ভারতীয় মননে এককালে পুরনো পাকিস্তান টিমের যে জায়গাটা ছিল, ক্রমশ তার দখল নিচ্ছে না তো বাংলাদেশ? জন্ম নিচ্ছে না তো একই রকম অপার ঘৃণা? সোশাল মিডিয়াই বলুন বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা। বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠলে কোথাওই সদর্থক বক্তব্য-মন্তব্য আর দেখি না। শুনি না। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের চিরকালই রাজনৈতিক টানাপোড়েন, সীমান্ত উত্তাপের সম্পর্ক। ’৪৭ থেকে যা চলছে। আগামী বছর সাতচল্লিশেও তা থাকবে। জনপ্রিয় মতবাদই হল, ভারত-পাকিস্তান, দু’দেশের ‘তখ্ত’-ই নাকি নির্ধারণ করে ‘এলওসি’ উত্তেজনা। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে সে জিনিস কখনও ছিল বলে তো মনে পড়ে না।
নাম-ধাম-নিবাস কিছুই লিখছি না। পদ্মাপারে দিনকাল ভাল নয়। নির্যাসটুকু লিখি। সপ্তাহখানেক আগে এক ওপার বাংলার ক্রিকেট সাংবাদিকের সঙ্গে গল্প-আড্ডার নির্যাস।
‘রাজর্ষি, সব ভালো তো?’
চলছে। তোমার?
‘আর কও ক্যান! এ যে কী স্বাধীনতা আমরা আনলাম, আল্লাহ্ জানেন!’
কেন? কী হল আবার?
‘কী বলব তোমায়। আমাদের কারওরই আর বাক্-স্বাধীনতা বলে কিছু অবশিষ্ট নেই, বুঝছো। ভাবতে পারো, সাংবাদিকরা পর্যন্ত গ্রেফতার হচ্ছে! হাজার-হাজার মোকোদ্দমা জমা হচ্ছে। সাংবাদিকদের ধরপাকড়ের কারণ, তারা এক সময় হাসিনা ঘনিষ্ঠ ছিল।’
কী বলছো তুমি!
‘এ দেশে থাকলে বুঝতে পারতে, রাজর্ষি। এ দেশে থাকলে বুঝতে পারতে। ভাবতে পারো, হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ কারও মামলা লড়তে গেলে প্রাণহানির হুমকি পাচ্ছে উকিলরা! বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার শাসানি আসছে! জজ-ব্যারিস্টাররা পর্যন্ত সব ভয়ে কেঁচো। সঙ্গে জুটেছে একদল অশিক্ষিত বেকারের দল। সকালে ঘুম থেকে উঠে, রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত যাদের একমাত্র কাজ হল ভারত-বিদ্বেষের দুর্গন্ধ দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া! এরা উগ্র মিম বানাচ্ছে। যা ইচ্ছে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে। টার্গেট শুধু এক ও একমাত্র ভারত। উচ্ছন্নে যেতে একটা দেশের যা যা প্রয়োজন, সব বাংলাদেশে এখন পাবে তুমি।’
উত্তরে আর কী বলব, কী বলা সমীচীন, বুঝে না পেয়ে ফোন ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভারত-বিদ্বেষের উগ্রতা যে পদ্মাপারে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, তা অনুধাবন করেছিলাম বহু আগে। প্রায় বছর দশেক আগে ভারত-বাংলাদেশ সিরিজ কভার করতে ওপার বাংলায় গিয়ে। মিথ্যে লিখব না। সে সময় বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষজন নিয়ে সুখী এবং দুঃখী– দুই অভিজ্ঞতাই হয়েছিল। কী করে ভুলব, মীরপুর প্রেসবক্সে বসে চাক্ষুষ করা ভারত-বিরোধী ঘৃণাস্রোত? কী করে ভুলব, মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারতের সিরিজ হারকে ঘিরে ধরে পদ্মাপার জনতার জান্তব উৎসব, ‘ভুয়া… ভুয়া’ চিৎকার, নারকীয় সোল্লাস? কী করে ভুলে যাব তাসকিন আহমেদের হাতে ধোনিদের কাটা মুণ্ডুর অপমানজনক ‘মিম’, যা কিছুতেই খেলাটাকে আর খেলায় সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং উগ্র এক ‘ধর্মযুদ্ধে’ পরিণত করে ছেড়েছিল। শত প্রতিবাদ এলেও এটা অবশ্যই লিখব যে, ২০১৫ সালের সেই ওয়ান ডে সিরিজে ভারতের বিরুদ্ধে কিছুতেই একটা নিছক ক্রিকেটীয় যুদ্ধ জেতেনি বাংলাদেশ। কিছুতেই না।
বাংলাদেশ সে দিন ‘জঙ্গ’ জিতেছিল, ‘জঙ্গ’!
