Robbar

খুনিকে কেন এত ভালোবাসলাম আমরা?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 8, 2025 4:55 pm
  • Updated:August 14, 2025 8:25 pm  

কিংবা এ লেখার শিরোনাম হতে পারত, বীরুর প্রেমের মডেল এই ডিজিটাল যুগেও টিকে গেল কেন? অথবা, বিজ্ঞাপনে যা গুরুত্ব পেয়েছিলেন গব্বর ও তাঁর দলবল, অমিতাভ- ধর্মেন্দ্র পাননি। হতে পারত, আরও বহু কিছু। কারণ, ছবির নাম শোলে। ১৯৭৫ সালে, মুক্তি পেয়েছিল এই ছবি। ৫০ বছর হল, এখনও আপামর ভারতে ঘুরে বেড়ায় এই সিনেমার সংলাপগুচ্ছ!   

রংগন চক্রবর্তী

‘শোলে’র ৫০ বছর পূর্ণ হল। শুনলে প্রথমেই মনে হয়, বাবা, আমার কত বয়স হয়ে গেল! কারণ, এ তো ‘বন্দে মাতরম্’ নয় যে, আমাদের জন্মের আগে লেখা হয়েছিল, এমনকী, ‘পথের পাঁচালী’ও নয়! এ ছবি তো মুক্তি পেয়েছিল যখন আমাদের ‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ’ চলছে। যখন কলকাতার যৌবন আক্রান্ত আর গোটা দেশে এমার্জেন্সির আতঙ্ক। ঘরে ঘরে মায়েরা বাচ্চাদের বলছে, ‘বেটা সো যা নহি তো সি আর পি আ জায়েগা!’

সেই আশ্চর্য সময়ে রিলিজ করে এই ছবি সুবিশাল হিট! প্রথমে নাকি তেমন চলেনি, তারপর লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল গব্বর আর ঠাকুর সাব, জয় আর রাধা, বীরু আর বসন্তীর গল্প। সুরমা ভোপালি আর অন্ধ ইমান সাবকেও ভুলতে পারল না কেউ। ১৯৯৪ সালে, মানে বছর ২০ পরে, ‘হম আপকে হ্যায় কৌন’ রিলিজ হওয়ার আগে অবধি সব চেয়ে বড় হিট নাকি এই ছবিটাই।

45 Years of #Sholay (15/08/1975) What is your favourite thing about Sholay? #SanjeevKumar #Dharmendra #AmitabhBachchan #JayaBachchan #HemaMalini #Asrani #Jagdeep #RameshSippy #AmjadKhan #RDBurman

সদ্য সমাপ্ত ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ থেকেই কিন্তু বোঝা যাচ্ছে যে, ৫০ পার করা সহজ নয়! ভারতীয় ব্যাটারা (গাল দিচ্ছি না, ইংরেজি শুদ্ধ উচ্চারণ মতে, নাকি ব্যাটার-এর ‘আর’ সাইলেন্ট থাকার কথা) একা একা তো দূরস্থান, সবাই মিলেও বেশিরভাগ সময়েই পারেনি, কাজেই বোঝাই যাচ্ছে হিসেবটা শক্ত। আমাদের দেশে ফিল্ম আলোচনার নানা ঘরানা আছে। খবরের কাগজে অদ্ভুত ভাবে দু’-এক জনের অভিনয় নিয়ে আলোচনা করে মোটামুটি গোটা গল্পটা বলে দেওয়া হয়। এখন আবার শুনি, কোনও কোনও কাগজে বিজ্ঞাপন বিভাগই রিভিউ লেখে, তার জন্য মূল্য ধরে দিতে হয়। এটা কিন্তু কোনও গোপন কিছু নয়। অনেক পাঠকই তাই এখন আবার ‘নিরপেক্ষ’ রিভিউ-এর জন্য সোশাল মিডিয়ার দ্বারস্থ হচ্ছেন! কিন্তু সাবধান। মনে রাখবেন, অনেক সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারই কিন্তু বাজারের নানা পণ্যের প্রচার করার জন্য ভালো দাম পেয়ে থাকেন। মানে গব্বর এখন অনেক প্রকার। টাকা কেড়ে নেওয়ার পথও বিবিধ।

This may contain: an old photo of a man with black hair and beard wearing a leather jacket looking at the camera
‘গব্বর’ আমজাদ খান

এর পাশাপাশি আমাদের ফিল্ম-শিক্ষিত সমাজে যেসব আলোচনা হয়, তা কেবল ফিল্ম-শিক্ষিতদের জন্যই। মানে আপনি যদি লাকাঁ, লরা মালভি, জিজেক প্রমুখের নাম ও কাজ না জানেন, তবে আপনি কিছু বুঝতেই পারবেন না। আর ভাষাও সাংঘাতিক! এত জটিল আর রেফারেন্স-মণ্ডিত যে, সাধারণের ‘প্রবেশ নিষেধ’ নোটিস টানানো থাকে। বিদেশে গিয়ে দেখবেন, আগে পৌঁছে গিয়ে বসবাস করা অনাবাসী ভারতীয়রা প্রথমেই আপনার দিকে ব্যাঁকাভাবে তাকাবে। ভাবটা হল, ‘আমরা এত পড়াশোনা করে কাঠখড় পুড়িয়ে এদেশে এসেছি, এ বেটি এসে পৌঁছল কী করে?’ আমাদের আকাদেমিয়ায় এই মনোভাব একেবারেই নেই কি? মানে যাকে বলে, ‘পাঠের ভাষায় পায়ে রক্ত না ঝরালে কী করে এখানে তুমি আসবে’? (সরি, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়)

যাক গে, বাকি রইল নানা ম্যাগাজিন ইত্যাদিতে সাধারণভাবে সমাজতত্ত্বভিত্তিক কিছু আলোচনা। ‘শোলে’ নিয়ে সেরকম আলোচনা করে ফেলা খুব কঠিন নয়। সে ছিল ভারতীয় সিনেমায় সেলিম-জাভেদ-অমিতাভ আর রাগী নাগরিকের যুগ। যদিও শোলে ছবির চরিত্র ‘দিওয়ার’ ইত্যাদি ছবির তুলনায় অনেক বেশি রূপকধর্মী আর লোকগাথা ধরনের, তবু হাত-কাটা ঠাকুর সাহেবের মধ্যে অসহায় নাগরিকত্ব, বিধবা রাধার মধ্যে অত্যাচারিতা কিন্তু নিজের সম্মানরক্ষায় বদ্ধপরিকর চিরন্তন ভারতীয় নারী, গব্বরের মধ্যে সামাজিক অত্যাচারী, ইমাম সাহেবের ট্রাজেডির মধ্যে সেকুলার ভারতের গল্প আর বিশেষ করে ছিঁচকে অপরাধী যুবক দু’জনের মধ্যে বৃহত্তর সাহস ও স্বধর্মের ধারণা চিনে নেওয়া আমাদের মতো সাধারণ দর্শকদের পক্ষেও কঠিন নয়।

This may contain: three men standing next to each other talking

সমস্যাটা হল, আমাদের চরিত্রে দ্বিচারিতা গভীর। আমরা এক রকমের জীবন যাপন করি, আবার সমালোচক হলে আমরাই বিবেকের ভেক ধরি। তাই আমাদের এই সব আলোচনায় যে ছবি আমাদের ভালো লাগছে, তার মধ্যে আমরা সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ, পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, হিংসার প্রতি সমর্থন– এই সব চিহ্নিত করি আর নিন্দা করি। এই ভাবে নিন্দা করে যেন আমরা পাপমুক্ত হয়ে আবার এই বিশ্বাসগুলোতে ফিরে যাই। মানে পাঁঠা বলি দিয়ে তার মাংস খাই। আমাদের সমালোচনায় তাই সাধারণত: আমাদের কী ভালো লাগছে, কেন ভালো লাগছে তার নির্লজ্জ আলোচনা করতে চাই না। কারণ তাহলে নানা মূল্যবোধ যেগুলোর আমরা নিন্দা করছি সেগুলো যে আমাদের মধ্যেও কাজ করে চলেছে সেটা স্বীকার করতে হয়। বাইরে দাঁড়িয়ে এক পবিত্র সত্তার ভান করা যায় না। কাজেই এই সব সমালোচনায় সত্যিই একটা ছবি একটা এত বড় দেশের মন কী ভাবে জিতে নেয়, ঠিক বোঝা যায় না।

বীরু-জয়ের দোস্তিকে ‘হোমো-সোশাল’ বলে দাগিয়ে দিয়ে আমরা কী রকম যেন অপরাধ চিহ্নিত করি। পুরুষে-পুরুষে বন্ধুত্ব কি কেবল সামাজিক পরিবেশের ফল? এই নিয়ে আমরা পাশ কাটিয়ে যাই। পাশাপাশি ভারতীয় ছবিতে শাম্মি কাপুরের ‘কাশ্মীর কি কলি’ আর গুরু দত্তের ‘পেয়াসা’ এই দুই ঘরানার উত্তরসূরি হিসেবে বীরু আর বসন্তী ও জয় আর রাধার ভালোবাসার আলাদা চরিত্র যে আমাদের গভীর ভাবে টানে, তাই নিয়েও আমরা ভাবি না। অথচ এরা আমাদের ভেতরে আর চারপাশে থেকেই যায়। এই তো গত কয়েক দিন আগে মেদিনীপুরের মহতাবপুরে এক ‘বীরু’ প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে জলের ট্যাঙ্কে উঠে ‘হম সোসাইট করেগা’ বলে কাঙ্ক্ষিত প্রেমিকাকে ভয় দেখাবেন বলে ভেবেছিলেন, উঠেও ছিলেন, সেই মেয়েটি সংগত কারণেই আসতে রাজি হননি, পুলিশ তাঁর বাড়িতে গিয়েও অনুরোধ করেছিল। তারপর ভুল বুঝিয়ে ‘বীরু’-কে নামিয়ে এনে লকাপে পোরা হয়, প্যাঁদানো হয়েছে কি না জানি না! প্রতিদিন কাগজে কিন্তু এই প্রত্যাখ্যাত প্রেমের নানা দুর্বিপাক ও রক্তপাত ছাপা হয়ে চলেছে। কী এই প্রেমের মডেল? কেন এই ডিজিটাল যুগেও এত টেকসই?

This may contain: two people riding on the back of a motorcycle down a road with their arms in the air

সব চেয়ে সমস্যাসংকুল বোধ হয় গব্বরের আমাদের সবার এত প্রিয় হয়ে ওঠা। সত্যি কথা বলতে গেলে, ‘শোলে’ ছবির আসল হিরো আমজাদ। পরবর্তী দিনে ভারতীয় সংস্কৃতিতে গব্বর ও তাঁর দলবল যতটা উদযাপিত হয়েছেন, অমিতাভ বা ধর্মেন্দ্র তার ছিটেফোঁটাও ভাগ পাননি। বিজ্ঞাপনের পর বিজ্ঞাপনে গব্বর ফাটিয়েছেন, তার মধ্যে ব্রিটানিয়ার ‘গ্লুকোজ ডি বিস্কুট’ ‘গব্বর কী অসলি পসন্দ’ বলে বাজার ধরেছে। সেলিম-জাভেদ মন প্রাণ দিয়ে গব্বরের চরিত্র আর ডায়লগ লিখেছিলেন বুঝলাম, কিন্তু একটা খুনিকে আমরা এমন ভালোবাসলাম কী করে? যত দিন যাচ্ছে গোধরা থেকে সিরিয়া, ইউক্রেন থেকে ঢাকা– এই প্রশ্নগুলো কিন্তু জোরালো হয়েই চলেছে। পবিত্র বিধান দিয়ে রক্তপাতের গ্রহণযোগ্যতা ঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে কি?

Full view

আমাদের দেশে যত দিন সমাজতন্ত্রের নামধারী রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি আর খানিকটা তার বিরোধিতা/সহায়তায় মাখামাখি সাংস্কৃতিক মতবাদের চল ছিল তত দিন সমাজের সমালোচনা করার একটা সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠরা খানিকটা চুপচাপ সমালোচনা মেনে নিয়েই নিজেদের মতবাদে অটল থাকতেন। কিন্তু গত দুই দশকে রাষ্ট্র সরাসরি প্রায় সব রকমের বিভেদের প্রবক্তা হয়ে ওঠায় লোকে আর তাদের মতামত নিয়ে ঢাকঢাক গুড়গুড় করার দরকার মনে করছে না। আওয়াজ উঠেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানেই সঠিক। শ্রেণিভিত্তিক পরিচয় পিছিয়ে যাওয়ায় ধর্ম আজ সংহতি ও বিভেদের মাপকাঠি। এই পরিবেশে হিংসা আমাদের জাতীয় চরিত্র। আজকে ‘অ্যানিমাল’ ভক্তদের আর হিংস্রতাকে নিয়ে কুণ্ঠিত হওয়ার দরকার নেই। সত্যি কথা বলতে কী, আলোচনার কণ্ঠও আর নেই। ‘শোলে’-তে সেন্সর করা হিংস্রতার চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র ছবি আমরা ছবিতে খবরে, সর্বত্র দেখছি। সেলিব্রেট করছি।

(উপ)সংহার

‘শোলে’ আমি প্রথম দেখেছিলাম ১৯৭৫ সালে কাশ্মীরের শ্রীনগর শহরে, ‘সিরাজ’ হলে। খুব মজার ছিল সেই অভিজ্ঞতা। আমরা তিন বন্ধু। হল ভরা মোটামুটি সাধারণ গরিব ধরনের মানুষ। সিট নাম্বার নেই তাই মারামারি করে সিট দখল। হলের বাইরে কী একটা মাছ ভাজা বিক্রি হচ্ছে। সেটা কিনে নিয়ে হলে বসে অনেকেই খাচ্ছেন আর থু থু করে কাঁটা ছিটোচ্ছেন। সিনেমা চলছে, হাল্লা চলছে। প্রায় সবাই উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে। ফলে কাঁটা অনেক দূর ছিটছে। যখন সচিনের দেহ পাওয়া গেল, অন্ধ ইমাম প্রার্থনা করলেন, হলের অনেকেই প্রার্থনায় যোগ দিল। ছবি কী রকম পর্দা পেরিয়ে পাশে চলে এল। নাচে সিটি পড়ল, পয়সা পড়ল। অনেক ডায়লগে হাসি, হাততালি। মানে সুস্থ স্বাভাবিক ভারত। হলের নামটা ভুলেই গিয়েছিলাম। অনেক বছর পরে অরুন্ধতী রায়ের ‘দি মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ বইটাতে ১৯৯০ দশকের কাশ্মীরের টর্চার সেন্টারের গল্প পড়লাম, সেখানে দেখলাম সেই ‘সিরাজ’ হল একটা অন্যতম টর্চার সেন্টারে পরিণত হয়েছে। অনেক রক্ত ঝরছে সেখানে। শোলে মনে পড়ল, সেই অন্ধ ইমাম আর মৃত নাতিকে মনে পড়ল। মনে পড়ল, ১৯৯৪ সালে রিলিজ হয়েছিল ‘হম আপকে হ্যায় কৌন’। হারিয়ে দিয়েছিল ‘শোলে’র জনপ্রিয়তা।

যেভাবে চলছে ‘আর আর আর’ আর ‘পুষ্পা টু’-এর দক্ষিণী রূপকথা… শোলের সেঞ্চুরি হবে কি? দেখা যাক।

…………………………..

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন

…………………………..