জন ক্লিল্যান্ডের ‘ফ্যানি হিল’। যে পর্নোগ্রাফি পৃথিবীর সমস্ত লাইব্রেরিতে রক্ষিত হবে। যে পর্নোগ্রাফি পড়ানো হবে পৃথিবীর সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্রুপদী সাহিত্যের ক্লাসে। যে পর্নোগ্রাফি পড়তেই হবে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীকে। যে পর্নোগ্রাফি থেকে পালাবার পথ নেই শিক্ষিত সমাজের। এমন একদিন আসবে যখন ‘ফ্যানি হিল’ না পড়া থাকলে ইন্টেলেকচুয়ালদের মদের মগ্নতায় হালে পানি পাওয়া যাবে না।
২৫.
বম্বে। ঘটনাটা ঘটল ১৭২৯ আর ১৭৪০-এর মাঝামাঝি কোনও একটা সময়ে। খাস ইংরেজ জন ক্লিল্যান্ড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে। নানা বদ খেয়ালের বশে সে ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে ঋণে। এরই মধ্যে সে কিনেছে একটা সস্তার টেবিল। এই টেবিলে সে খায়-দায়। জুয়া খেলে। লেখে। এবং তার নতুন সমস্যাটা এই লেখাটা নিয়ে!
লেখাটা নিজেই নিজেকে চালাচ্ছে। ফিবি (Phoebe) বলে একটা মেয়ে কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে এই গল্পটার নায়িকা হয়ে গেল! তারপর জন ক্লিল্যান্ডের সামনে জামাকাপড় ছাড়তে লাগল! তারপর জনকে বলল, তুমিও জামাকাপড় ছেড়ে আমার সামনে বিছানায় এসো। জন খুব লজ্জা পেল। আবার তার ইচ্ছেও করল। তখন ফিবি নিজেই জনের শরীর থেকে পোশাক ছাড়িয়ে নিল। বলল, তুমি দেখি কোনও কম্মের নও। নিজে নিজে ন্যাংটা হতেও পারো না!
জন এই ভাষায় আগে কখনও ইংরেজ মেয়েকে কথা বলতে শোনেনি। তার বেশ লাগল মেয়েটাকে। বলল, তোমার নাম কী? মেয়েটা বলল, ফিবি। আর জিগ্যেস করল, তোমার নাম? জন ক্লিল্যান্ড। আমি ইংল্যান্ডের লোক। ইন্ডিয়ায় এসেছি চাকরি নিয়ে। মেয়েটা বলল, আমিও ইংল্যান্ডের। আমি বম্বেতে এসেছি তোমার গল্পের নায়িকা হতে। আমার বয়স ২৫। তোমার গল্পের একেবার ঠিকঠাক নায়িকা আমিই হতে পারি। আমার শরীরটা কেমন বলো! বিছানাতেও লাজলজ্জা নেই। যেমন তুমি চাইছ।
জন মুহূর্তের মধ্যে মনে মনে গল্পটা শুরু করে দিল, ফিবি মিথ্যুক। অন্তত দশ বছর বয়স লুকিয়েছে। ‘She must have sunk at least ten good years!’ কী করে ২৫ হবে? বুক দুটো আলগা! ঝুলে পড়েছে। ‘A pair of breasts hanging loosely down.’ এরপর ওই আলগা বুকের মেয়েটা আমাকে যা বলতে লাগল, আমিও তাই শুনতে লাগলাম। কী আশ্চর্য! ইতিমধ্যে ফিবি আমার হাতদুটো নিয়ে ওর নুইয়ে পড়া বুকদুটোর ওপর চেপে ধরল। আর আমার বেশ লাগতে লাগল। এরপর ওই আলগা ঝোলা বুকের মেয়েটা আমাকে যা বলতে লাগল আমিও তাই শুনতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়েটা আমার সারা দেহের ওপর আঙুল চালাতে লাগল। আর আমি মনে মনে লিখতে লাগলাম যেরকম ভাবে আমি আগে কোনও দিন লিখতে পারিনি। ‘I lay then as she could wish. Every part of me was open and exposed to the licentious courses of her hands.’
আমি জন ক্লিল্যান্ড নিশ্চিত, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করা ইংরেজদের কেউ এমন ইংরেজি লিখতে পারবে না। আমিও তো পারি না । কিন্তু এখন লিখছি। কী করে? ফিবির হাতে ওই আগুনটা আমাকে লেখাচ্ছে। কেমন আগুন? আমার মন বলে উঠল এই ভাষায়, ‘like a lambent fire, ran over my whole body and thawed all coldness as they went.’ এদিকে অবাক কাণ্ড! ফিবির হাত আমার শরীরের আরও নিচে নামছে। আর আমার মন কথা বলছে এই ভাষায়: ‘Her lascivious touches had lighted up a new fire that went through all my veins!’ একটা সম্পূর্ণ উলঙ্গ মেয়ের আগুনে আঙুল আমাকে করে তুলছে এক ইংরেজ লেখক! কী করে সম্ভব। মেয়েটার বুক দুটো বুড়িয়ে গেছে। কিন্তু আঙুলে এত আগুন। তাই বা কেমন করে সম্ভব। আমি ফিবির জেগে ওঠা বুকে চুমু খেয়ে বলি, ‘ফিবি, আই লাভ ইউ।’ মেয়েটা বলে, ‘বাট আই ক্যান নট লাভ ইউ।’ কেন আমাকে ভালোবাসতে পারবে না? আমি চিৎকার করে উঠি। ফিবি ঠান্ডা গলায় বলে, ‘আই উইল লাভ ইউ ডিয়ারলি ইফ ইউ লেট মি আলোন অ্যান্ড গো আওয়ে।’ কথাটা বলার পরেই ফিবি ছুটে চলে যায় সস্তা টেবিলটার কাছে, যে টেবিলে আমি খাই, জুয়া খেলি, লেখালিখি করি।
বম্বে। বেশ কিছুদিন পরে। মধ্যরাত। জনের ঘর। সস্তা টেবিলটা মাঝখানে রেখে ফিবি আর জন মুখোমুখি। ওরা বম্বের দেশি মদ খাচ্ছে। দু’জনের মতেই স্কচ-এর থেকে অনেক স্বাদু ও তেজি ইন্ডিয়ার কান্ট্রি লিকর। ওরা মদ খাচ্ছে। কোনও কথা বলছে না।
ফিবি: তুমি তাহলে আমাকে ভালোবাসতে পারবে না?
জন: আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারলাম কি পারলাম না, সেটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়।
ফিবি: কোনটা ইম্পর্ট্যান্ট?
জন: তোমার ভবিষ্যৎ।
ফিবি: আমি যা জানি, তুমি জানো না। তাই আমার দায়িত্ব অনেক বেশি।
জন: তোমার দায়িত্বটা কী?
ফিবি: তোমাকে জানানো, আমি যা জানি।
জন: কী জানো তুমি?
ফিবি: এই চাকরি তোমাকে ছেড়ে দিতে হবে। ইন্ডিয়া থেকে তোমাকে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হবে।
জন: ইংল্যান্ডে কাজ নেই। থাকার খরচ অনেক। উপোস করে মরব।
ফিবি: ইংল্যান্ডে তোমাকে ফিরে যেতেই হবে। তোমার সঙ্গে সেখানে আলাপ হবে দুই সমকামী মেয়ের। তারা বেশ্যা। ফ্যানি হিল আর লুইসা। তারা তোমার ভাগ্য ফিরিয়ে দেবে। আর আমি সাজাব ঘুঁটি। দু’জনকেই আমি তৈরি করেছি নিজের হাতে। বাকি কাজ তোমাকে করতে হবে।
জন: কী কাজ ফিবি?
ফিবি: ফ্যানি হিলকে নায়িকা করে একটা উপন্যাস লিখতে হবে।
জন: ফিবি, তুমি তো আমার নায়িকা।
ফিবি: জন, আমি তোমার থেকে বয়েসে অনেক বড়। ৫০ বছর আগে আমার বয়েস ২৫ ছিল। আমি বুড়ি বেশ্যা। মিথ্যে কথার ঝুড়ি। তাছাড়া ফ্যানি চায় অমর হতে। ফ্যানিকে তুমি দেবে অমরত্ব। আর ফ্যানি করবে তোমাকে আমির। জন, তোমার টাকা রাখার জায়গা থাকবে না।
জন: ফ্যানি কে কী উপায়ে অমর করব আমি?
ফিবি: তোমার লেখা পর্নোগ্রাফির নায়িকা হবে ফ্যানি হিল।
জন: হোয়াট! আমি লিখব পর্নোগ্রাফি?
ফিবি: জন ক্লিল্যান্ড-এর সেই পর্নোগ্রাফির নাম হবে ‘ফ্যানি হিল’। পৃথিবীর অশ্লীলতম উপন্যাস ‘ফ্যানি হিল’ লেখার জন্য তোমার জেল হবে।
জন: তারপর?
ফিবি: তারপর চাকা ঘুরবে জন। মানুষের বোধবুদ্ধি বদলাবে। মানুষ ক্রমশ বুঝতে পারবে, পৃথিবীর সবথেকে অশালীন পাপের গল্পে তুমি বুনে দিয়েছ কালজয়ী সাহিত্য। পর্নোগ্রাফি ছাপিয়ে উঠবে তোমার ভাষার মাধুরী। তোমার জীবনবোধের গভীরতা। তোমার পর্নোগ্রাফির প্রত্যেক চরিত্র হয়ে উঠবে এতই বাস্তব যে, তারাই দেবে তোমার অশ্লীলতাকে বাস্তববাদী সাহিত্যের মাহাত্ম্য। আর তোমার নায়িকা ফ্যানি হিল সারা জীবন পৃথিবীকে মুগ্ধ করবে একই সঙ্গে তার মন ও শরীরের সৌন্দর্যে।
জন: ফিবি, থামো তুমি। আমাকে আর কত মিথ্যে বলে তোমার ফাঁদে ফেলবে? পর্নোগ্রাফিকে মহৎ সাহিত্যে উত্তীর্ণ করতে যে অসাধারণ প্রতিভার প্রয়োজন, তা আমার নেই। আমি কোনও জন্মে সাহিত্যিক হতে পারব না। আর আমার পর্নোগ্রাফি ভদ্রসমাজে ঘৃণ্য হয়েই থাকবে। আর বাকি জীবন আমার জেলেই কাটবে অশ্লীলতার অপরাধে।
ফিবি: না, জন না। তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তোমার এই সস্তার টেবিল যা করার করবে। তুমি শুধু টেবিলে বসবে। আর আসতে থাকবে তোমার বোধ, তোমার ভাবনা, তোমার ভাষা, তোমার দর্শন, আর পাঁক থেকে জেগে উঠবে , উঠে আসবে তোমার মরণজয়ী ভিনাস, অপরিমেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলোয় উপলব্ধ ফ্যানি হিল।
জন: আমার একটাই প্রশ্ন। ফিবি, এই টেবিলটার সঙ্গে তোমার ওই ফ্যানি হিলের কী সর্ম্পক? ফ্যানি হিল, যাকে আমি কোনও দিন দেখিনি, হয়তো কোনও দিন দেখব না।
ফিবি: তুমি যে বুড়ির আসবাবের নিলামে এই টেবিল সস্তায় পেয়ে আনন্দে দিশি মদের মাতোয়ারা করতে বম্বের বেশ্যাপাড়ায় গিয়েছিলে, সেই বুড়ি ফ্যানি হিলের মা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক অফিসারের মিস্ট্রেস হয়ে ইংল্যান্ড থেকে ইন্ডিয়ায় চলে আসে। বুড়ির ইচ্ছে ছিল সাহিত্যিক হয়ে নিজের কথা লিখবে। আর লিখবে মেয়ের প্রতিভার কথা। বুড়ি সিফিলিস-এ ভুগছিল। কবে যে এই মারাত্মক অসুখের ওষুধ বেরোবে?
জন: ফ্যানির প্রতিভা? সেও লেখক হতে চায়?
ফিবি: অত বোকা সে নয়। ইংল্যান্ডে ফিরে চলো জন। একবার দাড়াও সম্পূর্ণ নগ্ন ফ্যানি হিলের সামনে। শুষে নাও তার খোলা দেহের মহাকাব্য। তারপর সেই শরীর সমুদ্রকে সেলিব্রেট করো তোমার ফ্যানি হিল পর্নোগ্রাফিতে। যে পর্নোগ্রাফি পৃথিবীর সমস্ত লাইব্রেরিতে রক্ষিত হবে। যে পর্নোগ্রাফি পড়ানো হবে পৃথিবীর সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্রুপদী সাহিত্যের ক্লাসে। যে পর্নোগ্রাফি পড়তেই হবে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীকে। যে পর্নোগ্রাফি থেকে পালাবার পথ নেই শিক্ষিত সমাজের। এমন একদিন আসবে জন ক্লিল্যান্ড যখন ফ্যানি হিল না পড়া থাকলে ইন্টেলেকচুয়ালদের মদের মগ্নতায় হালে পানি পাওয়া যাবে না। আশা করি, ততদিনে সিফিলিসের ওষুধ আর চিকিৎসা এসে যাবে। সেই যুগের কোনও শেক্সপিয়রকে এই রোগে মরতে হবে না।
পরের দৃশ্য। লন্ডন। ১৭৪৮
প্রকাশিত হয়েছে জন ক্লিল্যান্ডের ‘ফ্যানি হিল’। পূর্ণ নগ্নতার মহাকাব্যে বইটি হাতে নিয়ে ফ্যানি দাঁড়িয়ে এক মায়াবী মঞ্চের দীপিত কেন্দ্রে। সেই দিকে তাকিয়ে সদ্য প্রকাশিত তাঁর ‘ফ্যানি হিল’ উপন্যাসটি থেকে পড়ছেন জন ক্লিল্যান্ড: ‘She is now in bed with me the first time and in broad day, lying with her naked glowing body. Oh, insupportable delight. Oh superhuman rapture. I fear any part of her should not be untouched by me. She has a strange longing to be satisfied in her best bodily gifts. She suffers with pleasure. And enjoys her pain.’
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল