আলাপের প্রথম দিন থেকেই ইলাদির কাছে আমি ‘তুমি’, কিন্তু কল্পনাদি আমাকে নাম ধরে সম্বোধন করলেও আমি তাঁর কাছে ‘তুমি’ কখনওই হতে পারলাম না। একজন অগ্নিযুগের বিপ্লবী, অন্যজন আরও দু’-দশক পরের কমিউনিস্ট কৃষক আন্দোলনের নেত্রী। ইতিহাসের বিচারে কল্পনা দত্তর মতো নেত্রী হয়তো তিনিও ছিলেন না, এমনকী, তাঁর কারাবাসের মেয়াদও কল্পনা দত্তর তুলনায় কম ছিল– মাত্র চার বছর। কিন্তু তাঁর অসাধারণ মনোবল ও দুঃসাহসিক কার্যকলাপ, সর্বোপরি পাকিস্তানের জেলে তাঁর যে দুঃসহ পাশবিক যন্ত্রণাভোগ, যা ছিল শাহদাত বরণকালীন যন্ত্রণাভোগের সমতুল। যার জন্য তিনি কবির ভাষায়, ‘তোমার আমার বিবেকের কণ্ঠস্বর’ হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষ করে সেই কারণেই কিংবদন্তি তাঁকে নেত্রীর আসনে বসিয়েছে, সেখানে এমনকী আন্দোলনের মূল সংগঠক রমেন মিত্র পর্যন্ত আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছেন। কল্পনা দত্ত– পরবর্তীকালে কল্পনা যোশী– নিজেই ঢাকা পড়ে গেছিলেন পুরণচাঁদ যোশীর অন্তরালে।
৪১.
ভুলিনি যাদের
দেশে থাকতে বিভিন্ন বামপন্থী গণ-সংঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী-স্থানীয় অনেকের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে এককালে অনুশীলন পার্টির সদস্য এবং পরে ভারতের কমিউনিস্ট শ্রমিক আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা ধরণী গোস্বামী, কিংবদন্তি বিপ্লবী কল্পনা দত্ত (কল্পনা যোশী) ও একসময় পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক আন্দোলনের কিংবদন্তি ইলা মিত্রের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
আমি মস্কো থাকাকালে ধরণীদা বেশ কয়েকবার নানা উপলক্ষে মস্কোয় এসেছিলেন। প্রায় প্রতিবারই পুরনো বন্ধু গোপেন চক্রবর্তীর সঙ্গে তিনি দেখা করে যেতেন। দু’জনেই একসময় অনুশীলন পার্টির সদস্য ছিলেন। আমি বেশ কিছুকাল যেহেতু গোপেনদার পাড়াতেই থাকতাম, তাই ধরণীদা যখন গোপেনদার কাছে আসতেন, তখন আমি ওদের দু’জনকেই আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসতাম, নয়তো বা আমিই ওদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করতাম। এছাড়া ডাক্তার শান্তি রায়ের নেতৃত্বে মস্কোয় বসবাসকারী ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির আরও কিছু সদস্য এসে জুটতেন। সেখানে আমার ভূমিকা হত নীরব শ্রোতার।
সেই সময় রুশ ভাষার শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক সেমিনার বা অন্য কোনও উপলক্ষে কল্পনা যোশীর মস্কোয় ঘন ঘন যাতায়াত ছিল। কল্পনাদির ছেলে সুরজ যখন প্রথমবার মস্কোয় পড়াশোনা করতে এসেছিল, সেই সময় থেকে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। যদিও বয়সে সে আমার চেয়ে অনেক ছোট। দ্বিতীয়বার সে মস্কোয় এসেছিল ১৯৮২ সালে সিনেমাটোগ্রাফির ওপর উচ্চশিক্ষার একটা বৃত্তি নিয়ে। ততদিনে সে দেশে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দলিলচিত্র তুলেছে, তার জন্য স্বীকৃতিও পেয়েছে, কিন্তু নিজের অস্থির স্বভাবের জন্য স্থিতিলাভ করতে পারেনি।
দেশ থেকে আসার আগে আমার বাড়ির ঠিকানা জানতে চেয়ে সে ফোন করেছিল, কিন্তু ঠিক কী উপলক্ষে, কবে আসবে, কোথায় গিয়ে উঠবে– সেসব কিছুই বলেনি। একদিন মাঝরাতে হুট করে এয়ারপোর্ট থেকে তল্পিতল্পা সমেত সোজা আমার ফ্ল্যাটে এসে হাজির!
