চিনা আলোর দাপটে যখন এ বঙ্গের বাজার ছেয়ে গিয়েছে, তখন আজও অযোধ্যা পর্বতের এই জেলায় সদর্পে বিরজিত ‘দিওয়ালি পুতুল’। ঘাগরা পরে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়াও পুরুলিয়ার বলরামপুরে আরও এক অন্য শৈলীর ‘দিওয়ালি পুতুল’ দেখা যায়। এই পুতুলটির শৈলী ‘গজলক্ষ্মী’র কথা মনে করিয়ে দেয়। সুর তুলে উদ্যত ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে হাতি। তার পিঠে শান্ত মুখে বসে রয়েছে এক নারীমূর্তি। হাতে লক্ষ্মীর ঝাঁপি। হাতির মাথায় আবার দুই ধরনের সোনালি প্রতীক। একটি ত্রিকোণ আকৃতির, অপরটি গোলাকার।
মুখে দেবীসুলভ অভয় হাসি। মাথায় সোনালি রঙের মুকুট। সিঁথির বিভাজন থেকে উঁকি দিচ্ছে টিকলি। কপালে লাল টিপ পরে তিনি তাকিয়ে রয়েছেন অনন্ত মনুষ্য প্রকৃতির দিকে। গলায়, কানে, হাতে এবং কোমরে স্বর্ণালি অলঙ্কারে শোভিত হয়েও দুই অতি প্রসারিত হাতে তুলে নিয়েছেন দীপ জ্বেলে যাওয়ার তীব্র অঙ্গীকার। তার কোমর থেকে পা উত্তর ভারতীয় শৈলীর ঘাগরায় আবৃত। যেন পুরুষতন্ত্র তাকে এগিয়ে যেতে দেবে না। তবুও সে অটল চিত্তে জীবনযুদ্ধে হাল না ছাড়তে প্রস্তুত। প্রতি বছর কালীপুজোর দিনদুয়েক আগে এভাবেই সেই দেবী পুরুলিয়া জেলার বলরামপুরের ব্যস্ত চকবাজার এলাকায় বিরাজ করেন। এই দেবীর জনপ্রিয় নাম ‘দিওয়ালি পুতুল’। আবার গবেষককুল একে ‘দীপলক্ষ্মী’ নামেও অভিহিত করে থাকেন।
পুরুলিয়া বললেই বঙ্গজীবনের মানসপটে চড়িদা গ্রামের ছৌ নাচের কথাই মনে আসে। কিন্তু স্বাধীন ভারতের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত এই জেলা তার দিওয়ালি পুতুলের জন্য গুরুত্ব অর্জন করে নিয়েছে লোকজ সংস্কৃতির জগতে। পোড়ামাটির এই পুতুলগুলো বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। হলুদ, সবুজ, রানি, কমলা, নীল, মেরুন-সহ আরও একাধিক রঙের মেলা খেলা করে যায় এই পুতুলে। যদিও একই পুতুলের মধ্যে দুই ধরনের রঙের মিশ্রণ দেখা যায় না।
প্রতিটি পুতুলেই চড়া অভ্রের ব্যবহার দেখা যায়। ফলে সূর্যের আলোয় পুতুলগুলোর ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পায়। এই ঔজ্জ্বল্যর মাঝেই পুতুলটির ঘাগরায় ফুলের ছবি আঁকা হয়ে থাকে। এই ফুল সম্ভবত পদ্মফুলের প্রতীক বহন করে চলেছে। সমুদ্রমন্থনে ক্ষীরোদ সাগর থেকে উঠে আসার সময় লক্ষ্মীর হাতে পদ্ম ছিল। আর দিওয়ালি পুতুলের আরও এক নাম যেহেতু দীপলক্ষ্মী অর্থাৎ লক্ষ্মীর সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই পদ্মের ছবি আঁকা হয়েছে।
পুতুলগুলো প্রসারিত হাতে বেষ্টনী করে তার ওপর পাঁচ, আবার কখনও চোদ্দো প্রদীপ থাকে। এই প্রসারিত বাহুর বেষ্টনী পুতুলটির মাথার ওপরের দিকে হয় আবার নিচের দিকেও হয়ে থাকে। খিলানের মতো দেওয়ালি পুতুলের মাথার ও শরীরের ওপর দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করে সেখানে প্রদীপ বসিয়ে দেওয়া হয়। আবার কিছু পুতুলের বাহু থাকে না। সেই পুতুলের কাঁধ ও কোমরের দুই দিকে প্রদীপ লাগানো থাকে। আর সেই পুতুলের ঘাগরার সামনের দিকেও একটি প্রদীপ দেওয়া হয়। পুতুলের তলার অংশ অর্থাৎ যেটিকে আমরা ঘাগরা বলছি সেটি চাক ঘুরিয়ে তৈরি কর হয়। মুখ, মুকুট এবং পুতুলটি গলা থেকে কোমর পর্যন্ত ছাঁচের তৈরি। আর প্রসারিত বাহু জোড়া হাতে টিপে করা।
লোকসংস্কৃতি গবেষক তারাপদ সাঁতরা তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ’ বইতে দেখিয়েছেন যে, দিওয়ালি পুতুলটির ঘাগরার মতো দেখতে ফাঁপা অংশটি আদতে বাতিদণ্ড। পুতুলটির আকার ও শৈলীতে তিনি আদিমতার বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে বলে দাবি করেছিলেন। দিওয়ালি পুতুলকে ‘দীপলক্ষ্মী’ বলার কারণ প্রসঙ্গে গবেষক তাঁর বইতে জানিয়েছিলেন যে, এই পুতুল ধনসম্পদের বৃদ্ধির প্রতীক শ্রী বা লক্ষ্মীর ভাবমূর্তি নির্দেশ করে থাকে।
কালীপুজোর প্রায় তিন মাস আগে থেকেই শিল্পীরা পুতুল তৈরি কাজ শুরু করে দেয়। চিনা আলোর দাপটে যখন এ বঙ্গের বাজার ছেয়ে গিয়েছে তখন আজও অযোধ্যা পর্বতের এই জেলায় সদর্পে বিরাজিত ‘দিওয়ালি পুতুল’। ঘাগরা পরে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়াও পুরুলিয়ার বলরামপুরে আরও এক অন্য শৈলীর ‘দিওয়ালি পুতুল’ দেখা যায়। এই পুতুলটির শৈলী ‘গজলক্ষ্মী’র কথা মনে করিয়ে দেয়। সুর তুলে উদ্যত ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে হাতি। তার পিঠে শান্ত মুখে বসে রয়েছে এক নারীমূর্তি। হাতে লক্ষ্মীর ঝাঁপি। হাতির মাথায় আবার দুই ধরনের সোনালি প্রতীক। একটি ত্রিকোণ আকৃতির, অপরটি গোলাকার।
এই হাতির পিঠে আরোহণ করা দিওয়ালি পুতুলের দু’টি শৈলী রয়েছে। একটি গজে আরোহণ করা নারী মূর্তির মস্তকে চূড়াবিশিষ্ট মুকুট নেই। রয়েছে শুধু রুপোলি আস্তরণ। মুখের অভিব্যক্তিতে শান্ত ভাব। শরীরের কোনও অংশে প্রদীপ বহন করার ক্লান্তি নেই। অপর শৈলীতে দেখা যাচ্ছে মাথায় চূড়াবিশিষ্ট মুকুট। প্রসারিত কাঁধে রয়েছে প্রদীপ। দু’টি হাতের মিলনস্থানে রয়েছে আরও একটি প্রদীপ। মুখে হাসি নেই। গলার দিকটি বর্মের মতো আস্তরণ দিয়ে ঘেরা। শরীরী ভাষা থেকে ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাব স্পষ্ট।
হাতি ছাড়াও দিওয়ালি পুতুলের অশ্বারোহণ শৈলীও রয়েছে পুরুলিয়ার বলরামপুরে। দেওয়ালি পুতুলের নাকে নথ। কাজল মাখা চোখের তীব্রতায় রণচণ্ডী ভাব পূর্ণ। বলরামপুরের পাশাপাশি পুরুলিয়া শহরের হাট মোড়ে দিওয়ালি পুতুলের মেলা দেখা যায় কালীপুজোর দিন কয়েক আগে। হাট মোড়ে নিজেদের শিল্প সম্ভার নিয়ে আসা শিল্পীরা শহরের মধ্যে থাকা কাটিং কুমোর পাড়া থেকে আসেন।
……………………………………………………
পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র ছাড়িয়ে হিন্দি বলয়ের দিকে তাকালে দেখা যায়, ছত্তিশগড় রাজ্যের লোকপরম্পরায় এই শৈলীর পুতুলকে ‘গোয়ালিনী’ বলা হয়ে থাকে। দিওয়ালিতে যে লক্ষ্মী পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে সেদিন সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির তুলসী গাছের কাছে গোয়ালিনীকে প্রজ্জ্বলিত করা হয়ে থাকে। গোয়ালিনী এখানে শ্রীরাধার প্রতীক। তিনিই আবার লক্ষ্মীর স্বরূপা। শ্রীকৃষ্ণের ফেরার অপেক্ষায় সে একাধিক প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রতীক্ষা করছেন।
……………………………………………………
পুরুলিয়ার পাশাপাশি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মির্জাবাজারের উত্তর কুমোরপাড়া দিওয়ালি পুতুল তৈরি অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। কিন্তু এখানকার দিওয়ালি পুতুলের শারীরিক শৈলী পুরুলিয়ার বলরামপুর থেকে স্বতন্ত্র। পুতুলের গায়ে চড়া অভ্রের ব্যবহার নেই। ফলে চকচকে ভাব নেই। পুতুলের শরীরজুড়ে সাদা খড়িমাটির রং করা। তার ওপর ঘাগরার সামনের দিকে ফুল আঁকা। পুতুলের বক্ষ উত্তর ভারতীয় শৈলীর বস্ত্র দিয়ে আবৃত। সিঁথিতে সিঁদুর। মুখে শান্ত ভাব। প্রসারিত বাহু জোড়ায় চুড়ি আঁকা রয়েছে। চুড়ি আঁকার এই বিন্যাস অনেকটা হরপ্পার সেই নৃত্যরত রমণীর হাতে থাকা চুড়ির কথা মনে করিয়ে দেবে।
মেদিনীপুরের দিওয়ালি পুতুলে পুরুলিয়ার মতো স্বর্ণালি অলঙ্করণের কোনও চিহ্ন নেই। যদিও পুরুলিয়ার মতো একই পদ্ধতিতে এই পুতুল তৈরি করা হয়ে থাকে। এখানে ছলনের ঘোড়ার মতো দেখতে একটি জন্তুর ওপর বসে থাকা দিওয়ালি পুতুলের দেখাও মেলে। এই পুতুল তার মাথায় নিয়েছে প্রদীপ। প্রসারিত দুই হাত দিয়ে ধরে রেখেছে সে প্রদীপ। এখানে সাতটি প্রদীপ হাতে নিয়ে থাকা দিওয়ালি পুতুলকে ‘সাতবাহনিয়া’ বলা হয়ে থাকে।
এখানে ভাবার বিষয় হল, এই দিওয়ালি পুতুলের গায়ের রং খড়ি মাটি দিয়ে কেন সাদা করা হল? এর অনুমান করা যেতে পারে যে ক্ষীরোদ সাগর বা ক্ষীর সাগর থেকে সমুদ্র মন্থনের সময় উঠে এসেছিলেন মা লক্ষ্মী। ক্ষীর সাগরের রং আবার সাদা। দিওয়ালি পুতুলকে আবার দীপলক্ষ্মীও বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ লক্ষ্মীর আরও এক রূপ ফলে খড়িমাটির সাদা আস্তরণ সেই ক্ষীর সাগরের পৌরাণিক প্রতীক বহন করে চলেছে। মেদিনীপুরের উত্তর কুমোরপাড়ার দিওয়ালি পুতুলের মধ্যে কয়েকটির মাথায় সোনালি রঙের মুকুট রয়েছে। আবার কোনওটিতে মুকুট নেই।
পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র ছাড়িয়ে হিন্দি বলয়ের দিকে তাকালে দেখা যায়, ছত্তিশগড় রাজ্যের লোকপরম্পরায় এই শৈলীর পুতুলকে ‘গোয়ালিনী’ বলা হয়ে থাকে। দিওয়ালিতে যে লক্ষ্মী পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে সেদিন সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির তুলসী গাছের কাছে গোয়ালিনীকে প্রজ্জ্বলিত করা হয়ে থাকে। গোয়ালিনী এখানে শ্রীরাধার প্রতীক। তিনিই আবার লক্ষ্মীর স্বরূপা। শ্রীকৃষ্ণের ফেরার অপেক্ষায় সে একাধিক প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রতীক্ষা করছেন।
লোকশ্রুতি রয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তীব্র ভালোবাসার টানে নিজের সৌন্দর্যকে গলিয়ে মাটি হয়ে গিয়েছিলেন শ্রীরাধিকা। মাটি হয়ে তিনি নিজের শরীরে দীপ প্রজ্জ্বলিত করে বিরহী নায়িকার মতো শ্রীকৃষ্ণের ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন। শ্রীরাধিকার চৈতন্য শক্তি যেন বিকশিত হয়েছে এই মৃৎপ্রতিমার মধ্য দিয়ে। যদিও ছত্তিশগড়ে গোয়ালিনী শাড়ি পরে রয়েছেন। তিনি পদ্মাসনে রয়েছেন। মাথায় মুকুট। তাকে ঘিরে বেষ্টনীতে প্রদীপ বসানো হয়েছে।
………………………………………………………
আরও পড়ুন শুভঙ্কর দাস-এর লেখা: কোলে গণেশ, তাই বঙ্গীয় লোকজ শিল্পের শিব গলায় সাপ রাখেননি
………………………………………………………
হিন্দি বলয়ের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের অন্যতম হল বুন্দেলখণ্ড অঞ্চল। মূলত উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের একাধিক জেলাজুড়ে এই অঞ্চলের বিস্তার। এখানে দিওয়ালির দিন লক্ষ্মী, গণেশ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজো করার পাশাপাশি গোয়ালন বা গোয়ালিনীকে স্থাপিত করা হয়। একে আবার দরিদ্র-লক্ষ্মীও বলা হয়ে থাকে। ন’টা প্রদীপে সজ্জিত গোয়ালন প্রতিমা আদতে ধন, ধান এবং সমৃদ্ধির প্রতীক বলে মনে করা হয়। এই ন’টা প্রদীপের গোয়ালন প্রতিমা আদতে নবগ্রহের প্রতীক বলেও ওই অঞ্চলের লোকশ্রুতি। প্রায় এক হাজার বছর ধরে বুন্দেলখণ্ড অঞ্চল জুড়ে গোয়ালন পুজোর ঐতিহ্য রয়েছে। মনে করা হয়ে থাকে, সমাজের প্রান্তিক শ্রেণিতে থাকা জনগণ এই পুজোর প্রচলন শুরু করেছিলেন।
………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..
দিওয়ালি পুতুল নিয়ে লিখতে লিখতে রামপ্রসাদ সেনের ‘বসন পরো মা’ গানটির একটা পঙক্তি মনে পড়ে গেল। যেখানে কবি বলছেন, ‘কালীঘাটে কালী তুমি, কৈলাসে ভবানী, বৃন্দাবনে রাধা পেয়ারী, গোকুলে গোপিনী, পাতালে ছিলে মাগো হয়ে ভদ্রকালী।’ ঠিক তেমনই দিওয়ালি পুতুল কখনও দীপলক্ষ্মী হয়েছে তো কখনও সে রাধা, আবার কখনও সে শাশ্বত আদি মাতৃকার প্রতীক হয়ে আমাদের মুক্তির আলো শত প্রতিকূলতার মধ্যে বহন করে চলেছে।
ছবি: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে