তিনি স্বাধীন এবং বিদ্রোহী। ১৯৫১ সালে সাহিত্যিক পারভেজ শাপুর সঙ্গে বিবাহ। একটি পুত্রসন্তান হওয়ার পর ১৯৫৪ সালে বিবাহবিচ্ছেদ। অবশ্যই তাঁর সাহিত্য-সৃজনে বেশি মন ও সময় দেওয়ার অপরাধের শাস্তি হিসাবে। পুত্রকে বোঝানো হয় তার মা সন্তান অপেক্ষা সাহিত্যকে বেশি ভালোবাসে– এই মানুষটিই ফরোগ ফরোখজাদ– একজন কবি, ইরানের। অকপটভাবে বলেন নারীর প্রেমের আকাঙ্ক্ষা, নারীর যৌন ইচ্ছা, প্রণয় আর যৌনতার দুর্দান্ত মিশ্রণের ইচ্ছা। অন্যদিকে সিলভিয়া প্লাথ আমেরিকান কবি, যিনি অসুখী দাম্পত্যের ভার বহন করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন স্বামীর কাছে। তাঁর কবিতাও স্বীকারোক্তিমূলক এবং এই নতুন ধারার কবিতার স্রষ্টা তিনি। ১৯৫৬ সালে বিখ্যাত সাহিত্যিক টেড হিউজের সঙ্গে বিবাহ আর দুই সন্তানের জননী হওয়ার পর ১৯৬৩ সালে আত্মহত্যা করেন।
যখন আমাদের এই দূর প্রাচ্যে ‘শেষের কবিতা’-র মতো উপন্যাসে প্রেমের মাধুর্য, নৈকট্য ও দূরত্ব, বিশুদ্ধ প্রেমে কল্পনার মাদকতা, উদাসীনতা, রোম্যান্টিসিজম ও বিবাহিত সম্পর্কের দায়িত্ব নিয়ে অত্যাধুনিক ভাষ্য রচিত হয়ে গেছে, পুরুষের পাশাপাশি নারীও প্রেম ও জীবন নিয়ে নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠা করছে, তখন মধ্যপ্রাচ্যের একটি শহর তেহরানে একটি শিশুকন্যা জন্ম নিচ্ছে ১৯৩৪ সালে, যে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করে ১৯ বছরের মাথায় বিবাহবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে আর নিজের মতামত জানাবে জনসমক্ষে কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে, কোনও রাখঢাক না করেই, বাস্তবকে প্রকাশ করবে সরাসরি কাব্যের সৌধ নির্মাণ করে। তবে সেই প্রখর তরুণী কাব্যের আড়াল খুঁজবে না নিজের কথা বলতে, বরং কবিতাকেই করবে আশ্রয়।
ফরোগ ফরোখজাদ এমন একজন ইরানীয় মহিলা কবি, যাঁর কবিতার বিস্ফোরক ক্ষমতার কথা বুঝে তাঁর মৃত্যুর প্রায় ২০ বছর পরেও তাঁর কবিতা নিষিদ্ধ করা হয় তেহরানে। সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থেকে ইরানের রক্ষণশীল সমাজের ওপর আঘাত হেনে সেই আধমরাদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন। নিজস্ব ভাব-ভাষা, চিত্রকল্প, বার্তা, সটান বলার অকপট ধরন কোনও উপমা রূপকের কাব্যিক আড়াল খোঁজা আঙ্গিকে নয়– সরাসরি স্বীকারোক্তি দিয়ে। তিনি বিতর্কিত এবং আধুনিক।
তিনি সাহসী এবং সংবেদনশীল। তিনি স্বাধীন এবং বিদ্রোহী। সমাজে তিনি একজন মহিলা এবং তিনি একজন মানুষ– এই ছিল তাঁর অভিব্যক্তি। ১৯৩৪ সালে তাঁর জন্ম, ১৯৫১ সালে সাহিত্যিক পারভেজ শাপুর সঙ্গে বিবাহ। একটি পুত্র সন্তান হওয়ার পর ১৯৫৪ সালে বিবাহবিচ্ছেদ। অবশ্যই তাঁর সাহিত্য-সৃজনে বেশি মন ও সময় দেওয়ার অপরাধের শাস্তি হিসাবে। পুত্রসন্তানের অধিকারও হারান। পুত্রকে বোঝানো হয় তার মা সন্তান অপেক্ষা সাহিত্যকে বেশি ভালোবাসে– এই মানুষটিই ফরোগ ফরোখজাদ– একজন কবি, ইরানের। অকপটভাবে বলেন নারীর প্রেমের আকাঙ্ক্ষা, নারীর যৌন ইচ্ছা, প্রণয় আর যৌনতার দুর্দান্ত মিশ্রণের ইচ্ছা, রক্ষণশীলতার শেকল ভাঙার ইচ্ছে, চোখের ঠুলি সরিয়ে নিজের দৃষ্টিতে অর্ধেক নয় গোটা আকাশটা দেখার ইচ্ছা। আর সেজন্যই তিনি কড়া সমালোচিত হয়েছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য ক্যাপটিভ’-এর পরে ‘দ্য ওয়াল’, ‘দ্য রেবেলিয়ান’, ‘অ্যানাদার বার্থ’, ‘রিবর্ন’ ইত্যাদি। সমস্ত কবিতাতেই মানুষ খুঁজেছেন, মানুষের কথা বলেছেন প্রতিটি স্বাভাবিক অনুভূতিকে সম্মান দিয়েছেন। সমালোচনার উত্তরে বলেছেন, ‘সম্ভবত আমিই প্রথম এমন কথা বললাম তাই আমি বিতর্কিত।’
ইরানের নতুন ভাবধারায় পথিকৃৎ তিনি। ব্যক্তিচেতনাকে সম্মান দিয়েছেন ,তাকে জাগিয়েছেন। তিনি সরকারের সমালোচনা করেছেন। তাঁর ‘ও বিজুয়েলড ল্যান্ড’ একটি অসামান্য দেশপ্রেমের কবিতা। মাত্র ১২ লাইনের একটি কবিতা– ‘পাপ’। অকপটে বলেছেন নারীর কামনা ও অভিজ্ঞতার কথা–
‘আমি একটি পাপ করেছি, পরমানন্দে ভিজেছে সে পাপ
উষ্ণ প্রণয় দহনের আলিঙ্গনে।’
স্বর্গীয় সারল্যে কবিতা হয়ে উঠেছে তীব্র আবেগী জৈবিক অনুভূতি। আর ঝড় উঠেছে ইরানের সমাজে। তিনি পরোয়া করেননি। তিনি জানতেন জীবন এত সত্য যে, সেখানে লুকনোর কিছু নেই, থাকতে পারে না। তিনি একজন চিত্রকর, তিনি একজন চিত্রনাট্যকার, তিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। ১৯৬২ সালে ইরানের নিউ ওয়েভ সিনেমার ধারায় তিনি ডকুমেন্টারি ছবি তৈরি করেন– ‘দ্য হাউস ইজ ব্ল্যাক’। কুষ্ঠ রোগীদের ওপর সিনেমাটি বানানোর সময়ে একটি কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত শিশুকে তিনি দত্তক নেন এবং তাঁর মায়ের বাড়িতে রাখেন। ইরানের ফিল্মমেকার আব্বাস কিয়েরোস্তামি তাঁর নিজের সিনেমা বোধের উত্তরণের ক্ষেত্রে ফরোখ ফরোগজাদের এই ছবির কাছে ঋণ স্বীকার করেন। মাত্র ৩২ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে তিনি যে দিগন্ত রচনা করেছেন, সে জন্য তাঁকে ইরানের ‘সিলভিয়া প্লাথ’ বলা হয়, যিনি এরকমই স্বতন্ত্র আমেরিকান একজন মহিলা কবি। একটি মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায় ফরোগ ফরোখজাদ প্রাণ হারান। আজ তাঁর কবিতা সারা বিশ্বে অসংখ্য ভাষায় অনূদিত এবং আদৃত।
সিলভিয়া প্লাথ-এর কথা যখন এল তখন তাঁর কথা বলতেই হয়। তিনি একজন আমেরিকান মহিলা কবি, যিনি অসুখী দাম্পত্যের ভার বহন করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। বাড়ির রান্নাঘরে গ্যাস ওভেন খুলে দিয়ে বিষাক্ত গ্যাসের শ্বাস নিয়ে। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন স্বামীর কাছে। হ্যাঁ, পাশ্চাত্যের উদার দেশে! তাঁর কবিতাও স্বীকারোক্তিমূলক এবং এই নতুন ধারার কবিতার স্রষ্টা তিনি। ১৯৩২ সালে জন্ম, ১৯৫৬ সালে বিখ্যাত সাহিত্যিক টেড হিউজের সঙ্গে বিবাহ আর দুই সন্তানের জননী হওয়ার পর ১৯৬৩ সালে আত্মহত্যা করেন। দাম্পত্যের চিড় ফাটল ক্রমশ চওড়া হয়ে হয়ে অশান্তির হাঁ মুখ তাকে গিলে নিয়েছে।
‘মর্নিং সং’, ‘থ্রি উইমেন’-এর ‘মনোলোগ ফর থ্রি ভয়েসেজ’, ‘দ্য নাইট ড্যান্সেস’, ‘ক্রসিং দ্য ওয়াটার’ কবিতায় তাঁর নিজস্ব ঘরানা সৃষ্টি করেছেন। তবে তিনি আজীবন বিষাদমগ্ন ছিলেন এবং সেটিই ছিল তাঁর সৃষ্টির উৎস। অত্যন্ত প্রতিভাময়ী এই কবি তাঁর ‘দ্য কলোসাস অ্যান্ড আদার পোয়েমস’, ‘অ্যারিয়েল’, ‘টিউলিপস’ প্রভৃতি কাব্য সংকলনে স্বীকারোক্তিমূলক কাব্যধারার চর্চা করেন। তাঁর ‘ড্যাডি’ কবিতায় অনুভূতির কী সরল ও অসামান্য প্রকাশ ঘটেছে– সেখানে আছে ক্রোধ ও কষ্ট, আছে মনের আনন্দ ও পীড়নের দ্বৈত চিত্র। তাঁর মৃত্যুর কিছু পূর্বে লেখা আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘দ্য বেল জার’ বিশ্ব সাহিত্যের এক মূল্যবান সম্পদ। তাঁর ছোটগল্পগুলো এখনও সমান আকর্ষণীয়। মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হন এই কবি।
কী আশ্চর্য! দুই কবির আয়ুষ্কাল মাত্রই ৩০-৩২ বৎসর। দু’জনেই নিজের ধারা তৈরি করেছেন। দু’জনেই প্রতিভাময়ী। দু’জনের জীবনসঙ্গীই সাহিত্যিক, তবু তাঁদের জীবন বিড়ম্বিত হয়েছে। দু’জনেই এখনও পঠিত, আদৃত হচ্ছেন বিশ্বসাহিত্যে। মৃত্যু তো তাঁদের থামাতে পারেনি। তাঁদেরই চেতনার রং ধারণ করে জ্বলেছে আলো– পুবে-পশ্চিমে। আমরা চোখ মেলেছি আকাশে– আমরা শুনছি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এই দুই নক্ষত্রের সংলাপ।
………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………….