সৃষ্টির আদি কাল থেকেই নারী-পুরুষের মিলিত শক্তিতেই সভ্যতার চাকা এগিয়ে চলেছে। যদিও একটা সময় সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। যেমনটা এখনও রয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বের কয়েকটি রাজ্যে। হয়তো বা বিশ্বেও। অন্যত্র অবশ্য রথচক্রের গতি পাল্টে সভ্যতার উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে পুরুষরা। কিন্তু সেটা শক্তির বিষয়, সভ্যতার বা সৃষ্টির নয়। নারী বা পুরুষ, রথের একটি চাকা বসে গেলেই সর্বনাশ। পৃথিবী রসাতলে যেতে পারে।
‘মৌচাক’ ছবির জনপ্রিয় গান ‘পাগলা গারদ কোথায় আছে’। যার শুরুর লাইনটাই ছিল ‘পুরুষ এবং নারী/ তাদের চিরকালের আড়ি’। সত্যিই কি তাই? এই নারী-পুরুষ দ্বন্দ্বের, আবার তার পাল্টা ন্যারেটিভ নিয়ে প্রচুর চর্চা আগেও হয়েছে। এখনও হচ্ছে। বিশেষত, সাম্প্রতিক আর জি কর হাসপাতালের নৃশংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু ভবিষ্যতেও কি এই দ্বৈরথ দেখার আদৌ সুযোগ থাকবে? কী হবে যদি এই সসাগরা পৃথিবী পুরুষ-শূন্য হয়ে যায়? সৃষ্টির চিরাচরিত ধারা যদি পাল্টে যায়? যদি সত্যি হয় ‘আদমের অভিশাপ’? যে আশঙ্কার কথা ২০০৩ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির হিউম্যান জেনেটিক্সের অধ্যাপক ব্রায়ান সাইকসের বই ‘অ্যাডামস কার্স: এ ফিউচার উইদাউট মেন’-এ উল্লেখ করা হয়েছিল।
সৃষ্টির আদি কাল থেকেই নারী-পুরুষের মিলিত শক্তিতেই সভ্যতার চাকা এগিয়ে চলেছে। যদিও একটা সময় সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। যেমনটা এখনও রয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বের কয়েকটি রাজ্যে। হয়তো বা বিশ্বেও। অন্যত্র অবশ্য রথচক্রের গতি পাল্টে সভ্যতার উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে পুরুষরা। কিন্তু সেটা শক্তির বিষয়, সভ্যতার বা সৃষ্টির নয়। নারী বা পুরুষ, রথের একটি চাকা বসে গেলেই সর্বনাশ। পৃথিবী রসাতলে যেতে পারে। আর তেমনই ভয়াবহ ইঙ্গিত মিলেছে সাম্প্রতিক গবেষণায়।
কী বলছে সেই গবেষণা? ক্রমশ কমে যাচ্ছে পুরুষের শরীরে থাকা ‘ওয়াই’ ক্রোমোজোম। এই ক্রোমোজোমই পুরুষের জন্মের নেপথ্য কারণ। অর্থাৎ, এই ক্রোমোজোম না থাকলে পুরুষের জন্মই হবে না। দুনিয়া থেকে মুছে যাবে পুরুষ নামক প্রজাতির চিহ্ন। ভবিষ্যৎ থাকবে মেয়েদেরই হাতে। আগামীতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে শুধুই জন্ম নেবেন প্রমীলারা। পুরুষরা আর নয়।
……………………………………………………
হোক্কাইডো ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী আসাতো কুরোইওয়ার নেতৃত্বে বিজ্ঞানীরা দু’টি ইঁদুরের বংশ বিশ্লেষণ করেন, যেগুলি ইতিমধ্যেই তাদের ওয়াই ক্রোমোজোম হারিয়েছে এবং পৃথিবীতে এখনও টিকে আছে। কীভাবে? ওয়াই ক্রোমোজোম বিলুপ্ত হওয়ার আগেই তারা একটি নতুন ক্রোমোজোম তৈরি করেছিল, যা পুরুষ ইঁদুরের জন্মের জন্য প্রয়োজনীয়। মানুষের ক্ষেত্রেও এমন কিছু ঘটে গেলে ভালো, নইলে ভবিষ্যতের দুনিয়া শাসন করবে প্রমীলা বাহিনীই।
