আমি বা গিন্নি কেউ-ই ‘উঠল বাই তো পুরী যাই’ টাইপ নই, ঝাউবনের বদলে সারি সারি হোটেল আর শহুরে হই-হট্টগোলের মধ্যে বসে সমুদ্রের ঢেউ গোনার কোথায় যে মজা, মাথায় ঢোকে না। তবু কয়েক বছর বাদে চিলকা হ্রদ বা লগুন দেখতে সাতপাড়া গিয়ে ফেরার পথে ক’দিন পুরীতে কাটানোর কথা ভাবলাম।
খুরদা রোড পেরতেই ‘ধাঁই কিরি কিরি পুরি’ বলে বিকট চিৎকারে পিলে চমকে দিল এক চাঅলা! বুঝলাম, এবার নীলাচল এসে গেছে। সেবার প্রথম বউবাচ্চা সমেত জগন্নাথ দর্শনে চলেছি,আনাড়ির মতো এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে এমন এক হলিডে হোম বুক করেছিলাম, শেষমেষ হোলসেল বসে কপাল চাপড়াতে হল! ছাদের জলের ট্যাঙ্ক একটা অ্যাম্বাসেডার গাড়ির মতো দেখতে বলে ওই বাড়িটা সবাই চেনে ‘ট্যাক্সি বাড়ি’ বলে। কিন্তু দেখলাম, সমুদ্র অবধি পৌঁছতে হলে ট্যাক্সি ভাড়া করা ছাড়া গতি নেই। তাছাড়া কে-ই বা ভেবেছিল যে, ডিসেম্বর মাসের শেষে দুপুরবেলা বালিতে পা দিলে রীতিমতো ছ্যাঁকা লাগবে! আর রাতে মাথার ওপর বাঁই বাঁই করে পাখা চালাতে হবে!
এমনিতে আমি বা গিন্নি কেউ-ই ‘উঠল বাই তো পুরী যাই’ টাইপ নই, ঝাউবনের বদলে সারি সারি হোটেল আর শহুরে হই-হট্টগোলের মধ্যে বসে সমুদ্রের ঢেউ গোনার কোথায় যে মজা, মাথায় ঢোকে না। তবু কয়েক বছর বাদে চিলকা হ্রদ বা লগুন দেখতে সাতপাড়া গিয়ে ফেরার পথে ক’দিন পুরীতে কাটানোর কথা ভাবলাম। সাতপাড়ায় যেখানে ছিলাম, সেই সরকারি যাত্রীনিবাসটি চমৎকার– দোতলার ঘরের বারান্দায় বসে সামনে শুধু থইথই জল, জেলে নৌকো ভেসে যাওয়া আর চারধারে ছোট ছোট পাহাড়ের সারি দেখে দিব্যি সময় কাটানো যায়। অক্টোবরের শেষেও মাঝে মাঝেই ঝেঁপে বৃষ্টি নামছে। তারও বাড়তি মজা– তবে আশপাশের ফেরিঘাট, সারি সারি নৌকো আর জেলেদের ঝুপড়ি আঁকতে বেরিয়ে আমার তো এদিকে সবকিছু ভেস্তে যাওয়ার জোগাড়!
দ্বিতীয় দিন সকালে দশ-বারোজনের একটা দল মোটর লঞ্চে চেপে লেক পরিভ্রমণে যাওয়া হল ডলফিন দেখার উদ্দেশ্য। আগে-পরে টুরিস্টদের নিয়ে চলতে শুরু করল আরও কয়েকটা লঞ্চ। আমাদের পাইলট মাঝে মাঝে তাক বুঝে ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজটা বন্ধ করছিল বটে, কিন্তু ততক্ষণে ডলফিনের দল বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পগার পার! কয়েকবার মনে হল, ছাইরং-এর কিছু একটা বহুদূরে জল থেকে উঠে সামান্য লাফাল, ব্যস ওই পর্যন্তই। আমাদের দেশের ডলফিন সম্প্রদায় কবে যে পাকা জিমন্যাস্টদের মতো সবার সামনে এসে বুক ফুলিয়ে খেলা দেখাতে শিখবে, কে জানে!
যাই হোক, এরপর আমাদের লঞ্চগুলো একে-একে গিয়ে ভিড়ল লেকের শেষ মাথায় হন্সরাজ দ্বীপে– যেটা আসলে সরু একফালি ভূ-খণ্ড, যার অন্যদিকটাতে রয়েছে অপার সমুদ্র। কয়েক-পা হাঁটলেই ছোট ছোট ঢেউ এসে পা ভিজিয়ে দেবে। বালিয়াড়ির ওপর টুরিস্টদের জন্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে রেখেছে স্থানীয় লোকজন, রয়েছে প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া খাবার জায়গা, টুকটাক নানা জিনিসের জোর কেনাবেচাও চলছে। জলভর্তি গামলায় কিছু ঝিনুক নিয়ে বসেছে ডোরাকাটা রংচঙে গেঞ্জি-পরা একজন, গিন্নি কাছে যেতেই ম্যাজিক দেখানোর মতো পটাপট মুক্তো বের করে ওর হাতে তুলে দিল আর গিন্নিও দিব্যি সমঝদারের মতো ওগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে ঝিনুকঅলার সঙ্গে কিছুক্ষণ খোশগল্প চালিয়ে নিল। ঝালমুড়ি, চিপস, কিংবা শাঁসালো ডাব থেকে নিয়ে টাটকা মাছভাজা– হন্সরাজে সব কিছুরই আয়োজন রয়েছে।
সেঞ্চুরি করার পর ব্যাটসম্যান যেভাবে ব্যাট আর টুপি তুলে দর্শকদের অভিবাদন কুড়িয়ে নেয়, একজন দেখলাম সেইরকম দু’হাতে হলুদ মাখানো দুটো পেল্লাই সাইজের রুপোলি পম্ফ্রেট মাছ তুলে সবাইকে ডাকছে তার ছাউনিতে। পাশেই আরেক জায়গায় কড়ায় ছ্যাঁক ছোঁক শব্দে চিংড়িমাছ ভাজা হচ্ছে দেখে ডাবের শাঁস চিবতে চিবতে আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লাম। রীতিমতো বড় সাইজের চিংড়ি প্রায় জলের দরে দিচ্ছে, আমরা তিনজনে মিলে প্রায় কিলোটাক চিংড়ি ওখানেই উড়িয়ে দিলাম। আর বেশ কিছুটা ঠোঙায় মুড়ে সঙ্গে নিলাম ফিরে গিয়ে প্রি-লাঞ্চ স্টার্টার হিসেবে আয়েশ করে খাব বলে। চিলকা হ্রদের কোলে দিন তিনেক আমাদের সত্যিই বেশ কেটেছিল, তারপর জগন্নাথদেবের ডাকে আবার একবার ফিরতে হল পুরীর উদ্দেশে।