আমরা সাহেবদের বর্ণবিদ্বেষী বলি, আমাদের থেকে বড় বর্ণবিদ্বেষী কেউ নেই, সাম্প্রদায়িক কেউ নেই। তাই গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা অধিকাংশ মানুষই নিম্নবর্ণের, নিম্নবর্গের, আর এখন আরও বেশি বেশি করে সংখ্যালঘু, কারণ তাদের ঠিকঠাক শিক্ষা ও কাজের সুযোগ কম। তাই তারা অপরিচিত জায়গায় পালিয়ে এসে, নিজেদের অপরিচয় তৈরি করে কাজ পাওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের চোলির পিছনে যে ক্যানসার, তাকে সারানো সহজ কাজ নয়।
‘সামান্য ক্ষতি’ নামে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা ছিল। ২৫ আশ্বিন, ১৩০৬ সালে উনি এই কবিতাটা লিখেছিলেন। এই কবিতার কাহিনিটি ছিল যে এক রানি নদীতে স্নান করতে গিয়েছিলেন, স্নান করার পরে তাঁর শীত করেছিল বলে, তিনি খানিকটা কৌতুকের ছলে দীনের কুটির জ্বালিয়ে দিয়ে উষ্ণতার আয়োজনের আদেশ দিয়েছিলেন। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ায় দরিদ্রদের গ্রামটাই জ্বলে গিয়েছিল। রানি র্নিবিকার চিত্তে সখীদের নিয়ে প্রাসাদে ফিরে এসেছিলেন। পরের দিন প্রজারা এসে অভিযোগ জানানোয়, রাজা (মানতেই হবে আজকের দিনে এই রকম রাজা আমরা আর পাই না) গরিবের গৃহে আগুন লাগানোর জন্য মহিষীকে ভর্ৎসনা করলে, মহিষী বিষয়টা বুঝতেই পারলেন না। রাজা ওই গুটিকতক জীর্ণ কুটিরকে ‘গৃহ’ বলছেন কী হিসেবে? রানি বলেছিলেন, ‘কতটুকু ক্ষতি হয়েছে প্রাণীর/ কত ধন যায় রাজমহিষীর/ এক প্রহরের প্রমোদে’।
এই কবিতার কাহিনির সঙ্গে আমাদের আলোচ্য বিষয়ের মিল একটাই। আজকে আমাদের এই দেশের সচ্ছল নাগরিকরা– যাঁরা সমাজ রাজনীতি, সংস্কৃতি, মিডিয়ায় জনমতের একটা প্রধান ভিত্তি, তাঁরাও ওই রানির মতোই বুঝতে পারেন না যে, নানা শহরের নানা খালের ধারে, ফ্লাইওভারের নীচে, ফুটপাথের ওপরে, ফাঁকা জমিতে, যেমন তেমনভাবে গজিয়ে ওঠা গরিবের জীর্ণ কুটিরগুলোকে ‘গৃহ’ হিসেবে দেখা যায় কী করে? ওগুলো তো নরক, শহরের লজ্জা, তার উন্নত চেহারায় কালো দাগ। আমাদের চাঁদের গায়ে কলঙ্ক!
তাই নতুন দিল্লিতে জি-২০-র শীর্ষ সম্মেলনের আগেও যে আরও একবার ভোর হওয়ার আগেই বুলডোজার আর সরকার হাজির হল গরিবের বস্তি ভাঙতে, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে? সমাজের জন্য এ তো ‘সামান্য ক্ষতি’। বরং, এই নরক বিদেশিদের চোখে ধরা পড়লে আজকের ‘শাইনিং ভারতের’ অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত না কি? এই ঘটনা তো নতুন কিছু নয়। ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন গুজরাতে এসেছিলেন তখন বস্তিগুলোকে আড়াল করতে রাতারাতি রাস্তার পাশে আধ কিলোমিটার লম্বা একটা দেওয়াল বানানো হয়েছিল। সরকারি কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল ‘নিরাপত্তার ব্যবস্থা’।
আমাদের দেশ দ্বিচারিতার দেশ। সব রাজনৈতিক দল একই ধরনের কাজ করলেও, সুযোগ-সুবিধে বুঝে অন্যের দিকে আঙুল তোলে। আজকে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায়, কেবল সেই দারিদ্রর চিহ্ন মুছে দেওয়ার জন্য রাতারাতি ‘বেআইনি’ বলে বস্তি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, বা দারিদ্রকে লুকোনোর জন্য দেওয়াল তুলছে– তা কিন্তু কোনওভাবেই নয়। ১৯৮২ সালে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘এশিয়ান গেমস’। সারা দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মজুর তখন দিল্লি এসেছিল। তারা এক নতুন দিল্লি বানিয়েছিল তাদের রক্ত আর ঘাম দিয়ে। স্টেডিয়াম, ফ্লাইওভার, হাইওয়ে, হোটেল– কী বানায়নি তারা! ১৯৮২-র পরে তাদের অনেকেই কাজের সন্ধানে থেকে গিয়েছিল এই শহরে, নানা বস্তিতে, ঝুপড়িতে, যমুনার পারে। ২০০৪ থেকে ২০১০-এর কমন ওয়েলথ গেমস পর্যন্ত, যখন ইউপিএ-২ সরকার ক্ষমতায়, তখন নির্মম আর পরিকল্পিতভাবে বস্তি উচ্ছেদ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহহীন করা হয়েছিল। কাজেই রক্ত সবার হাতেই রয়েছে। দিল্লি শহরে যত মানুষ বাস করেন, তাঁদের মাত্র ২৩% মতো বাস করেন পরিকল্পিত আবাসনে। বাকি মানুষেরা থাকেন নানারকম জোড়াতালি মারা, তথাকথিত বেআইনিভাবে তৈরি ঘর-বাড়িতে। আমরা এ-ও জানি যে নানা আধিকারিক, পুলিশ, রাজনীতিবিদদের জীবিকার একটা মূল উৎসই হচ্ছে বেআইন। বিপন্ন মানুষকে নানা ধরনের আইনের ভয় দেখানোটা রাজনীতিবিদদের একটা বড় অংশের জীবিকা ও ক্ষমতার উৎস। আমাদের মনে থাকতে পারে, আমাদের এই প্রদেশেই হকার উচ্ছেদের জন্য সেই ‘অপারেশন সানশাইন’, যখন বামপন্থী সরকারের বুলডোজার পথে নেমেছিল।
আসলে বিদেশিদের আমরা দেখাতে চাই আমরা কত সুন্দর। আমাদের দেশ তখন চোলি পরে নাচে আর আমরা গান গাই ‘চোলিকে পিছে কেয়া হ্যায়’। আমাদের আশা প্রত্যেকে বুঝবে যে চোলির পিছনে আছে উন্নতিশীল দেশের সুপুষ্ট উদ্ধত যৌবন, আমাদের সামনের ঢাকনা তাকে আরও আর্কষণীয় করে তুলছে, আরও খোলামেলা সম্ভাবনার, বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনার, হাত মেলানোর আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের অপুষ্টি, অসুখ যে লুকোনো যায় না। সম্প্রতি আমি গুরগাঁও গিয়েছিলাম। গুরগাঁও আমাদের উন্নয়নের শো কেস, মিলেনিয়াল সিটি। তার রাস্তায় ভরা মার্সেডিজ, অউডি, হামার ইত্যাদি গাড়ি। গুরগাঁওয়ের রাস্তা ধরে গেলে আপনি দারিদ্র প্রায় দেখতেই পাবেন না। কিন্তু যে কোনও আকাশছোঁয়া বাড়িগুলোর পিছন দিকে যান, দেখবেন নোংরা জমা জল, ঝুপড়িতে বাস করছে হাজার হাজার মানুষ। বড় রাস্তা থেকে তাদের দেখা যায় না। বড় বাড়িগুলোর সব কাজের মেয়ে, দরোয়ান, ড্রাইভার কিন্তু এই বস্তির ভারতই জোগান দেয়। কিন্তু তাদের লুকিয়ে রাখা হয়। এই লুকোনোটা যেন নগর পরিকল্পনায় ঢুকে গিয়েছে।
জি-২০-তে যে ঘটনা ঘটছে, তার নিন্দা করে হাততালি পাওয়া খুব সহজ। কিন্তু গরিব মানুষদের নিয়ে উন্নয়ন ভাবার রাজনীতি কোনও দল করে না। আর যত দিন সেটা না হবে, আমাদের দেশে গরিব মানুষ উপচে পড়বে, বাঁচার দায়ে রাস্তায়, ব্রিজের নিচে বসে পড়বে। গ্রামে কাজ নেই, তাই এখানে দুমুঠো খাওয়ার চেষ্টা করবে। আমরা সাহেবদের বর্ণবিদ্বেষী বলি, আমাদের থেকে বড় বর্ণবিদ্বেষী কেউ নেই, সাম্প্রদায়িক কেউ নেই। তাই গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা অধিকাংশ মানুষই নিম্নবর্ণের, নিম্নবর্গের, আর এখন আরও বেশি বেশি করে সংখ্যালঘু, কারণ তাদের ঠিকঠাক শিক্ষা ও কাজের সুযোগ কম। তাই তারা অপরিচিত জায়গায় পালিয়ে এসে, নিজেদের অপরিচয় তৈরি করে কাজ পাওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের চোলির পিছনে যে ক্যানসার, তাকে সারানো সহজ কাজ নয়।
পাশাপাশি এখন আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতেও আমরা বাচ্চাদের ২০-২২ লক্ষ টাকা খরচ করে ম্যানেজমেন্ট পড়াচ্ছি, যাতে তারা বছরে ২০-২২ লক্ষ টাকা মাইনে দিয়ে জীবন শুরু করে কোটি কোটির দিকে এগোতে পারে। গরিব মানুষের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব আমরা জেনেশুনে বাড়াচ্ছি। আমাদের বাচ্চাদের ধারণা, মেরিট নেই বলে গরিবরা গরিব। বাপের টাকা না থাকলে যে তোরা মেরিট নিয়ে ঝুপড়িতে থেকে ড্রেনের জল গুলে খেতিস, সেটা বুঝতে পারছে না। এই বিভেদ বাড়ছে, বাড়বে। তাই এই ধরনের উচ্ছেদকে আমরা ‘সামান্য ক্ষতি’ বলেই মেনে চলব। জি-২০-র অধিবেশনের আশপাশে আমাদের সন্তানরা দুধে-ভাতে থাকবে।
জাতি হিসেবে বাঙালি নির্বাক ছিল না কখনও, তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির দিকচিহ্নগুলিকে আবারও নতুন করে ফিরে দেখা সম্ভব হবে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর তাবৎ সংস্কৃতি গবেষণার চিন্তন-ভূগোলে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক নতুনতর মাত্রা যোগ করবে– এ দাবি অহেতুক নয়।