সন্দেহ করা হয় লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করার পিছনে উদ্দেশ্য হল তার প্রাকৃতিক সম্পদকে কর্পোরেটের হাতে বিক্রি করা। কিন্তু লাদাখ ষষ্ঠ সিডিউলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে সেখানে শিল্পপতিদের জমি কেনা অসম্ভব হবে, খনি হাঙরদের সম্পদ লুট বাধাপ্রাপ্ত হবে। এই ধূর্ত প্রচেষ্টা, অর্থাৎ কাশ্মীর থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত পর্যন্ত জমি জায়গাকে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছে বিক্রি করে দেওয়া, যাতে অর্থনৈতিকভাবে ও জনসংখ্যাগতভাবে যারা ভূমিপুত্র, তারা সংখ্যালঘু হয়ে যায় তাদের আপন বাসভূমিতেই, এইখানে বাধ সাধলেন সোনাম ওয়াংচুক ও তাঁর সঙ্গীরা।
সুদূর লাদাখ থেকে ওঁরা যাত্রা শুরু করেছিলেন ১ সেপ্টেম্বর, এক রবিবার। উদ্দেশ্য ছিল দিল্লি পৌঁছনো। ২ অক্টোবর রাজঘাটে গান্ধীজির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ওঁদের দাবি নিয়ে আলোচনার আবেদন করবেন কেন্দ্র সরকারের কাছে। ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁরা রাজধানীর উপকণ্ঠে সিঙ্ঘু বর্ডারে পৌঁছতেই তাদের আটকে দেওয়া হল। তারপর তাদের পুলিশি হেফাজতে দু’দিন রেখে মুক্তি দেওয়া হল। প্রায় শতাধিক লাদাখি মানুষ আর তাদের সঙ্গে ছিলেন প্রযুক্তিবিদ ও পরিবেশ আন্দোলনের অগ্রগণ্য সেনানী সোনাম ওয়াংচুক। কিছুটা শ্লেষ আর খেদ মেশানো উচ্চারণে সোনাম ওয়াংচুক বললেন, ‘আমাদের শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা ছিল রাজঘাটে ২ অক্টোবর বাপুকে শ্রদ্ধা জানানোর লক্ষ্যে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র, গণতন্ত্রের জননী, তার সহ্য হল না আমাদের শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা। হায় রাম!’
অবশেষে সোনাম ওয়াংচুক ও তাঁর সাথীরা এসে উঠলেন দিল্লির লাদাখ ভবনে। সেখানেই ৬ অক্টোবর শুরু হল অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন। প্রধান দাবি, লাদাখকে সংবিধানের ৬ষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে লাদাখের সংষ্কৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষিত থাকে। দেশের বহু পরিবেশপ্রেমী মানুষ ও সংবেদনশীল রাজনৈতিক নেতানেত্রী সেখানে গিয়ে তাঁদের এই অনশনে সংহতি জানিয়ে এলেন।
কী চাইছিলেন স্বয়ং ওয়াংচুক? এককথায় বলতে গেলে বলা যায়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভোগবাদের বিরুদ্ধে তাঁর জেহাদ। তিনি বিশ্বাস করেন, তাঁর জন্মভূমি লাদাখকে শিল্পপতি আর খনি মাফিয়াদের হাত থেকে বাঁচাতে গেলে, লেহ, কারগিল আর পুঞ্চের পাহাড়গুলোকে, নীল আকাশকে আর তুষারশুভ্র হিমালয়ের চূড়াগুলোকে পুঁজিবাদের লোভের হাত থেকে রক্ষা করতে গেলে কনজিউমারিজমের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন হতে হবে। ২০১৯ সালের আগস্টে কেন্দ্র সরকার তৎকালীন জম্মু-কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা কেড়ে নিলেন। আর তারই সঙ্গে তাকে ভেঙে লাদাখকে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বলে ঘোষণা করা হল। লাদাখের মানুষ সেদিন খুশি হয়েছিলেন, ভেবেছিলেন তাদের বিশেষ আইডেন্টিটির এটা স্বীকৃতি।
অচিরেই ভুল ভাঙতে শুরু করল। বোঝা গেল আসলে উদ্দেশ্য হল লাদাখের পাহাড়, প্রকৃতি, জমি এসব কিছুকে কর্পোরেটের হাতে বিক্রি করে দেওয়া। তৎপরতার সঙ্গে সেখানে সাতটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করে ফেলল কেন্দ্র সরকার। অনুমতি চাওয়া হল বিদ্যুতায়নের জন্য ৩৮৮ একর বনভূমিকে নিশ্চিহ্ন করার। প্রায় এক শতাধিক কর্পোরেট মাইনিংয়ের প্রস্তাব চলে এল। পাহাড়ের বুক চিরে থেকে তোলা হবে বোরেক্স, সোনা, গ্রাফাইট, চুনাপাথর আর মার্বেল। ভবিষ্যতে নাকি সেখানে পাহাড় ফাটিয়ে ইউরেনিয়াম তোলা হতে পারে। টাকা উড়ছে লাদাখের হিমশীতল মরুপাহাড়ে!
কিন্তু লাদাখবাসীদের সৌভাগ্য, তাদের মধ্যে রয়েছেন এমন একজন মানুষ, যিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞানকে ব্যবহার করতে চান পরিবেশ আর মানুষকে রক্ষা করতে। যিনি কর্পোরেট আধুনিকতাকে বর্জন করে আধুনিকতার বিকল্প এক বিজ্ঞানভিত্তিক মডেল অনুশীলন করে চলেছেন লাদাখের মাটিতে আর পাহাড়ে। মোটামুটি আজকের দিনে সারা ভারত জানে সেই মানুষটির নাম সোনাম ওয়াংচুক। মূলত তাঁর কাজকর্ম ও কথাবার্তার সূত্র ধরে লে এপেক্স বডি ও কারগিল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স দাবি তুলল লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সংবিধানের ষষ্ঠ তফশীল দেশের বিভিন্ন উপজাতি-প্রধান অঞ্চলগুলিতে অধিবাসীদের সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষাকবচ দেয়। অর্থাৎ আদিবাসী অঞ্চল অনাদিবাসীদের কাছে বিক্রি করা চলবে না। একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার দ্বারা সুরক্ষিত হবে আদিবাসী অধিকার ও আঞ্চলিক স্বার্থ।
কিন্তু এখানেই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সন্দেহ করা হয় লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করার পিছনে উদ্দেশ্য হল, তার প্রাকৃতিক সম্পদকে কর্পোরেটের হাতে বিক্রি করা। কিন্তু লাদাখ ষষ্ঠ সিডিউলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে সেখানে শিল্পপতিদের জমি কেনা অসম্ভব হবে, খনি হাঙরদের সম্পদ লুট বাধাপ্রাপ্ত হবে। এই ধূর্ত প্রচেষ্টা, অর্থাৎ কাশ্মীর থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত পর্যন্ত জমি জায়গাকে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছে বিক্রি করে দেওয়া, যাতে অর্থনৈতিকভাবে ও জনসংখ্যাগতভাবে যারা ভূমিপুত্র, তারা সংখ্যালঘু হয়ে যায় তাদের আপন বাসভূমিতেই, এইখানে বাধ সাধলেন সোনাম ওয়াংচুক ও তাঁর সঙ্গীরা। তিনি বললেন, কী অর্থ সেই ধরনের উন্নয়নের, যাতে করে লাদাখের পরিবেশ ধ্বংস হবে, যা তাদের আপন জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি থেকে উৎপাটন করবে! লাদাখের ৯৭% মানুষ আদিবাসী। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। আছে পাহাড়ের সঙ্গে মিলেমিশে এক নিজস্ব জীবন ছন্দ। তাকে ধ্বংস করে উন্নয়নের বাহানায় কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্য সফল হতে দেওয়া যায় না। সোনাম ওয়াংচুকের সবচেয়ে বড় সাফল্য তিনি তাঁর লাদাখবাসীকে এই কথাগুলো বোঝাতে পেরেছেন। প্রচলিত দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকেও তাদের প্রকৃত অর্থে রাজনীতি সচেতন করে তুলতে পেরেছেন এবং শেষ পর্যন্ত তা এক হিমালয়ের মতো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছে। তিনি যেমন পাহাড় বাঁচাতে, জল বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন, তেমনই এগিয়ে এসেছেন পশুপালক গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থ সুরক্ষিত করতে। বিগত ভারত-চিন সংঘাতের পর লাদাখের পশুপালকদের যারা বহুকাল ধরে নো-ম্যান্স-ল্যান্ডের তৃণভূমিতে পশুচারণ করেন, তাদের সেনাবাহিনী আটকে দিচ্ছে। অথচ ভারত সরকার এইসব সামান্য মানুষগুলোর স্বার্থে কিছু করার কথা ভাবছে না।
……………………………………………
আরও পড়ুন: একা, সাধারণ জেগে উঠলে অসাধারণ
…………………………………………….
গত বছর জানুয়ারি মাসের প্রবল ঠান্ডায় তিনি পাঁচদিন ধরে তার সাথীদের নিয়ে অনশন করেছিলেন লাদাখের স্বার্থ ও হিমালয়ের পরিবেশ সুরক্ষার দাবিতে। ২৬ জানুয়ারি তিনি খার্দুংলা পাস যেতে চেয়েছিলেন প্রতিবাদ যাত্রা করে। যদিও তাঁকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। ফলে তাঁর নিজের হাতে তৈরি প্রতিষ্ঠান ‘হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অফ অল্টারনেটিভ, লাদাখ’-এর ক্যাম্পাসেই তিনি অনশন করেন। না, স্বাভাবিকভাবেই দিল্লির সরকার যারা ঠান্ডা ঘরে বসে লাদাখ চালান, তারা শূন্যের অনেক নিচে থাকা তাপমাত্রায় খোলা মঞ্চে অনশনরত কতিপয় পরিবেশকর্মীর আবেদনে কর্ণপাত করেননি। কিন্তু লাদাখের মানুষের সংঘটিত প্রতিরোধ থেমে থাকেনি। এই বছর ৬ মার্চ আবার ২১ দিন ক্লাইমেট ফাস্ট বা পরিবেশ অনশন করলেন সোনাম ওয়াংচুক। তাতেও দিল্লির শাসকদের বধির কর্ণে এই আবেদন প্রবেশ করল না। ওঁরা ঠিক করলেন মার্চের আন্দোলনের ধারাবাহিকতা হিসেবে রাজধানীর দিকে পদযাত্রা করবেন। অবশেষে তাদের পদযাত্রা সিংঘু বর্ডারে থামিয়ে দেওয়া হলেও সোনাম ওয়াংচুক এবং আরও ২৪ জন সাথী দিল্লির লাদাখ হাউসে শুরু করলেন আমরণ অনশন। অবশেষে ১৫দিন টানা অনশনের পর সরকারের দূত এসে তাদের জানাল যে, ডিসেম্বর মাস থেকেই লাদাখ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হবে লাদাখের সমস্যাগুলি সমাধানের উদ্দেশ্যে। কমিটি গঠিত হবে। ২১ অক্টোবর তাঁরা অনশন ভঙ্গ করলেন। তবে সোনাম ওয়াংচুক ও তাঁর সাথীরা জানেন এই লড়াই কেবল কিছু দাবি আদায়ের লড়াই নয়। পরিবেশকে, পাহাড়কে, নদীকে, জঙ্গলকে, মাটিকে কর্পোরেট গ্রাস থেকে বাঁচানোর লড়াইটা একটা বিরাট যুদ্ধ। কোনও সন্দেহ নেই এই যুদ্ধে সোনাম ওয়াংচুক সারাদেশের মানুষের কাছে এক লাইটহাউস।
সরাসরি রাজনীতি তিনি করেননি যেমন, তেমন সোজা কথা বলতেও তার মুখে বাধে না। তিনি বলছেন, বিজেপি অন্তত দু’বার লাদাখের মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিল মোতাবেক তারা লাদাখের আইডেন্টিটি রক্ষা করবে। কোথায় গেল সেই প্রতিশ্রুতি! ক্ষুব্ধ সোনাম বলেছেন, আদিবাসী অধ্যুষিত লাদাখে সংরক্ষণের অধিকার মানা হয় না। গণতন্ত্র নেই সেখানে। ওরা চায় কেবল আমাদের পাহাড়গুলোকে লুট করতে। শীতকালের চার মাস বাদ দিয়ে প্রতিমাসে লাদাখে গড়ে ৫৬ হাজার টুরিস্ট যান। লাদাখের পরিবেশ কম ক্ষতিগ্রস্ত হয় না তাতে। কিন্তু এতেও নিস্তার নেই। এবার কর্পোরেট আগ্রাসনের জন্য লাদাখকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। কিন্তু কর্পোরেট আর পরিবেশের মাঝখানে লাদাখকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে হিমালয়ের মতো অটল সোনাম ওয়াংচুক। কেবল আন্দোলনের প্রশ্নে নয়, এই মানুষটির চিন্তার জগৎ ও দর্শন আশ্চর্য রকমভাবে আলাদা। শিক্ষাগত দিক থেকে তিনি একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। শ্রীনগর এনআইটি থেকে ডিগ্রি কমপ্লিট করে তিনি প্যারিসেও কিছুদিন পড়াশোনা করেছেন ‘আর্থেন আর্কিটেকচার’ বিষয়ে। তারপর দেশে ফিরে আধ কোটি এক কোটির চাকরি না খুঁজে তাঁর জ্ঞান এবং বিদ্যা দিয়ে লাদাখের মানুষ এবং পরিবেশের স্বার্থে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।
প্রথমে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্টুডেন্টস এডুকেশন অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অফ লাদাখ’। সেখানে তার মোট ভাবনার প্রধান বিষয় ছিল শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষা কাঠামো ও শিক্ষার বিষয়বস্তু। তিনি বলছেন আমাদের দেশে ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার সূত্র ধরে এমন এক ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি চালু হয়েছে, যার ফলে পড়ুয়ারা যে বিদ্যা লাভ করে, তা তার চারপাশের পরিবেশের কাজে লাগে না বরং তা আসলে একটা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সেবা করে। ফলে শিক্ষা একটা সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ হয়। একেবারে প্রথম থেকেই প্রযুক্তিবিদ হিসেবে এবং শিক্ষাবিদ হিসেবে তার মধ্যে একটা বিকল্প আধুনিকতার দর্শন গড়ে উঠেছিল।
এই শিক্ষা আন্দোলনেরই পরবর্তী পর্যায়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অফ অল্টারনেটিভ, লাদাখ’। যা এইচ.আই.এ.এল. নামে আজ পরিচিত। ভৌগোলিক অঞ্চল হিসাবে লাদাখ মূলত হিমবাহ এবং হিমবাহ হ্রদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ধারক। অনেকগুলি প্রধান নদীকে লাদাখের হিমবাহ এবং হিমবাহ হ্রসগুলি জল দিয়ে পুষ্ট করে। লাদাখকে তাই বলা হয় ‘এশিয়ার জল-মিনার’। কিন্তু এখানেই সবচেয়ে বড় আইরনি। এপ্রিল-মে এই দু’মাসের সময়টাতে লাদাখের নদীগুলোতে জল তেমন থাকে না কৃষিকাজের জন্য। পানীয় জলেরও বিরাট সংকট তৈরি হয়। তিনি শেখালেন কীভাবে সাধারণ প্রযুক্তিগত কৌশল ব্যবহার করে শীতকালে নদীর জলকে টেনে এনে প্রাকৃতিকভাবে কোন আকৃতির বরফের ৬০-৮০ফুট উঁচু মিনার বানানো যায়। আর এপ্রিল-মে মাসে জলসঙ্কটের সময় তা থেকে বরফ-গলা জল পাওয়া যেতে পারে চাষের জন্য ও অন্যান্য প্রয়োজনে। এই কৌশল তাঁকে কেউ শেখায়নি। পৃথিবীর কোনও সিলেবাসে এই প্রযুক্তি নেই। তিনিই এই কৌশলের আবিষ্কর্তা এবং একাধারে প্রয়োগকর্তা। প্রকৃতিবান্ধব কৌশল ব্যবহার করে প্রকৃতির কাছ থেকেই লাদাখের জল সংকটের সমাধানের রাস্তা তিনি চেয়ে নিলেন।
লাদাখে একটি প্রাকৃতিক ধসের ফলে ফুগতাল নদীর গতি রোধ হয়ে প্রায় ১৫ কিলোমিটার লম্বা এক বিরাট প্রাকৃতিক হ্রদ তৈরি হয়ে যায়। এই বিরাট হ্রদে বরফ গলা জল সঞ্চিত হতে থাকার ফলে আশঙ্কা তৈরি হয় যে জল জমতে জমতে একদিন বিপুল জলরাশি পাড় ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে নিচের উপত্যকা অঞ্চল। তাহলে উপায় কী? তিনি একটা প্রযুক্তিগত সমাধানের কথা বলেন, যেখানে অনেকগুলি পাইপ ব্যবহার করে সাইফানিং করে ধীরে ধীরে হ্রদের জল নিয়মিত বার করে দিলে বাকি জলটুকু সহনশীল মাত্রায় থেকে যাবে। তিনি অঙ্ক কষে দেখালেন, নদী থেকে ৭০ কিউসেক জল ঢুকছে আর ৬ ইঞ্চি ব্যাসের একটি সাইফন পাইপ ৩৫ কিউসেক জল বার করে দিতে পারে। এই হিসাবে ৮০টা সাইফন পাইপ মাত্র একদিনে সব জল বার করে দিতে পারে। অবশ্যই তাঁর কথায় সরকারি প্রযুক্তিবিদরা কর্ণপাত করেননি। তারা হ্রদে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে হ্রদ উপচে জল বার করার চেষ্টা করে। ফল হয় মারাত্মক। হ্রদের পাড় ভেঙে শেষ পর্যন্ত বিরাট প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয় লাদাখের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। চাষের মাঠ ভেসে যায়, ১২টা ব্রিজ তলিয়ে যায়। পরবর্তীকালে সিকিম সরকার তাঁর সাহায্য নিয়ে এই কৌশলগত জ্ঞানকে ব্যবহার করেছে সফলভাবে। ইউরোপে সুইস-আলপসের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে এই ধরনের সমস্যার সমাধানে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি সফলভাবে তার সাইফানিং পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ করেছেন।
…………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………
এইরকম আশ্চর্য সৃজনশীল পরিবেশবান্ধব একজন প্রযুক্তিবিদ ভারতকে পথ দেখাতে পারেন। কিন্তু সে কথা শুনলে কর্পোরেট-প্রেমী সরকারগুলোর চলবে কেন? আমরা শৈশব থেকে জেনেছি, উত্তরে গগনচুম্বী হিমালয় দাঁড়িয়ে থেকে এই দেশকে বাঁচায় তীব্র শীত আর শুকনো হাওয়া থেকে, হিমালয়ের গ্লেসিয়ার এ দেশকে শস্য শ্যামলা করে তোলে। আজ সেই হিমালয় সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। হিমালয় বাঁচবে যদি সোনাম ওয়াংচুকের পন্থায় আমরা চলতে পারি। তাই তিনি যথার্থই বলেছেন, এ লড়াই কেবল লাদাখের লড়াই নয়, এ হল দেশ বাঁচানোর লড়াই।