আমার প্রিয় রং লাল, হয়তো, আমি বামপন্থী বলে, হয়তো, আমি মানুষের পক্ষে বলি, আমি একসময়, শুধুমাত্র কালো ও সাদার বড় বড় ক্যানভাসে নানা ঘটনা ঘটাতাম। বিশাল কালো আকাশ, বিস্তৃর্ণ তৃণভূমি জেগে আছে, ধূসর সমুদ্র, ঢেউ এর পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে, হঠাৎ দেখা গেল এক ফোঁটা লাল, নৌকা, সেখানে দুলছে, লাল, আবেগ, প্রেম, ভালবাসা, উষ্ণ স্পর্শ, সবই দুলতে লাগল।
ঘটনাটা মে মাসের গোড়ার। ১৮৮৬ সাল। শিকাগো শহরের, হে মার্কেট। প্রায় ৩০-৪০ হাজার শ্রমিকের জমায়েত। দিনে ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের জন্য আন্দোলন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ। ভয়ংকর রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। একজন শ্রমিক সাদা কুর্তা পরে, এগিয়ে গিয়েছিল প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরে, পতাকা ধরে। হঠাৎ গরম ধাতুর বুলেট তার শরীর বিদ্ধ করে। মুহূর্তেই রক্তে ভিজে ওঠে সেই সাদা কুর্তা। স্বাভাবিকভাবেই সেই সাদা হয়ে যায় লাল। তিনি, সেই শ্রমিক, তার পোশাক খুলে উন্মুক্ত বক্ষে, সেই পতাকার দণ্ড যে বেঁধে দেন, আজ থেকে ১৩৯ বছর আগে, লাল পতাকার জন্ম হল, বামপন্থা, প্রতিবাদের রং হল লাল। যার শুরু হয়েছিল হে মার্কেটে।
এই লাল অবশ্য, দেশে দেশে, মুক্তির রং হিসেবে, ছড়িয়ে পড়লেও, তার রং, ফ্যাকাশে হতেও সময় লাগেনি। ঘন লাল, মাঝারি লাল, হালকা লাল, গোলাপি লাল, আগ্রাসী লাল, একসময় সাম্রাজ্যবাদী লালও হয়ে ওঠে, একনায়ক লাল, ফ্যাসিস্ট লাল– এমনভাবেই লাল তার এক ধরনের রাজনৈতিক চেহারা নিল, আমরা দর্শক বনে গেলাম।
আমার খুব ছোটবেলায়, লাল রং ছিল আতঙ্কের রং, কারণ নানা রকম। একবার, বঁটিতে আঙুল দু’-টুকরো হয়ে যায়। সাবানের গোলা কাটতে গিয়ে। বেশ ভয়ংকর মজার ব্যাপার। নিজেই নিজের আঙুল কাটি, অবশ্য তা জোড়াও লাগে, আশ্চর্যভাবে। আজও তার চিহ্ন বহন করছি। ওইরকম, লাল রক্ত, মেঝে ভেসে যাওয়া, দেখে বিস্মিত হয়েছি। নিজের শরীরের লাল রক্ত।
এরপরের লাল আতঙ্ক, পেনের লাল কালির আঁচড়। কাকা ছিলেন শিক্ষক, স্কুলে পড়াতেন, বাড়িতে পরীক্ষার খাতা আসত, আমাদের ছোটদের হাতে ভার পড়ত, ওই উত্তরপত্রের সংশোধন করে নম্বর দেওয়া ইত্যাদি। তা করতে হত লাল পেনে। তখন ঝরনা কলমের যুগ, পাঁচের দশক। ভুল মানেই লাল দাগ। সারা জীবন লাল তাড়া করল। ভয়ে ভয়ে থাকি কোথায় কোন কথা ভুল লিখে ফেললাম, লাল দাগ পড়বে! কাকাও চলে গেছে, আজ পরীক্ষার খাতার আতঙ্ক, স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে। পরীক্ষার ভয়, উত্তর ভুলে যাওয়া, পড়ার যথাযথ প্রস্তুতি না থাকার ভয়, ইত্যাদির শেষ নেই। লাল কিন্তু এত নির্মম নয়। আমরা মানসিকভাবে শুধু শুধুই বিপর্যস্ত হই। রং সবসময় বহু সংবাদ গায়ে মেখে রাখে। লাল রং বহু দূর থেকে দেখা যায়। সমুদ্রের জলযানগুলো, লাল, গালা দিয়ে রাঙিয়ে তোলার রেওয়াজ আছে। নীল সমুদ্রের ভিতর যাতে তা হারিয়ে না যায়। পাহাড়ের অভিযাত্রীরাও লাল ব্যবহার করে, ওই একই কারণে, চোখে পড়ার জন্য। আগুন লাল। গোলাপ লাল, সিঁদুর লাল, আলতা লাল, আর প্রতিটা লাল তার নিজস্ব, আবেগ, কাহিনি, নানা ভাবের কথা বলে যায়। লাল আগুন, উত্তাপ ছড়ায়। দূর থেকে নিশানা দেয়। তার লেলিহান শিখা, সাপের ফনার মতো হয়ে হিস্ হিস্ করে অন্ধকার আকাশে ফণা মেলে।
চিতার লাল আগুন, আত্মীয় বিয়োগ, বিচ্ছেদের কথা বলে। বাগানে লাল গোলাপ, ভোরের শিশির মেখে, ভোরের নরম আলোয়, যেন স্নান করে ওঠা, হাওয়ায় সামান্য দুলতে থাকে। তার গন্ধে, মৌমাছি ঘুরপাক খায়। তুলতে গেলে, হাতে কাঁটা বেঁধে। নতুন বিবাহিত, একমাথা লাল সিঁদুর মেখে, লজ্জায় মুখ ঢেকে, ঘোমটা টেনে যায়। ধীর পায়ে, ঘরে ঢোকে, চৌকাঠ পার হয়। বিবাহও লাল যেন, তাকে বৃত্তাকারে ঘিরে রেখেছে। লাল বেনারসী। লাল চোলি, লাল ফুলের মালা, লাল পলা হাত ভর্তি, লাল ফরাস, লাল সিঁদুর কৌটো, লাল ঠোঁট। লাল টিপ। পা ভর্তি লাল আলতার আলপনা। লাল জীবনের প্রতীক বনে গেল। প্রেমের প্রতীক বনে গেল।
লাল এইখানে আমাদের নিশ্চিন্তি দেয়। হাতে হাত রাখে। সূর্যের সাতরঙের সবচেয়ে উজ্জ্বল রঙ লাল। যার বিপরীত আঁচে সবুজ। অনেকক্ষণ লাল রঙের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, হঠাৎ চোখ সরিয়ে নিলে, চোখে সবুজই ভেসে ওঠে। আইজ্যাক নিউটন, এই রঙের চাকা, বা কালার হুইল আবিষ্কার করেন। সূর্যের আলোর রং বিভাজন করেন। আমরা তখন থেকেই জানতে পারি, রং-এর পারস্পরিক প্রভাব, মিশ্রণ ও নিজস্বতা। উষ্ণ রং ও শীতল রং। লাল উষ্ণ রং, হয়ে আমাদের তাপ দেয়। তাই এ জীবন!
আমার প্রিয় রং লাল, হয়তো, আমি বামপন্থী বলে, হয়তো, আমি মানুষের পক্ষে বলি, আমি একসময়, শুধুমাত্র কালো ও সাদার বড় বড় ক্যানভাসে নানা ঘটনা ঘটাতাম। বিশাল কালো আকাশ, বিস্তৃর্ণ তৃণভূমি জেগে আছে, ধূসর সমুদ্র, ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে, হঠাৎ দেখা গেল এক ফোঁটা লাল, নৌকা, সেখানে দুলছে। লাল, আবেগ, প্রেম, ভালবাসা, উষ্ণ স্পর্শ, সবই দুলতে লাগল।
এই লাল একসময়, বিশাল ক্যানভাস জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল, দু’হাত মেলে সামনে দাঁড়াল। মনে পড়ে, বহু বছর আগে, একটা কালো জানালার, গরাদের ওপর ঝুলছিল একটা লাল পর্দা। দমকা হাওয়ায় সে সেদিন উড়ে গিয়েছিল, এই কাজটা বহুদিন আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছিল। ওই লাল পর্দাই, পুরো ক্যানভাস ঘিরে ফেলে। জেগে ওঠে কালো আঁচড়। আমার সাম্প্রতিক লাল ক্যানভাস থেকে কালো অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল, অঝোর ধারায়। লাল বেদনা।