ধরুন, জমিদার বাড়িতে ঝামেলা বেধেছে। তার জেরে নায়েব, গোমস্তারাও বিরক্ত আর নানা কারণে চোটপাট করছেন। আর সেই চোট এসে লাগছে উলুখাগড়ার গায়ে। সে বেচারির প্রাণ তখন যায় যায়! অথচ এই বিবাদে তার তো কোনও ভূমিকাই ছিল না। উদাহরণটিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা জায়গায় ফেলে দেখা যায়। দেখা যাবে,– অফিসে, পাড়ায়, চারপাশে এই ঘটনা নিয়ত ঘটে চলেছে। কোথাকার তরবারি যে কোথায় এসে পড়ছে তার ঠিজ নেই। ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয়, জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে এর প্রভাব আমাদের উপর এসে পড়ছেই। কাজেই পাঁক লেগে যাওয়াটাই যে স্বাভাবিক, এটা বুঝতে এবং মেনে নিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
প্রচ্ছদ শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
৪.
সংসারে পাঁকাল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। অর্থাৎ, সংসারেই থাকতে হবে, কিন্তু গায়ে পাঁকটি লাগলে চলবে না। বিষয়টা সহজসাধ্য নয় মোটেই। নয় বলেই ঠাকুরের এই সাধনার উপদেশ। আত্মাকে শুদ্ধ এবং একে নিষ্ঠ করতে না পারলে পাঁকে জড়িয়ে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেটাই সচরাচর হয়ে থাকে।
এবার, পুরো কথাটা থেকে আধ্যাত্মিকতা বা ধার্মিকতার বাইরের পরতটি যদি সরিয়ে দেখি, তো চোখে পড়বে, এক রকমের অনিবার্যতা। সংসারের পাঁক যেন-তেন গায়ে লেগেই যায়। সংসারটাকে আর একটু বড় অর্থে ধরে নিলে দেখা যাবে, সর্বত্রই এই পঙ্কিলতা সত্য। ধরুন, জমিদার বাড়িতে ঝামেলা বেধেছে। তার জেরে নায়েব, গোমস্তারাও বিরক্ত আর নানা কারণে চোটপাট করছেন। আর সেই চোট এসে লাগছে উলুখাগড়ার গায়ে। সে বেচারির প্রাণ তখন যায় যায়! অথচ এই বিবাদে তার তো কোনও ভূমিকাই ছিল না। উদাহরণটিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা জায়গায় ফেলে দেখা যায়। দেখা যাবে– অফিসে, পাড়ায়, চারপাশে এই ঘটনা নিয়ত ঘটে চলেছে। কোথাকার তরবারি যে কোথায় এসে পড়ছে তার ঠিক নেই। ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয়, জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে এর প্রভাব আমাদের উপর এসে পড়ছেই। কাজেই পাঁক লেগে যাওয়াটাই যে স্বাভাবিক, এটা বুঝতে এবং মেনে নিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাই বুঝি পাঁকাল হওয়ার জন্য এত আয়াস।
তবে, কথাটা উলুখাগড়াদের নিয়েই। সে বেচারিরা চায় যে, এই ঝামেলায় যেন না পড়ে! স্বাভাবিক জীবনটুকু যেন বাঁচতে পারে। এদিকে ঝামেলায় পড়ে যে যায়, এই-ই তাদের নিয়তি। কিন্তু পৃথিবীর যাবতীয় ঝামেলা মেটানোর ক্ষমতা কি তাদের থাকে? ব্যক্তি মানুষের দৌড় আর কতটুকু? উত্তরে জীবনানন্দ দাশের ‘জলপাইহাটি’ মনে পড়ে। বন্ধুর মানিব্যাগ থেকে কয়েকটি নোট হাতে নিয়েও আবার রেখে দেয় নিশীথ। তারপরই সেই অমোঘ উপলব্ধি– ‘পৃথিবী এর, ওর, তার, নয়– ইতিহাসের সকলেরই নিজের জিনিস। যে সূর্য নিভে যাচ্ছে, যে সময় মানুষকে ধ্বংস করে ফেলবে একদিন– এইসব বড় বড় ব্যক্তির লীলার জিনিস পৃথিবী। একজন মানুষ, একটা দল, একটা দেশ বা মহাদেশ কী করে সুনিয়ন্ত্রিত করবার শক্তি পাবে পৃথিবীকে। মানুষের মন উন্নত হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু দু-পাঁচ দুশো-পাঁচশো বছরের মধ্যে তো নয়ই, কত সময় লাগবে কে জানে– কিন্তু সে সফলতা না-ও লাভ করা যেতে পারে– মানুষের পৃথিবীতে কোনোদিনই। আজকের পৃথিবীর এরকম ভয়ংকর বিস্রস্ত প্রস্থানের ভিতর ব্যক্তি নিজের শুভার্থ ছাড়া আর কী কামনা করতে পারে– কী মানে আছে অন্য কোনও কামনার?’ এই আত্মোপলব্ধি কি নিশীথের একার, নাকি জীবনানন্দের নিজেরও? আসলে হেন বোধ বোধহয় এই শতকে ঘুরতে থাকা সব বিচ্ছিন্ন একা মানুষেরই।
………………………………………………………
কথাটা উলুখাগড়াদের নিয়েই। সে বেচারিরা চায় যে, এই ঝামেলায় যেন না পড়ে! স্বাভাবিক জীবনটুকু যেন বাঁচতে পারে। এদিকে ঝামেলায় পড়ে যে যায়, এই-ই তাদের নিয়তি। কিন্তু পৃথিবীর যাবতীয় ঝামেলা মেটানোর ক্ষমতা কি তাদের থাকে? ব্যক্তি মানুষের দৌড় আর কতটুকু? উত্তরে জীবনানন্দ দাশের ‘জলপাইহাটি’ মনে পড়ে। বন্ধুর মানিব্যাগ থেকে কয়েকটি নোট হাতে নিয়েও আবার রেখে দেয় নিশীথ।
………………………………………………………
এখানে থেমে যেতে পারলেই ল্যাটা চুকে যেত। তা তো হয় না। ফলে পৃথিবীর ঢেউ তার গায়ে এসে লাগেই। ফলে দোটানায় সে পড়বেই, অতএব জীবনানন্দ বলবেন, ‘নিশীথ ভাবছিল,ব্যক্তি সে, অতিস্তনিত সমুদ্রের ভিতর ফেনার গুঁড়ির মতো অনেকটা, প্রতিটি ফেনার গুঁড়িকে যদি দান করা যায় ভেবে দেখবার শক্তি, তা হলে ব্যাপারটা যেরকম চাঁছাছোলা নিষ্ঠুর হয় পৃথিবীতে প্রতিটি ব্যক্তির জীবন আজ সেই রকমই তো। এ অবস্থায় কী করতে পারে ফেনার গুঁড়ির মতো মানুষ, প্রতি মুহূর্তেই টালমাটাল সমুদ্রের রাক্ষুসে শক্তির আক্রোশ থেকে নিজেকে নিজের পরিবারকে সামলানো ছাড়া! সেটুকুও কি পারবে মানুষ?’
এই না-পারার ভিতরই উলুখাগড়ার যাবতীয় সংকট। সে না পারে বড় কিছু করতে, না পারে পৃথিবীর ঝঞ্ঝা এড়াতে। বড় কিছু করতে গেলেও তাকে বেশিরভাগ সময়ই পিছু হটতে হয়। সে সত্য, ন্যায়ের পক্ষে থাকতে চায়। অথচ অন্যায়ের বিষবাষ্প থেকে রেহাই পায় না। বুঝতে পারে, সে আসলে দোটানার ভিতর বন্দি। না তার কপালে থাকে সাধারণের সুখ, না বীরের গৌরব! উলুখাগড়ারা তখন কেবলই হেরে যেতে থাকে। যদি তাকে প্রশ্ন করা যায়, কেন হেরে গেলে, তখন সে কী বলবে? শম্ভু মিত্র তাঁর ‘চাঁদ বণিকের পালা’য় এই প্রশ্নই তো বসান লখিন্দরের মুখে। আর ক্লান্ত চাঁদ উত্তরে বলতে থাকেন– ‘সেইটা তো আমারো জিজ্ঞাসা, চাঁদ কেন হের্যে গেল? হয়তো নির্বোধ বল্যে। শুধু সত্যের সপক্ষ হয়্যা দাঁড়ালেই জয় তো আসে না। ক্ষমতাও থাকা চাই। তাই হয়তো-বা আরও বড়, আরও-কোনও অমিত-বিক্রমী বীর এস্যা শিবায়ের সিংহাসন প্রতিষ্ঠিত কর্যে দিয়্যা যাবে। শুধু চাঁদ হের্যে গেল। আর অপরান্তে দেখ, এই ভার কাঁধে নিয়্যা সাধারণ গৃহস্থের সহজ যে সাংসারিক সুখ তা-ও সে পেল না। কী করা উচিত ছিল চাঁদ বণিকের? বীর হ’তে যাওয়া, কিংবা সামান্য গৃহস্থ হয়্যা নিজের এ বান্ধা গৃহটারে আরও মিষ্ট কর্যে গড়ে তোলা? কী? সে কোন শ্রীকৃষ্ণ সারথি আমার স্বধর্মট্যারে আমারে বুঝ্যায়ে দিবে?’
………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
………………………………………….
এই বুঝে উঠতে পারা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। সারথি এসে বোঝান না স্বধর্ম। অতএব হেরে যাওয়া মানুষের ভিড় ক্রমাগত আমাদের ঘিরে ধরে। আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি না, কী করণীয়। আবার সেই ঠাকুরের কথামৃতেই তাই ফিরে যাই। সংসারে পাঁকাল তো হতে বলছেন তিনি, কিন্তু ন্যায়-অন্যায়ের এই বিরাট সংসারে তা কি হওয়া আদৌ সম্ভব? বোধহয় না।
পাঁকাল হতে চেয়ে নাকাল হওয়াই বরং এই জীবনের ওপেন সিক্রেট।
……………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে