১৯০৫-এর ‘বঙ্গলক্ষ্মী ব্রতকথা’ অরন্ধনকে প্রথম রাজনৈতিক রূপ দেয়। এই বইটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, ১৯০৫ থেকে ১৯১০ অবধি– পাঁচ বছর এটি বহুল পরিমাণে বিক্রি হয়। পরে বিপ্লবী আন্দোলনে প্রেরণা জোগানোর সন্দেহে ব্রিটিশ পুলিশ এই গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯১০ সালে বাংলার গোয়েন্দা বিভাগ এই পুস্তক বাজেয়াপ্ত করে, প্রকাশকের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া প্রায় দু’-হাজারের কাছাকাছি মুদ্রিত বই পুনরায় বিক্রি করার অনুমোদন দেয়নি তৎকালীন সরকার। অরন্ধনের মতো অহিংস এবং মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত কর্মসূচিও রাজনৈতিক বাধা পায় সেই সময়। খাদ্য দিবস উপলক্ষে অরন্ধন নিয়ে বিশেষ নিবন্ধ।
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
অনশন আর অরন্ধন– দু’টি একেবারেই সমার্থক নয়। কিন্ত পশ্চিমবঙ্গের চলতি আন্দোলনে যখন আমরণ অনশনের কথা উঠল, তখন বাড়িতে বাড়িতে অরন্ধনের প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছিল কিছুদিন আগে। অরন্ধন বিষয়টি ঠিক কী? ভাদ্র মাসের শেষ দিনে পশ্চিমবঙ্গবাসীদের অরন্ধন দিবস পালনের কথা শোনা যায়। মনসা পুজোয় নাকি সারারাত রান্না করে পরের দিন সেটি প্রসাদ রূপে গৃহীত হয়ে থাকে।
অরন্ধনের সঙ্গে অবশ্যই জড়িত শুচিতা বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ধারণা। উত্তর ভারতে দিওয়ালি উপলক্ষে যেমন ঘরবাড়ি পরিষ্কার বা শুচিতা এক বিশেষ কর্মসূচি রূপে দেখা দেয়, তেমনই গ্রামবাংলার গৃহে ভাদ্র সংক্রান্তিতে ঘরের উঠোন, দাওয়া, বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার নিয়ম। তার সঙ্গে যুক্ত হয় রান্নাবান্না থেকে বিরত থাকা, যাতে আনাজপাতি, সবজি বা মাছের উচ্ছিষ্ট ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। এই শুচিতার সঙ্গে প্রবল বর্ষার নানা কীটপতঙ্গ ও সাপের উপদ্রব থেকে বাঁচার প্রয়াসও যুক্ত। অনেক বাড়িতে উনুনের পাশে আলপনা দেওয়া হয় সাপ ও পদ্ম। উনুনের ওপর রাখা হয় ফণিমনসার ডাল। রসুই ঘর নিকানো, বর্ষা শেষে গ্রামের বাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড় পরিষ্কার– সকল কাজেই সময় জোগায় অরন্ধনের কর্মসূচি।
বাংলার প্রত্যেকটি ব্রতই আসলে কৃষিপ্রধান সমাজের এক একটি আর্থিক দিককে তুলে ধরে। বর্ষাকালের নানা রকম শাক, কচু, ইলিশ মাছ, খেসারির ডাল, সবজি অরন্ধনের আগের দিন প্রস্তুত করে রাখা হয়। অরন্ধন যেন বর্ষা শেষে আশ্বিনকে আহ্বানের এক পর্ব। একটা দিন গতানুগতিক রান্না বা গৃহস্থালির কাজ বন্ধ রেখে চারপাশটা একটু গুছিয়ে নেওয়ার পালা। এই সাময়িক বিরতির ধর্মীয় কাঠামো থাকলেও এর পরিবেশগত গুরুত্ব অপরিসীম। জল, জঙ্গল, জমি এবং আপামর পরিবেশ বিষয়ক নানা চেতনার উৎস খুঁজতে গিয়ে ঐতিহাসিক এবং গবেষকদের তাকাতে হয় বাংলার ব্রত, পাঁচালি ও ধর্মীয় সংস্কৃতির দিকে। ‘অরন্ধন’ তাই কৃষিপ্রধান বাংলার বাস্তুতন্ত্র, অর্থনীতি ও পরিবেশবিদ্যা পাঠের উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। তবে মনসা পুজো, আলপনা এবং অন্ত্যজ শ্রেণির শুচিতা ছাড়াও বিশ শতকের গোড়ায় অরন্ধন এক নতুন তাৎপর্য লাভ করে। চলে আসা যাক, ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবরে।
লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী অরন্ধনের ডাক দেন। রবীন্দ্রনাথের রাখিবন্ধন, বিলেতি দ্রব্য বর্জন, স্বদেশি সভা, পিকেটিং ও মিছিলের মতো প্রমুখ কর্মসূচির মধ্যে অরন্ধনের বিষয়টি আলাদা তাৎপর্য বহন করেছিল। কারণ, এই প্রথম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সীমানা ছাড়িয়ে অরন্ধন এক রাজনৈতিক রূপ পেল। বঙ্গভঙ্গের যদি দু’টি অসামান্য দিক তুলে ধরা যায়, প্রথমটি অবশ্যই তার সর্বব্যাপকতা। রাখিবন্ধন নিয়ে প্রবল আলোচনা হলেও ময়মনসিংহের মুসলিম ভাইদের ১৯০৬-এ স্বদেশি গান বাঁধা, আব্দুল রসুল বা লিয়াকত হোসেনের মতো নেতাদের বয়কট আন্দোলন পরিচালনা, এমনকী, ১৯০৫-এর ২৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার রাজাবাজারে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের জমায়েত নিয়ে আলোকপাত জরুরি।
শুধু হিন্দু-মুসলিম ঐক্য নয়, দ্বিতীয় যে বিষয়টি নজর কাড়ে, তা অবশ্যই লিঙ্গের প্রশ্ন। ১৯০৫-এ অবনীন্দ্রনাথ ভারতমাতা আঁকছেন, দেশপ্রেমের সঙ্গে মাতৃস্নেহর ধারণা প্রোথিত হচ্ছে উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে। জাতীয়তাবাদ, লিঙ্গসাম্য ও মহিলাদের সশস্ত্র বিপ্লবকে ঘিরে নানা প্রতর্ক তৈরি হবে আগামী বিশ বছরের মধ্যেই। এমন পরিস্থিতিতে ১৯০৫-এর অরন্ধন যেন এক ঊষাকালের মতো। মহিলারা তাদের গৃহস্থালির দায়দায়িত্বকে একদিনের জন্য বিরতি দিয়ে দেশের সেবায় নিয়োজিত করবেন নিজেদের। এটিকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে অরন্ধনের মতো কর্মসূচি। ঘর ও বাহিরের দোলাচলে এই প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলনে (সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও) মহিলাদের একটা নিজস্ব জায়গা প্রস্তুত হল। অরন্ধন শুধুমাত্র রান্না করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান নয়, গৃহস্থ কাজের পরিবর্তে মহিলারা কী করবেন, এই প্রশ্নই যেন বেশি দামি। মহিলারা বিদেশি কাচের চুড়ি, বিদেশি সাজসজ্জা, বস্ত্র, এমনকী, চুলের রাবার ব্যান্ড ব্যবহার করবেন না– এই ধরনের কর্মসূচির পাশাপাশি রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর লেখা ‘বঙ্গলক্ষীর ব্রতকথা’ বইয়ে অরুন্ধনের নিয়মাবলি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করা হচ্ছে।
১৩১২ বঙ্গাব্দে (১৯০৫) ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় ত্রিবেদীর প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশ পায়, তার পরের বছর যদিও পুস্তক আকারে ছাপানো হয় এই গ্রন্থ। বইয়ের ভূমিকা বলছে, বঙ্গলক্ষীর ব্রত মানে অরন্ধন। বাড়িতে কোনও মুমূর্ষু রুগী বা শিশু থাকলে তার জন্য দুধ ব্যতীত ঘরে উনুন জ্বলবে না। ফলমূল, চিড়ে, মুড়ি এবং আগের দিনের রান্না করা খাবার খাওয়া যেতে পারে। এই ব্রত পালনে বিধবারা মাথায় চন্দন নেবেন, সধবারা সিঁদুর, হরিতকি বা সুপুরি নিয়ে তারা সমবেত হয়ে ‘বঙ্গলক্ষীর ব্রতকথা’ বইটি পাঠ করবেন। সঙ্গে থাকবে শঙ্খধ্বনি, স্বদেশি কার্পাসের সুতো দিয়ে সকলে একে-অপরকে রাখি পরাবে এবং পাটালি-গুড় প্রসাদ রূপে গ্রহণ করবে। এ-ও বলা হয় যে এই ব্রত একদিনের নয়, মহিলারা যাতে প্রতিদিন নিজেদের গৃহকর্ম শুরু করার আগে লক্ষ্মীর ঘটে কিছু মূল্য সঞ্চয় করেন এবং মাসের শেষে তা যেন দেশের কোনও কাজে বিনিয়োগ করা হয়। সুতরাং, অরন্ধন এখানে কেবলমাত্র একটি ব্রত অনুষ্ঠান নয়; ধর্মের আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা ছাড়িয়ে এটি হয়ে উঠেছিল বাড়ির মহিলাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের সংগঠিত করার এক উপায়। গৃহের বাইরে না গিয়েও অন্যান্য মহিলার সঙ্গে একত্রিত হয়ে ঔপনিবেশিক বিরোধী কার্যকলাপের অংশ হয়ে ওঠার অভূতপূর্ব পন্থা।
বাংলার ব্রতকথা, রামায়ণ পাঠ, পাঁচালী বা সমবেত কীর্তন গানে মহিলাদের মেলামেশার ইতিহাস পাওয়া যায়। তাদের নিজস্ব ক্ষেত্র, যেমন নদীর ঘাট, রান্নাঘর, বা বাড়ির অন্দরমহলে গড়ে ওঠা প্রাত্যহিক রাজনীতি, কথোপকথন বা সংযোগ নিয়ে আজ লিঙ্গের আলাদা ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে। অরন্ধনের ইতিহাসও যেন হয়ে উঠেছে অতি সাধারণ গৃহস্থ বাড়ির মহিলাদের এক সাময়িক লিঙ্গমৈত্রীর পর্ব।
নিম্নবর্গীয় বা মুসলিম মহিলাদের মধ্যে অরন্ধনের কর্মসূচি কতটা পালিত হয়েছিল– এই বিষয়টি নির্ধারণ করা কঠিন, কিন্তু হিন্দু মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত বাড়িতে অরন্ধনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এমনকী, পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনেও মহিলাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ‘লবণ সত্যাগ্রহ’ থেকে ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ অবধি ভারতীয় মহিলারা ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে অরন্ধনকে হাতিয়ার করেছে। কিন্তু, এর শুরু ১৯০৫-এর ‘বঙ্গলক্ষ্মী ব্রতকথা’ দিয়ে, যা অরন্ধনকে প্রথম রাজনৈতিক রূপ দেয়।
এই বইটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, ১৯০৫ থেকে ১৯১০ অবধি– পাঁচ বছর এটি বহুল পরিমাণে বিক্রি হয়। পরে বিপ্লবী আন্দোলনে প্রেরণা জোগানোর সন্দেহে ব্রিটিশ পুলিশ এই গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯১০ সালে বাংলার গোয়েন্দা বিভাগ এই পুস্তক বাজেয়াপ্ত করে, প্রকাশকের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া প্রায় দু’-হাজারের কাছাকাছি মুদ্রিত বই পুনরায় বিক্রি করার অনুমোদন দেয়নি তৎকালীন সরকার। অরন্ধনের মতো অহিংস এবং মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত কর্মসূচিও রাজনৈতিক বাধা পায় সেই সময়।
……………………………………………
আরও পড়ুন রামকুমার মুখোপাধ্যায়-এর লেখা: জল, খিদে ও চিকিৎসার সমস্যায় অপুষ্ট গণেশের ভুঁড়ি নেই
……………………………………………
মধ্যযুগীয় ব্রতকথা থেকে শুরু করে বঙ্গভঙ্গের অরন্ধন আজকের দিনে এসেও রাজনৈতিক প্রতিরোধের ভাষা রূপে বিবেচিত হয়েছে। যদিও প্রতীকী অরন্ধনকে ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে অনেকে সেরকম মূল্য দিতে রাজি নন। গ্রামের শুচিতা বা স্বদেশির স্বতঃস্ফূর্ততা কোনওটাই আজকের দিনে পাওয়া সম্ভব নয়। উপরন্তু এই ডিজিটাল যুগে যুক্ত হয়েছে অনলাইন মারফত খাবার আনিয়ে নেওয়ার যথেচ্ছ সুযোগ-সুবিধা। তাই বিশ্বকর্মা পুজো, মনসা পুজো বা সরস্বতী পুজোর সময় শীতলা ষষ্ঠীতে অরন্ধন পালিত হলেও প্রতিবাদের পরিভাষা হিসেবে অরন্ধন আজ কতটা জনপ্রিয়তা লাভ করবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..
দরজার সামনে শম্ভু মিত্র, রেকর্ডিং শেষ করে সবে ফ্লোর থেকে বেরিয়েছেন। গম্ভীর মানুষ, সাহস সঞ্চয় করে কাছে গিয়ে প্রণাম করি, মাথায় হাত রাখলেন। পাশে ছিল চৈতি ঘোষাল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বাড়ির টিভিতে আমাকে দেখতে পায় তাই এই বিস্ময়, নিচু গলায় জানাল ডাকঘরের অমল।