সুরার ভাই ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম ভারততত্ত্ববিদ, তিনি ‘লেনিন বিদ্যালয়’-এ পড়াতেন, সম্ভবত সেই সূত্রেই গোপেন চক্রবর্তীর সঙ্গে আলাপ, প্রেম ও পরিণয়। তবে পরিণয় সম্ভবত রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়নি। বিদেশিদের সঙ্গে বিবাহ সেই সময় বিধিবদ্ধ ছিল না, এমন নয়। শুধু ১৯৪৭-১৯৫২ সাল পর্যন্ত অইনত নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৫৩ সাল থেকে সে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। তাছাড়া তাঁর সমসাময়িক অবনী মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী-ই তো রুশি ছিলেন– অবশ্য কেউ কেউ বলতে পারেন অবনী মুখোপাধ্যায় তো সোভিয়েত নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
২৮.
বিপ্লবীর মস্কোয় পুনরাগমন
সুরা, যার নাম অবশ্যই আলেক্সান্দ্রা, তাঁকে আমি গোপেনদার মস্কোর ফ্ল্যাটে কোনও দিন দেখিনি। আমি যখন মস্কোয় আসি, ততদিনে তাঁর বয়স বোধহয় ৭০ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর অল্প বয়সের একটা ছবি গোপেনদার ঘরে আলমারির ভেতরে দেখেছিলাম। অপূর্ব সুন্দরী! যতদূর মনে পড়ে গোপেনদা বলেছিলেন ‘বালাবুশেভিচ্’ তাঁর পৈতৃক পদবি– অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে– তাঁর বাবা সেই সময়কার একজন অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী ছিলেন। একবার কথায় কথায় গোপেনদা আক্ষেপ করে বলেছিলেন দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় সুরার ছবি পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। যখন তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান, তখনও তাঁর মেয়ে ‘জয়েচকা’ বা ‘জোইকার’ জন্ম হয়নি।
গোপেনদার মেয়ে জয়েচকাকে অবশ্য গোপেনদার বাসায় একাধিকবার দেখেছি। গোপেনদার জামাই ইউরিকেও দেখেছি। গোপেনদা ওদের দু’জনের সঙ্গেই আমার আলাপও করিয়ে দিয়েছিলেন। তবে দু’জনকে একসঙ্গে গোপেনদার বাসায় কখনও দেখিনি। পরে শুনেছি ওদের দু’জনের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও ইউরি গোপেনদার কাছে প্রায়ই আসতেন। প্রথমবার যখন গোপেনদার মেয়েকে দেখি, তখনই তিনি মাঝবয়সি। প্রথমবার তাঁকে দেখে চমকে উঠেছিলাম গোপেনদার চেহারার সঙ্গে তাঁর আশ্চর্যরকম মিল দেখে।
………………………………………………
জয়ার জন্মের আগেই তাঁর বাবা ভারতে ফিরে আসেন এবং সকল যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। কয়েক বছর পর তাঁরা খবর পান যে তাঁকে ইংরেজরা গুলি করে হত্যা করেছে। সেকালে এমনটি স্বাভাবিক ছিল এবং রাশিয়ার তৎকালীন পরিস্থিতিতে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের কোনও উপায়ও ছিল না।
……………………………………………….
সুরার ভাই ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম ভারততত্ত্ববিদ, তিনি ‘লেনিন বিদ্যালয়’-এ পড়াতেন, সম্ভবত সেই সূত্রেই গোপেন চক্রবর্তীর সঙ্গে আলাপ, প্রেম ও পরিণয়। তবে পরিণয় সম্ভবত রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়নি। বিদেশিদের সঙ্গে বিবাহ সেই সময় বিধিবদ্ধ ছিল না, এমন নয়। শুধু ১৯৪৭-১৯৫২ সাল পর্যন্ত অইনত নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৫৩ সাল থেকে সে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। তাছাড়া তাঁর সমসাময়িক অবনী মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী-ই তো রুশি ছিলেন– অবশ্য কেউ কেউ বলতে পারেন অবনী মুখোপাধ্যায় তো সোভিয়েত নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
এর পরের ঘটনা, অর্থাৎ পাঁচের দশকের মাঝামাঝি কোনও এক সময় মেয়ে জোইকা কীভাবে কলকাতায় গিয়ে বাবাকে খুঁজে বের করেন এবং মস্কো রেডিয়োতে তাঁর জন্য একটি চাকরি জোগাড় করে তাঁকে মস্কোয় নিয়ে আসেন– সে কাহিনি আমরা নানা সূত্রে নানাভাবে শুনেছি। তা সত্ত্বেও নয়ের দশকের শুরুতে কোনও এক সময় মস্কোয় থাকাকালে আমার বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু এবং এককালে ‘প্রগতি’-তে আমার সহকর্মী দ্বিজেন শর্মা ব্যক্তিগত উদ্যোগে জোইকার যে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, সেখান থেকে এই প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। জোইকার বয়স তখন ৬৬, তাঁর মায়ের বয়স ৮৮– তিনি জীবিত হলেও শয্যাশায়ী, তবে তাঁর স্মৃতিশক্তি অটুটু।
দ্বিজেনদা যখন এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তখন আমি ছুটিতে কলকাতায় ছিলাম, তাই উপস্থিত থাকতে পারিনি। থাকলে আমি কিছু প্রশ্ন করতাম।
জয়ার জন্মের আগেই তাঁর বাবা ভারতে ফিরে আসেন এবং সকল যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। কয়েক বছর পর তাঁরা খবর পান যে তাঁকে ইংরেজরা গুলি করে হত্যা করেছে। সেকালে এমনটি স্বাভাবিক ছিল এবং রাশিয়ার তৎকালীন পরিস্থিতিতে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের কোনও উপায়ও ছিল না। ইতিমধ্যে সুরা তাঁর ভাইয়ের চেষ্টায় ‘লেনিন বিদ্যালয়’-এ গ্রন্থাগারিকের একটি চাকুরি পান, যেখানে মার্কিন দেশ থেকে সদ্য ফেরত জনৈক রুশি কমিউনিস্টের সঙ্গে পরিচিত হন এবং তাঁকে বিয়ে করেন। জয়াকে ওই বিপিতা খুবই ভালোবাসতেন এবং তাঁরা সুখেই ছিলেন।
“ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সুরার আকাদেমিশিয়ান ভাই দিল্লি সফরে যান এবং সুরার প্রাক্তন স্বামী বেঁচে আছেন জানতে পারেন। অতঃপর জয়া বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি কলকাতা রওয়ানা হন। সেই যাত্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে জয়া বলেন: বিমানে বসে আকাশপাতাল কত কিছু ভাবছিলাম। ইংরেজি জানি, কিন্তু বলতে পারি না। জীবনে বাইরে কোথাও যাইনি। কলকাতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। টেলিগ্রাম পাঠানো সত্ত্বেও সেটা পৌঁছোবেই এমন কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। পাশে বসে ছিলেন জনৈক ইংরেজ। সম্ভবত আমার অবস্থা আঁচ করে নিজেই আলাপ করেন এবং সব ধরনের সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে আমাকে নিশ্চিত করতে চান। কলকাতা পৌঁছে দেখি কেউ আমাকে নিতে আসেনি। ইংরেজ ভদ্রলোক মাইকে আমার নাম ঘোষণার ব্যবস্থা করেন, কিন্তু কোনো সাড়া মেলে না। আমার কী অবস্থা! অগত্যা তিনি আমাকে তাঁর গাড়িতে তুলে আমার গন্তব্যে রওয়ানা হলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাড়িটার হদিশ মেলে। একটি সরু গলিতে অন্ধকার এক ভূতুড়ে বাড়ির সামনে আমরা দাঁড়ালাম। আদুড় গা ধুতিপরা এক বৃদ্ধ দরজা খুললেন। মনে হল আমাকে দেখে অবাক হয়েছেন। বুঝলাম টেলিগ্রাম তাঁরা পাননি। আমি হোটেলে যাব কি না ইংরেজ ভদ্রলোকটি জানতে চান। কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শেষে বলতে পারেন, অনিশ্চিতেই ঝাঁপ দিলাম। সুটকেস নিয়ে অন্ধকার ঘরে ঢুকে পড়লাম। আমাকে ভিতরের ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে বিছানায় শুয়ে আছেন এক মুমূর্ষু বৃদ্ধ, আমার পিতামহ। কেউ কথা বলছেন না। অসহ্য শ্বাসরোধী আবহ। হোটেলে ফিরে যাওয়ার কথা মনে হচ্ছিল এবং তখনই উচ্ছল কলকণ্ঠে গুমোট অন্ধকার কেটে গিয়ে হঠাৎ আলো ফেটে পড়ল। আমার পিতৃপক্ষীয় অল্পবয়সি আত্মীয়দের একটা গোটা দল ঘরে ঢুকল এবং আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার বাবা এসেছিলেন পরে, কিছুটা দূরে তাঁর বাড়ি থেকে, ওখানে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে তাঁর সংসার, তাই সেই ঠিকানা আমাকে দেননি।’ (‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’, দ্বিজেন শর্মা, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৯১, পৃ. ৩২-৩৯)।
এরপর, আগেই বলেছি, দেশে ফিরে জোইকা তাঁর বাবাকে মস্কো আনার ব্যবস্থা করেন। গোপেনদা মস্কো রেডিয়োতে চাকরি পেয়ে সেই থেকে মস্কোতেই থেকে যান।
এই প্রসঙ্গে ১৯৫৬ সালে মস্কোর বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশনায় অনুবাদক হিসেবে সদ্য যোগদানকারী কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী রেখা চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা থেকেও দু’-এক ছত্র উদ্ধার করা যেতে পারে: ‘একদিন বিকেলে একটি মেয়ে তার স্বামীকে নিয়ে এল। মেয়েটি বলল গোপেন চক্রবর্তীর মেয়ে। ভারি সুন্দর মেয়েটি। কালো চুল, চোখ কালো, গায়ের রং জলপাই-এর মতো। দুজনেই অল্পবয়েসি। মেয়েটির নাম জোয়ে (জয়া)। মেয়েটি বলল, বাবাকে আনব তাই আপনাদের সঙ্গে আলাপ করতে এলাম। বাবার একা একা লাগবে না।… পরে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওর বাবার জন্য ঘর ঠিক করে সাজিয়েছে। খুব ভালো লাগল। ওর মা আলাদা থাকেন। তিনিও এসেছিলেন।’ (স্মৃতিরেখার স্মৃতির ঝাঁপি: রেখা চট্টোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং ২০১৫, পৃ. ৯৯)
তবে গোপেনদা মস্কোয় চলে আসার পর সুরা তাঁর প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে কখনওই দেখা করেননি, যদিও তাঁর বর্তমান স্বামী এর অল্প কিছুদিন পরে মারা যান।
গোপেনদার ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মস্কোয় হিন্দুস্তানি সমাজের পক্ষ থেকে ওঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় সেখানকার একটি কমিউনিটি হল ভাড়া করে। ১৯৮০ সালের ঘটনা। বিংশ শতাব্দীর সমবয়সি মানুষ গোপেনদা। প্রচুর খাওয়া-দাওয়া ও গানবাজনার আয়োজন হয়েছিল। আমিও রান্না করে খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন গোপেনদা তাঁর বিপ্লবী জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৭। বিপ্লবের ভাঙা হাট ও একজন ভগ্নহৃদয় বিপ্লবী
পর্ব ২৬। ননী ভৌমিকের মস্কোর জীবনযাত্রা যেন দস্তইয়েভস্কির কোনও উপন্যাস
পর্ব ২৫। ননীদা বলেছিলেন, ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না
পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ
পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে
পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত
পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি