মাত্র দশ বছরের মধ্যেই মনমোহনের ভবিষ্যদ্বাণীফলতে শুরু করল যেন। বলা যায়, ইতিহাস এখন তাঁর প্রতি বাস্তবিক যথেষ্ট সদয়। তাঁর প্রয়াণের পর বিভিন্ন জনের প্রতিক্রিয়া থেকে এমন একটি ছবিই ফুটে উঠছে। গত শতকের নয়ের দশক থেকে ভারতীয় অর্থনীতির যে দিকবদল ঘটেছে, যার ফলে জাতীয় আয় ধারাবাহিকভাবে কমবেশি ছয় শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে তিন দশক জুড়ে, তার কৃতিত্বের অনেকটাই মনমোহনের দিকে যাচ্ছে স্বাভাবিক কারণেই। সদ্য প্রয়াত ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।
ইতিহাস আমার প্রতি অনেক বেশি সদয় হবে, সমসাময়িক সংবাদমাধ্যমের তুলনায়’, বলেছিলেন মনমোহন সিংহ ২০১৪ সালে, প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে তাঁর বিদায়কালে। ‘সমসাময়িক সংবাদমাধ্যম’ বলতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ‘টাইম’ বা ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’কেও ধরতে হবে। একের পর এক অতিকায় সব দুর্নীতির অভিযোগে দ্বিতীয় ইউপিএসরকার যখন জেরবার, প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল– কেন তিনি কিছু বলছেন না। দেশের কর্পোরেট জগতের কেষ্টবিষ্টুরা ক্রমাগত বলে চলেছেন, একটা বড়সড় সংস্কার কিছু করুন। শ্রমের বাজারে সংস্কার হচ্ছে না বলেও নিরন্তর চাপ। ওদিকে যোগ হয়েছে মাল্টিব্র্যান্ড খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশি পুঁজিকে প্রবেশাধিকার দেওয়া নিয়ে আমেরিকার চাপ। এমনকী, ব্যারাক ওবামাও যখন তখন মনে করিয়ে দিচ্ছেন ভারতের আশু কর্তব্য হল সংস্কারগুলি দ্রুত সেরে ফেলা। শেষমেশ মোক্ষম ধাক্কাটা আসতে থাকল বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলি থেকে– যেমন ‘টাইম’ আর ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’। ‘টাইম’ পত্রিকা তো প্রচ্ছদকাহিনিই করে ফেলল প্রধানমন্ত্রীকে ‘দ্য আন্ডারঅ্যাচিভার’ বলে।
সেসব এখন অতীত। মাত্র দশ বছরের মধ্যেই মনমোহনের ভবিষ্যদ্বাণীফলতে শুরু করল যেন। বলা যায়, ইতিহাস এখন তাঁর প্রতি বাস্তবিক যথেষ্ট সদয়। তাঁর প্রয়াণের পর বিভিন্ন জনের প্রতিক্রিয়া থেকে এমন একটি ছবিই ফুটে উঠছে। গত শতকের নয়ের দশক থেকে ভারতীয় অর্থনীতির যে দিকবদল ঘটেছে, যার ফলে জাতীয় আয় ধারাবাহিকভাবে কমবেশি ছয় শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে তিন দশক জুড়ে, তার কৃতিত্বের অনেকটাই মনমোহনের দিকে যাচ্ছে স্বাভাবিক কারণেই। প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার আগে অর্থমন্ত্রী ছিলেন নব্বইয়ের গোড়ায়, নরসিংহ রাও যখন প্রধানমন্ত্রী। সে সময়েই অর্থনীতির নীতিমুখ বড়সড় দিকবদল করল। প্রথমে হল বহির্বাণিজ্যে উদারিকরণ, আমদানির উপর শুল্ক অনেকটা কমিয়ে। তারপর শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স প্রাপ্তির প্রক্রিয়াকে সরল করা হল, তারপর বিদেশি পুঁজিকে আসতে উৎসাহ দেওয়া ইত্যাদি।
অবশ্য আরম্ভেরও আরম্ভ থাকে। আটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজীব গান্ধীর আমলে নীতিমুখে খানিক বদল শুরু হয়েছিল, যাকে অনেকটা ‘ব্যবসামুখী’ বলা যায়, মুক্ত-বাজার-মুখী তেমন নয়। কিন্তু তার ফলেই বৃদ্ধির হার বাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু সে সময়টায় সরকারি ব্যয়– বিশেষত পরিকাঠামোয়– বেড়েছিল এমনই যে, সরকারের ঘাড়ে ঋণের বোঝা চেপে বসল। বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলও তলানিতে এসে ঠেকল। এমতাবস্থায় আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়া সাব্যস্ত হল, আর অনুষঙ্গ হিসেবে এল সংস্কার করতে হবে এমন শর্ত।
…………………………..
