১৮২৭ সালে কলকাতায় একদল উচ্চশ্রেণির সাহেব মিলে চালু করেছিলেন ‘বেঙ্গল ক্লাব’। বিলেতে এই ধরনের ক্লাব খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সেই সময়ে। দেশীয় সংস্কৃতির রেশ উপনিবেশে ধরে রাখতে এই ক্লাবগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিলেত থেকে কোনও পুরুষ প্রথম কলকাতায় এলে এই ক্লাবের মাধ্যমেই শহরের অন্যান্য বড় মানুষের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হত, এখান থেকেই সে জেনে নিত বাংলায় অবস্থিত কর্তাব্যক্তিদের নানা কথা, খানিক গুজব, চেখে দেখত ভারতীয় বাবুর্চির হাতে তৈরি ইউরোপীয়-ভারতীয় মিশ্র খানা।
৩০.
‘সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর’ বা ‘প্রাসাদ নগরী’ হিসেবে ঔপনিবেশিক কলকাতাকে বর্ণনা করার মধ্যে যে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তাকে ইতিহাসবিদরা নানাভাবে প্রশ্ন করেছেন বহুদিন ধরেই। সাহেবি নজর থেকে বেরিয়ে এসে তাঁরা দেখিয়েছেন যে কলকাতার বেড়ে ওঠার সঙ্গে কীভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল ভারতীয়দের জীবনযাত্রা, কীভাবে এই শহরের ইতিহাস কটন বা বাস্টিড সাহেবের লেখা শুধুমাত্র বিলিতি শাসকের ইতিহাস নয়। এ সবই এখন সাধারণ জ্ঞানের কথা। কলকাতার বৃদ্ধি সাহেবদের হাত ধরে শুরু হলেও তা বাঙালিদের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল উনিশ শতক থেকেই। শহরের ইতিহাসচর্চাতেও সেই ছাপ পড়ে। কিন্তু এ কথা ভুললে চলে না যে এই শহরে সাহবেরা শুধুই প্রশাসনিক কর্তা ছিলেন না; শহরের সামাজিক জীবনেও তাঁদের বিস্তর প্রভাব ছিল। এখানেই তাঁরা গড়ে নিয়েছিলেন নিজেদের রুচি, সমাজ, সংস্কৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন পরিসর। সেরকমই এক নিখাদ বিলিতি সামাজিক প্রতিষ্ঠান ছিল ‘জেন্টলম্যানদের’ নানা ‘ক্লাব’।
১৮২৭ সালে কলকাতায় একদল উচ্চশ্রেণির সাহেব মিলে চালু করেছিলেন ‘বেঙ্গল ক্লাব’। বিলেতে এই ধরনের ক্লাব খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সেই সময়ে। দেশীয় সংস্কৃতির রেশ উপনিবেশে ধরে রাখতে এই ক্লাবগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিলেত থেকে কোনও পুরুষ প্রথম কলকাতায় এলে এই ক্লাবের মাধ্যমেই শহরের অন্যান্য বড় মানুষের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হত, এখান থেকেই সে জেনে নিত বাংলায় অবস্থিত কর্তাব্যক্তিদের নানা কথা, খানিক গুজব, চেখে দেখত ভারতীয় বাবুর্চির হাতে তৈরি ইউরোপীয়-ভারতীয় মিশ্র খানা। তবে এই ক্লাবে গরিব সাহেব বা মেমসাহেবদের কোনও জায়গা ছিল না। তেমনই এখানে ছিল না কোনও ভারতীয় সদস্য। এই ক্লাব ঘিরে তাই গড়ে উঠেছিল এক বিশেষ ‘ঔপনিবেশিক জনপরিসর’, যা উপনিবেশের বুকে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের নিজস্ব এক আস্তানা, ঘরের থেকে দূরে আর এক ঘর। বিলিতি পুরুষদের কাছে বেঙ্গল ক্লাবের ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ক্লাবের এক সময়ের সেক্রেটারি এইচ. আর. প্যাঙ্ক্রিজ লিখেছেন, “the idea of the club makes a special appeal to the large number of men, who are compelled by circumstances to be separated from their wives and families for longer or shorter periods…[the clubs] offer a welcome solution of a difficult problem to the many bachelors with a distaste for housekeeping.”
