না আজকাল। আমি সাত-পাঁচ না ভেবেই ফোন করেছিলাম। উৎপলেন্দু ধরেছিল সেই ফোন। ‘কী ব্যাপার উৎপলেন্দু? আমি নিমাই বলছি।’ ওপারে উচ্ছ্বাস টের পেলাম, ‘আরেহ! কী ব্যাপার? একদিন এসো! তাড়াতাড়িই যোগাযোগ করছি।’
যোগাযোগ আর হল কই, উৎপলেন্দু?
ফটোগ্রাফির মস্ত শখ বিপুলদার। মাঝে মাঝেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ছবি তুলতে পত্রপত্রিকার জন্য। নানা বিষয়ে আজগুবি সব ছবি দেখেছি সে ছবি খুব একটা কোথাও প্রকাশ করতেন না। অবাক হয়েছিলাম ওঁর পাবলিক টয়লেটের প্যান ভর্তি বিষ্ঠার ছবি দেখে। অনেক। গা ঘিনঘিন করেনি, বরং মনে হচ্ছিল যেন চমৎকার সব বিমূর্ত চিত্রকলা।