……………………………………………………
মানুষ-সহ একাধিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর লিঙ্গ নির্ধারিত হয় এক্স এবং ওয়াই ক্রোমোজোমের মাধ্যমে। মহিলাদের ক্ষেত্রে দু’টি এক্স ক্রোমোজোম থাকে। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে থাকে একটি এক্স এবং একটি ওয়াই ক্রোমোজোম। এটাই ধরা-বাঁধা হিসাব। শুধু তাই নয়। এক্স ক্রোমোজামে অন্তত ৯০০টি জিন থাকে, যার যোগসূত্র যৌন কার্যকলাপের সঙ্গে রয়েছে। অন্যদিকে, ওয়াই ক্রোমোজোমে অন্তত ৫৫টি জিন থাকে, যা এমব্রায়ো তথা ভ্রূণে পুরুষ বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দাবি করা হচ্ছে, এই ওয়াই ক্রোমোজোমের সংখ্যাই ধীরে ধীরে কমে আসছে। প্লাটিপ্লাসের প্রসঙ্গ তুলে ধরে মেলবোর্নের জিন-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জেনিফার গ্রিভস জানিয়েছেন, গত প্রায় ১৬৬ মিলিয়ন বছর ধরে মানুষ এবং প্লাটিপাস, উভয় ক্ষেত্রেই ওয়াই ক্রোমোজোমে ৫৫ থেকে ৯০০ সক্রিয় জিন হারিয়েছে। এই ক্ষতির পরিমাণ সংখ্যার হিসাবে প্রতি মিলিয়ন বছরে প্রায় পাঁচটি। এই হার চলতে থাকলে ১১ মিলিয়ন বছরে শেষ ৫৫টি জিনও হারিয়ে যাবে। ‘দ্য উইক’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেশিরভাগ ওয়াই ক্রোমোজোম পুনরাবৃত্তিমূলক ‘জাঙ্ক ডিএনএ’ দিয়ে গঠিত। গ্রিভসের কথায়, ‘এত অশক্ত, দুর্বল গঠনের কারণেই ওয়াই ক্রোমোজোম ক্রমশ নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছে না।’ এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স’-এ।
বিভিন্ন ধর্মেই পুনর্জন্মের কথা বলা আছে। বিশেষত, হিন্দু ধর্মে তো জন্মান্তরবাদ স্বীকৃত। তাদের মতে, আত্মা অবিনশ্বর। জীবের মৃত্যুর পর আত্মা ফের নতুন দেহ ধারণ করে। জীবাত্মা অপরিবর্তনীয় সত্ত্বা। তাকে ঈশ্বরের অংশ বলেই মনে করা হয়। গীতায় বলা আছে, ‘মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, আত্মাও তেমনই জীর্ণ শরীর পরিত্যাগ করে নতুন শরীর পরিগ্রহ করে।’ আর মানব সৃষ্টির উৎস সম্পর্কে বলা হয়েছে, ব্রহ্মা প্রথম জন্মগ্রহণকারী এবং গৌণ স্রষ্টা। তিনি নিজের শরীর থেকে ‘শতরূপা’ এবং ‘স্বয়ম্ভু মনু’ নামে নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করেন। তাঁদের প্রিয়ব্রত এবং উত্তানপাদ নামে দুই পুত্র, আকুতি, দেবাহুতি ও প্রসূতি নামে তিন কন্যার জন্ম হয়। তাঁদের মাধ্যমেই পৃথিবীতে মানুষের বংশ বিস্তার শুরু হয়।
খ্রিস্টধর্মেও আদম ও ইভের মধ্যে সৃষ্টি রহস্যের কথা বলা হয়েছে। অন্য প্রাণীকূলের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়মটা প্রায় একই। অর্থাৎ, স্ত্রী-পুরুষ প্রজাতি না থাকলে বংশবিস্তার কার্যত অসম্ভব। আবার জন্মের ক্ষেত্রেও কিন্তু ধর্মশাস্ত্রে ‘বীজ’-এর কথা বলা হয়েছে। সেই বীজ গর্ভে নিষিক্ত হলে তবেই ভ্রূণের সৃষ্টি হতে পারে। যা আধুনিক বিজ্ঞানেরও কথা।
…………………………………………………..
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: নারীবিদ্বেষ আসলে সন্ত্রাসবাদের নামান্তর, রাষ্ট্র তা কবে বুঝবে?
…………………………………………………..
কিন্তু সাইকস, গ্রিভসদের মতে, মানব সভ্যতার বেঁচে থাকার বিকল্পগুলির মধ্যে একটি হল মহিলাদের দ্বারা ইউনিসেক্স প্রজনন। সাইকসের বিকল্প পদ্ধতিতে স্ত্রী ডিম অন্য মহিলার পারমাণবিক এক্স ক্রোমোজোম দ্বারা নিষিক্ত এবং ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে রোপন করা হয়। পুরুষত্ব এবং পুরুষ উর্বরতার জন্য দায়ী এসআরওয়াই এবং সংশ্লিষ্ট জিনগুলিকে অন্য ক্রোমোজোমে স্থানান্তরিত করার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, যাকে তিনি ‘অ্যাডোনিস ক্রোমোজোম’ হিসাবে উল্লেখ করেন, যা একটি এক্সএক্স ক্যারিওটাইপ-সহ উর্বর পুরুষদের জন্ম দেয়। আবার হোক্কাইডো ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী আসাতো কুরোইওয়ার নেতৃত্বে বিজ্ঞানীরা দু’টি ইঁদুরের বংশ বিশ্লেষণ করেন, যেগুলি ইতিমধ্যেই তাদের ওয়াই ক্রোমোজোম হারিয়েছে এবং পৃথিবীতে এখনও টিকে আছে। কীভাবে? ওয়াই ক্রোমোজোম বিলুপ্ত হওয়ার আগেই তারা একটি নতুন ক্রোমোজোম তৈরি করেছিল, যা পুরুষ ইঁদুরের জন্মের জন্য প্রয়োজনীয়। মানুষের ক্ষেত্রেও এমন কিছু ঘটে গেলে ভালো, নইলে ভবিষ্যতের দুনিয়া শাসন করবে প্রমীলা বাহিনীই। আবার জিন বিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হতে পারে নতুন কোনও লিঙ্গও।
……………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
……………………………………………………
পুরাণের কাহিনি বলে, পিতা জমদগ্নির মৃত্যুর বদলা নিতে পরশুরাম ২১ বার পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন। তারপরেও কীভাবে তাদের বংশরক্ষা হয়? তারপরেও রাজা-মহারাজারা কীভাবে জন্মালেন? কারণ, তখন ‘নিয়োগ’ প্রথা ছিল। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ বা অন্য পুরুষের বীর্যে ক্ষত্রিয় রমণী অন্তঃসত্ত্বা হলেও তাঁর সন্তান ক্ষত্রিয় হিসাবেই পরিচিত হতেন বংশের ‘পুরুষ’টির নামে। কিন্তু যদি পুরুষই না থাকে, তাহলে আর ‘নিয়োগ’ হবে কী করে? শুক্রাণু ‘ব্যাঙ্ক’ও হতে পারে বিকল্প। তার আয়ুই বা ক’দিন? বাস্তবতা যা-ই হোক, এতদিনের সমস্ত অপমানের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বে নারীশাসনের সম্ভাবনা কিন্তু অলীক নয়। খেল খতম হতে চলেছে পুরুষদের। অতএব, সাধু সাবধান।