আমার সঙ্গে যখন মনোজ মিত্রের আলাপ হচ্ছে, সেই সময় তিনি দ্বিতীয় শৈশবে পা দিয়েছেন। যে সময়ে হাসি-মজা-আবদার-অভিমান-নালিশ নিয়ে তিনি ভরপুর শৈশব কাটাচ্ছেন, সেই সময় আমি ‘মনোজাগতিক’ কলামের দায়িত্ব নিয়ে তাঁর থেকে লেখা আদায় করে, লেখা সম্পাদনা করে ‘রোববার’-এর পাতা সাজাচ্ছি। তাই কিছুদিনের মধ্যেই আমি মনোজ মিত্রের অভিভাবক হয়ে উঠলাম। আর শাসন করব না-ই বা কেন? লেখা না দিতে পারার কারণ হিসেবে বলছেন, আজ ইচ্ছে করছে না, পা ব্যথা করছে। কখনও বলছেন, পিসিমা মারা গেছেন। আর এই সব অজুহাত দিচ্ছেন একটু ভয়ে ভয়ে, যদি মঞ্জুর না হয়! আর মঞ্জুর হয়ে গেলেই যে আনন্দ, সেটা খুব একটা চেপেও রাখছেন না।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
ছবি: সায়ন্তন দত্ত
এই লেখা অনেকদিন আগেই লেখার কথা ছিল। কিন্তু লিখিনি। লিখিনি, কারণ এই কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করছিল না। লিখিনি, কারণ মনে হচ্ছিল এই লেখার কোনও পাঠচিন্তা নেই। লিখিনি, কারণ এই কথাগুলো ব্যক্তিগত। লিখিনি, কারণ এই কথাগুলো আমার মনোজ মিত্রকে সরাসরি বলা হয়নি।
যে কথা তাঁকে বলা হয়নি, সেই কথা তাঁর মৃত্যুর পর ঘটা করে বলতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল থাক এই কথাগুলো আমার ছোট্ট বৃত্তের মধ্যেই।
তবুও লিখছি, কারণ মনোজ মিত্রের যে শিশুসুলভ মনটার পরিচয় পেয়েছি, যে ভণিতাহীন সারল্য দেখেছি, সেটা আমাদের সময়ের শুশ্রূষা হয়ে উঠতে পারে। আমরাও খানিক সেই আঁচে তাপ নিতে পারি।
আমার সঙ্গে যখন মনোজ মিত্রের আলাপ হচ্ছে, সেই সময় তিনি দ্বিতীয় শৈশবে পা দিয়েছেন। যে সময়ে হাসি-মজা-আবদার-অভিমান-নালিশ নিয়ে তিনি ভরপুর শৈশব কাটাচ্ছেন, সেই সময় আমি ‘মনোজাগতিক’ কলামের দায়িত্ব নিয়ে তাঁর থেকে লেখা আদায় করে, লেখা সম্পাদনা করে ‘রোববার’-এর পাতা সাজাচ্ছি। তাই কিছুদিনের মধ্যেই আমি মনোজ মিত্রের অভিভাবক হয়ে উঠলাম। আর শাসন করব না-ই বা কেন? লেখা না দিতে পারার কারণ হিসেবে বলছেন, আজ ইচ্ছে করছে না, পা ব্যথা করছে। কখনও বলছেন, পিসিমা মারা গেছেন। আর এই সব অজুহাত দিচ্ছেন একটু ভয়ে ভয়ে, যদি মঞ্জুর না হয়! আর মঞ্জুর হয়ে গেলেই যে আনন্দ, সেটা খুব একটা চেপেও রাখছেন না। রোববারের ঘরে এসেছেন আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। তখন আমাদের ছাদে ঘর। চারতলা উঠেছেন। কোনও হাঁপানি নেই, নেই অভিযোগ। আড্ডা মারার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কী খাবেন? অনেক ভেবেচিন্তে বললেন চপ-মুড়ি। দুটো পেঁয়াজি, দুটো আলুর চপ নিলেন। খেতে খেতে চলল আড্ডা। উনি চলে যাওয়ার পর দেখলাম সোফার কুশনের পিছনে মুড়ির ঠোঙাটা গুঁজে রেখেছেন। পেঁয়াজি আর আলুর চপ সাবাড় করে দিয়েছেন। সত্যিই তো, চপ ছেড়ে কেউ মুড়ি খায়? কিন্তু এই যে মুড়ি খাবেন না, সেটা বলতে পারেননি। পাছে বকা খান।
তবে, যে মুহূর্তে লিখতে বসতেন, তিনি অন্য মানুষ। লেখাটা হাতে পেয়ে ভাবতাম যেই লোকটার সঙ্গে এখুনি ফোনে ঝগড়া করে এলাম, বলে এলাম এত দেরি করে লেখা দিলে আমিই বা পারব কী করে– সেই লোকটা এই কথাগুলো লিখছেন? এমন বিস্তার এনে দিচ্ছেন এই কলকাতাটার মধ্যে? হঠাৎ না-বলে চলে যাচ্ছেন ওপার বাংলায়। কলকাতা আর ওপার বাংলার মধ্যে এমন মসৃণ যাতায়াত একমাত্র সম্ভব ছিল মনোজ মিত্রের লেখায়। সীমান্তহীন এক মানুষ! ভাগ্যিস লেখা দিয়েছিলেন, দেরি করে হলেও। ভাগ্যিস তাঁর আচমকা কলাম বন্ধ করার দাবি আমরা কোনও দিনও মেনে নিইনি।
…………………………………………….
লেখার প্রতি তাঁর ছিল একটা আশ্চর্য নিস্পৃহ ভালোবাসা। কোনও দিনও লেখা নিয়ে উত্তেজিত হননি, কোনও লেখা লিখে তিনি ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে ওঠেননি। লেখার টেবিলে গিয়ে বসেছেন প্রত্যহিক অভ্যাসে, খুব সাধারণ কলমে লিখেছেন, লিখতে লিখতে বেশিরভাগ সময়ই কালি শেষ হয়ে গেছে, নীল কালিতে লিখতে লিখতেই কালো কালি তুলে নিয়েছেন, হাতের কাছে যা পাওয়া যায় আরকি, প্রচুর কাটাকুটি করেছেন, পাতা ছাড়িয়ে চলে গেছে লাইন। কারণ, লেখাকে জীবন অতিরিক্ত কোনও মহত্ত্ব তিনি দেননি।
…………………………………………….
কলকাতাকেও দুর্দান্ত ভালোবেসেছিলেন। কলকাতাকে তিনি দেখতেন রঙ্গনগরী হিসেবে। এই শহরের কোণায় কোণায় নাটকের ইতিহাস, আর সেই ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর দারুণ সম্পর্ক। কলকাতায় রাত নেমে এলে পর্দা উঠে যেত আসলে। শুরু হত নতুন কলকাতা, বা সুপ্রাচীন কলকাতা। এক আকাশ ভরা জ্যোৎস্নার সঙ্গে নাটকের তুলনা করা একমাত্র বোধহয় তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। তাঁর নাটকে যেমন জীবন ঝরে পড়ে, তাঁর লেখায় তেমন জ্যোৎস্না।
তাই লেখার প্রতি তাঁর ছিল একটা আশ্চর্য নিস্পৃহ ভালোবাসা। কোনও দিনও লেখা নিয়ে উত্তেজিত হননি, কোনও লেখা লিখে ‘ইউরেকা’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেননি। লেখার টেবিলে গিয়ে বসেছেন প্রত্যহিক অভ্যাসে, খুব সাধারণ কলমে লিখেছেন, লিখতে লিখতে বেশিরভাগ সময়ই কালি শেষ হয়ে গেছে, নীল কালিতে লিখতে লিখতেই কালো কালি তুলে নিয়েছেন, হাতের কাছে যা পাওয়া যায় আরকি, প্রচুর কাটাকুটি করেছেন, পাতা ছাড়িয়ে চলে গেছে লাইন। কারণ, লেখাকে জীবন অতিরিক্ত মহত্ত্ব তিনি দেননি। পাতার কোনও অংশও সাদা ছেড়ে রাখেননি। একটা পাতার কোনও অংশ ছেড়ে রেখে অন্য পাতায় চলে যাওয়া তাঁর কাছে ছিল পাতার অপচয়, মধ্যবিত্তের টানাটানি। ওই দুটো রুল টানা পাতায় ঠেসেঠুসে লিখে ফেলেছেন নাটক থেকে জ্যোৎস্না– সবই।
তাঁর লেখা কেউ পড়ল কি পড়ল, তা নিয়েও তেমন চিন্তা ছিল না। ছোট ছোট অক্ষরে, ঠাসা লেখা কেউ পড়ে উদ্ধার করতে পারবে কি পারবে না– ভাবেননি। আসলে পাঠকের কথা ভেবে কোনও লেখা লেখেননি, শুধু নিজের জন্য, নিজের খেয়ালে লেখা। ওই ছোট ছোট অক্ষর, এক অক্ষরের গায়ে অন্য অক্ষরের হেলান– আমি বুঝতে পারছি না বলে অভিযোগ করেছিলাম। যেন হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এসেছিলেন এ কথা শুনে। তারপর থেকে লেখা পাঠাতেন, রাজুদা ডিটিপি করে দিত যতটা বোঝা যেত, তারপর উনি সেটা পুরোটা ফোনে পাঠ করে দিতেন আমাকে। আমি কানে শুনতে শুনতে কারেকশন করতাম। এই পদ্ধতিও যথেষ্ট খাটনির– জানাতে বাধ্য হলাম একদিন। পরের সপ্তাহে দেখলাম ডিটিপি করা কপি এসেছে। আমি অবাক হয়ে জানতে চাই– কীভাবে সম্ভব হল এটা?
উনি জানালেন লেখার পর বাড়িতে ডেকেছিলেন তাঁর নাটকের দলের একজনকে। তাঁকে দিয়ে টাইপ করিয়েছেন, তাঁকে দিয়েই মেল করিয়েছেন। না, এটা এক সপ্তাহের ঘটনা নয়, লেখা লিখে প্রতিবেশীকেও ডেকে আনতেন টাইপ করার জন্য, নাটকের দলের মানুষেরা তো আছেনই, আছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা মানুষও। আমার পড়তে অসুবিধা বলে তিনি সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে লেখা টাইপ করে আমাকে পাঠাতেন। লেখা শেষ হওয়ার পর যে কত মানুষকে তাঁকে ফোন করতে হত বাড়ি আসার জন্য। লেখা নিয়ে এক বৃদ্ধ বসে আছেন, সেই লেখা কেউ পড়তে পারছে না, কারণ প্রযুক্তি সাহায্য করছে না। এদিকে প্রযুক্তির নাকি সাহায্য করার কথা ছিল আমাদের। কত লেখা পড়ে আছে এভাবে, কেউ তা পড়েনি, কারণ তা টাইপ করা না, কারণ তা ইমেলে পাঠানো যায়নি।
এ কথা আমার ওঁকে জানানো হয়নি যে, আমি কৃতজ্ঞ, আমার জন্য দিনের পর দিন লেখা নিয়ে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। টাইপ করার মানুষ না আসা পর্যন্ত। আমি দুঃখিত, আমি সেই অপেক্ষা বুঝতে পারিনি।
আমাদের রোববারের ঘরে একজন বৃদ্ধ আসতেন সুন্দরবন থেকে। বয়স ৮১। একটা হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজে নীল কালি দিয়ে লিখে আনতেন তাঁর লেখা। যদি ছাপা হয়! তিনি নিয়মিত ‘রোববার’ পড়েন, ‘সংবাদ প্রতিদিন’ পড়েন। হাতে লাঠি, লাঠিটাকেও মজবুত করা হয়েছে গেরস্তের জিনিসপত্র দিয়ে। আমরা বারবার বলতাম, আপনি এত দূর থেকে আসেন, লেখাটা কি কোনওভাবে পাঠানো সম্ভব নয়?
উনি অবাক হয়ে বলতেন, লেখা পাঠানো যায় নাকি ফোন থেকে? নিজের ফোনটা বের করে বলতেন, বলে দাও কীভাবে পাঠাব। দেখতাম পুরনো দিনের ফোন। আজ তাঁর কথাও মনে পড়ছে খুব। উনি অনেকদিন আসেননি অফিসে। অনেকদিন তাঁর লেখা পাইনি হাতে।
অনেক দিন মনোজ মিত্রেরও লেখা আসে না।
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..