দিকে দিকে পাঠকরুগ্ণ লাইব্রেরির বাজারে অলৌকিক লাগছে তো এই দৃশ্য? অথচ অলৌকিক নয়, ঘোর বাস্তব। পরের প্রশ্ন, কোথায় দেখা মেলে ঘোড়া লাইব্রেরির? সে উত্তর দেওয়ার আগে স্বীকার করা ভাল, যে ইন্টারনেট আর অত্যাধুনিক মোবাইল ফোনের দুনিয়ায় সিধু জ্যাঠাদের অপমৃত্যু ঘটছে দিকে দিকে। উইকি সার্চ করছে না কেন ফেলুদা? প্রশ্ন তুলছে বঙ্গীয় নব্য প্রজন্ম।
কুয়াশা কেটে সূর্য উঠছে পাহাড়ে। সেই প্রথম আলোয় পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উঠছে একটি ঘোড়া। বিপজ্জনক রাস্তা। এক ধারে খাদ। অশিক্ষার মতো অতল খাদ। তবু থামার ফুরসত নই ঘোড়ার। অবশ্যি ঘোড়া নয়, ‘ঘোড়া লাইব্রেরি’ বললে ঠিক বলা হয়। কারণ ওর পিঠ ভর্তি বই। চড়াই ডিঙিয়ে ওই বই পৌঁছে যাবে দুর্গম দূরে, প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুদের হাতে হাতে। তারপর আরও এক ভোরের সম্ভাবনা!
দিকে দিকে পাঠকরুগ্ণ লাইব্রেরির বাজারে অলৌকিক লাগছে তো এই দৃশ্য? অথচ অলৌকিক নয়, ঘোর বাস্তব। পরের প্রশ্ন, কোথায় দেখা মেলে ঘোড়া লাইব্রেরির? সে উত্তর দেওয়ার আগে স্বীকার করা ভাল, যে ইন্টারনেট আর অত্যাধুনিক মোবাইল ফোনের দুনিয়ায় সিধু জ্যাঠাদের অপমৃত্যু ঘটছে দিকে দিকে। উইকি সার্চ করছে না কেন ফেলুদা? প্রশ্ন তুলছে বঙ্গীয় নব্য প্রজন্ম। ‘ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে’– এই ভাবনাও বুঝি ধোঁয়াশায়। তাছাড়া দলবেঁধে পাড়ায় পাড়ায় বাঙালি যুবকদের গ্রন্থাগার গড়ার উদ্যোগ অতীত। পাঠ না করলে পাঠাগারের প্রয়োজনটাই বা কী?
তবু বেঁচেবর্তে বই, লাইব্রেরি। ভাগ্যিস এক পৃথিবীর সকলেই এক কালখণ্ডের অধিবাসী নন। উত্তরাখণ্ডের কুমায়ূন অঞ্চলের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামগুলি সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি, চেন্নাইয়ের মতো কসমোপলিটন শহরগুলির থেকে কম করে ৫০ বছর পিছিয়ে। স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো প্রাথমিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। মৃত্যুশীত-খাড়াই-পৃথিবীতে নিতান্ত বেঁচে থাকাই চ্যালেঞ্জ। শিশুদের জন্য শিক্ষার আলো তো দূর, বহু দূর! বহু গ্রামে স্কুল নেই। অশিক্ষার অতল খাদের ধারে বিপজ্জনক বেঁচে থাকাই নিত্য জীবন। সেই অভ্যাস ভাঙার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন ২৯ বছরের এক যুবক।
নাম শুভম বাধানি। নৈনিতালের বাসিন্দা। নিজে একজন লাইব্রেরিয়ান। গ্রন্থাগারের গুরুত্ব ও ক্ষয়, দুই তাঁর নখদর্পণে। ‘ঘোড়া লাইব্রেরি’র উদ্যোগ নেন স্বপ্নসন্ধানী এই যুবক। তারপর থেকেই কুমায়ূন পাহাড় এক অপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী হচ্ছে। একটি ঘোড়ার পিঠ ভর্তি ঝুলছে একাধিক বই। পাঠ্যবই তো আছেই। সঙ্গে সাধারণ জ্ঞান, নৈতিক শিক্ষা আর বৃহত্তর আকাশের হাতছানি দেওয়া গল্প ও কবিতার বই। উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি পথের আশ্চর্য ‘ঘোড়সওয়ার’ শুভম জানান, বৃষ্টিতে পাহাড়ি রাস্তায় ধস নামে, ছোটরা স্কুল যেতে পারে না। পড়াশোনার সুযোগ পায় না। তখনই কাজে আসে ঘোড়া লাইব্রেরি।
খারাপ কাজের মতো শতকোটি না হলেও, ভাল কাজেও সঙ্গী মেলে। শুভমের হাত ধরে অভিনব গ্রন্থাগারের পথ চলা শুরু হলেও এখন তাঁর সঙ্গী হয়েছে দু’টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তারা বই এবং অর্থ নিয়ে সাহায্য করছে ‘ঘোড়া লাইব্রেরি’-কে। আশ্চর্য লাইব্রেরির দূতরা কুমায়ূন অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রাম ঘুরে ছোটদের শনাক্ত করেন। যারা পড়তে চায়, তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় বই। বিনামূল্যে এক সপ্তাহে নিজের কাছে রাখা যায় সেই বই। পরের সপ্তাহে ঘোড়া লাইব্রেরি যখন পৌঁছবে ওই গ্রামেই, ফিরিয়ে দিয়ে নেওয়া যাবে নতুন বই।
ভেবে দেখলে বই দিয়েই ভাগ করা যায় এই পৃথিবীকে। একপক্ষ ‘বইপ্রেমিক’ তো অপরপক্ষ ‘বইদস্যু’ বটে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘বই হল অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেওয়া সাঁকো’। বারবার সেই সাঁকো ভাঙার ষড়যন্ত্র করেছে বইদস্যুরা। তুর্কি যোদ্ধা মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি যেমন হামলা চালান নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ৯০ লক্ষ বই। যেন ৯০ লক্ষ সূর্য! বলা হয়, তিন মাস পরে নিভেছিল বইপোড়া আগুন। এর ঠিক বিপরীতে কুমায়ূনের পাহাড় বেয়ে উঠছে একটি ঘোড়া। তার পিঠ ভর্তি বই। বইগুলিকে এমনভাবে ঝোলানো হয়েছে যে, মনে হচ্ছে ডানা। যেন পক্ষীরাজ ঘোড়ার লাইব্রেরি!