দেশের বামপন্থী কোনও পার্টি থেকে কেউ বা কোনও প্রতিনিধি দল এসেছে, হয়তো বা দেশ থেকে কোনও কোনও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল এসেছে, নয়তো বিশ্ব শান্তি পরিষদের চিত্ত বিশ্বাসের মতো কোনও সচিব হেলসিঙ্কি থেকে মস্কো এসেছেন, অথবা হেলসিঙ্কি-দিল্লি বা দিল্লি-হেলসিঙ্কি থেকে যাতায়াতের পথে মস্কোয় এসেছেন। মস্কোয় আন্তর্জাতিক পার্টি সম্মেলন, ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলন, যুব উৎসব, আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছা ক্রীড়া-উৎসব– এসব আকছারই লেগে থাকত। অতএব অতিথি অভ্যাগতেরও কামাই নেই। এরই ফাঁকে ফাঁকে রাত জেগে যে করে হোক সময় বের করে কাজ করতে হত।
৩৬.
মস্কোর আড্ডা প্রসঙ্গে
মস্কোয় আমাদের বাড়িতে যে সমস্ত বড় বড় আড্ডা বা আসর বসত, সেগুলির বেশিরভাগেরই উদ্যোক্তা ছিল এককালে সোভিয়েত ইউনিয়নে উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত, পরবর্তীকালে সফল ব্যবসায়ী, আমাদের পুরনো বন্ধু হিতাংশু দাশগুপ্ত। তার জনসংযোগ এমনই ছিল যে, যেখানে-সেখানে যখন-তখন কোথা থেকে লোকজন জুটিয়ে ঠিক আড্ডা জমিয়ে ফেলত, বিশেষত দেশ থেকে কেউ বা কোনও রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল এলে তো কথাই নেই। তার বেশভূষা এতটাই কেতাদুরস্ত আর রুচিসম্মত ছিল যে দেখার মতো। মহিলা মহলে তার বিশেষ খাতিরও ছিল। নিজের ফ্ল্যাটে আড্ডা জমানোর তেমন পরিসর বা সুযোগ না থাকায় বেশিরভাগ সময়ই হয় তার অফিস ঘরে নয়তো বা তার বন্ধু-বান্ধবদের কারও ফ্ল্যাটে সেসব আড্ডা বসত। সেসব আসরের মধ্যমণি যে সে হত এমন নয়, সেরকম হওয়ার কোনও বাসনাও তার কখনও দেখিনি।
অনেক সময়ই সে স্বল্পকালীন নোটিশে সদলবলে এসে আমাদের ফ্ল্যাটে হানা দিত– নয়তো ওর অফিসে, বা অন্য কোথাও আড্ডায় শামিল হওয়ার জন্য ডাক পড়ত। হয়তো দেশের বামপন্থী কোনও পার্টি থেকে কেউ বা কোনও প্রতিনিধি দল এসেছে, হয়তো বা দেশ থেকে কোনও কোনও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল এসেছে, নয়তো বিশ্ব শান্তি পরিষদের চিত্ত বিশ্বাসের মতো কোনও সচিব হেলসিঙ্কি থেকে মস্কো এসেছেন, অথবা হেলসিঙ্কি-দিল্লি বা দিল্লি-হেলসিঙ্কি থেকে যাতায়াতের পথে মস্কোয় এসেছেন। মস্কোয় আন্তর্জাতিক পার্টি সম্মেলন, ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলন, যুব উৎসব, আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছা ক্রীড়া-উৎসব– এসব আকছারই লেগে থাকত। অতএব অতিথি অভ্যাগতেরও কামাই নেই। এরই ফাঁকে ফাঁকে রাত জেগে বা যে করে হোক সময় বের করে কাজ করতে হত, কেননা ফুরনের কাজ হোক আর যা-ই হোক, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ দিতেই হত– বিশেষত ‘সোভিয়েত নারী’ বা ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ পত্রিকার হলে তো কথাই নেই। কিন্তু হিতাংশুর মতো মানুষেরা বোধহয় রুশিদের যে প্রবচনটাকে অনুসরণ করে চলে, তা এই যে ‘কাজ তো আর বনের বাঘ নয় যে পালিয়ে যাবে!’