আগের স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তার বর্তমান স্ত্রী রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা। ওদের দু’টি ছেলে আছে, খুবই ছোট। সুরজের ইচ্ছে পোস্ট ডক্টরেট গবেষণার জন্য কোনও বৃত্তি জোগাড় করে স্ত্রীকে এখানে নিয়ে আসে। বাচ্চা দুটোকে কোথায় রাখবে সেই নিয়েই সমস্যা।
সেই রাতেই সে তড়িঘড়ি সুটকেস খুলে তার কোনও এক দলিলচিত্রের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের স্মারক ও সম্মানপত্র ইত্যাদি দেখাতে শুরু করল, এমনকী, ওর স্ত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য সংক্রান্ত কাগজপত্রও আমাকে দেখাল। আমি যখন বললাম ওর স্ত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ওর চেয়ে অনেক বেশি, তখন সে হাসতে হাসতে সেটা মেনে নিল, এমনকী এও বলল যে, ওদের বিয়ের কয়েকদিন বাদেই নাকি ওর শ্বশুরমশাই হার্টফেল করে মারা যান। উদাসভাবে বলল, হয়তো বা শকেই। আমি যখন বললাম সেটাই স্বাভাবিক, তখন সে এতটুকু রাগ না করে মুচকি হাসল।
ছাত্রাবাসে থাকার বন্দোবস্ত হতে যে ক’দিন সময় লাগল, সেই ক’দিন সে আমার বাড়িতেই ছিল, ওর তল্পিতল্পা এর পরও দীর্ঘদিন আমার বাড়িতে পড়ে ছিল। মাঝে মাঝে রাতের বেলায় এসে আমার বাড়ি থেকে দেশে ফোন করত। দুই ছেলের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথাও বলত। দেখে মনে হল, সুরজ হয়তো এবারে থিতু হল।
একবার বেশ কিছুদিনের জন্য পরিবারের সকলকে মস্কোয় নিয়েও এসেছিল। সেই সময় কল্পনাদিও মস্কোয় এসেছিলেন। একদিন সকলে মিলে আমার ফ্ল্যাটে মধ্যাহ্নভোজনও করে যান।
কিন্তু না, সুরজের স্বভাব-চরিত্র বদলানোর নয়। ওকে বারবার করে বারণ করে দিয়েছিলাম ‘লাল জল’ বেশি না খেতে। সেই থেকে আমার বাড়িতে এলেই ‘সাদা জল’ চাইত– ‘সাদা জল’ বলতে তার কাছে ছিল ভোদকা; বলত, ‘লাল জল খেতে বারণ করেছ, তাই বলে সাদা জলও খাওয়া যাবে না নাকি?’ ফ্রিজ খুলে নিজেই ঢেলে নিত। অকালেই চলে গেল।
পরে শুনেছি, কল্পনাদি নাকি তাঁর দুই নাতিকে শান্তিনিকেতনে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, মাসে একবার করে সেখানে গিয়ে তাদের দেখেও আসতেন। শান্তিনিকেতনের প্রতি অবশ্য কল্পনাদির বিশেষ দুর্বলতা ছিল। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ সুপারিশেই বিপ্লবী কল্পনা দত্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও ছ’বছরের মাথায় জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলেজের শিক্ষা শেষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
কল্পনা যোশীর তুলনায় ইলা মিত্রকে অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি বলে মনে হয়েছে। কল্পনা যোশীর সঙ্গে আমার যখন পরিচয়, সেই সময় মনে হয়েছিল, তিনি যেন অনেকটা উচ্চকোটিতে উঠে গিয়েছিলেন, যদিও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কল্পনা যোশী ও ইলা মিত্র– দু’জনেই কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।
আলাপের প্রথম দিন থেকেই ইলাদির কাছে আমি ‘তুমি’, কিন্তু কল্পনাদি আমাকে নাম ধরে সম্বোধন করলেও আমি তাঁর কাছে ‘তুমি’ কখনওই হতে পারলাম না। একজন অগ্নিযুগের বিপ্লবী, অন্যজন আরও দু’-দশক পরের কমিউনিস্ট কৃষক আন্দোলনের নেত্রী। ইতিহাসের বিচারে কল্পনা দত্তর মতো নেত্রী হয়তো তিনিও ছিলেন না, এমনকী, তাঁর কারাবাসের মেয়াদও কল্পনা দত্তর তুলনায় কম ছিল– মাত্র চার বছর। কিন্তু তাঁর অসাধারণ মনোবল ও দুঃসাহসিক কার্যকলাপ, সর্বোপরি পাকিস্তানের জেলে তাঁর যে দুঃসহ পাশবিক যন্ত্রণাভোগ, যা ছিল শাহদাত বরণকালীন যন্ত্রণাভোগের সমতুল। যার জন্য তিনি কবির ভাষায়, ‘তোমার আমার বিবেকের কণ্ঠস্বর’ হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষ করে সেই কারণেই কিংবদন্তি তাঁকে নেত্রীর আসনে বসিয়েছে, সেখানে এমনকী আন্দোলনের মূল সংগঠক রমেন মিত্র পর্যন্ত আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছেন। কল্পনা দত্ত– পরবর্তীকালে কল্পনা যোশী– নিজেই ঢাকা পড়ে গেছিলেন পুরণচাঁদ যোশীর অন্তরালে। সর্বোপরি ইলা মিত্র ঘটনার মধ্য দিয়ে উঠে এলেও ঘটনাকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে নিয়ে দুই বাংলার কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ কত যে লেখা হয়েছে, বলা দুষ্কর! গোলাম কুদ্দুসের ‘ইলা মিত্র’ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কেন বোন পারুল ডাকো রে’, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ফুল ফোটার গল্প’, তার মাত্র স্বল্প কয়েকটি দৃষ্টান্ত।
ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতির সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে আমার আলাপ আর সেই সূত্রে আমাদের ছাত্রজীবনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘ইলা মিত্র’ কবিতার স্রষ্টা গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গেও। পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক আন্দোলনের বীর নেত্রীর কাহিনি, পাকিস্তানের জেলে তাঁর ওপর পাশবিক নির্যাতনের বিবরণ এবং সর্বোপরি কবি গোলাম কুদ্দুসের ‘ইলা মিত্র’ সেই সময় আমাদের শিহরিত করে। সেই ইলা মিত্র, সেই গোলাম কুদ্দুস কিনা এত কাছের মানুষ! গোলাম কুদ্দুসকে অবশ্য এর আগেও দেখেছি। পার্ক সার্কাসের থাকতেন। কাছাকাছি ‘প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সমাজ’ নামে একটি পাঠাগার ছিল, সেখানে কাজি আবদুল ওদুদ, বরেন বসু– তাঁদের সঙ্গে অনেকেই আসতেন অনেক সময়ই সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত নানা ধরনের আলোচনা করতে। কবি গোলাম কুদ্দুসও ছিলেন তাঁদের একজন। সকলেই আমাদের পাড়ার লোক।
ইলাদি একসময় পশ্চিমবঙ্গের ভারত সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন, সেই সূত্রে একসময় প্রায় রোজই সন্ধেবেলা সমিতির কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হত, সমিতির কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হত, প্রয়োজনে আমি পার্ক সার্কাস অঞ্চলে সিআইটি রোডে তাঁর বাড়িও গেছি। সেটাও আমাদের পাড়া। পরে রমেন মিত্রের সঙ্গে এবং তাঁদের একমাত্র সন্তান মোহনেরও পরিচয় হয়। ইলাদির ভাই ডাক্তার নৃপেন সেনের সঙ্গেও পরিচয় হয়। আমাদের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে বহুবার এসেছেন ইলাদি । মস্কোতে যাওয়ার পরেও ছুটিছাটার সময় দেশে এলে সপরিবার ওদের বাড়িতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ বাঁধা ছিল। পাকাপাকিভাবে দেশে চলে আসার পরও ওদের বাড়িতে গেছি। ওঁর মতো বিনম্র স্বভাবের মানুষ কদাচিৎ দেখেছি। আমাদের বাড়ি এলে আমার বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম পর্যন্ত করতেন– তাতে বাবা বেশ বিব্রতই হয়ে পড়তেন। একসময়ের অমন ডাকসাইটে নেত্রী বলে তাঁর কথাবার্তা বা ভাবভঙ্গিতে একবারও মনে হত না। অথচ তিনি যখন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন, এমনকী, তখনও শুনেছি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন গভর্নর পদ্মজা নাইডু নাকি ওঁর কথা উঠলেই ‘That Lady!’ বলে আঁতকে উঠতেন– উনি নাকি একবার সরকারি নীতির প্রতিবাদস্বরূপ তাঁর পথ অবরোধ করে শুয়ে পড়ে তাঁকে ভীষণ বিপাকে ফেলে দিয়েছিলেন।
আমি যখন মস্কোয় ছিলাম, সেই সময় ইলাদি মস্কোয় এসেছিলেন, কিন্তু তখন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি, উনি এসেছিলেন আরও কয়েকজন কমরেডের সঙ্গে মস্কোর পার্টি-স্কুলে মাস ছয়েকের জন্য মার্কসবাদ-লেলিনবাদের একটি শিক্ষাশিবিরে যোগ দিতে। উনি যে এখানে এসেছেন, তা দেশেও অনেকেই জানে না। সংবাদটা গোপনীয়। তাই মস্কোয় আমার সঙ্গে দেখা করেননি, যদিও পরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পার্টি কমরেডদের অনেকেই সেই গোপনীয়তা খুব একটা মানতেন না। একবার শুধু ঘটনাচক্রে মস্কোর পাতালরেলের কোনও এক স্টেশনে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে আরও কয়েকজন কমরেড ছিলেন। উনি শুধু দূর থেকে হাত নাড়লেন। পার্টি শৃঙ্খলা উনি কড়াকড়ি ভাবে মেনে চলতেন।
একবার এই রকমই একটি শিক্ষাশিবিরে যোগদানের জন্য কলকাতা থেকে তখনকার এক বিখ্যাত ট্রেড ইউনিয়ন নেতা মস্কোয় এসেছিলেন। সঙ্গে আরও কয়েকজন কমরেড ছিলেন। ট্রেড ইউনিয়ন নেতার সঙ্গে তো বটেই, দলের আরও সকলের সঙ্গেই দেশে থাকতে আমার আলাপ ছিল। দেখলাম তাঁরা ইলাদির মতো অতটা নিয়মকানুন মেনে চলেন না। নেতাটি রুশভাষা না জানলেও মাসখানেকের মধ্যে মস্কোর রাস্তাঘাট তাঁর মোটামুটি জানা হয়ে গিয়েছিল। একদিন তিনি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে সন্ধেবেলা দলবল নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে এসে হাজির। অন্যেরা রাস্তাঘাট ভালো মতো চেনেন না, কিন্তু এসেছেন ওঁর ভরসায়। ওঁর ফরমাসমতো রান্নাও করে এনেছিলাম। অন্যেরা পানীয় ছুঁলেন না, কিন্তু পানীয়ের ব্যাপারে নেতার বিশেষ উৎসাহ ছিল। কথায় কথায় খেয়াল না থাকায় মাত্রাতিরিক্ত পান করার ফলে উনি একসময় বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। আমি তো বটেই, বিশেষ করে সঙ্গীরা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। ফিরবেন কী করে? অনেক কষ্টে, ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনার পর সকলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলেন। এরপর অবশ্য আরও বেশ কয়েকবার তিনি আমার ফ্ল্যাটে এসেছিলেন, তবে একা– হয়তো তাঁর সঙ্গীসাথীরা আসার ইচ্ছে থাকলেও আর ঝুঁকি নিতে চাননি।
মনে আছে, আমার স্ত্রীর সামনে নিজের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য তিনি একটি বেফাঁস স্বীকারোক্তিও করে ফেলেছিলেন; বলেছিলেন যে, তাঁর মেয়েটি তৃতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করা সত্ত্বেও তিনি তদ্বির করে উচ্চশিক্ষার জন্য তাকে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পাঠিয়ে পিতা হিসেবে তাঁর কর্তব্য পালন করেছেন। স্বজনপোষণের এই সুযোগটি পার্টির অনেকেই করেছেন, কিন্তু এভাবে আর কাউকে স্বীকার করতে কখনও শুনিনি।
দেশে থাকতেই যাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয়, ১৯৮৫ থেকে ’৯০ সালের মধ্যে, অর্থাৎ পেরেস্ত্রৈকা আমলে, নানা উপলক্ষে তাঁদের অনেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে গেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ সাংবাদিক, কেউ পার্টি-কর্মী, কেউ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, কেউ বা কবি-সাহিত্যিক অথবা সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্ট শিল্পী।
সাংবাদিক বিক্রম নায়ারের সঙ্গে অনেক বছর বাদে আকস্মিকভাবে দেখা। কলকাতায় ভারত- সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতিতে আমার রুশ ভাষার ছাত্র ছিলেন। তাঁকে নিয়ে মস্কোয় মে দিবসের শোভাযাত্রায় বের হতে হয়েছিল, কিন্তু ততদিনে সে শোভাযাত্রার তেমন আর জৌলুস ছিল না– রেড স্কোয়ারে আগেকার মতো আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রা হত না। মস্কোর রাস্তাঘাটও বিকিকিনির হাটের আকার ধারণ করেছে, যে কোনও ক্যাফেতে ডলার ভাঙানো যেত। ডলারের বাজারদর এত বেড়ে গেছিল যে, বিদেশিদের কাছে মস্কো বেশ সস্তার শহর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেক সচ্ছল নাগরিক দেশের অর্থনীতির বেহাল অবস্থা বুঝতে পেরে রুবলের বিনিময়ে ডলার কিনে জমাতে শুরু করে দিয়েছিল। একসময় দেশে আকস্মিকভাবে আলাপ হয়েছিল লোকায়ত দর্শনের লেখক, দার্শনিক ও প্রাবন্ধিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সম্ভবত ‘৭৭ সালে। তখন কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারের ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান ছিলেন হরিশচন্দ্র গুপ্ত। আলাপ হয়েছিল তাঁরই অফিসঘরে। এরপর থেকে যতবার কলকাতায় এসেছি, ততবারই তাঁর শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিটের বাড়িতে গেছি। ওঁদের বাড়িতে মাছের ঝোল ভাত খাওয়ার নিমন্ত্রণ থাকত। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও অলকা মজুমদার দু’টি ফুটফুটে তিব্বতি মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন। ওঁদের মুখে পরিষ্কার বাংলা শুনে ভারি অদ্ভুত লাগত। কলকাতায় এসে ওঁদের বাড়িতে না গেলে অলকাদি খুব রাগ করতেন।
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাসস্থান তাঁদের পৈতৃক বাড়ির পাশের একটি অংশে তাঁর দাদা কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবার থাকতেন, তাঁদের সঙ্গেও আলাপ হল। ১৯৮১ সালের কোনও একসময় দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় সস্ত্রীক বার্লিন গিয়েছিলেন মস্কো হয়ে সেখানকার বিজ্ঞান আকাদেমির প্রদত্ত সাম্মানিক ডিলিট উপাধি গ্রহণের জন্য। সেই সময় আমি সবে বাসস্থান বদল করেছি, নতুন বাড়িতে তখনও টেলিফোন আসেনি, তাই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রগতির অফিসে গিয়ে আমার খোঁজখবর করেছিলেন, দেখা হল না বলে আক্ষেপ করে একটি চিঠিও লিখে রেখে এসেছিলেন।
মস্কোতে প্রথম বছরেই সাংবাদিক সুমিত চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার আলাপ। তিনি তখন সবে ‘পেট্রিয়ট (Patriot)’ সংবাদপত্রের সংবাদদাতা হয়ে মস্কোতে আছেন। সুমিত চক্রবর্তী ‘Mainstream’ পত্রিকার স্বনামধন্য সম্পাদক সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তীর পুত্র। আমি মস্কোয় যাচ্ছি জানতে পেরে কলকাতা থাকতেই ওঁর শ্বশুরমশাই শান্তিময় রায়, আমার পার্ক সার্কাসের বাসায় এসে তাঁকে দেওয়ার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আমাকে দিয়েছিলেন। সেই সূত্রেই সুমিতের সঙ্গে আলাপ। অবশ্য নিখিল চক্রবর্তীর বোন উমা সেহানবীশ আর তাঁর স্বামী চিন্মোহন সেহানবীশের সঙ্গে আমার আগেই আলাপ ছিল। আমার মস্কোযাত্রা উপলক্ষে উমা সেহানবীশ এবং তখনকার ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতি সমিতির কর্ণধাররা ‘জিমিস কিচেন’-এ আমাকে বিদায় সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। কবি গোলাম কুদ্দুসও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। উমাদি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে একটা ভুটানি শাল উপহার দিয়েছিলেন। মস্কোয় রাতে ঘরে বসে সেই শাল মুড়ি দিয়ে দীর্ঘদিন আরাম বোধ করেছি।
সুমিতের অনুরোধে আমি তাঁকে রুশভাষার পাঠ দিতে রাজি হই। তিনি আমার বাড়ি এসে রুশভাষার পাঠ নিতেন। একবার তাঁর শ্বশ্রূমাতা ‘পাকা ধানের গান’-এর বিখ্যাত লেখিকা সাবিত্রী রায়কে তিনি মস্কোতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। সেই সঙ্গে সেখানকার পলিক্লিনিক ও হাসপাতালে বার কয়েক তাঁর দোভাষীর কাজও করেছি।
১৯৮৫ সালে, পেরেস্ত্রৈকার সূচনাকালে আমার মাসতুতো দাদা, বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের তৎকালীন বিশিষ্ট নেতা চিত্তব্রত মজুমদারও মস্কো ঘুরে গেছেন– ঠিক মস্কোতেই যে এসেছিলেন, বললে ভুল হবে– আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার আয়োজিত কোনও এক সেমিনারে যোগ দিতে বাইরে কোথাও যাচ্ছিলেন, যাতায়াতের পথে দু’-এক দিন করে মস্কোয় ছিলেন। তখন পর্যন্ত পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে ওই ধরনের বামপন্থী কোনও সংগঠনের সেমিনার বা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে, তার ব্যয়ভার মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নই বহন করত। এছাড়া পৃথিবী জুড়ে বিশ্ব শান্তি পরিষদ, অ্যাফ্রো-এশিয়া সংহতি সমিতি ইত্যাদি আরও ছোট-বড় কত বামপন্থী সংগঠনেরও ব্যয়ভার যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বহন করত, তার ইয়ত্তা নেই! আমার এক পুরনো বন্ধু কোরিয়ান ভাষা জানার সুবাদে একসময় নানা উপলক্ষে উত্তর কোরিয়ার সরকারের আমন্ত্রণে অসংখ্যবার আয়রোফ্লোত-এর টিকিটে মস্কো হয়ে পিয়ংইয়ং যাতায়াত করত। একবার সপরিবার আসা-যাওয়ার পথে মস্কোয় আমার ফ্ল্যাটে আতিথ্যগ্রহণও করেছিল। তবে এই বিনের অতিথিদের এমনিতেই এমন সমস্ত অতিথিশালায় তোলা হত, যেখানকার বন্দোবস্ত অনেকটাই তখনকার পাঁচতারা হোটেলের শামিল।
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪০। বেসরকারিকরণের শুরু দিকে রাস্তাঘাটে ছিনতাই বেড়ে গেছিল, কারণ সব লেনদেন নগদে হত
পর্ব ৩৯। হাওয়া বদলের আঁচ অনেকেই আগে টের পেয়েছিল, বদলে ফেলেছিল জীবনযাত্রা
পর্ব ৩৮। শুধু বিদেশে থাকার জন্য উচ্চশিক্ষা লাভ করেও ছোটখাটো কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছেন বহু ভারতীয়
পর্ব ৩৭। একটা বিদেশি সাবানের বিনিময়েও নাকি মস্কোয় নারীসঙ্গ উপভোগ করা যায়– এমনটা প্রচার করেছে ভারতীয়রা
পর্ব ৩৬। মস্কোর ঠান্ডায় লঙ্কা গাছ দেখে পি.সি. সরকার বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে বড় ম্যাজিক হয় নাকি?’
পর্ব ৩৫। রুশদের কাছে ভারত ছিল রবীন্দ্রনাথের দেশ, হিমালয়ের দেশ
পর্ব ৩৪। সোভিয়েত শিক্ষায় নতুন মানুষ গড়ে তোলার ব্যাপারে একটা খামতি থেকে গিয়েছিল
পর্ব ৩৩। দিব্যি ছিলাম হাসপাতালে
পর্ব ৩২। মস্কোর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সাধারণ ডাক্তাররা অধিকাংশই মহিলা ছিলেন
পর্ব ৩১। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা নিজভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছিল শুধু আমার জন্য
পর্ব ৩০। শান্তিদা কান্ত রায়ের প্রিয় কাজ ছিল মস্কোয় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কমিউনিজম পড়ানো
পর্ব ২৯। পেরেস্ত্রৈকার শুরু থেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন গোপেনদা
পর্ব ২৮। দেশে ফেরার সময় সুরার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাননি গোপেনদা
পর্ব ২৭। বিপ্লবের ভাঙা হাট ও একজন ভগ্নহৃদয় বিপ্লবী
পর্ব ২৬। ননী ভৌমিকের মস্কোর জীবনযাত্রা যেন দস্তইয়েভস্কির কোনও উপন্যাস
পর্ব ২৫। ননীদা বলেছিলেন, ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না
পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ
পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে
পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত
পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি