জাকির হুসেনকে আমি যতটুকু শুনেছি, বুঝেছি, জেনেছি, চিনেছি, তার সম্বন্ধে আমার এবং আমার মতো অনেকেরই শেষ কথা, সে তবলার ভগবান। এবং ভগবানকে ‘তিনি’ বলতে পারছি না আমি, এই মুহূর্তে। তাই ‘তিনি’ মুছে, আমার ভালবাসার, আমার হৃদয়ের, আমার কান্নার এবং আদরের ‘সে’ ভেসে রইল অনন্তে।
জাকির হুসেন কোন ধর্মের অধিবাসী? কোন প্রত্যয়ের শ্বাস ফেলত সে? এইসব প্রজ্ঞ প্রশ্ন, প্রাবন্ধিক প্রণিধান হয়ে উঠত নিস্পন্দ নন্সেন্স, যে মুহূর্তে তাঁর দশটি আঙুল মন্থন করত, তবলার দৈববাণী, সৃজন করত সুর ও শরীরের নিরন্তর অমৃত-তরঙ্গ। সে, একমাত্র সে-ই, রচনা করতে পারত তবলার মহাকাল।
তবলার হৃদয় থেকে জাকির তুলে এনেছিল সুরের সংহিতা। এবং মৃত্যুহীন অনন্তে প্রসারিত করেছিল তবলার মহিমা। তার শৌভিক আঙুল স্পর্শ করেছিলাম আমি, তাজ বেঙ্গলের লাউঞ্জে, একটি নিবিড় নিমগ্ন সংলাপের শেষে। মনে হয়েছিল, সত্যি মনে হয়েছিল, স্বয়ং সরস্বতীর বরপুত্রকে স্পর্শ করলাম আমি। যতবার শুনেছি আমি তার তবলা-লহরীর প্রসারিত বিস্তার, কখনও সে একাই অশেষ, কখনও রবিশঙ্করের দুর্বার দোসর, ততবার দেখেছি আমি তার প্রাণীত পূজায় জীবন্ত উঠে আসছেন সরস্বতী মর্তের, মরমি মঞ্চে! ঠিক যেমনভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’-য় মঞ্চে তাঁর দেবদ্যুতি ছড়িয়ে আবির্ভূতা হচ্ছেন সরস্বতী, একইসঙ্গে হাত রাখছেন অন্তহীন মাঙ্গলিক কামনার বাল্মীকি ও বাল্মীকিবেশী রবীন্দ্রনাথের মস্তকে, ঠিক তেমনিভাবেই জাকিরকে আশীর্বাদ করছেন সরস্বতী, পুত্রস্নেহে।
শুধু তাই কি? আমি যে সরস্বতীকে বারবার দেখেছি মিশে যেতে জাকিরের তবলার স্বর্গে, তবলার মগ্নতায়, তবলার ধ্যানে, তবলার অক্লান্ত অবদানে। আর তাঁর প্রতিটি অনুষ্ঠানের শেষে, কী কলকাতায়, কী লস অ্যাঞ্জেলসে, সরস্বতী ঘোষণা করেছেন, ‘আমার পুত্রের উপর বর্ষিত হোক পৃথিবীর সব পুণ্যতা। এই পৃথিবীতে যদি স্বর্গ কোথাও থাকে, তা আমার দুই পুত্র, জাকির আর রবির মৃত্যুঞ্জয়ী মিলনোৎসবে! এইটুকু বার্তা দিয়ে যাচ্ছি আমি, এরা পৌঁছেছে অপূর্ব অশেষে। শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে?’
……………………………………………
জাকির কার আকস্মিক আহ্বানে তোমার এই অপ্রত্যাশিত চলে যাওয়া? শূন্য হল চিরকালের জন্য তোমার সৃজনের দীধিতি ও বীরাসন। কিন্তু থেকে গেল তোমার তবলালহরীর রেকর্ডেড সাগরস্নান। আমরা ধরে রাখতে পারিনি, শ্রীকৃষ্ণকণ্ঠে উচ্চারিত গীতা। ধরে রাখতে পারিনি, তানসেনকণ্ঠে কসমিক মেঘমল্লার। কিন্তু তোমার তবলার আনন্দলহরী থেকে গেল মর্তভূমিতে। যতদিন সুর থাকবে মানুষের প্রাণে, যতদিন প্রাণন থাকবে মানবের সংগীত-ধ্যানে, ততদিন মানুষের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, আনন্দ, উৎসবের গহন বুননে ধ্বনিত হবে তোমার সৃজন, তোমার বোল আর লহরী।
……………………………………………
তবু শেষ কথা আছে। জাকির হুসেনকে আমি যতটুকু শুনেছি, বুঝেছি, জেনেছি, চিনেছি, তার সম্বন্ধে আমার এবং আমার মতো অনেকেরই শেষ কথা, সে তবলার ভগবান। এবং ভগবানকে ‘তিনি’ বলতে পারছি না আমি, এই মুহূর্তে। তাই ‘তিনি’ মুছে, আমার ভালবাসার, আমার হৃদয়ের, আমার কান্নার এবং আদরের ‘সে’ ভেসে রইল অনন্তে।
এবার সত্যি কথাটা বলি। জাকিরের অনুষ্ঠানে, তার প্রতিটি উৎসর্গ ও আরাধনায়, তার প্রতিটি প্রকাশে ও প্রসারে, তার অনন্য প্রতিভার আদাব ও আহ্বানে, সরস্বতী ছাড়া আরও এক চিরন্তনী বারবার এসেছে মঞ্চে, নেচেছে তার তবলার বোলে, ঈর্ষিত ইন্দ্র দূর থেকে দেখেছে তাকে– নাচছে উর্বশী জাকিরের তবলার তালে। নাচছে উর্বশী মহাকালের মঞ্চে। আর সেই অপরূপার শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে সেই আনন্দস্ত্রোত্র, যা লিখে গিয়েছিলেন বহু যুগ আগে এমনই কোনও মুহূর্তের জন্য শঙ্করাচার্য ‘আনন্দলহরী’ নামে:
‘সমুদ্রের মতো ছড়িয়ে আছে আনন্দ, দিগন্ত থেকে দিগন্তে:
মধ্যখানে সেই মণিদ্বীপ, সেই চিন্তনীয় মন্দির
যেখানে দেবগণ হন আনত, তোমার পায়ের তলায়
ধাপে ধাপে সোপান,
যখন তুমি আরোহণ করো, মোহিনী, তোমার তুঙ্গ, মহান কামনার পর্যঙ্কে।’
(শঙ্করাচার্যর ‘আনন্দলহরী’: অনুবাদ– বুদ্ধদেব বসু)
জাকির, তোমাকে বলি, শঙ্করাচার্য তাঁর ‘আনন্দলহরী’ স্তোত্রে ‘পর্যঙ্ক’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন দ্বৈত অর্থে। একটি অর্থ ‘পালঙ্ক’। অন্যটি, বিশেষ ভঙ্গিতে উপবেশন, যেভাবে তুমি বসতে দু’টি তবলার অব্যর্থ আয়ুধ নিয়ে। এ তো উপবেশন নয় জাকির, এ তো ‘বীরাসন’। আমার মনুষ্যজন্ম বারবার সার্থক হয়েছে জাকির মঞ্চে তোমার ধ্যানমগ্ন, নিবিড়, জ্যোতির্ময় বীরাসন দেখে। সেই পরমা উর্বশী, যে নহে মাতা, নহে কন্যা, নহে বধূ, যে শুধুই বিশুদ্ধ নারী, – সে এসেছে, তার স্বর্গচ্যুতি মেনে নিয়ে, তোমার বাজনার মর্তমহিমার আহ্বানে, যেখানে যখন বাজিয়েছ তুমি, যেখানে যখন তবলার অন্তহীন প্রসারে লীলায়িত হয়েছে তোমার দশ অঙ্গুলি, তখনই এসেছে সেই নিখাদ নারী– জাকির, তুমিই কতবার তৈরি করেছ তোমার তবলার ইন্দ্রলোক, এই মর্তভূমিতে! মুগ্ধ হয়েছে অনন্তকালের শেষহীন ঊর্বশী, তোমার আঙুলের ছন্দবন্ধ দুর্বার দ্রুতির দহন ও দানে! নেচেছে ঊর্বশী তার সমস্ত শরীরের উড়ান ও উৎসাহনে শুধুমাত্র তোমারই তবলার প্রণয় ও প্রাণনে!
এই যে এত বছর বেঁচে আছি, কত স্মৃতির শ্মশান ও চিতা সঙ্গে নিয়ে, বৃথা কি হতে পারে এই দীর্ঘ যাত্রা? বেঁচে থাকা সার্থক হয়ে উঠল এক সন্ধ্যায় আমার ত্রিকালজয়ী ত্রিভুজ দর্শনে! ত্রিভুজের এককোণে তোমার পিতা ও গুরু উস্তাদ আল্লা রাখা। অন্য কোণে তরুণতুর্কি তুমি। আর ত্রিভুজশীর্ষে পণ্ডিত রবিশঙ্কর! তোমরা পিতা-পুত্র রবিশঙ্করের সেতারের সঙ্গে হিরণ্ময় সঙ্গতে। কিন্তু সঙ্গতের অন্য এক পরতে চলতে লাগল পিতা-পুত্রের দৈব-দ্বৈরথ! আমৃত্যু মনে থাকবে সেই সুবর্ণ প্রাবল্য। অনুষ্ঠান অন্তে তোমার মাথায় হাত রাখলেন পিতা। ঢেলে দিলেন অভিনন্দন, আদর, আশীর্বাদ। এবং সেই দৃশ্যের সামনে দ্রব হলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর মাঙ্গলিক অশ্রুতে। আর কি কখনও কবে, এমন সন্ধ্যা হবে?
জাকির কার আকস্মিক আহ্বানে তোমার এই অপ্রত্যাশিত চলে যাওয়া? শূন্য হল চিরকালের জন্য তোমার সৃজনের দীধিতি ও বীরাসন। কিন্তু থেকে গেল তোমার তবলালহরীর রেকর্ডেড সাগরস্নান। আমরা ধরে রাখতে পারিনি, শ্রীকৃষ্ণকণ্ঠে উচ্চারিত গীতা। ধরে রাখতে পারিনি, তানসেনকণ্ঠে কসমিক মেঘমল্লার। কিন্তু তোমার তবলার আনন্দলহরী থেকে গেল মর্তভূমিতে। যতদিন সুর থাকবে মানুষের প্রাণে, যতদিন প্রাণন থাকবে মানবের সংগীত-ধ্যানে, ততদিন মানুষের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, আনন্দ, উৎসবের গহন বুননে ধ্বনিত হবে তোমার সৃজন, তোমার বোল আর লহরী।
কিন্তু কেন তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে এত তাড়াতাড়ি? এই নালিশ ও জিজ্ঞাসা জড়িয়ে থাকবে আমাদের সংস্কৃতি ও সংগীতের অববাহিকায়। জাকির, শঙ্করাচার্য কি তোমারই জন্য লিখেছিলেন তাঁর ‘আনন্দলহরী’ স্তোত্রের এই দু’টি প্রদ্যোতিত পংক্তি?
‘বাইরে পড়ে থাকে সময়, সেবকের মতো অপেক্ষমাণ–
রাত্রির মতো বিশাল তোমার কেশদাম, মাথায় জ্বলে নক্ষত্রের মুকুট!’
(অনুবাদ: বুদ্ধদেব বসু)
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………