১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরের কোনও এক সময় মহম্মদ ইলিয়াস মস্কো হয়ে যাচ্ছিলেন কিউবায় ট্রেড ইউনিয়নের কোনও এক সম্মেলনে যোগ দিতে। ফেরার পথে দিন দুয়েক মস্কোয় থাকার কথা। হিতাংশু তাকে হোটেলের বদলে আমার বাড়িতে এনে তুলল। সেই সময় আবার হিতাংশুর যোগাযোগেই ইলিয়াসদাকে উপলক্ষ করে আমার বাড়িতে সারা রাতের একটা আড্ডা বসে গেল।
মস্কোয় তখন বাংলাদেশের যিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তাঁরও নাম ছিল শামসুর রহমান, তবে অসাধারণ পাণ্ডিত্য বা ইংরেজি ভাষায় অসাধারণ দখলের দরুনই হোক, ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি ‘জনসনদা’ নামে পরিচিত ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধু রাষ্ট্রগুলির কোনও কোনও রাষ্ট্রদূত বা দূতাবাসকর্মীর মতো তিনিও অনেক সময় কূটনৈতিক আচরণবিধি মেনে চলতেন না।
হিতাংশুর মারফতই তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ নানা উপলক্ষে– বিশেষত হায়াৎ মামুদ, দ্বিজেন শর্মা বা খালেদ চৌধুরির বাড়িতে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা তো হতই। তিনি আমার নাম দিয়েছিলেন ‘সূর্যচন্দ্র’। সেদিন তিনি ইলিয়াসদাকে তাঁর নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ করতে ইচ্ছুক। কিন্তু ইলিয়াসদা বললেন তিনি খুবই ক্লান্ত, কোথাও নড়ছেন না, তবে যদি কেউ দেখা করতে চান এখানে এসে দেখা করতে পারেন। জনসনদা এক কথায় আমার ফ্ল্যাটে এসেই ইলিয়াসদার সঙ্গে দেখা করতে রাজি। ঠিক হল সন্ধ্যাবেলায় হিতাংশু গিয়ে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে সাধারণ বিদেশি নাগরিকের মতোই তাঁকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসবে।
কিন্তু তারপর মস্কোতে আমাদের যেটা রেওয়াজ ছিল, তাই হল– কে আমন্ত্রণকর্তা আর কে আমন্ত্রিত– তা বোঝা ভার হয়ে দাঁড়াল। একে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা মহম্মদ ইলিয়াস, তার ওপর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত– সংবাদটা পাঁচ কান হতেই ওই ঠান্ডার মধ্যেই প্রগতির বাংলা বিভাগের অনুবাদকদের প্রায় সকলেই আসরে যোগ দেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেন– এমনকী বিষ্ণুদা, যিনি বাড়ি ছেড়ে বিশেষ কোথাও যেতেন না, তিনিও আসতে চাইলেন। আমি মহা ফাঁপড়ে পড়ে গেলাম। আমি তখন একা মানুষ, বাড়িতে অত পরিমাণ খাবারদাবার আর পানীয়ের ব্যবস্থা নেই, এত অল্প সময়ের মধ্যে এই বিশাল আয়োজন করবই বা কী করে? কিছু শুকনো খাবারদাবার না হয় আনা গেল, কিন্তু সান্ধ্য আসরের নিমন্ত্রণ মানে যে ভুড়িভোজের নিমন্ত্রণ– সে তো বলাই বাহুল্য। হিতাংশু ভরসা দিয়ে বলল, চাল-ডাল-মাংস আর সেই সঙ্গে পানীয়ও জনসনদা নিয়ে আসবেন, আমরা দু’জনে মিলে রান্নার কাজটা ঠিক সেরে ফেলব।
……………………………………………………..