আসলে কী জানেন, ক্রিকেট ম্যাচ জিতলে মানুষ আনন্দ করে। উৎসব করে। কিন্তু কখনও পৈশাচিক নটনৃত্য করে না। মাঝে মাঝে ভাবি, ’৭১-এর পর কী এমন ‘অকথ্য অনাচার’ ঘটিয়ে ফেলল আমার-আপনার দেশ যে, ‘ভারত’ নামটা শোনামাত্র পদ্মাপারের গরিষ্ঠ অংশ তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে? শুধুই কি একটা তিস্তা-কাঁটা? নাকি কারণটা অনেক বেশি করে ধর্মীয়? আবারও নাম লিখছি না। কিন্তু ও দেশের এক সিনিয়র ক্রিকেট সাংবাদিক আছেন, যিনি আমায় নির্দ্বিধায় দশ বছর আগে বলে দিয়েছিলেন যে, ভারত-পাকিস্তানে খেলা হলে তিনি সোজা পাকিস্তানকে সমর্থন করেন। কায়মনোবাক্যে ভারতের হার চান! কেন, কী যুক্তি, কেউ জানে না। অন্তত পাকিস্তানি প্লেয়ারদের স্কিলের প্রতি আনুগত্যে তো করেন না! ঠিক আছে, ছাড়ুন। বাদ দিন। ভুলে যান বছর দশেক আগে কী ঘটেছে। মাসখানেক আগে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার নেপথ্যে কাঠগড়ায় যেভাবে ভারতকে তুলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ জনতার একাংশ, যথেষ্ট নথি-প্রমাণ তাঁদের হাতে ছিল তো? কখনও কি ছিল? আছে?
সময়-সময় সন্দেহ হয়, ভারতীয় মননে এককালে পুরনো পাকিস্তান টিমের যে জায়গাটা ছিল, ক্রমশ তার দখল নিচ্ছে না তো বাংলাদেশ? জন্ম নিচ্ছে না তো একই রকম অপার ঘৃণা? সোশাল মিডিয়াই বলুন বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা। বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠলে কোথাওই সদর্থক বক্তব্য-মন্তব্য আর দেখি না। শুনি না। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের চিরকালই রাজনৈতিক টানাপোড়েন, সীমান্ত উত্তাপের সম্পর্ক। ’৪৭ থেকে যা চলছে। আগামী বছর সাতচল্লিশেও তা থাকবে। জনপ্রিয় মতবাদই হল, ভারত-পাকিস্তান, দু’দেশের ‘তখ্ত’-ই নাকি নির্ধারণ করে ‘এলওসি’ উত্তেজনা। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে সে জিনিস কখনও ছিল বলে তো মনে পড়ে না।
…………………………………………………
কী করে ভুলব, মীরপুর প্রেসবক্সে বসে চাক্ষুষ করা ভারত-বিরোধী ঘৃণাস্রোত? কী করে ভুলব, মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারতের সিরিজ হারকে ঘিরে ধরে পদ্মাপার জনতার জান্তব উৎসব, ‘ভুয়া… ভুয়া’ চিৎকার, নারকীয় সোল্লাস? কী করে ভুলে যাব তাসকিন আহমেদের হাতে ধোনিদের কাটা মুণ্ডুর অপমানজনক ‘মিম’, যা কিছুতেই খেলাটাকে আর খেলায় সীমাবদ্ধ রাখেনি। বরং উগ্র এক ‘ধর্মযুদ্ধে’ পরিণত করে ছেড়েছিল। শত প্রতিবাদ এলেও এটা অবশ্যই লিখব যে, ২০১৫ সালের সেই ওয়ান ডে সিরিজে ভারতের বিরুদ্ধে কিছুতেই একটা নিছক ক্রিকেটীয় যুদ্ধ জেতেনি বাংলাদেশ। কিছুতেই না।
…………………………………………………
আশ্চর্যের হল, অধুনা পাকিস্তান কিন্তু তার পুরনো ভারত-বিবমিষার বিধান থেকে অনেকটা সরে এসেছে। অন্তত ক্রিকেট মাঠে। বাবর-রিজওয়ান-শাহিনরা আজ আর মিয়াঁদাদ সুলভ অসভ্যতা করেন না ২২ গজে। বরং ভারতকে ১০ উইকেটে হারানোর পরেও দৌড়ে গিয়ে সর্বাগ্রে বিরাট কোহলিকে জড়িয়ে ধরেন! রোহিত শর্মা নিয়ে বলার সময় হ্যারিস রউফের গলায় সম্ভ্রমের বাতাস বয়। মাস কয়েক পূর্বে ভারত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার সময় শোয়েব আখতার নিজের ইউটিউব চ্যানেলে সর্বসমক্ষে ‘হিন্দুস্তান’-কে অকুণ্ঠ বাহবা দিয়েছিলেন। এক-আধ বার নয়, বারবার। সীমান্তে কী চলছে, কী ঘটছে, তাকে ন্যূনতম আমল না দিয়ে। ওয়াসিম আক্রম উদাত্ত প্রশংসা করে গিয়েছেন ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মার। তিনি যে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের, সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনও ক্রিকেটারকে দেখেছেন, রোহিতদের বিশ্বজয় নিয়ে একখানা, সরি, সরি আধখানা টুইটও করতে? ওহ্, মনে পড়ল। পদ্মাপার ক্রিকেটারদের মধ্যে শেষ যাঁর ভারত নিয়ে টুইট মনে আছে, তিনি মুশফিকুর রহিম। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ভারতের হারের পর উৎসবমাখা টুইট করেছিলেন যিনি! এক্ষেত্রেও কেন, কী তার হেতু, কেউ জানে না। এটুকু জানি, দেশজ স্বাধীনতার মতো বাংলাদেশের ক্রিকেট-স্বাধীনতার নেপথ্যেও ভারত ছিল। ২৪ বছর আগে জগমোহন ডালমিয়া বাংলাদেশকে টেস্ট স্ট্যাটাস না দিলে লাল বলের ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পদ্মাপারের অপেক্ষা আরও দীর্ঘায়িত হত!
অগত্যা, ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সিরিজ একদিক থেকে প্রভূত অর্থবহ সিরিজ। নানা প্ররোচনার, নানা যুক্তিহীন দোষারোপের জবাবি সিরিজ। কিন্তু আর একদিক থেকে দেখতে গেলে আবার, প্রায় অর্থহীন এক সিরিজ! শুনতে যতই কর্কশ লাগুক, পাকিস্তানে গিয়ে শান মাসুদের ‘মূমূর্ষু’ পাকিস্তানকে হারানো, আর ভারতে এসে রোহিত শর্মাদের হারানোয় ততটাই ফারাক, যতটা চাঁদ আর চাঁদমালায়! মনে রাখতে হবে, গত এক দশকের সবচেয়ে দুর্বল টিমটা নিয়ে এখন মাঠে নামছে পাকিস্তান। যারা ভারতের মাঝারি শক্তির রনজি টিমের বিরুদ্ধেও তিন ম্যাচের সিরিজ জিতবে কি না সন্দেহ! তার উপর নিরন্তর দলাদলি, খেয়োখেয়িতে জর্জরিত। ভারত কিন্তু তা নয়। ভারত কিন্তু তা হবে না। ধারে-ভারে-পরাক্রমে শান্ত-সাকিবের বাংলাদেশের চেয়ে এক আলোকবর্ষ এগিয়ে থাকবে রোহিতের ভারত। সে অনুপাতে, দু’টো টেস্ট ম্যাচ তিন দিন পার করলেই বরং আশ্চর্যের হবে!
……………………………………………………………..
আরও পড়ুন ফারজানা জহির পমি-র লেখা: নতুন বাংলাদেশে ক্রিকেটারদের শরীরীভাষায় জেতার অদম্য তাগিদ চোখে পড়ছে
……………………………………………………………..
আর পার না করলে কী? তাতে কী-ই বা আসে যায়? ‘নতুন’ বাংলাদেশের প্রতি পুরনো দিনের মতো সূক্ষ্ম সহানুভূতি দেখানোর প্রয়োজনটাই বা কোথায়? যে দেশে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙচুর চলে, রবীন্দ্রনাথ আক্রান্ত হন, সে দেশের প্রতি মাঠে-ময়দানে অত মায়া-মমতা দেখানোর তো প্রয়োজন নেই। মহাশয় ভুলে যান, ও সমস্ত সোনার বাংলা-টাংলা ভুলে যান। সোনার বাংলা এখন সে দেশে সোনার পাথরবাটি মাত্র! তার চেয়ে ওই হিমহিমে ব্যাপারটাই থাকুক না। চলুক। যার প্ররোচনা ওপার বাংলা থেকে ইদানীং আসে প্রতি মুহূর্তে। প্রতিনিয়ত।
চলুক, এবার থেকে একটু না হয় ‘জঙ্গ’-ই চলুক!
.………………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
…………………………………………………………