বিরোধীরা সে সময়ে যথেষ্ট শোরগোল তুলেছিলেন, কিন্তু তা যতটা জোরালো হবে ভাবা হয়েছিল হয় নি। তখন রাজনৈতিক মনোযোগের সিংহভাগটাই নিয়ে নিয়েছিল বাবরি মসজিদ আর মণ্ডল কমিশন। বাবরি-পরবর্তী পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতা এবং তার বিরোধিতা যে রাজনৈতিক মাত্রা পেয়েছিল, সেখানে আর্থনীতিক সংস্কার যেন সরে এসেছিল গৌণ স্থানে। ফলে অনেক নীতিই পাশ করিয়ে নেওয়া গিয়েছিল শোরগোল ছাড়াই। বিশেষজ্ঞরা যাকে বলেছেন, ‘চুপিসারে সংস্কার’।
…………………………..
বিরোধীরা সে সময়ে যথেষ্ট শোরগোল তুলেছিলেন, কিন্তু তা যতটা জোরালো হবে ভাবা হয়েছিল হয় নি। তখন রাজনৈতিক মনোযোগের সিংহভাগটাই নিয়ে নিয়েছিল বাবরি মসজিদ আর মণ্ডল কমিশন। বাবরি-পরবর্তী পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতা এবং তার বিরোধিতা যে রাজনৈতিক মাত্রা পেয়েছিল, সেখানে আর্থনীতিক সংস্কার যেন সরে এসেছিল গৌণ স্থানে। ফলে অনেক নীতিই পাশ করিয়ে নেওয়া গিয়েছিল শোরগোল ছাড়াই। বিশেষজ্ঞরা যাকে বলেছেন, ‘চুপিসারে সংস্কার’। ২০১২-’১৩-এ এসে দেখা যাচ্ছে তেমন চুপিসারে অনেক কিছুই আর করা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের শোরগোলে জরুরি বেশ কিছু বিষয় আড়ালে চলে যাচ্ছিল, রাজনীতিতে অপটু অর্থনীতিবিদ মনমোহনের অসহায়তা তখন যেন প্রকাশ্যে চলে আসছিল। তিনি এমন একজন রাজনীতিক, যাঁর কাছে রাজনীতি আগ্রহের বস্তু নয়।
মনমোহন দু’দফা মিলিয়ে দশ বছর প্রধানমন্ত্রীর আসনে ছিলেন, গান্ধী পরিবারের বাইরে প্রথম কেউ এই কৃতিত্বের অধিকারী হলেন। তাঁর ওই দশ বছরের মূল্যায়ন করতে গেলে প্রথম ও দ্বিতীয় দফার মধ্যে ফারাকটি এসে পড়বেই, বিশেষত দ্বিতীয় দফার শেষাংশের সঙ্গে মর্মবস্তুতে প্রথমাংশ ও প্রথম দফার পার্থক্য। প্রথম ইউপিএ আমলে (২০০৪-’০৯) দেখা যাচ্ছে ভারতের জাতীয় আয় বাড়ছে প্রায় আট শতাংশ হারে, যা অভূতপূর্ব। তেমন বৃদ্ধি তার আগে বা পরে হয়নি। সে সময়ে উন্নয়নের অন্য মাত্রাগুলির দিকেও গুরুত্ব দেওয়া হতে থাকল, যার ফলশ্রুতি বিভিন্ন অধিকার-ভিত্তিক আইন পাশ। প্রথমে হল ‘এনআরইজিএ’ বা জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন ২০০৫, সাধারণের ভাষায় যাকে ‘একশো দিনের কাজ’ বলা হয়। ওই একই বছরে পাশ হল তথ্যের অধিকার আইন। তারপর হল শিক্ষার অধিকার আইন। সবশেষে অনেক টালবাহানা পেরিয়ে পাশ হল ‘খাদ্য সুরক্ষা আইন’ ২০১৩-এ। এভাবে আইন বলবৎ করে নাগরিকের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি সুনিশ্চিত করা প্রশাসনিকতার দিক থেকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক, এবং যা হয়েছিল প্রথম ইউপিএ আমলে।
নয়ের দশকের গোড়ার দিকে বামপন্থী আখ্যান জুড়ে থাকত সংস্কার-বিরোধিতা। তার মধ্যে মতাদর্শগত অভ্যস্ত চিন্তার পুনরাবৃত্তি যতটা থাকত মুক্ত বিশ্লেষণ তেমন থাকত না। কিন্তু ভারত সরকারের উপর সেই বিরোধিতার সুফল হল সংস্কার নিয়ে ‘বিগ ব্যাং’ নীতি পরিহার করে চলা। সংস্কারোত্তর ভারতীয় অর্থনীতিকে এখন যদি খোলা চোখে দেখা যায়, মনে হয় এই ‘ধীরে চলো’ ব্যাপারটা ঘটেছে, এর ডিজাইনে না থাকলেও। আর এখানেই গণতন্ত্রের শক্তি। মনমোহন ভারতীয় গণতন্ত্রের শক্তি সম্পর্কে ছিলেন সদা সচেতন। কথা কম বলতেন, কিন্তু কখনও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকার এড়িয়ে যাননি। সাংবাদিকদের প্রশ্ন গুরুত্ব দিয়ে শুনেছেন, উত্তর দিয়েছেন।
নেহরু-গান্ধী-যুগের সঙ্গে যদি সংস্কার-পরবর্তী যুগের অর্থনীতির তুলনা করি, মনে হয় যেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে মতাদর্শে। কিন্তু একটি বিষয়ে অন্তত এক ধরনের ধারাবাহিকতা রয়েছে যা উল্লেখ করতে হয়। মনমোহন সিংহ ছিলেন আধুনিকতায় দীক্ষিত একজন মানুষ। উনিশ এবং বিশ শতকে পশ্চিমি দুনিয়ায় মেধাজীবীদের মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের মুঠো যখন আলগা হতে থাকল এক নতুন ধরনের সংলাপের উত্থান হল, যার নাম আধুনিকতা। তথ্যভিত্তিক, বস্তুনিষ্ঠ, যুক্তিবাদী চর্চাই এই আধুনিকতার লক্ষণ। গত শতকের মাঝামাঝি সদ্য স্বাধীন হওয়া তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির রাষ্ট্রনায়কদের চেতনার মধ্যে এই আধুনিকতা কমবেশি ছিল। এঁদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, পণ্ডিত নেহরু আর তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নিয়েরেরের কথা। এই দুই রাষ্ট্রনায়কই আধুনিকতায় অন্য অনেকের থেকে এগিয়ে ছিলেন। নেহরুর কথা বিশেষভাবে বলতেই হবে রাষ্ট্রভাবনায় এই আধুনিকতাকে অনেকটা জায়গা দেওয়ার জন্য। এই আধুনিকতা আগাগোড়া বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চোবানো, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে। মনমোহন ছিলেন এই মতাদর্শের ধারক ও বাহক। মনমোহন-পরবর্তী যুগে ভারতীয় রাষ্ট্র চরিত্রে ও প্রশাসনিকতায় তাকে আর যেন খুঁজে পাওয়া যায় না।
লেখক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা-র অধ্যাপক
রিয়েঙ্কা ইউক্রেনের স্থানীয় ফুটবল দল নাইভা-র হয়ে গলা ফাটাত মাঠে গিয়ে। যুদ্ধের সময় চার মাস রুশ সেনার অধীনে বন্দিত্ব এবং ছাড়া পেয়ে ফ্রন্টলাইনে রাইফেল নিয়ে থাকা। গত ২১ মে মাত্র ২১ ছোঁয়া রিয়েঙ্কা চলে যায় গানশটে! গ্যালারিতে সেই মুখ, টিফো– লেখা– ‘পিস হ্যাজ আ প্রাইস’।