তবে এই ক্লাবের সদস্যদের মধ্যেও চাপা নানা বিভেদ ছিল। মূল পার্থক্য ছিল প্রশাসনিক কর্মকর্তা আর ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যে। এঁদের একে অপরের সঙ্গে সাম্রাজ্য চালনা নিয়ে নানা মতানৈক্য থাকত অনেকসময়েই। তবে একই সঙ্গে এই ক্লাব ঘরই কখনও-সখনও হয়ে উঠত একে অপরকে নানা বিষয়ে সাহায্য করার জায়গা। বিশেষত ইউরোপীয় ব্যবসায়ী আর শিল্পপতিদের বিশেষ সুবিধে হত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীর সঙ্গে ক্লাবের সূত্রে আলাপ-পরিচয় থাকল। কলকাতা হাই কোর্টে ক্যানিং বন্দর এলাকায় জমি সংক্রান্ত এক মামলার নিষ্পত্তি হয় বেঙ্গল ক্লাবের নৈশভোজনে। সরকারের কর্তাটি পরবর্তীকালে লেখেন যে, “the counsel for the plaintiff was a friend of mine, and after we had been served with notice of appeal I spoke to him about the case one day at the Club”। কথাবার্তা বলে ব্যাপারটার ফয়সালা করে নেন তাঁরা। বিদায় নেওয়ার আগে বন্ধুটি এই সরকারি কর্তাকে মনে করিয়ে দেন, “You must not betray my after-dinner confidences.” বলা বাহুল্য, ভারতীয় ব্যবসায়ীদের এই সুযোগ ছিল না।
১৮৬০-এর দশকে ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে খানিক বিরোধ দেখা দেয় ‘নীল দর্পণ’ নাটকটিকে ঘিরে। জেমস লং-এর অনুবাদের ফলে অনেকেই গ্রামাঞ্চলে নীল-চাষিদের দুর্দশা আর নীলকুঠির মালিকদের অত্যাচারের কথা জানতে পারেন। সরকার এর পর যখন কুঠির মালিকদের উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে চাষিদের সুরক্ষার খাতিরে তখন কলকাতার ইউরোপীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অনেকেই এতে আপত্তি জানায়। সেই সময়ে বেঙ্গল ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মরডুয়ান্ট ওয়েলস, যিনি কলকাতা হাই কোর্টে জেমস লং-এর বিরুদ্ধে আনা মামলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ক্লাবের সরকারি আর বেসরকারি সদস্যদের মধ্যে এই পর্বে এক চাপা উত্তেজনা নজরে পড়ত। সরকারি কর্তাদের খানিক এড়িয়ে চলত বাকিরা। হেনরি কটনের ভাষায়, এই অসন্তোষের সময়ে, “it was the practice to blackball an official at the Bengal Club…merely because he was an official.” তবে এই রেষারেষি ক্লাবঘরেই সীমাবদ্ধ থাকত, বাইরের ঔপনিবেশিক জগতে এই টানাপোড়েন বিশেষ পৌঁছত না।
ক্লাবের আলাপ-আলোচনা নিয়ে সরকার খেয়াল রাখত, কারণ এই কথাবার্তা থেকে উপনিবেশের ইউরোপীয় জনমত সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেত। ১৮৮৩ সালে লর্ড রিপনের আমলে ইলবার্ট বিল নিয়ে বিতর্কের সময়ে বেঙ্গল ক্লাবের সদস্যরা একজোট হয়ে প্রতিবাদ জানায়। তাঁরা European and Anglo Indian Defence Association (EAIDA) নামে এক সংস্থা তৈরি করেন যার উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপীয় জনগণের স্বার্থরক্ষা। ইউরোপীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের পুনর্নির্মাণ নয় শুধু আর, উনিশ শতকের শেষভাগে ক্লাবঘর হয়ে উঠেছিল এক বিশিষ্ট রাজনৈতিক পরিসরও।
ইউরোপীয় এই প্রতিষ্ঠানের সমতুল্য ধনী ভারতীয়দের এক নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টায় ছিলেন অনেকেই। ১৮৮২ সালে কোচবিহারের মহারাজের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতায় চালু হয় ‘ইন্ডিয়া ক্লাব’। প্রথম বছরেই ক্লাবের সদস্য সংখ্যা ছিল ২০০; ১৮৯০ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৪৩৫-এ। বেঙ্গল ক্লাবের সদস্য সংখ্যা সেই সময়ে ছিল ৮০০-র কাছাকাছি। প্রথম পর্যায়ে ইন্ডিয়া ক্লাবের প্রবেশ মূল্য ছিল পাঁচ টাকা; একই সময়ে বেঙ্গল ক্লাবের মূল্য ছিল ২০০ টাকা। ইন্ডিয়া ক্লাবে ইউরোপীয়রাও স্বাগত ছিলেন, তবে অনেকেই বলতেন যে, তাঁরা ভারতীয়দের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশায় বিশেষ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না।
ভারতীয় সদস্যদের ক্লাব চালু হলেও এই প্রাতিষ্ঠানিক ধারণাটি একেবারেই ইউরোপীয় আমদানি ছিল। কলকাতা ছাড়াও অন্যান্য বড় শহর আর মফসসলে এই ‘জেন্টেলম্যান’ ক্লাব গড়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক পর্ব জুড়ে। ইউরোপীয় আদব-কায়দা বজায় রেখে, ভারতীয়দের থেকে সচেতন দূরত্বে নিজেদের পরিচিতি ধরে রাখার চেষ্টায় এক বিশেষ পরিসর রচনা করাই ছিল এগুলির উদ্দেশ্য। জাতিগত স্বাতন্ত্র্য যেমন জরুরি ছিল তেমনই এই ক্লাবঘরে শ্রেণিচেতনাও যথেষ্ট প্রখর ছিল।
স্বাধীনতার বারো বছর পরে, ১৯৫৯ সালে, বেঙ্গল ক্লাব ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করে। মহিলাদের অপেক্ষা করতে হয় আরও তিন দশক! ঔপনিবেশিক কলকাতার এক বিশেষ চিহ্ন স্বরূপ আজও দাঁড়িয়ে আছে এই প্রতিষ্ঠান, ইঙ্গবঙ্গ সংস্কৃতির মিলিত রূপ নিয়ে, পোশাক-আশাকের বিধিনিষেধ নিয়ে। সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখলেও সাম্রাজ্যের এই বিশেষ পরিসরকে অগ্রাহ্য করে কলকাতার অতীতকে বোঝা সম্ভব নয়।
ঋণস্বীকার: Mrinalini Sinha, ‘Britishness, Clubbability, and the Colonial Public Sphere: The Genealogy of an Imperial Institution in Colonial India’, The Journal of British Studies, vol. 40, issue 04, 2001, pp. 489-521.
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৯: মেসের বাঙালি ছাত্ররা ঝাঁপ দিয়েছিল সরকার-বিরোধী কর্মকাণ্ডে
পর্ব ২৮: কলকাতার রাস্তা নিয়ন্ত্রণ সহজ নয়, দেখিয়ে দিয়েছিল পালকি-বেহারাদের ধর্মঘট
পর্ব ২৭: কোনটা কলকাতা, কোনটা নয়!
পর্ব ২৬: দ্বীপের মতো করেই যেন গড়ে তোলা হয়েছিল কলকাতাকে
পর্ব ২৫: কালো ভিক্টোরিয়া ও থমথমে কলকাতা
পর্ব ২৪: ঘোড়ার কলকাতা: ট্রাম থেকে রেসের মাঠ
পর্ব ২৩: গোলদীঘি গণ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে জেগে উঠেছিল স্বদেশি সময়ে
পর্ব ২২: স্মৃতিদের এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র
পর্ব ২১: কলকাতার কেল্লা এবং ময়দানি মতবিরোধ
পর্ব ২০: সঙের গানে শতবর্ষের পুরনো কলকাতা
পর্ব ১৯: দেশভাগ ও উদ্বাস্তু মানুষদের শিয়ালদা স্টেশন
পর্ব ১৮: কলের গাড়ি ও কলকাতার নিত্যযাত্রীরা
পর্ব ১৭: বাবুদের শহর যেভাবে বদলে গেল আবেগের শহরে
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট