কঠোরভাবে বিভাজিত নারী আর পুরুষের দুনিয়ায় অনয়ার মতো ক্রিকেটারের ভবিতব্য কী?
Published by: Robbar Digital
Posted on: November 14, 2024 9:29 pm
Updated: November 14, 2024 9:29 pm
অনয়া আজ বহুদিন ক্রিকেট খেলার সঙ্গে যুক্ত। ভারতের পাশাপাশি ইংল্যান্ডের ক্রিকেট সার্কিটেও তার বহু অর্জন আছে। সে গুণী খেলোয়াড়। তাহলে এই খেলার কঠোরভাবে বিভাজিত নারী আর পুরুষের দুনিয়ায় অনয়ার মতো মানুষদের ভবিতব্য কী? অনয়া হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির মাধ্যমে শারীরিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। পেশিশক্তি কমেছে, টেস্টোস্টেরন নেমেছে ০.০৫ অ্যানোমলে। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি তার অনুরাগ যে বিন্দুমাত্র কমেনি। এখন কর্তৃপক্ষ কোন দলে অনয়াকে প্রবেশাধিকার দেবে?
ভাস্কর মজুমদার
ও তুমি আমারই মতন জ্বলিও, জ্বলিও
বিরহকুসুম-হার গলেতে পরিও
তুমি যাইও যমুনার ঘাটে
না মানি ননদির বাধা
বনমালী তুমি, পরজনমে হইও রাধা..
সম্প্রতি প্রাক্তন ক্রিকেটার সঞ্জয় বাঙ্গারের সন্তান হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির সাহায্যে তার কাঙ্ক্ষিত নারী শরীর প্রাপ্ত হয়েছে ইংল্যান্ডে। ‘আরিয়ান’ এখন থেকে ‘অনয়া’। সে নিজেই তার রূপান্তরের যাত্রাপথ সম্বন্ধে সকলকে অবহিত করেছে সমাজমাধ্যম মারফত।
ভারতে রূপান্তরকামী মানুষের অস্তিত্ব সভ্যতার প্রথম লগ্ন থেকেই উপস্থিত। খজা মানুষ বা পরবর্তীকালে হিজড়া গোষ্ঠীর মানুষ যে ইতিহাসের সব পাতায় রয়েছে, তা আমাদের জানা। আমরা এ-বিষয়েও পরিচিত যে লিঙ্গ একটি চলমান পরিচয় এবং কঠোরভাবে ‘নারী’ বা ‘পুরুষ’ বলে কিছু হয় না। জন্মলগ্নে প্রাপ্ত লিঙ্গপরিচয় আসলে এক সামাজিক নির্মাণ। তারপরেও শ্রমের সূত্রে নারী-পুরুষ-রূপান্তরকামী বিভাজনটি একটি রাজনৈতিক বীক্ষা। কিন্তু মুশকিল হল এই বীক্ষাই সমাজের কোনও মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে যা আমরা অনয়ার প্রসঙ্গে আরও একবার স্পষ্ট উপলব্ধি করছি। আমাদের সমাজে সমকামিতা-রূপান্তরকামিতা সহ সমস্ত লিঙ্গযৌনতার মানুষই বিদ্বেষের শিকার। ইংরেজিতে এই বিশেষ ঘৃণাকে বলা হয় ‘হোমোফোবিয়া’ এবং ‘ট্রান্সফোবিয়া’। ‘হোমোফোবিক-ট্রান্সফোফিক’ সমাজে কোনও পুরুষ তথাকথিত নারীর আচরণ করলে, নারীর সমাজ-নির্দিষ্ট কাজ করলে, নারীর পোশাক পরিধান করলে, আবার কোনও নারী উল্টোটা করলে তাকে বা তাদের মারাত্মক হেনস্তা-হিংসার সম্মুখীন হতে হয়। এবং এই অত্যাচার শুরু হতে পারে সেই ছোটবেলা থেকে। একজন সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষ এ-দেশে স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্র, পরিবার-সহ সামাজিক প্রতিটি প্রকোষ্টে নির্যাতিত হয়ে থাকে। এমনকী এই সেদিন অবধি ব্রিটিশ আমলের নানা আইনে দেশের সমস্ত সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষ ‘অপরাধী’র তকমা পেত। অথচ সমকামিতা বা রূপান্তরকামিতা একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক জীবনচর্যা। এবং এর গভীরে রয়েছে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ও তার গোপনীয়তার প্রশ্ন। কে কী পরবে, কী তার খাদ্যাভ্যাস হবে তার ওপর কোনও সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে না। এর সঙ্গে সমানতা, সমানাধিকারের জায়গাটিও স্পষ্ট হওয়া জরুরি।
লিঙ্গযৌনপরিচয়ের কারণে সামাজিক কোনও ব্যবস্থা থেকে কেউ যেন বিতারিত না হয় সেটা দেখতে হবে। কিন্তু অনয়ার ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। অনয়া আজ বহুদিন ক্রিকেট খেলার সঙ্গে যুক্ত। ভারতের পাশাপাশি ইংল্যান্ডের ক্রিকেট সার্কিটেও তার বহু অর্জন আছে। সে গুণী খেলোয়াড়। তাহলে এই খেলার কঠোরভাবে বিভাজিত নারী আর পুরুষের দুনিয়ায় অনয়ার মতো মানুষদের ভবিতব্য কী? অনয়া হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির মাধ্যমে শারীরিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। পেশিশক্তি কমেছে, টেস্টোস্টেরন নেমেছে ০.০৫ অ্যানোমলে। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি তার অনুরাগ যে বিন্দুমাত্র কমেনি। এখন কর্তৃপক্ষ কোন দলে অনয়াকে প্রবেশাধিকার দেবে? খেলার দুনিয়াকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে এই জন্য যে খেলাধূলা আন্তর্জাতিকভাবে আগাগোড়া অত্যন্ত বৈষম্যমূলক একটি ক্ষেত্র। এখানে নারী এবং পুরুষের বেতন ও পুরস্কার-মূল্য ভিন্ন। এবং এই ভিন্নতা আসলে পুরুষের তুলনায় নারীর কম প্রাপ্তি। এমনকি হরমোনের প্রসঙ্গে বহু নারী খেলাধূলা থেকে অনেক সময় বর্জিতও হয়েছে। নারী শারীরিক শক্তিতে পুরুষের তুলনায় খাটো হবে ধরে নিয়েই খেলার দুনিয়া চলে এবং সে-কারণে বর্ধিত টেস্টোস্টেরনের কোনও নারী এমনকি নারী বিভাগ থেকে বাদ পর্যন্ত যায়। সাম্প্রতিক অলিম্পিকে ইমান খালিফের ওপর চলা ক্রমাগত হেনস্তার ঘটনা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। আর অনয়ার ক্ষেত্রে তো কোনও নিয়মই নেই বরং নিষেধাজ্ঞা আছে। আন্তর্জাতিক নিয়মে কোনও রূপান্তরকামী-নারী খেলাধূলাতে কোনও নারী বিভাগে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। আবার হরমোনের প্রসঙ্গে সে পুরুষের বিভাগেও প্রবেশ করতে পারবে না। তাহলে অনয়া বা তার মতো মানুষেরা যাবে কোথায়? অনয়া নিজের সমাজমাধ্যমে এই প্রশ্নগুলি তুলেছে। ভেবে দেখতে হবে অনয়া তার জীবনের এই বিভীষিকাময় অধ্যায়ের মুখোমুখি হচ্ছে আসলে ইংল্যান্ডে বসে। ভারতের পাশাপাশি ইউরোপ-আমেরিকার মতো জায়গাগুলো তবে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য কোনও স্বস্তির জায়গা নয়!
অনয়াকে হয়তো শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট ছেড়ে দিতে হবে। হয়তো তার মন যা চেয়েছিল সেই লিঙ্গযৌনপরিচয় নিয়ে বাঁচার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে পরে অনুশোচনার অন্ধকূপে ডুব দিতে হবে। কিন্তু অনয়া বাঙ্গার আন্তর্জাতিক খেলাধূলার জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে এই মর্মে যে খেলাকে খুব ভালবাসা সত্ত্বেও তাকে কেউ খেলতে দিল না!
আত্মজীবনীতে কথা বলে ওঠে ইতিহাস। 'স্মৃতির সরণি বেয়ে' সে জাতীয় নয়। ক্ষমতার অলিন্দে থেকে সেই ক্ষমতার বিকৃত রূপ তুলে ধরে না এই গ্রন্থ। বরং দাঁড়িয়ে থাকে বেশ খানিকটা বাইরে।