বস কে? যে আপনাকে প্রমোশন দেয়, ফলে আপনার গাড়িটা, বাড়িটা আরেকটু ভালো হয়। মুসুম্বি লেবুর জায়গা করে নেয় অ্যাভোকাডো। হ্যাঁ, সেটার জন্য হয়তো নিজের ছেলের প্রথম জন্মদিনের দিনও বসে বসে প্রেজেন্টেশন বানিয়েছেন। কিন্তু বস বললে যে লোকটা নিজের জীবন দিয়ে দিতেও রাজি তার কাছে এ আর এমন কী! আর এই এতটা পরিশ্রমের ফলে শেষমেষ তিনিও যখন বস হয়ে হয়েছেন তখন স্বাভাবিকভাবে তিনি নিজের কর্মচারীদের কাছ থেকে সে ব্যবহারই আশা করেন যে-ব্যবহার কর্মচারী থাকাকালীন উনি নিজেও করেছেন। এইবার আপনি যদি ‘ধরা যাক আজ রবিবার কোনও কাজ করব না’ মোডে চলে গিয়ে রাত্রি সাড়ে দশটা নাগাদ বসের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ফোনটা না তোলেন, তাহলে তো আপনার জায়গাটা বেশ নড়বড়ে হয়ে গেল।
সত্যজিৎ রায় নির্মিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিটিতে রবি ঘোষ অভিনীত শেখর চরিত্রটি বন্ধুদের সঙ্গে জঙ্গল বেড়াতে গিয়ে ‘ড্রামাটিক ব্যাপার’ করার জন্য খবরের কাগজ পুড়িয়ে দিয়ে বলেছিল– ‘সভ্যতার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করলাম’।
আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই বোধহয় আছে এমন এক বন্ধু, তাই না? সেই বন্ধুটি যে আপনাকে আপনার নতুন প্রেমিক-প্রেমিকার সামনে বেফাঁস পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য পারে না, এমন কাজ নেই। সেই বন্ধু, যে না-আসলে জমায়েত বৃথা! দলের প্রত্যেকের প্রাচীনতম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মাঠ-ময়দান করা ঘটনাও যার মুখস্থ। যে হইহুল্লোড় করে, ইয়ার্কি মেরে, মাতিয়ে রাখা সারাটাক্ষণ, আর জমায়েতের সময় কেউ ফোন ঘাঁটলে বা তড়িঘড়ি বেরিয়ে যেতে চাইলে ফোন লুকিয়ে রাখে। কিন্তু সেই সবচেয়ে ফাজিল, কোনও কিছুতেই তোয়াক্কা না করা বন্ধুটিকেও চুপ করিয়ে দেওয়ার মোক্ষম উপায় হল– ‘আরে ভাই বস ফোন করেছে!’ এর উত্তরে সে বড়জোর বলতে পারে, ‘আমরা কেন চুপ করব, তুই বাইরে গিয়ে ফোন ধর’, কারণ সে-ও জানে ‘বস’ ফোন করলে তুলতে হয়। সেটাই অলিখিত নিয়ম।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার এ বিষয়ে একটি লিখিত নিয়ম করেছে। যার অবস্থান অবশ্য এই অলিখিত নিয়মের সম্পূর্ণ বিপরীতে। সেখানে বলা হয়েছে– কাজের সময়টুকু বাদ দিয়ে বসের ফোন ধরা বাধ্যতামূলক নয়। এমনকী, কাজের বাইরে তাঁকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ারও কোনও দরকার নেই। রীতিমতো আইন পাশ হয়েছে, তা কার্যকরও হয়েছে। যে-আইনে লেখা আছে যে কোনও কর্মচারীর কাজের সময়টুকু বাদ দিয়ে তার বসের অনুরোধ না রাখার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। কাজের সঙ্গে জড়িত সমস্ত যন্ত্রপাতি যেমন মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ইত্যাদিও বন্ধ রেখে আক্ষরিক অর্থে সভ্যতার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করা যাবে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কিছু দেশে অনেক কাল ধরেই এই নিয়ম চালু ছিল। এখন অস্ট্রেলিয়াও সেই পথ অনুসরণ করল। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য হল কাজটাকে কাজের ক্ষেত্রেই বেঁধে রাখা। যতক্ষণ কাজের জায়গায় আছেন, ততক্ষণই কাজ। সেখান থেকে বেরোনোর পর আপনি গান গাইলেন না ‘সহজে পেঁচা প্রতিপালন’ করা নিয়ে বই লিখলেন, তা আপনার ব্যাপার। সেখানে কেউ মাথা গলাতে যাবে না।
……………………………………………………
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার এ বিষয়ে একটি লিখিত নিয়ম করেছে। যার অবস্থান অবশ্য এই অলিখিত নিয়মের সম্পূর্ণ বিপরীতে। সেখানে বলা হয়েছে– কাজের সময়টুকু বাদ দিয়ে বসের ফোন ধরা বাধ্যতামূলক নয়। এমনকী, কাজের বাইরে তাঁকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ারও কোনও দরকার নেই। রীতিমতো আইন পাশ হয়েছে, তা কার্যকরও হয়েছে।
……………………………………………………
আসলে সেই করোনার সময় থেকেই ‘অফিস’ বিষয়টা একেবারে বাড়ির লোক হয়ে গেছে। হ্যাঁ, সেটার ফলে হাফপ্যান্ট পরে, পাশবালিশ জড়িয়ে কন-কলে ‘অ্যাম আই অডিবল, অ্যাম আই অডিবল’ করা যাচ্ছে। নিজের মিষ্টি বিছানাটার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে, পা দোলাতে দোলাতে, মেল করা যাচ্ছে। ভুঁড়ি চুলকোতে চুলকোতে প্রোগ্রামিং করা যাচ্ছে। যদিও শুনতে একবারে সন্দেশের মতো ভালো, এই জিনিসটার দু’খানা অন্য দিকও রয়েছে। প্রথমত, বাড়ি থেকে কাজ করার কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকছে না। রাত এগারোটা হোক, বা সকাল আটটা, বা সন্ধ্যা সাতটা বা আপনার বিবাহবার্ষিকী, কন-কলে শিডিউলে আপনি থাকতে বাধ্য। প্রেজেন্টেশন দিতে বাধ্য। মিটিং করতে বাধ্য। দ্বিতীয়ত, সেই বাধ্যতায় আমরা অভ্যস্থ হয়ে গেছি। আমাদের মনে হচ্ছে না– এ জিনিস দিনের পর দিন চলতে পারে না। উল্টে মনে হচ্ছে, এটাই তো স্বাভাবিক, হওয়ার কথা। কারণ আমরা বড়ও হয়েছি ঠিক এভাবেই।
‘এ যা যুগ পড়েছে তাতে কাজের জায়গায় একটু অ্যাডজাস্ট করতে হয়ই’– এই কথা আমরা সেই প্রস্তরযুগ থেকেই কি নিজের বাড়িতে কখনও না কখনও শুনিনি? বাড়ির অনুষ্ঠানে দেখিনি বাবার ‘বস’-কে ছোট পিসেমশাইয়ের থেকেও বেশি খাতির পেতে? আলবাত দেখেছি আর শুধু আমি বা আপনি দেখিনি, আমাদের যিনি বস, তিনিও দেখেছেন। তিনিও এই শিক্ষাতেই বড় হয়েছেন– ‘এ যা কম্পিটিশনের যুগ তাতে তুই না করলে অন্য কেউ হাসতে হাসতে করে দেবে’। এইবার প্রতিটি শাশুড়ি যেমন একদিন বউমা ছিল, তেমনই প্রতিটি বসও একদিন কর্মচারী ছিলেন। সেই কর্মচারী জীবনে বর্তমান ‘বস’ নিজের তৎকালীন বসকে মনে মনে ‘জো হুজুর’ স্থান দিয়েছিলেন। বসের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। কারণ বস হল সেই লোকটা যাঁর ওপর আপনার বেঁচে থাকা নির্ভর না করলেও, আপনি ওটাই জানেন, ওটাকেই সত্যি মনে করেন।
বস কে? যে আপনাকে প্রমোশন দেয়, ফলে আপনার গাড়িটা, বাড়িটা আরেকটু ভালো হয়। মুসুম্বি লেবুর জায়গা করে নেয় অ্যাভোকাডো। হ্যাঁ, সেটার জন্য হয়তো নিজের ছেলের প্রথম জন্মদিনের দিনও বসে বসে প্রেজেন্টেশন বানিয়েছেন। কিন্তু বস বললে যে লোকটা নিজের জীবন দিয়ে দিতেও রাজি তার কাছে এ আর এমন কী! আর এই এতটা পরিশ্রমের ফলে শেষমেশ তিনিও যখন বস হয়ে হয়েছেন তখন স্বাভাবিকভাবে তিনি নিজের কর্মচারীদের কাছ থেকে সে ব্যবহারই আশা করেন যে-ব্যবহার কর্মচারী থাকাকালীন তিনি নিজেও করেছেন। এইবার আপনি যদি ‘ধরা যাক আজ রবিবার কোনও কাজ করব না’ মোডে চলে গিয়ে রাত্রি সাড়ে দশটা নাগাদ বসের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ফোনটা না তোলেন, তাহলে তো আপনার জায়গাটা বেশ নড়বড়ে হয়ে গেল। গুডবুক থেকে সোজা বেঞ্চে। এমন পরিণতি কে বা চায়! তাই আপনাকেও চলে যেতে হয় সবার ওপর বস সত্য তাহার উপর নাই মোডে। এরপর আপনিও যখন একদিন বস হবেন… তখন ওই… ওই আর কী… একই জিনিস হয়ে চলেছে লুপে…
………………………………………………………
আরও পড়ুন শুভঙ্কর দাস-এর লেখা: বাংলায় বিলুপ্তির পথে বাঘ-পুতুলের শিল্পধারা
………………………………………………………
এ জিনিস হয় কারণ এতে কোনও বাঁধা নেই। আরে এই জিনিস বন্ধ হতে পারে তখনই যখন নিউটনের সূত্র মেনে বাইরে থেকে কোনও কড়া আইন প্রয়োগ করা হবে। যখন লিখিতভাবে বলা হবে, এ জিনিস করা যায় না। আপনি চাইলেই যখন তখন আপনার কর্মচারীর ব্যক্তিগত জীবন ডেটায় ভরিয়ে তুলতে পারেন না। অস্ট্রেলিয়াতে ঠিক সেইটেই হয়েছে। এই বিষয়গুলো না পারার আওতায় চলে এসেছে। হয়তো আমাদের দেশেও এরকম হবে কোনও একদিন। আইন হবে, অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আপনার সহ-গায়ক, বা পেঁচা প্রতিপালককে আর বলতে হবে না, ‘আটটা থেকে একটা কল আছে, ওটা সেরে আসছি’।
সেই দিন বোধহয় শেখরের সংলাপখানা এভাবেও বলা যাবে,
‘কাজ নেই তাই হাসছে!’
হাসাহাসির দিন আসুক সত্বর।
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
………………………………………………