পেশাদারি-ভিত্তিতে অভিনয় করার চ্যালেঞ্জ নিয়েই ১৯৭১-এ শুরু হল নান্দীকারের রঙ্গনা-পর্ব। সেখানে জমিয়ে তুললেন ‘তিন পয়সার পালা’। কিন্তু পেশাদার মঞ্চের খিদে যে হাতির পেট— তার রোজ রোজ হল ভর্তি দর্শক চাই। অজিতেশ পেশাদার হয়ে ওঠার সাধনায় ফিল্ম-কেরিয়ারকে আরও বেশি আঁকড়ে ধরলেন। ‘সমঝোতা’ করতে ছুটলেন বোম্বে। একদিকে বালতি-পোঁতা সংসারের হাঙরের খিদে, অন্যদিকে দলের মধ্যে শুরু হওয়া আদর্শগত মতদ্বন্দ্ব— একা নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর হয়ে যাওয়া অজিতেশ!
কুলটি হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর কোলিয়ারিতে চাকরিরত দরিদ্র পিতা তাঁকে বলেছিলেন, ‘পাস তো করলে, এবার কোলিয়ারিতেই চাকরি নিয়ে নাও।… এখানকার বড়বাবু হয়ে যাওয়াটা তোমার পক্ষে কোনো ব্যাপারই না।’ কৈশোর-উত্তীর্ণ অজিতেশ সেদিন পিতার কথা শোনেননি, কয়লা-ক্ষেত্রের শ্রমিক-শোষণের বিরুদ্ধে ততদিনে সেই কিশোরের মনে জমে উঠেছিল অসন্তোষের পাহাড়। ‘চাকরি না করো, তাহলে অন্তত স্টোন্চিপ্সের ব্যবসা করো, ওতেও প্রচণ্ড লাভ’— পিতার এই পরামর্শও তিনি শুনলেন না। বাড়ির অমতে গিয়েই আসানসোল কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্সে ভর্তি হলেন। এই কলেজ-জীবনেই তাঁর নাট্যচর্চার শুরু। এই কলেজেরই বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উদ্যোগ-আয়োজনে নেমে তাঁর প্রথম শম্ভু মিত্রকে সামনে থেকে দেখা। তবে শম্ভু মিত্র নন, মফস্সলের ক্ষুদ্র জগতের বাইরে বৃহত্তর জীবনের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মন্ত্র তাঁকে দিয়েছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী, তিনি তাঁকে বলেছিলেন, ‘অজিত, এই মফস্সল শহর তোমার উপযুক্ত জায়গা নয়, তুমি কলকাতায় যাও। কলকাতার জীবনের একটা বহমান স্রোত আছে, সেই স্রোতের একেবারে মাঝখানটাতে গিয়ে পড়ে, তবেই লড়াই করে কিছু আদায় করতে পারবে জীবন থেকে।’
ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বর্ধমান রাজ কলেজে আইএসসি-তে ভর্তি হয়ে কিছুদিন বর্ধমানে কাটানো। সে পড়া শেষ না করেই, বৃহত্তর মহাজীবনের ডাক শোনা সেই যুবক পকেটে সামান্য ক’টা টাকা সম্বল করে সব ছেড়েছুড়ে কলকাতায় পাড়ি দিলেন— শুধু সেই একার মহাজীবনকে খুঁজবেন বলে। এই বিরাট অচেনা শহরে মফস্সলের শিকড় উপড়ে উঠে আসা একা এক সদ্য যুবক। দুটোদিন হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কাটিয়ে, এর-ওর মুখে শুনে রাজাবাজারের এক বস্তির গলিতে মাসে ছ’-টাকা ভাড়ায় একচিলতে মাথা গোঁজার ঠাঁই নিলেন। পকেটে তখন সিকি পয়সা সম্বল। যুবকটি জীবিকার সন্ধানে সারাদিন স্টুডিও পাড়ায় চক্কর কেটে, কোনও দিন ফুটপাতে দুটো রুটির সঙ্গে ফাউ গোরুর নাড়িভুঁড়ির ছেঁচকি খেয়ে, কিংবা পয়সার অভাবে কোনও দিন কিচ্ছুটি না খেতে পেয়ে, কলেরায় ভুগে, কিছুদিন বেলেঘাটার আইডি হসপিটালে কাটিয়ে, অবশেষে দু’-একটি পত্রিকায় লেখালিখির কাজ পেলেন। হাতে একটু টাকা আসতেই রাজাবাজারের বস্তি ছেড়ে উঠে এলেন পাতিপুকুর বস্তিতে, বেশ ক’টা টিউশনিও জুটিয়ে নিলেন, তারপর ভর্তি হলেন শ্যামবাজারের মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজে।
শুরু হল তাঁর নতুন জীবনসংগ্রাম। কলেজে পড়াকালীনই কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে পার্টির কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হলেন। যোগ্যতার নিরিখে পার্টির দমদম লোকাল কমিটির সেক্রেটারিও হলেন। পাশাপাশি গণনাট্যের নাট্যকর্মী হিসেবেও বছর চারেক সক্রিয়ভাবে নাট্যচর্চা চলতে লাগল। গণনাট্যের জন্যই লিখলেন ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ ও ‘কয়লার রঙ কালো’ নামে দু’টি নাটক। অজিতেশ তখনও ‘অজিতেশ’ হয়ে ওঠেননি, তবে কলেজের সহপাঠীদের চোখে তখন তিনি এক আশ্চর্য বিস্ময় যুবক। কলেজ পাস করে অজিতেশ দমদমের একটি স্কুলের হেডমাস্টারির চাকরিতে ঢুকলেন, যদিও বেশিদিন থাকতে পারলেন না তিনি সেই চাকরিতে, ইস্তফা দিলেন। তারপর হঠাৎই এই প্রতিভাবান যুবকের এলোমেলো জীবনটাকে ঠিকমতো গুছিয়ে রক্ষা করার নৈতিক দায় থেকে তাঁরই পূর্বপরিচিত— একাধিকবার জেলখাটা পার্টির সক্রিয়-সহকর্মী, তাঁর থেকে বয়সে অন্তত আট-নয় বছরের বড়— লিলি অজিতেশকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। একপ্রকার বাধ্য হয়েই সে বিয়েতে রাজি হলেন তিনি। তখন ১৯৬০। বিয়ের পর পাতিপুকুরের বস্তি ছেড়ে শ্যামবাজার ট্রামডিপোর উল্টোদিকে লিলির ঘরে ঠাঁই হল অজিতেশের। বাগুইআটির একটি স্কুলে আবারও পেলেন শিক্ষকতার চাকরি। এবার শুরু হল অজিতেশের সংসারজীবন।
প্রতিভা বাঁধা পড়ল সংসারে। অথচ সংসারকে ঘিরে চারপাশে জমতে থাকা তেল-কালি-আবর্জনার স্তূপ থেকে মুক্তিই তো খুঁজছিলেন তিনি। এই সময়েই ১৯৬০-এ কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নান্দীকার’। ক্রমশ নান্দীকারই হয়ে দাঁড়াল তাঁর একমাত্র মুক্তির জায়গা। নিজেকে ঢেলে দিলেন থিয়েটারের কাজে। থিয়েটারের জন্য শিক্ষকতার চাকরি ছাড়লেন, ছাড়লেন পার্টিও। কলকাতার অন্যতম প্রধান গ্রুপ হিসেবে নান্দীকারকে প্রতিষ্ঠা দিলেন। প্রতিভার বিচ্ছুরণ থিয়েটার-পাড়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছল টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায়। এবং সেখান থেকে বোম্বে। ‘অতিথি’ ও ‘হাটে বাজারে’ তাঁকে এনে দিল ভারতজোড়া খ্যাতি। কিন্তু তাঁর খ্যাতি ও ব্যস্ততার মাঝে বাধা হায়ে দাঁড়াল সেই সংসার। স্ত্রী লিলির মনে সন্দেহ, ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা সংসারকে ক্রমশ বিষিয়ে তুলল। দু’দিন পরেই নতুন আর এক অভিশাপ নেমে এল তাঁর জীবনে— ‘হঠাৎই বাবা মারা গেলেন, ঝপ্ করে কাঁধে এসে পড়ল দশ এগারো জনের একটা বিশাল ফ্যামিলিও। তিনটে অবিবাহিত বোন…।’ ফের বাড়ি বদল, উঠে এলেন বাগবাজারের রামকান্ত বোস স্ট্রিটের আড়াইখানা ঘরের বাড়িতে। এতগুলো মানুষের ভাত-কাপড় ও অন্যান্য সমস্ত দায়-দায়িত্ব মাথায় নিয়ে অজিতেশকে এবার টাকার পিছনে দৌড়তে হল। মধ্যবিত্তের নেশার থিয়েটারের নির্দেশক-কাম-অভিনেতা হয়ে বিরাট যশ-খ্যাতি-পুরস্কার-সম্মাননা বাগিয়ে তাঁর প্রয়োজন কি মিটবে? সংসারের খিদে মেটানো যাবে? তবে কি এবার অভিনয়কে পেশা করে তোলার ভাবনা তাঁকে পেয়ে বসবে?
শুরু হল পেশাদার হয়ে ওঠার লড়াই— পেশাদারি-ভিত্তিতে অভিনয় করার চ্যালেঞ্জ নিয়েই ১৯৭১-এ শুরু হল নান্দীকারের রঙ্গনা-পর্ব। সেখানে জমিয়ে তুললেন ‘তিন পয়সার পালা’। কিন্তু পেশাদার মঞ্চের খিদে যে হাতির পেট— তার রোজ রোজ হল ভর্তি দর্শক চাই। অজিতেশ পেশাদার হয়ে ওঠার সাধনায় ফিল্ম-কেরিয়ারকে আরও বেশি আঁকড়ে ধরলেন। ‘সমঝোতা’ করতে ছুটলেন বোম্বে। সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কারের পাঁচ হাজার টাকায় বোনের বিয়ে সম্পন্ন হল। মুশকিল হল, সিনেমার দর্শক তাঁকে ভিলেন রূপেই দেখতে চাইছেন। অজিতেশ মজার ছলে ভাবছেন— ‘আবছা ডানদিকের চোখটাকে সেলাই করে পার্মানেন্টলি ভিলেনের চোখের মতো বানিয়ে নিলে কেমন হয়?’ একদিকে বালতি-পোঁতা সংসারের হাঙরের খিদে, অন্যদিকে দলের মধ্যে শুরু হওয়া আদর্শগত মতদ্বন্দ্ব— একা নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর হয়ে যাওয়া অজিতেশ! যেন সমস্ত জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে তাঁর। ক্রমশ ভাগ্য তাঁকে নিয়ে এ কী নিষ্ঠুর খেলা খেলছে— এই বৃহত্তর মহাজীবনকে ছুঁতেই কি তিনি একদিন সর্বস্ব ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন?
ঠিক এমন সময়েই অজিতেশ বন্ধু হিসেবে পেলেন বাগবাজারের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী, একদা তাঁরই সহপাঠী-বন্ধু অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী, তাঁরই মতো সংসারে অসহায়, আউটসাইডার, একটি সন্তানের মা— রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়কে। নিঃসঙ্গতা আর অসহায়তাই ক্রমশ দুই নারী-পুরুষকে মানসিকভাবে কাছে নিয়ে আসে, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। তারপর একদিন সমস্ত লোকলজ্জা ভুলে, মধ্যবিত্তের যাবতীয় সংস্কারের ক্ষুদ্রতা তুচ্ছ করে, উপড়ে ফেলে, মধ্যরাত্রে ভরা সংসার ছেড়ে এক কাপড়ে দুই নারী-পুরুষের রাস্তায় এসে পাশাপাশি দাঁড়ানো। এরপর কখনও হস্টেল-বোর্ডিং, হোটেল কিংবা পরিচিত-অপরিচিত বন্ধুদের বাড়িতে কাটিয়ে অজিতেশ ও রত্না অবশেষে সংসার পাতলেন বেলেঘাটার পি ৮৩, সি আই টি রোডের বাড়িতে। এই ঘরই শেষ পর্যন্ত থিতু হওয়া অজিতেশের জীবনের শেষ ঠিকানা, বিবাহ-সম্পর্কহীন দুই নারী-পুরুষের বিশ্বস্ত সংসার।
সাতের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে অজিতেশ প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন এমন একটি ভাবনায় যে, গ্রুপ থিয়েটারকে বাঁচতে গেলে তাঁর পেশাদার হওয়া ছাড়া উপায় নেই। থিয়েটার-সিনেমা-বেতার-যাত্রাজগৎ– এসবই তাঁকে করতে হয়েছে শুধু অর্থের তাগিদে। মধ্যবিত্তের থিয়েটার শখ মেটাতে পারে, পেট ভরাতে পারে কি? তাহলে নাট্যকর্মীর পক্ষে নিজেকে একশো শতাংশ নিংড়ে দেওয়া কতদিন সম্ভব? কীভাবে সম্ভব? বিভিন্ন লেখায় বক্তৃতায় সাক্ষাৎকারে নানা সময়ে সেসব কথাই তিনি বলেছেন, ‘থিয়েটার মধ্যবিত্তদেরই খেলনা’ এবং ‘শ্রেণী হিসেবে মধ্যবিত্তের মধ্যে গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত থাকা আজকাল একটা ফ্যাশানের অন্তর্গত, কারণ এতে বেশ গ্ল্যামার বাড়ে।’ কখনও বলেছেন, ‘গ্রুপ থিয়েটারের মধ্যে একটা চালাকি আছে। সেটাই মধ্যবিত্তের চালাকি।… এক ধরনের আপস মানতে মানতে এগিয়ে চলা, তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে ফুরিয়ে যাওয়া এবং অবশেষে হতাশা প্রচার করা।’ বস্তুত, থিয়েটার নিয়ে মধ্যবিত্তের চালাকি আর গ্ল্যামারের লোভনীয় জগৎকে তিনি যে রিজেক্ট করতেই চেয়েছিলেন, তার পিছনে ছিল সেই বৃহত্তর মহাজীবনকে ছোঁয়ার স্বপ্ন। যে-স্বপ্ন শিক্ষক প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী তাঁর আঠারো-উনিশের বুকের মধ্যে এঁকে দিয়েছিলেন, অজিতেশকে তাই-ই যেন তাড়া করে বেরিয়েছে সারাটা জীবন। মধ্যবিত্তের নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার সংসারের চার-দেওয়াল আর প্রসেনিয়ামের ছোট্ট খোপে তাঁকে এঁটে রাখার সাধ্য কলকাতার এলিটদের ছিল না। সেই চার-দেওয়াল আর বাক্সের মধ্যে বাঁধা পড়া অজিতেশ চিরটাকাল দেওয়ালগুলো ভাঙতেই তো চেয়েছিলেন। কী আশ্চর্য তাঁর ট্র্যাজিক জীবন, একের পর এক দেওয়াল ভাঙতে চাওয়ার মধ্য দিয়েই একদিন নিঃশেষ হয়ে গেল তাঁর জীবনীশক্তি, গড়তে চাওয়ার স্বপ্নগুলো সেভাবে পাখা মেলার অবকাশ পেল কই!
স্কুল গড়ার কাজে উমাদির সঙ্গে নিরঞ্জনবাবু ছিলেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। স্কুল নিয়ে দু’জনের মধ্যে তর্ক-বিতর্কও হত খুব। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বুঝতেন স্কুল নিয়ে কতখানি প্যাশন ছিল দু’জনের মধ্যে সেসব তর্কে। স্কুলের কাজে চিনুদা প্রত্যক্ষভাবে জড়াননি, কিন্তু তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল।