‘কলের গান’ বলতে আমরা যা বুঝি, ভারতে সেই কলের গানে প্রথম কণ্ঠ দেন গওহরই। ‘গ্রামোফোন গার্ল’ গওহর ইংরেজি, ফরাসি ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় ১০টি ভাষায় রেকর্ড করে ফেলেন মোট ৬০০, বা তারও অধিক গান। আজ থেকে ১২৫ বছর আগে তাঁর পারিশ্রমিক ছিল ৩০০০ টাকা। এ কথা হাওয়া-বাতাসেই শোনা যায় যে, গওহর নিজের অধিকারের দাবিটুকু বুঝে নিতে জানতেন। তাই তো তাঁর প্রতিপত্তি হতে পেরেছিল আকাশ-ছোঁয়া। জীবন বিলাসবহুল।
জন্মসূত্রে ইহুদি, গওহর জানের নাম আগে ছিল ‘অ্যাঞ্জেলিনা’। ইলিন অ্যাঞ্জেলিনা ইওয়ার্ড। এ কথা কে না জানে? ১৮৭৩ সালে আজমগড়ে (তৎকালীন ইউনাইটেড প্রভিন্সেস) জন্ম নেন তিনি। বাবা কর্মরত ছিলেন আজমগড়েরই একটি বরফ তৈরির কারখানায়। শৈশবে ঘটে যায় বাবা-মায়ের বিবাহ-বিচ্ছেদ, গওহর-ও মায়ের হাত দু’টি ধরে চলে আসেন বারাণসীতে। তাঁর মা– ভিক্টোরিয়া ইওয়ার্ড তখনই গ্রহণ করেন ইসলাম ধর্ম– সেই তো ভিক্টোরিয়ার ‘মালকা জান’ হয়ে ওঠার গল্প। সেই তো অ্যাঞ্জেলিনারও সকলের প্রিয় হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী ‘গওহর জান’ হয়ে ওঠার গল্পের শুরু।
হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সংগীতের হওয়ার কথা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার প্রতীক। যেমনটা ঠিক গওহর জানের জন্মের ইতিবৃত্ত। গওহরের ঠাকুমা ছিলেন হিন্দু, দাদু ব্রিটিশ এবং বাবা আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরে গওহর সে ধর্মেই অনুগত থাকেন মৃত্যু ইস্তক। লিখতে লিখতে ভেবে দেখলাম, আমাদের তো জানার কথা ছিল না, গওহরের ধর্ম কী! কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে সুর, তা এখন কেবলই হারিয়ে যাচ্ছে ভারতের মাটি থেকে।
এর আগে ‘রোববার.ইন’-এই রসুলনবাই সাহিবাকে নিয়ে একটি নিবন্ধে (https://robbar.in/daily-update/an-article-about-rasoolan-bai/) লিখেছি, সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস বোঝা এবং বোঝানোর ধরনের ফলস্বরূপ যে ভিন্ন ভিন্ন সমস্যায় এখনও আমরা জর্জরিত, তার মধ্যে অন্যতম আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির ইতিহাস বোঝা। গওহর জানকে ‘তাহাদের’ ইতিহাস যেমন করে চেনাবে, সে চেনার মধ্যে এক ধরনের তথ্য থাকবে, ঠিক। কিন্তু গওহর জানের গতিময় জীবনের সম্পূর্ণ ছবিটা তাতে ধরা পড়বে না।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মাথার ওপরে চড়েই গওহর নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম সারির ‘মহিলা সংগীত শিল্পী’ হিসেবে। সাফল্যের শিখরে পৌঁছে সেই শিখরেই রয়ে যান জীবনের অনেকখানি সময় জুড়ে। কোথায় এই সাফল্যের গোড়াপত্তন? সে ধারণা তৈরি করাও কোনও দুষ্কর কাজ তো নয়। বারাণসীর সাংস্কৃতিক পরিবেশে গওহরের সহজাত নৃত্য এবং সংগীত প্রতিভা প্রাণ পেতে শুরু করে প্রথমে। স্থানান্তরে কলকাতা চলে আসার পর পরই ওয়াজেদ আলী শাহ-র দরবারে গওহর প্রথম পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেন। নবাব নিজেও যে ছিলেন সংগীতে পারদর্শী! নবাবের দরবারেই একবার মায়ের সঙ্গত করতে গিয়ে চোখে পড়ে গিয়েছিলেন তাঁর গুরুর– অতঃপর প্রথাগত তালিম শুরু হয় সংগীতে এবং নৃত্যে।
কৈশোরের দোরগোড়ায় পৌঁছে দারভাঙা রাজ (বিহার) দরবারে গওহরের প্রথম সংগীত পরিবেশন। একক। ধ্রুপদ, ঠুমরি, দাদরা, কাজরি, হোরি, তারানা– প্রতিটা ক্ষেত্রেই তিনি তালিমপ্রাপ্ত, পারদর্শী। অচিরে তাঁর কণ্ঠ, এবং কণ্ঠের দখলটি ভিজিয়ে দিতে থাকে গুরুগম্ভীর শাসকের মন! দরবারের পর দরবারে তাঁকে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়। জনতার স্নেহমাখা ভক্তির কৃপায় নামটি এখন তাঁর ‘গওহর জান কালকাত্তাওয়ালি’।
গওহর জানকে যখনই আমি মনে মনে দেখেছি, যে ছবি প্রথমেই এসেছে, তা হল, রূপবতী, মুখরা এক মেয়েমানুষ অনুষ্ঠানের আয়োজকের কাছে, রেকর্ডিং শেষে প্রযোজকের কাছে নিজের প্রাপ্য পারিশ্রমিক চাইছেন। চাওয়ার সাহস করছেন। পাচ্ছেনও। পাওয়ামাত্র যেন হেসে নিচ্ছেন খুব জোর। অর্থাৎ, আমাদের সমাজে মেয়েমানুষ যে তার প্রাপ্য মান, প্রাপ্য পারিশ্রমিক পাবেন, তা এখনও আমাদের অনেকেরই ধারণার বাইরে। অথচ আমি বলছি উনিশ শতকের গোড়ার কথা। ‘কলের গান’ বলতে আমরা যা বুঝি, ভারতে সেই কলের গানে প্রথম কণ্ঠ দেন গওহরই। সে সময় ব্রিটিশ গ্রামোফোন কোম্পানির একটি উদ্যোগে ফ্রেড গাইসবার্গ গওহরকে আরপিএম ডিস্কের জন্য একটি গান রেকর্ড করার সুযোগ দেন প্রথম। তারপর থেকে ‘গ্রামোফোন গার্ল’ গওহর ইংরেজি, ফরাসি ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় ১০টি ভাষায় রেকর্ড করে ফেলেন মোট ৬০০, বা তারও অধিক গান। আজ থেকে ১২৫ বছর আগে তাঁর পারিশ্রমিক ছিল ৩০০০ টাকা। এ কথা হাওয়া-বাতাসেই শোনা যায় যে, গওহর নিজের অধিকারের দাবিটুকু বুঝে নিতে জানতেন। তাই তো তাঁর প্রতিপত্তি হতে পেরেছিল আকাশ-ছোঁয়া। জীবন বিলাসবহুল।
রেকর্ড প্রসঙ্গেই বলে রাখি, ‘খেয়াল’ সম্পর্কে জনতা বরাবরই সচেতন। খেয়ালের গায়ে আঁচ লাগলে এখনও ‘গেল গেল’ রব ওঠে– খেয়ালকে দেওয়া হয় অবিমিশ্রতার স্বীকৃতি, ‘ঠুমরি-টুমরি’র চেয়ে উচ্চতর আসন। সে সময় দাঁড়িয়ে আরপিএম ডিস্কের স্বার্থে গওহর তিন মিনিটেই পছন্দের, বা ফরমায়েশি খেয়ালগুলিকে নিজের মতো করে বদলে নিতেন। এই ‘ব্লাসফেমি’ নিয়ে মুহূর্তেই নিন্দার ঝড় ওঠে। গা করেন না গওহর। খেয়াল উপস্থাপনার প্রথাগত ঢং ভেঙে নতুন এক উপস্থাপনার পথ বাতলে দেন। রেকর্ডিং শেষে তিনি দৃপ্ত স্বরে বলতেন, ‘মাই নেম ইজ গওহর জান’। বিখ্যাত এই বাক্যটি এখন তো শ্রোতাদের লবজে চলে এসেছে। গওহর জান কেন এই ঘোষণা ধারাবাহিক ভাবে করেছেন, তাই নিয়ে নানা রয়েছে জল্পনা। এই ঘোষণার প্রয়োজন যে পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য ছিল, তা যেমন সত্যি, এই ঘোষণাকে কি আপাদমস্তক দ্বিচারিতায় মোড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সামনে খুল্লাম-খুল্লা দাঁড়িয়ে একপ্রকার যুদ্ধঘোষণাও নয়? যেন, কেবল গান শুনিয়ে চলে যাওয়া গওহরের একমাত্র কাজ নয়। তাঁর একটি সত্তা আছে, সেই সত্তার স্ব-ভাব আছে, ভাষা আছে, দৃঢ়তা আছে– যাকে কোনওভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।
গওহর জান নামের ‘তোওয়াইফ শিল্পী’র জীবনের আগাগোড়াই সংগ্রাম। মঞ্চে, আনুষ্ঠানিক মঞ্চের বাইরে, জীবনের মঞ্চেও। গওহর কখনও ধার ধারেননি লিঙ্গ-নির্দিষ্ট সংকেতগুলির। বারেবারেই তাদের পায়ে ঠেলে শ্রোতাকে, দর্শককে তাজ্জব বনিয়ে দিয়েছেন। পারফরমেন্স তো কেবল নাচ-গান-অভিনয় নয়, জুডিথ বাটলার বলেছেন, জেন্ডার নিজেই একটি পারফরমেন্স। জন্মের মুহূর্ত থেকেই আমাদের সেই আরোপগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। গওহর শোনাবে মনের গান, ঠুমরি-দাদরা, জনতা বলবে ‘ওয়াহ-ওয়াহ’! ইডেনে গওহর ফিটন চড়বে, সেই জনতাই দেবে দুয়ো। সামান্য নারী, তায় কণ্ঠশিল্পী, উপরন্তু ‘তোওয়াইফ’– কোন সাহসে লাট-সাহেবের ব্যাটা সাজে সে? জনতার চরিত্র এমনই। নীতিশাস্ত্রের ফাঁস কিছুতেই এসে লাগেনি শিল্পীর স্বাধীনচেতা মনটিতে। তাঁর ঠাঁট দেখে যে লাটসাহেব জরিমানা করতে এসেছিলেন, তাঁর মুখেই গওহর ছুড়ে মেরেছিলেন ধার্য মূল্যটি। গওহরের নাম এখন স্পর্ধা।
স্পর্ধার প্রকাশ নিয়ে গওহর জান সম্বন্ধে একটি বহুশ্রুত গল্প এই যে, সামান্য এক ‘তোওয়াইফ’, তার রুৎবা ‘ঘাজাবকা’– সাধারণ মানুষের যখন আচার-অনুষ্ঠান মেনে বিয়ে-শাদি করতে কালঘাম ছুটছে, হাজার-হাজার টাকা খরচ করে, ধুমধাম করে দিয়েছিলেন নিজের বেড়ালের বিয়ে। যত লেখা আমি গওহর জানের সম্পর্কে এযাবৎ পড়ে দেখেছি, সেসব লেখায় এই গল্পের উল্লেখ থেকেই গেছে। গওহরের মাপের সংগীত সম্রাজ্ঞীর এত এত সাহসিকতার পরিচয়ের গল্পের মধ্যে এই গল্পটিই কেন বহুশ্রুত হয়েছে, আমি ভালো বুঝেছি বললে অসত্য বলা হবে। তবে শুনতে যে মজা পাইনি, এমনটিও নয়।
সংগীতকে গওহর সীমাবদ্ধ করে রাখেননি নিজের সচ্ছল বিচরণেক্ষেত্রে। যখন রবীন্দ্রসংগীত ছিল রবীন্দ্রগান, যখন রবীন্দ্রসংগীতকে কেন্দ্র করে এই বৈষম্যসংস্কৃতি তৈরি হয়নি, তখন তার মুক্ত আনাগোনা ছিল এ দরবারে সে দরবারেও। গওহর গাইছেন– ‘কে জানিত আসবে তুমি গো, অনাহূতের মতো!’ সেই গানে কোনও পূর্বনির্দিষ্ট ভঙ্গিমা ছিল না। কানে শোনার সৌভাগ্য না হলেও একাধিক স্মৃতিচারণে এই বিবরণ পড়ে মনে হয়েছে, গওহরের রবীন্দ্রগানে প্রাণের অভাব ছিল না। যে অভাব কোনও কোনও ক্ষেত্রে ‘রবীন্দ্রসংগীত’কে আমরা যেমন করে বুঝে নিয়েছি, তাতে থাকে না, হলফ করে বলতে পারব? যে রবীন্দ্রনাথের গান ঘিরে এত হই-হট্টগোল, এত বাধা-বিপত্তি, তোয়াইফ হয়ে মেহেফিলে সেই গানই শুনিয়ে ফেলা প্রতিরোধের, স্পর্ধার প্রতীক নয়?
প্রতিবাদে, প্রতিরোধে পাকা গওহরকেও ঠকতে হয়েছিল জীবনের শেষে এসে– প্রেমের কাছে, প্রতিষ্ঠানের কাছে। তবু তো তাঁর প্রতাপের রংটি মলিন হয়নি মোটে। জীবনের শুরু থেকে আইন-কাছারিকে বুড়ো আঙুল দেখাতে দেখাতে তাই যেন অভ্যেসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এই সমাজ ‘তোয়াইফ’কে ‘শিল্পী’র স্বীকৃতি তো দিল, যত্নটুকু দিল না। প্রাণের কলকাতা ছেড়েই সুদূর মাইসোরে জায়গাবদল করে কেটেছিল তাঁর দিনগুলি। অসুস্থতায়, অবহেলায়। বেশিদিন সেই অবস্থায় থাকতে হয়নি গওহরকে। ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যু তাঁকে টেনে নেয়। ফেলে রেখে যায় তাঁর সুরের উত্তরাধিকারের মায়া। যে মায়ায় এখনও বাতি নিভে যায় না, নতুন প্রজন্ম যে মায়ায় জড়িয়ে এখনও শিল্পী হওয়ার, সুপারস্টার হওয়ার স্বপ্ন সাজায়– স্বপ্ন সাজায় প্রতিবাদী হওয়ার। এখন গওহরের নাম ‘লেগাসি’… জিলা রাগে, দাদরা তালে অবিরাম বেজে চলেছে– ‘ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি উড়ে গেল, আর এলো না।’
গওহর জান, কে তোমাকে টেনে নিয়ে গেল ষাটের দুয়ারেও না পৌঁছতেই? বেহায়া সমাজ বলবে একাকিত্ব, একাকিত্ব বলবে, বেহায়া সমাজই… তুমি যাচ্ছ রাঙা ঘোড়ার পরে, টগবগিয়ে, কাহার পাশে পাশে? রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে, রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে। আকাশের রংটুকু এবার বদলে যাচ্ছে। বিদায়, পরিচিতা।
‘মাই নাম ইজ গওহর জান’– পৃথিবী ঘুরতে থাকবে, শ্রেণি ও সংগ্রামও ঘুরতে থাকবে যেমন ঘুরছে রোজ, গওহর জানের নামটি থাকবে গওহর হয়েই। স্থিতিশীল– যেন ভরা নদীতে ঢিল ছুড়লেও জল নিজের জায়গা থেকে এতটুকু সরবে না। শিল্পীর নামটি এমন করেই আমাদের মাথায় গেঁথে গিয়েছে।
ছবি কৃতজ্ঞতা: https://bajakhana.com.au/