যেখানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর শিঙাড়াই হাপিশ হয়ে যায় সেখানে প্রশাসনের শীর্ষস্তরে সমন্বয়ের যে কতটা অভাব, তা আন্দাজ করা যায় সহজেই। তার ওপর আবার গোটা ঘটনাটিকে নাকি ‘সরকার বিরোধী’ ঘটনা বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু বিরোধীদের মতে, প্রশ্নটা হচ্ছে, জিনিসটা এনেছে সরকারি আধিকারিকরা, জিনিসটা অদল-বদল করেছে সরকারি আধিকারিকরা, জিনিসটি খেয়েওছে সরকারের সঙ্গে জড়িত মানুষ। তাহলে কে-ই বা সরকার, কে-ই বা বিরোধী, কে-ই বা ডলফিন, কে-ই বা ক্যাপ্টেন স্পার্ক!
আমাদের ছোটবেলায় একটি জিনিস বেরিয়েছিল– মিষ্টি শিঙাড়া। বানানোর প্রসেস সেই একই, খালি ময়দার ভেতরে আলুর পরিবর্তে ঠেসে দেওয়া হত মনে রাখার মতো খারাপ স্বাদের মিষ্টির পুর। যেসব মিষ্টি বিক্রি হয়নি, কারণ হওয়ার কথাও ছিল না, সেগুলো দলা-পাকানো অবস্থায় শিঙাড়ার ভেতর থেকে জুল জুলু করে চেয়ে থাকত। তারপর মালটা সিল করে, ভেজে, চিনির রসের চুবিয়ে ট্রেতে সাজিয়ে দেওয়া হত। প্রথম প্রথম মার্কেটিংয়ের দৌলতে সেই প্রহসন বিক্রি হত খুবই। কিন্তু কালচক্রে যা হওয়ার তাই হল। কারণ প্রথমত কোনওটার স্বাদ একরকম হত না। এক দোকানের হয়তো কালোজাম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সে কালোজাম ভরে দিয়েছে। কোনও দোকানের নিকটবর্তী অঞ্চলে হয়তো আবার ইদানীংকালে কারও শ্রাদ্ধ হয়নি, ফলে ওই সাদা সাদা মিষ্টি বিক্রি হয়নি, দিয়েছে সেগুলো ঠেসে। একবার একটা মিষ্টি শিঙাড়ায় ফুটকড়াইও পাওয়া গেছিল। দ্বিতীয়ত, ওই একটা মাল পুরোটা খেয়ে ফেলার পর, ঠিক কত সেকেন্ডের মধ্যে চোঁয়া-ঢেঁকুর উঠতে শুরু করবে তাই নিয়ে রীতিমতো বাজি ফেলা শুরু হল। এ বলে অমুক দোকানের মিষ্টি শিঙাড়া ১০ মিনিটের মধ্যে পেটের ভেতর টক জলের ট্যাঙ্কি গড়ে ফেলতে সক্ষম। ও বলে, তমুক দোকানের মিষ্টি শিঙাড়ার দিকে নাকি তাকালেই বুক পেটে জ্বালা দিচ্ছে। তাই আবিষ্কারের খুব কমদিনের মধ্যেই মিষ্টি শিঙাড়াও বিক্রি হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু প্রোডাকশন তো চালিয়ে যেতে হবে, শুরু হল মিষ্টি শিঙাড়ার ভেতর মিষ্টি শিঙাড়ার পুর সেঁধিয়ে দেওয়ার এক অপূর্ব ব্ল্যাকহোলীয় খেলা। আজও বোধহয় কিছু দোকানে সেসব বিক্রি হয়, আজও বোধহয় কিছু অম্বলপ্রেমী লোক সেসব কিনে খান। আমার ধারণা ছিল শিঙাড়া বিষয়টা আমাকে এর চেয়ে বেশি অবাক করতে পারবে না।
কিন্তু তারপরও হুট করে একদিন পাড়ার দোকানে শিঙাড়ায় মাচা ফাংশানের শেষ কণ্ঠশিল্পীর মতো একটা ফুলকপি বেরিয়ে এল। ও! সে যে কী আনন্দ! আমি আগের অবাক হওয়াকে ত্যাগ দিয়ে, এই অবাক হওয়ায় বেশি করে মনোযোগ দিলাম। তারপর এই বছর সাত-আটেক আগে দেখি শিঙাড়ার ভেতর বেশ খানিকটা বাসি চাউমিন ঠেসে দিয়ে, চাইনিজ শিঙাড়া বলে বিক্রি করছে। এই গোটা বিষয়টিকে অরুণাচলের বদলা হিসেবে দেখে খুবই উজ্জীবিত হয়ে ঠিক করেছিলাম শিঙাড়ার বিষয়ে এই আমি শেষবার অবাক হলাম। কিন্তু কে জানত হিমাচলে বাড়িছে সে… এমন এক বিধ্বংসী শিঙাড়া, যাকে নিয়ে সিআইডি পর্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে খানিক এমন।
গেল মাসের ২১ তারিখে হিমাচলের মুখ্যমন্ত্রী সুখবিন্দর সিং সুখু সিআইডি-র সাইবার সেল উদ্বোধনের জন্য গেছিলেন সেই দপ্তরে। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর আতিথেয়তা ও জলখাবারের জন্য নামজাদা এক হোটেল থেকে শিঙাড়া-মিষ্টি– এইসব নিয়ে আসার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিছু অধস্তন অফিসারকে। যদিও সেই শিঙাড়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে উঠতে পারেনি। কোনও এক ভুল বোঝাবুঝি বশত সেই সমস্ত মিষ্টি ও শিঙাড়া ভাগ করে দেওয়া হয় মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা রক্ষীদের মধ্যে। এবার এই ঘটনাটির পর ঠিক কী হওয়া উচিত ছিল? হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন, আর যাই হোক না কেন, খবর হওয়া তো উচিত ছিলই না। তাই এই লেখা খবরটিকে আমার ট্রিবিউট। তো যাক গে, জলখাবার বদলের এহেন অনভিপ্রেত ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর, সিআইডি প্রবল বিব্রত হয়ে ওঠে। রীতিমতো, তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। ডেপুটি পুলিশ সুপার পদমর্যাদার আধিকারিক এর ওপর দায়িত্ব পড়ে কালপ্রিটদের খুঁজে বের করার।
এবার ধরা যাক, আপনি বিরোধী দলের নেতা। আপনি যদি জানতে পারেন যে ক্ষমতায় থাকা দল শিঙাড়া নিয়ে সিআইডি তদন্ত চালাচ্ছে, তাহলে আপনি কী করবেন? যেটা যেটা মনে হচ্ছে, এক্ষেত্রেও বিরোধী দল ঠিক তাই করেছে। ওদের মতে, যেখানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর শিঙাড়াই হাপিশ হয়ে যায়, সেখানে প্রশাসনের শীর্ষস্তরে সমন্বয়ের যে কতটা অভাব, তা আন্দাজ করা যায় সহজেই। তার ওপর আবার গোটা ঘটনাটিকে নাকি ‘সরকার বিরোধী’ ঘটনা বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু বিরোধীদের মতে, প্রশ্নটা হচ্ছে, জিনিসটা এনেছে সরকারি আধিকারিকরা, জিনিসটা অদল-বদল করেছে সরকারি আধিকারিকরা, জিনিসটি খেয়েওছে সরকারের সঙ্গে জড়িত মানুষ। তাহলে কে-ই বা সরকার, কে-ই বা বিরোধী, কে-ই বা ডলফিন, কে-ই বা ক্যাপ্টেন স্পার্ক! এই সমস্ত ‘যুক্তিযুক্ত’, ‘বাস্তব বোধসম্পন্ন’ এবং সর্বোপরি ‘ভীষণ দরকারি’ কথাবার্তাই ভেসে ভেসে আসছে বারবার।
……………………………………….
আরও পড়ুন সৌমিত দেব-এর লেখা: মাগনায় খাটিয়ে নেওয়া বাংলা বাজারে সুপারহিট
……………………………………….
যদিও সিআইডি-র ডিজি বলেছেন যে, এটা তাদের ডিপার্টমেন্টের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তাঁরা তো আর কাউকে কোনও চিঠি ধরিয়ে তদন্ত করতে বলেননি, আসল ঘটনাটা কী ঘটেছে, কাদের গাফিলতিতে ঘটনাটি ঘটেছে, সেইসব একটু খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। ব্যাস, এইটুকুই। ওঁর মতে, এই ঘটনায় রাজনৈতিক রং দেওয়া একেবারেই উচিত হচ্ছে না। কারণ এই বিষয়টা সরকারের বিষয় নয় একটা নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্টের বিষয়। সঙ্গে একথাও বলেছেন যে, ওঁরা ঠিক খুঁজে বের করবেন কে বা বিষয় খবরটা ‘খবর’ করায় মদত দিয়েছেন। তবে সর্বোপরি ওঁর যে, বক্তব্যটি আমার মন ছুঁয়ে গিয়েছে, সেটি হল মুখ্যমন্ত্রী শিঙাড়াই খান না। এবার কথা হচ্ছে, তাহলে শিঙাড়া খামোখা আনা হলই বা কেন? যাঁর জন্য আনা হয়েছে তিনিই যখন খান না, কেন এত হইচই কেন এত হট্টগোল! প্রশ্নগুলো সহজ, আশা করা যায়, সমস্ত কিছুর উত্তরও খুব শীঘ্রই পাওয়া যাবে।
আর শীঘ্রই আবারও শিঙাড়া সংক্রান্ত নতুন কোনও বিষয় আমায় এমনভাবে অবাক করে তুলবে, ভাবিয়ে তুলবে, যাতে এই ঘটনাটিও আমার কাছে একেবারেই তুচ্ছ বলে মনে হয়। আমি নিশ্চিত হব। নিশ্চিতভাবে জানি, আমি পারব।
কারণ, এক পড়ন্ত বিকেলে, স্কুলের ব্যাগ কাঁধে বাড়ি ফেরার সময় খাওয়া প্রথম মিষ্টি শিঙাড়াটার দিব্যি খেয়ে বলছি, শিঙাড়া হওয়া সহজ নয়।
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..