শীতের রাত– বেশ গভীর রাতই। হায়াৎ আর দ্বিজেনদা পানাহার শেষ করে রাত এগারোটা নাগাদ বিদায় নিলেন। ওরা দু’জনে একই পাড়ায় একই বাড়ির বাসিন্দা, তৃতীয়জন অর্থাৎ খালেদ চৌধুরিও তাই। কিন্তু তিনি গেলে চলবে কী করে? তিনিই তো আড্ডাধারী। তাই উঠি উঠি করেও তিনি উঠতে পারলেন না– মানে, তাঁকে ছাড়াই হল না। আর বিষ্ণুদা? তিনি অত রাতে একা একা যাবেনই বা কী করে? এত বছর মস্কোতে বাস করা সত্ত্বেও মস্কোর রাস্তাঘাট তো তিনি চেনেনই না, রুশ ভাষাটাও ভালো মতো জানেন না।
……………………………………………………..
সন্ধ্যা আটটা নাগাদ হিতাংশু জনসনদাকে ট্যাক্সি করে নিয়ে এল, সেই সঙ্গে ননীদা আর বিষ্ণুদাকেও। অন্যান্য কাঁচা খাদ্যসামগ্রীর সঙ্গে জনসনদা যে বিশাল ঢাউস জনি ওয়াকার নিয়ে এলেন, ওই মাপের জনি ওয়াকার আমি এর আগে আর কখনও দেখিনি।
বাইরের ঘরে বসার আয়োজন হয়েছে। সেখানেই একপাশে সোফা। ইলিয়াসদা চেয়ারে না বসে বেশ আয়েস করে হেলান দিয়ে সোফাতেই বসলেন। আমি আর বিশু অতিথিদের জন্য টুকটাক খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে রান্না করতে চলে গেলাম।
আসর ঠিকমতো বসতে বসতে রাত ন’টা পেরিয়ে গেল। শীতের রাত– বেশ গভীর রাতই। হায়াৎ আর দ্বিজেনদা পানাহার শেষ করে রাত এগারোটা নাগাদ বিদায় নিলেন। ওরা দু’জনে একই পাড়ায় একই বাড়ির বাসিন্দা, তৃতীয়জন অর্থাৎ খালেদ চৌধুরিও তাই। কিন্তু তিনি গেলে চলবে কী করে? তিনিই তো আড্ডাধারী। তাই উঠি উঠি করেও তিনি উঠতে পারলেন না– মানে, তাঁকে ছাড়াই হল না। আর বিষ্ণুদা? তিনি অত রাতে একা একা যাবেনই বা কী করে? এত বছর মস্কোতে বাস করা সত্ত্বেও মস্কোর রাস্তাঘাট তো তিনি চেনেনই না, রুশ ভাষাটাও ভালো মতো জানেন না। হিতাংশু তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার মুডে নেই। সে পাশের ঘরে শুয়ে বিশ্রাম করছে, মাঝে মাঝে এ ঘরে এসে তদারকি করে যাচ্ছে। আমি প্রয়োজনীয় খাবারদাবার সময়মতো পরিবেশন করে যাচ্ছি।
জনসনদার আনা পানীয় শেষ হতে আমার ভাঁড়ারেও হাত পড়ল। তখন রাত বারোটা। ইলিয়াসদার চোখ জবা ফুলের মতো লাল। আগের দিন সত্যি সত্যি তাঁর ওপর দিয়ে বেশ ধকল গেছে। তিনি ঢুলছেন, মাঝে মাঝে চমকে উঠে অতিথিদের কথাবার্তা, চুটকি ও খোশগল্পের মাঝপথে দু’-একটি সরস মন্তব্যও করছেন। ঘড়ির কাঁটা একটার ঘর ছাড়িয়ে যেতে জনসনদা ও ঘর থেকে হিতাংশুকে ডেকে পাঠালেন: এবারে ফোনে ট্যাক্সি বুক করা দরকার। জনসনদাকে ফিরে যেতে হবে। বিষ্ণুদা আর খালেদ চৌধুরিও যাবেন, হিতাংশু ওদের নিয়ে যাবে। ননীদাকে থেকে যেতে বললাম– সকালে আমিই তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেব। মিনিট পনেরোর মধ্যে ট্যাক্সি এসে গেল। জনসনদা ওভারকোট গায়ে দিলেন, বিষ্ণুদাও উঠি উঠি করছেন, এমন সময় ইলিয়াসদা ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে বললেন: ‘সে কী, এখনই চলে যাবেন! আসর তো সবে জমে উঠেছিল।’ জনসনদা বললেন: ‘বলছেন?’ তারপর গা থেকে ওভারকোট খুলতে খুলতে বললেন: ‘ট্যাক্সিটা ফেরত পাঠানো যায় কি না দেখো। আরও ঘণ্টাদুয়েক পরে যেন আসে, নইলে অন্য ট্যাক্সি বুক করা যাবে।’ আবার নতুন করে আসর বসে গেল। ইলিয়াসদা ততক্ষণে ঘুমে বেহুঁশ।
ভোর পাঁচটার দিকে ননীদা ছাড়া বাকি অতিথিদের নিয়ে হিতাংশু বিদায় হল। সেই সময় বিষ্ণুদা একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন: ‘দোকান কখন খোলে?’ আমি বললাম: ‘দশটার আগে তো নয়।’ শুনে উনি বেজার হয়ে গেলেন, নইলে হয়তো পুরনো বন্ধু ননী ভৌমিকের সঙ্গে থেকেই যেতেন। কিন্তু ননীদা ততক্ষণে শুয়ে পড়েছেন।
গাড়ি দূতাবাসের কাছাকাছি আসতে রাষ্ট্রদূত মশাই নাকি বলেছিলেন, ‘আরে, জায়গাটা যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে।’
আগেই বলেছি, মস্কোয় কখনও ভারত উৎসব, কখনও যুব উৎসব এরকম কিছু না কিছু লেগেই থাকত– বিশেষত গ্রীষ্মকালে। আর সংস্কৃতি বিনিময় কর্মসূচিতে গানবাজনা ও নাচের দল, যুব প্রতিনিধি দল ইত্যাদি অনেকেরই আনাগোনা ছিল। বিশু এঁদের সঙ্গে ঠিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলত, আর তাঁদের অনুষ্ঠানসূচির মাঝখানে কোনও ফাঁক দেখলেই পুরো দলটাকে আপ্যায়ন করার জন্য আমার বাড়িতে নিয়ে আসত।
একবার সেটা ১৯৮৩ সালের শরৎকালের কোনও এক সময়কার ঘটনা, কোনও একটা উৎসব উপলক্ষে পি.সি. সরকার (জুনিয়র) এখানে ম্যাজিক দেখাতে এসেছিলেন। আমরা অনেক কষ্টে টিকিট জোগাড় করে সেই অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের শেষে গ্রিনরুমে গিয়ে পি.সি. সরকার আর তার গ্রুপের অনেকের সঙ্গে আলাপ হল। পরের দিন অনুষ্ঠান সকাল সকাল শেষ হচ্ছে। ঠিক হল হিতাংশু ওদের সকলকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসবে। নিয়েও এসেছিল এক বিশাল ট্যুরিস্ট বাসে করে। সেদিন তিনি একাই খালি হাতে বেশ কিছু ম্যাজিক দেখিয়ে আমাদের অবাক করে দিয়েছিলেন। ওই ঠান্ডার মধ্যে আমাদের ঘরে জবা থেকে শুরু করে নানা ধরনের দেশি-বিদেশি ফুল আর গাছ-গাছড়ার উদ্যান দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, আর রান্নাঘরে টবে লাগানো লঙ্কা ফলতে দেখে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন: ‘এর চেয়ে বড় ম্যাজিক হয় নাকি?’ খাওয়ার সময় গাছ থেকে লঙ্কা ছিঁড়ে ছিঁড়ে সকলের পাতে দেওয়া হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস বা ওই রকম কোন একটা সময়ে সস্ত্রীক বিনয় রায় মস্কোয় এসেছিলেন। বিনয় রায় এসেছিলেন তাঁর স্ত্রীর চোখের চিকিৎসা করাতে। এককালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের গণসংগীতশিল্পী এবং গায়ক ও গীতিকার হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি রুশ ভাষাবিদও ছিলেন। এক সময় বছর দশেক মস্কো রেডিয়োতে কাজও করে গেছেন। সেই সময় তিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে রুশ ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনাও করেন। তাঁর সঙ্গে কলকাতায় থাকতে আমার পরিচয় হয়েছিল ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতিতে কর্মসূত্রে। এই সময় ঠিক কী উপলক্ষে মনে নেই কল্পনা যোশিও মস্কোয় এসেছিলেন। ওর সঙ্গেও কলকাতায় থাকতে আমার পরিচয়, তবে সে পরিচয় সেই ছয়ের দশক থেকে এবং অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। কল্পনাদি তখন কলকাতায় স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটে কর্মরত ছিলেন। থাকতেন আমাদেরই পাড়াতে বেনিয়াপুকুর অঞ্চলে তাঁর দাদার বাড়িতে। তখন তাঁর দুই ছেলে চাঁদ আর সুরজ কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়ত। কল্পনাদি কলকাতার ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতিতে রুশ ভাষা শেখেন। তাঁরই উদ্যোগে পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতির বিভিন্ন শাখাগুলিতে রুশ ভাষা শিক্ষার একই শিক্ষাক্রম এবং কেন্দ্রীয় পরীক্ষাব্যবস্থা চালু করার উদ্দেশে ‘All India Institute of Russian Language’ স্থাপিত হয়। রুশ ভাষার শিক্ষক হিসেবে আমিও তার কার্যনির্বাহী সমিতির একজন সদস্য ছিলাম। সুরজের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয় মস্কোয়, ১৯৬৫ সালে যখন সে স্নাতক পর্যায়ে সিনেমাটোগ্রাফি শেখার জন্য সেখানে এসেছিল।
সেদিন বিনয় রায় আর কল্পনাদির গলায় নবজীবনের যে সমস্ত গান আবার নতুন করে শুনলাম সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। কিন্তু তারপরের দিনের ঘটনাটাই ছিল মর্মান্তিক: পরদিন রাতে বিনয় রায় গোপেনদার বাড়ি থেকে লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসে ফিরছিলেন, নির্দিষ্ট স্টপে বাস থেকে নেমে তিনি যখন রাস্তা পার হতে যাচ্ছিলেন সেই সময় পিছন থেকে আসা একটা বাসের ধাক্কায় পড়ে গিয়ে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। মাথাটা এমন থেঁতলে গিয়েছিল যে দেখে চেনা যায় না। আমরা স্তম্ভিত।
১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে মস্কোয় আকস্মিকভাবে মারাত্মক ঠান্ডা পড়ে গিয়েছিল। মস্কোয় শীতকালে অবশ্য এমনিতেই প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে, তবে বড়জোর শূন্যাঙ্কের ৩০-৩৫ ডিগ্রি নিচে: কিন্তু সেবারে শূন্যাঙ্কের ৪৩ ডিগ্রি নিচে নেমে গিয়েছিল। এই সময় আমার ছোট মেয়ের জন্ম। প্রসূতিভবন থেকে প্রসূতি আর নবজাতকদের আগে আগে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যেহেতু হাসপাতালগুলিতে জলসরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার উপক্রম, কোনও কোনও জায়গায় জলের পাইপে জল জমে বরফ হয়ে যাওয়ায় পাইপ পর্যন্ত ফেটে গিয়েছিল। কাজের জায়গায় যাতায়াত করা ছাড়া লোকে পারতপক্ষে রাস্তায় বেরচ্ছিল না। স্কুল-কলেজও বন্ধ। অনেক সাধ্যসাধনা করে একটা ট্যাক্সি ভাড়া নিয়ে সেটাকে প্রসূতিভবনের দ্বারের কাছে খাড়া করে রেখে এসেছি। সঙ্গে হিতাংশু– সেই ভরসা। বাচ্চা নিয়ে বাইরে বের হওয়াই কঠিন। গরম জামাকাপড়ে মোড়া বাচ্চাকে কোলে নিয়ে কীভাবে গাড়িতে তুলব সেই ভেবে আমি দিশেহারা। শেষকালে হিতাংশু তাঁকে গ্রহণ করল। সেই থেকে সে আমার মেয়ের ধর্মপিতা।
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..
এই সময় আমার পরিচিত কবি ও অধ্যাপক তরুণ সান্যাল সেখানকার বিখ্যাত চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ স্ভেতোস্লাভ্ ফিয়োদরভ-কে চোখ দেখাতে মস্কোয় এসেছিলেন। চোখে একটা ছোটখাটো অপারেশন করা দরকার হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ডাক্তার ফিয়োদরভের ক্লিনিকেও জল গরম করার ব্যবস্থা অচল হয়ে যাওয়ার ফলে তাঁকে সেখান থেকে সাময়িক ভাবে উঠে যেতে হয় মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে।
কলকাতায় আমি যখন ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, সেই সময় কোনও এক পর্বে তিনি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মস্কোয় আমার বাসভবনে বেশ কয়েকবার এসেছেন। উনি এলেই গান বাজনা ও কবিতার আবৃত্তি এবং চুটকিতে ঘরোয়া আড্ডা জমে উঠত। গণনাট্য সংঘের বেশ কিছু গান তিনিও সুন্দর গাইতেন– আর আশ্চর্য এই যে, সেই সময়ই আবিষ্কার করি, সেগুলির বেশ কয়েকটির সুর রুশসংগীত থেকে গৃহীত। আমার শ্বশ্রুমাতা সুকণ্ঠী ছিলেন। তরুণ সান্যালের গলার সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনি যখন রুশ ভাষায় সেই গানগুলি গাইতে লাগলেন, একমাত্র তখনই আমরা সেই মিলটা বুঝতে পরলাম। সেও এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩৫। রুশদের কাছে ভারত ছিল রবীন্দ্রনাথের দেশ, হিমালয়ের দেশ
পর্ব ৩৪। সোভিয়েত শিক্ষায় নতুন মানুষ গড়ে তোলার ব্যাপারে একটা খামতি থেকে গিয়েছিল
পর্ব ৩৩। দিব্যি ছিলাম হাসপাতালে
পর্ব ৩২। মস্কোর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সাধারণ ডাক্তাররা অধিকাংশই মহিলা ছিলেন
পর্ব ৩১। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা নিজভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছিল শুধু আমার জন্য
পর্ব ৩০। শান্তিদা কান্ত রায়ের প্রিয় কাজ ছিল মস্কোয় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কমিউনিজম পড়ানো
পর্ব ২৯। পেরেস্ত্রৈকার শুরু থেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন গোপেনদা
পর্ব ২৮। দেশে ফেরার সময় সুরার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাননি গোপেনদা
পর্ব ২৭। বিপ্লবের ভাঙা হাট ও একজন ভগ্নহৃদয় বিপ্লবী
পর্ব ২৬। ননী ভৌমিকের মস্কোর জীবনযাত্রা যেন দস্তইয়েভস্কির কোনও উপন্যাস
পর্ব ২৫। ননীদা বলেছিলেন, ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না
পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ
পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে
পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত
পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি