শ্যামল দত্ত রায়ের কাজ দেখে এবং ওঁর সঙ্গে কথা বলে কাজের নতুন অধ্যায় শুরু হল যেন। স্কেচ শব্দটার ঠিক বাংলায় তরজমা করতে পারছি না। স্কেচ মানে ঠিক রেখা নয়, ড্রয়িংও নয়। ওঁর কাজে যেন একটা কবজির জোরের আঁচড়, কোনও ক্ষত, কোনও খোঁচা। যেন তারা জলরঙের ওয়াশের সঙ্গে সঙ্গে চলে আর সেগুলো ছবিতে দেয় নরম ভাব কাটিয়ে একটা শক্ত শক্তি, একটা আর্মেচার। জলরঙের যে পেলবতা, তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে ওজন। মানুষটাকে যত চিনছি, জানছি তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে একটা জীবন সংগ্রামের অনুভূতি। খরখরে ভিসুয়াল, বাধা-বিঘ্ন, এমনকী, রহস্যময়তার নানা রকম ছাইপাশ। শিখেছিলাম মূল মোটিফের সঙ্গে আশপাশ কেমন হবে ছবিতে, তার একটা অনুভূতি আর আবহ, যা কি না সম্পূর্ণ শ্যামল দত্ত রায়ের নিজস্ব।
২০.
সারা ভারতে তখনকার সময়ে কলকাতার জলরঙের দারুণ প্রশংসা ছিল। বিশেষ করে, কলকাতার আর্ট কলেজের ছাত্ররা নাকি জলরঙে দারুণ কাজ করে, সে কথা কলকাতার বাইরে অনেকবার শুনেছি। সত্যি কথা বলতে কী, সত্তরের গোড়ার দিকে আমরা যখন কলেজে পড়ছি তখন কিন্তু কলেজের সিলেবাসে জলরং ছিল না। সেই সময়ে জলরঙের কোনও ক্লাস নেই, অর্থাৎ ক্লাসের মধ্যে শেখানো হয় না, পরীক্ষার ব্যবস্থাও নেই। আসলে কলেজের সিনিয়র-জুনিয়র ছাত্ররা মিলে আউটডোর করতে যাওয়ার ধুম ছিল এবং সেই করতে করতেই জলরঙে হাত পাকাত। মূলত ল্যান্ডস্কেপ আর সিটিস্কেপ স্টাডি। যেমন দেখি তেমন আঁকি অথবা যেমন দেখি, তেমন হুবহু আঁকি না। গাছপালা, ঘরবাড়ি– নিজের ইচ্ছেমতো আলাদা করেও সাজাই। মনে মনেও যে ছবি তৈরি হয় সেটাকে কাগজে বা পটে কীভাবে আঁকব? আউটডোর পেইন্টিং এবং স্টুডিও পেইন্টিং যে আলাদা– সেটা বলার কেউ ছিল না, কারণ কলেজে জলরঙের কোনও ক্লাসই নেই।
ছাত্রাবস্থায় কিংবা কলেজ থেকে বেরিয়েও অনেক দিন বড় বড় চোখ করে জগৎ দেখার চেষ্টা করি। সে সময়ে সোসাইটি অফ কন্টেম্পোরারি আর্টিস্ট, কলকাতার এমন একটা দল যেখানে দেখতাম বাঘা বাঘা শিল্পী এবং ছবির জগতের হিরোদের দহরম মহরম! কলেজ থেকে বেরোনোর পর কী করা যায় সে সম্পর্কে জ্ঞান একেবারেই শূন্য। শিল্প চর্চা, ছবি দেখা এবং প্রতিযোগিতা বা প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ার একমাত্র ভরসা, একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের বার্ষিক প্রদর্শনী। সেরকম একটা সময়ে, চোখ-কান খোলার আগে ভাগ্যিস দুটো বড় দল ছিল কলকাতায়। হলে কী হবে, শিল্পীদের কাছে পৌঁছনো একটা সমস্যা। নামীদামি শিল্পীদের কাছে পৌঁছানো আরও কঠিন। তারপরে কাজ দেখার, তাঁদের সঙ্গে কথা বলার জন্য স্টুডিওতে গিয়ে কাজের টেকনিক ইত্যাদি অনুশীলন করার সুযোগ খুবই কম। এক্ষেত্রে এই দলগত একজিবিশনের সময় বড় শিল্পীদের বা গুণী মানুষদের কাছে যাওয়ার একটা সুযোগ। ওঁদের কাছে আমরা ঋণী, কারণ দলগতভাবে যখন থাকেন ওঁরা তখন সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারেও সহজ হন। দেখা গেছে, কোনও শিল্পক্ষেত্রে যাঁরা খুব উচ্চ মানের এবং উচ্চ মাপের হন, তাঁরা সহজে সাধারণের সঙ্গে নেমে এসে কথা বলতে চান না। যখন কোনও বড় একটা আয়োজন, অনেক মানুষ, সেখানে কিন্তু তাঁরা কাছে আসেন।
এখানে আমি বেছে নিলাম শিল্পী শ্যামল দত্ত রায়কে। আমি ওঁর একলব্য হলাম। কারণটা হচ্ছে, কলেজের বাইরে এসে নানা দিকে হাতড়াতে হাতড়াতে একটা সিদ্ধান্তে আসলাম যে, জলরংটাই আমার মাধ্যম করব। সব মিলিয়ে একটা মাধ্যম বাছাই আমার কাছে খুব জরুরি মনে হল। জলরং মাধ্যমটা নিয়ে কাজ করতে চাই বলে সেটার ওপরে জোর দিতে চাই এবং সেই বিষয়ে কোনও রকম নতুন কিছু জানার, পরীক্ষার সুযোগ পেলেই সেটাকে আমি আঁকড়ে ধরতে চাই। সোসাইটি অফ কনটেম্পোরারি আর্টিস্টদের মধ্যে তখন জলরঙে কাজ যারা করছেন বা জলরং থেকে এসে তার পাশাপাশি আর একটা মিডিয়ামে কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত মানুষ গণেশ হালুই, গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, অনিল বরণ সাহা, শ্যামল দত্ত রায় প্রমুখ। অন্য মাধ্যমকে শ্রদ্ধার চোখে তো দেখছি, কিন্তু নিজের যে ইচ্ছে এবং প্রবল যে বাসনা আমার মাধ্যমটাকে আমি কীভাবে আরও উন্নত স্তরে নিয়ে যাব। জলরঙে নতুন পথের একটা দিশা পেতেই হবে।
সেই সময়ের জলরং সম্পর্কে যদি বলি, তখন আমরা একেবারেই বেঙ্গল স্কুলের জলরং অথবা ব্রিটিশ ওয়াটার কালার অর্থাৎ, ইংরেজদের জলরং এই দুটোর মধ্যে একটিকে বেছে নিচ্ছি। মনে হত, বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট-এর দৃশ্যগত মেজাজ একটু স্তিমিত, শান্ত। সেটাই একটা ঘরানা। আর অন্যদিকে যেহেতু গভঃ আর্ট কলেজ ব্রিটিশদের তৈরি, তাই ব্রিটিশ ওয়াটারকালার-টাই সেখানে একটা প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। সত্যি বলতে কী, আমরাও ওই চটজলদি শুকনো সাদা কাগজে নানা রকমের আঁচড় এবং জল ঝরানোর খেলাটাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। ধীরে সুস্থে, বসে গুছিয়ে, এমন অনুভূতির ব্যাপারগুলো তখন আমাদের ঠিকমতো মাথায় আসেনি। মাথায় আসেনি মিনিয়েচার পেইন্টিং, আঞ্চলিক পেইন্টিং এবং আমাদের ভারতীয় ধারার জলরঙের কাজ, গুহাচিত্র ফ্রেস্কো ইত্যাদি। পরবর্তীকালে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝেছি যে, সমগ্র ভারতের প্রকৃত মিডিয়াম বা মাধ্যমই আসলে জলরং।
শ্যামল দত্ত রায়কে বিশেষভাবে বেছে নেওয়ার কারণ হল, তখন জলরং বলতে কেবলমাত্র নিসর্গ দৃশ্য বা ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিংয়ের মধ্যেই আবদ্ধ ছিলাম আমরা। এই মাধ্যম আর স্টুডিও পেইন্টিং, অর্থাৎ ঘরের মধ্যে বসে নিজের মতো বিষয় ভাবনা, ছবি সাজানো, নির্মাণ ইত্যাদি– সেটার ইঙ্গিত পেলাম শ্যামল দত্ত রায়ের কাছ থেকেই। শ্যামল দত্ত রায় নিজেই বেঙ্গল স্কুলে বিশ্বাসী হয়ে কাজ শুরু করে পরে বর্তমান বা সমকালীন ধরনে এসেছেন। কলকাতার ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টারদের মধ্যে ব্রিটিশ স্টাইলেও ‘ওজনহীনতা’ ছিল জলরঙের এক পীড়াদায়ক ব্যাপার। সব সময় যেন একটা ঝাপসা কুয়াশা মেজাজ। কাঠামো নির্মাণ এবং কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে পদ্ধতি বা প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যাওয়া, আবার সেই প্রসেসটা এনজয় করা এই সমস্ত ব্যাপারগুলো কিন্তু কলেজ থেকে আমরা পাইনি। পেয়েছিলাম বাইরের এই প্রদর্শনী দেখে। কতগুলো ভিসুয়াল অর্থাৎ দৃশ্যগত জ্ঞান আর কাজের মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ থেকেই চিন্তার মোড় ঘুরল। চিন্তা-ভাবনা, অনুশীলন, খসড়া-নকশা-স্কেচ শব্দগুলো আস্তে আস্তে মাথায় আসছে নতুন অর্থে। শ্যামল দত্ত রায়ের কাজ দেখে এবং ওঁর সঙ্গে কথা বলে কাজের নতুন অধ্যায় শুরু হল যেন। স্কেচ শব্দটার ঠিক বাংলায় তরজমা করতে পারছি না। স্কেচ মানে ঠিক রেখা নয়, ড্রয়িংও নয়। ওঁর কাজে যেন একটা কবজির জোরের আঁচড়, কোনও ক্ষত, কোনও খোঁচা। যেন তারা জলরঙের ওয়াশের সঙ্গে সঙ্গে চলে আর সেগুলো ছবিতে দেয় নরম ভাব কাটিয়ে একটা শক্ত শক্তি, একটা আর্মেচার। জলরঙের যে পেলবতা, তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে ওজন। মানুষটাকে যত চিনছি, জানছি তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে একটা জীবন সংগ্রামের অনুভূতি। খরখরে ভিসুয়াল, বাধা-বিঘ্ন, এমনকী, রহস্যময়তার নানা রকম ছাইপাশ। শিখেছিলাম মূল মোটিফের সঙ্গে আশপাশ কেমন হবে ছবিতে, তার একটা অনুভূতি আর আবহ, যা কি না সম্পূর্ণ শ্যামল দত্ত রায়ের নিজস্ব।
আমাদের নতুন দল কন্ট্রিভান্সের প্রদর্শনীতে নিয়মিত আসতেন শ্যামলদা। আমার ছবি দেখতে আসতেন যে কারণে, সেটা উনিও বলেছেন আর আমিও লক্ষ করেছি। ছবিতে রং খুঁজতেন। উনি আমার রং পছন্দ করতেন। শুধু বিষয় নয়, বর্ণ আরোপেরও যেখানে মহান ভূমিকা, ছবিতে সেটা যেমন আমি ওঁর কাছ থেকে নিয়েছি, তেমনই আবার সেই রংকে বদল করে আমার প্যালেট চেঞ্জ করেছি কীভাবে, সেটা দেখে উনি খুশি হচ্ছেন। আমরা আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছি।
মনে পড়ছে, কলকাতার বিড়লা অ্যাকাডেমিতে শৈবাল ঘোষ একবার একটা খুব বড়সড় জলরঙের এগজিবিশনের আয়োজন করেন। শৈবালদা আমাদের খুব কাছাকাছি সিনিয়র, মানে দুই এক বছরের বড়। চমৎকার কাজ করতেন, জলরঙে একেবারে সাহেবদের মতো। ওঁর মনে হল যে, শহরের সবচেয়ে ভালো গ্যালারিতে একটা জলরঙের কাজেরই শুধু এগজিবিশন করা যাক, যেখানে দেশের যারা সত্যিকারের ভালো কাজ করেন তাঁদের কাজ থাকবে। সফল হয়েছিল ওঁর ইচ্ছে, সত্যিই সবাই ভালো কাজ দিয়েছিলেন। আমি সেবারে একটা খুব বড় সাইজের কাজ করেছিলাম। আশি বাই ষাট ইঞ্চি। বড় জমিতে রঙের ঢল নামছে যেন। শ্যমলদা খুব প্রশংসা করেছিলেন। সংবাদপত্রে ওঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, জলরঙে এতক্ষণে যে একটা একঘেয়েমি ঝাপসা রং ছিল সেখানে আমি নাকি উজ্জ্বল এবং প্রাথমিক রং ব্যবহারে নতুন কিছু দেখিয়েছি। সে ছিল আমার কাছে মস্ত পুরস্কারের মতো।
আমার বিয়ের পরপর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় হাজিরা একটু কমে গেল। ওরা আমায় খ্যাপাতে লাগল। সমীরকে আজকাল আর পাওয়া যাবে না তো, ও তো এখন রান্নাঘরে ঢুকে বসে আছে। সেটা শুনে সত্যি সত্যি রান্নাঘরে ঢুকেছিলাম আমি। মধ্যবিত্ত সংসারে রান্নাঘর আসলে একটা স্টোর রুম, কী নেই সেখানে! এমন অদ্ভুত আজগুবি সব জিনিসপত্র পাওয়া গেল, যেগুলো রান্নাঘরের কোনও কাজেরই নয়। রান্নাঘরের ওই জিনিসপত্র স্টিললাইফ আকারে ছবিতে সাজিয়ে একটা এগজিবিশন করেছিলাম অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ। প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন শ্যামলদা, বিকাশ ভট্টাচার্য আর অমিতাভ ব্যানার্জি। সঙ্গে করে এনেছিলেন মাদ্রাজের মিসেস সারা আব্রাহামকে।
তখনকার দিনে শুরু শুরুতে সারা ভারতে গুটিকয়েক পেশাদার বাণিজ্যিক গ্যালারি, বম্বে, দিল্লি, মাদ্রাজ আর কলকাতায়। মাদ্রাজে মিসেস আব্রাহামের গ্যালারি ‘কলাযাত্রা’। বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া, একেই বলে! মিসেস সারা আব্রাহাম ছবি দেখে খুব খুশি। ছবি কিনলেনও আর ওঁর মনে হল যে, আমাদের কাছাকাছি বয়সি যারা, তাদের মাদ্রাজে একটা এগজিবিশন করলে হয়। তিন চারজনের নাম ঠিক হল গ্যালারিতে দাঁড়িয়েই আর সেই নামগুলো দিয়েছিলেন শ্যামল দত্ত রায়। মনে পড়ছে, তার মধ্যে অশোক ভৌমিক, আদিত্য বসাকের নাম ছিল। অদ্ভুত আন্তরিকতা এবং বড়-ছোট শিল্পীদের মধ্যে একটা স্নেহ আর শ্রদ্ধার সম্পর্ক কাজ করত তখন।
মিসেস আব্রাহাম মাদ্রাজে ফিরে গিয়েই চিঠি দিয়েছিলেন আমাদের, ওর গ্যালারি ‘কলাযাত্রা’র লেটারহেডে। আনকোটেড আইভরি কালারের পেপারে পায়ের ছবি দিয়ে কলাযাত্রা-র লোগো। সেই চিঠির অনুভূতি আলাদা। প্রফেশনাল শিল্পকর্মের জগতে ঢুকছি প্রথম। একটা অদ্ভুত ঘটনা হল, চিঠি এল ইংরেজিতে। আমাদের কলেজে পড়াশোনার বালাই নেই। শুধুই আঁকা, প্র্যাকটিক্যাল। আমরা ইংরেজিত লিখতে তো পারতামই না, বলতেও পারতাম না! আদিত্য, অশোকরা কেউই সে চিঠির উত্তর দেয়নি। আমি তখন সবে সরকারি অফিস, সায়েন্স মিউজিয়ামে কাজ করতে শুরু করেছি। আমার সহকর্মীরা ছিল খুব ভালো, চিঠির উত্তর তারাই লিখে দিল। আমি একাই উত্তর দিলাম। সারা আব্রাহাম খুশি। আমাকে বললেন, ‘গ্যালারির একটা সময় তোমাদের জন্য রেখেছিলাম সেই সময়টা ব্লক করে রাখা আছে এখনও। কেউ যখন সায় দিল না, তুমি কি একা গোটা কুড়ি ছবি দিতে পারবে? তাহলে আমি ওই টাইম স্লটে তোমার একটা একক শো করতে পারি মাদ্রাজে।’
ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স-এর অফিসে গিয়ে কাপড়ে মুড়ে, তুলি দিয়ে ঠিকানা লিখে, জীবনে প্রথম এয়ার পার্সেল করলাম কুড়িখানা ছবি। প্রদর্শনী হল, মাদ্রাজের কাগজে আমার নামে ছবি সম্পর্কে লেখা বের হল। সব ছবি কিনে নিলেন সারা আব্রাহাম নিজেই। মোটা টাকার চেক পেলাম। আনন্দবাজারে সন্দীপ সরকার সুখবর লিখলেন কলকাতার কড়চায়। সেই টাকা দিয়ে হয়ে গেল আমার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান। এ ব্যাপারে আমি শ্যামলদার কাছে চিরঋণী হয়ে রইলাম।
দীর্ঘদিনের সম্পর্কে তখন আমরা অনেক সহজ। বয়সের ব্যবধান ঘুচে গিয়ে পেশাদারি কাজে সবাই একই ফিল্ডে। অনেকটাই বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আমরা অনেক সহজ আর সরল বা রসালো খোশগল্পও করতাম দেখা-সাক্ষাতে। অনেক গল্প আছে একটা বলে আপাতত শেষ করি।
আমি তখন কলকাতা ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরে, নতুন কর্মক্ষেত্রে। সেখানে একটা আর্ট ক্যাম্পে গিয়েছেন শ্যামলদা সঙ্গে বন্ধু অমিতাভ ব্যানার্জি। এই আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন কর্ণাটক চিত্রকলা পরিষদে। আমি মাঝে মাঝে সঙ্গ দিতে যেতাম এমনকী শহরের দু’-চার জায়গায় একটু ঘোরাঘুরিও করেছি একসঙ্গে। আর্ট ক্যাম্প তো হল, কিন্তু বাঙালির খাওয়া দাওয়া! দক্ষিণ ভারতের খাবার বাঙালিদের খুব পছন্দ নয়। বাঙালিরা দক্ষিণ ভারতের খাবারে নাকি নারকেল তেলের গন্ধ পায় আর সব খাবারের মধ্যে পায় তেতুলের টক। শ্যামলদারাও ব্যতিক্রম নন।
শ্যামলদা এবং অমিতাভদা যেদিন ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতায় ফিরবেন, সেদিন ওদের ফ্লাইট ছিল সন্ধেবেলা। আমরা থাকতাম ইন্দিরা নগরে, সেখান থেকে এয়ারপোর্ট খুব কাছে। ক্যাম্পের কাজ শেষ, একটা গোটা দিনই হাতে আছে। সময় আছে বলে আমি ওদের দু’জনকে নিয়ে এলাম আমার বাড়িতে। কলকাতা ছেড়ে দক্ষিণ ভারতে থাকাকালীন আমার ছবিতে কোনও স্বাদবদল হল কি না, সেটা দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন শ্যামলদা। ভালোই হল। ছবি দেখা, আলোচনা, আড্ডা খানিক। কেবল অসুবিধা বলতে বাড়িতে সেই সময় আর কেউ নেই। বউ তখন কলকাতায় বাপের বাড়িতে।
বাংলা রান্না করে খাওয়ানোর ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পাশের বাজারে আমাদের মতো মাছ পেলাম না, পেলাম সামুদ্রিক মাছ। কলকাতা থেকে যাওয়ার সময় আমরা রান্নাঘরের অন্যান্য সরঞ্জামের সঙ্গে শিল-নোড়াটা নিয়ে গেছিলাম। শিলে-বাটা মশলায় রান্না হত তখন আমাদের। সেই শিলে সর্ষে বেটে, পরে ছেঁকে, হালকা সর্ষের জলে আলু বেগুন দিয়ে সামুদ্রিক মাছ সুরমাই-এর একটা বাংলা মতো ঝোল রান্না করেছিলাম। দারুণ তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন ওঁরা। তারপরে খাওয়ার তৃপ্তিতে ভালো একটা দুপুরের ঘুম। আহা! শ্যামল দত্ত রায়ের মতো ব্যক্তি আমার বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছেন ভেবেও তৃপ্তি হয়! বিকেল পাঁচটায় ফ্লাইট ধরার জন্য বাড়ি থেকে বেরোনোর ছিল। আমি চারটের সময় চা বানিয়ে ডেকেছিলাম। সময় মতো এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হয়েছিলেন, কিন্তু তার আগে আমাকে শ্যামলদা যেন সার্টিফিকেট দিলেন। বললেন, ‘তুমি দেখছি শুধু ভালো শিল্পী নও, সুগৃহিণীও বটে।’
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ১৯: দু’হাতে দুটো ঘড়ি পরতেন জয়াদি, না, কোনও স্টাইলের জন্য নয়
পর্ব ১৮: সিদ্ধার্থ যত না বিজ্ঞানী তার চেয়ে অনেক বেশি কল্পনা-জগতের কবি
পর্ব ১৭: ডানহাত দিয়ে প্রতিমার বাঁ-চোখ, বাঁ-হাত দিয়ে ডানচোখ আঁকতেন ফণীজ্যাঠা
পর্ব ১৬: আমার কাছে আঁকা শেখার প্রথম দিন নার্ভাস হয়ে গেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং
পর্ব ১৫: শঙ্করলাল ভট্টাচার্য শিল্পীদের মনের গভীরে প্রবেশপথ বাতলেছিলেন, তৈরি করেছিলেন ‘বারোয়ারি ডায়রি’
পর্ব ১৪: নাটককে পৃথ্বী থিয়েটারের বাইরে নিয়ে এসে খোলা মাঠে আয়োজন করেছিল সঞ্জনা কাপুর
পর্ব ১৩: চেষ্টা করবি গুরুকে টপকে যাওয়ার, বলেছিলেন আমার মাইম-গুরু যোগেশ দত্ত
পর্ব ১২: আমার শিল্প ও বিজ্ঞানের তর্কাতর্কি সামলাতেন সমরদাই
পর্ব ১১: ছবি না আঁকলে আমি ম্যাজিশিয়ান হতাম, মন পড়ে বলে দিয়েছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৫: কলকাতা সহজে জয় করা যায় না, হুসেন অনেকটা পেরেছিলেন
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল