লোকালে ভিড়ের সময়ে সাধারণ কামরার চেয়েও মহিলা কামরায় ভিড় অনেক সময়েই বেশি হয়। সহ-নাগরিকদের বলব, গত কয়েক বছরে রেলের অব্যবস্থা, ব্যস্ত সময়ে অতিরিক্ত বিলম্ব হওয়া বা ট্রেন বাতিল হওয়ার সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই সমস্ত যাত্রীদেরই ভোগান্তি বেড়েছে। সেখানে, বিশেষত পুরুষ-যাত্রীদের– ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো, ভিড় সময়ে আরও ঘনঘন ট্রেন চালু করাটাই দাবি হওয়া উচিত ছিল নাকি? কিন্তু তা না হয়ে মহিলা কামরার ওপর পুরুষদের ক্ষোভ এসে পড়ল কেন? মহিলা কামরা কি কোনও বাড়তি সুবিধা? নাকি প্রতিনিয়ত কিছু পুরুষের কুদৃষ্টি-কুস্পর্শ এড়ানোর জন্য সামান্য মুক্ত একটা পরিসর? নিরাপত্তার যৎকিঞ্চিৎ একটি ব্যবস্থা?
২০১০ সালে শিয়ালদহ ও হাওড়া ডিভিশনে ‘মাতৃভূমি লোকাল’ চালু হয়েছিল মহিলা যাত্রীদের সুবিধার্থে। যদিও তা সম্পূর্ণ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ছিল না। তিনটি কামরা সংরক্ষিত ছিল সাধারণ যাত্রীদের জন্য। এবার আরও কয়েকটি কামরা সাধারণ যাত্রীদের জন্য বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নিল রেল।
যাত্রাপথে যৌন ও মৌখিক হেনস্তা, অবাঞ্ছিত স্পর্শ ও আচরণ টপকে নিত্যদিন যাতায়াত করেন মহিলারা। ট্রান্স-মানুষদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। তাদের ক্ষেত্রে দৃষ্টি আরও কটু, আচরণ আরও উগ্র। সাধারণ কামরায় মেয়েদের যাত্রা করতে হয় বুকে ব্যাগ চাপা দিয়ে, চোখ নামিয়ে! যেন কেউ দেখছে না, এমন ভাব করতে হয়! কারণ, ‘কেউ দেখছে না’– এমনটা কখনওই হয় না। চোখ তুলে তাকালেই দেখি, কেউ-না-কেউ, কোথাও-না-কোথাও আমাদের ‘ভোগ্যবস্তু’ হিসেবে দেখে চলেছে। না, এই দৃষ্টির জন্য কোনও শাস্তি নেই। কিন্তু প্রায় নিত্যদিন, হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন! প্রায় প্রত্যেক দিনই এই দৃষ্টিই অকস্মাৎ আমাদের শরীরের বিশেষ অংশে নোংরা স্পর্শ হয়ে ওঠে! এ ঘটনা এত সংখ্যায় এবং এমন ‘স্বাভাবিক’ ভাবে ঘটে যে, বেশিরভাগ সময়েই প্রতিবাদ করবার উপায় থাকে না, একরকম উপেক্ষা করেই চলতে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই ভোগ্যবস্তু-স্বরূপ শরীর নিয়ে জন্ম না হলেই বোধ হয় ভালো হত! মনে পড়ে চম্বল-দস্যু ফুলন দেবীর কথা। পুরুষ ডাকাতদের কী যেন এক অমানুষিক জোরে কুপোকাত করে জীবন বাঁচিয়েছিলেন নিজের ও পরিবারের– এমনই শোনা যায়! এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, পরের জন্মে এই নারী শরীরটা আর চাই না, নারী হয়ে জন্মাতে চাই না!
আমাদের মতো ট্রান্স-মানুষদের অবশ্য ‘সমাজ’ এটুকুও ‘স্বীকার’ করে না। আমাদের ক্ষেত্রে অনেক ‘স্বাভাবিক’ ভাবেই শরীরে হাত দেওয়া বা স্পর্শ করা যেন নিয়মের মধ্যে পড়ে! মনের আনন্দে কারও অবদমিত যৌনক্ষুধা, যতটা সম্ভব মিটিয়ে নিতে কেউ যা খুশি করতে পারেন আমাদের নিয়ে– এটাই সমাজের দস্তুর। চিৎকার করে প্রতিবাদ করলেও ন্যূনতম কর্ণপাত করার ‘গণতান্ত্রিকতা’টুকু সিংহভাগের থেকেই পাওয়া যায় না। আমরা ‘গড়পড়তা মানুষ’ হিসেবেই স্বীকৃত নই যে! হ্যাঁ, মানুষ হিসেবে আমাদের ধরে নেওয়া হয় ‘গড়পড়তার নিচে’! আমাদের পরিবর্তনকামী/ পরিবর্তনশীল শরীর দৃশ্যত যে ধাক্কা দেয় সমাজের অধিকাংশ বিষমকামী মনে ও দৃষ্টিতে– তার ফলে আমাদের শরীরী উপস্থিতিটাই শুধু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভেতরের মানুষটা ‘অদৃশ্যায়িত’ (invisibilized) থেকে যায়।
এই কোতি-ধুরানি/ রূপান্তরকামী জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যা সঞ্চয় করেছি, তার থেকে একটা অপেক্ষাকৃত ‘মৃদু’ ঘটনার উল্লেখ করি–
একদিন ট্রেনে ফিরছি। কিছুটা রাত হয়েছে। আমার অপর দিকের সিটে বসে রয়েছেন একটি দৃশ্যত স্বচ্ছল পরিবার। সালংকারা এবং দামি পোশাক-পরিহিত। বিয়েবাড়ি থেকে ফেরার গল্পে তারা মশগুল। হঠাৎ আমাকে দেখে তাদের মধ্যে গুঞ্জন, ফিসফাস, কানাকানি শুরু হল। যা স্বাভাবিকভাবেই আমার মনকে ক্ষণিকের জন্য বিষণ্ণ করে তুলল। এমনিই আমরা ট্রান্স এবং প্রান্তিকায়িত যৌনতার মানুষরা বহু সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে বাদ যাই, আমাদের প্রান্তিকায়িত লিঙ্গযৌনতাভুক্ত পরিচিতির কারণে। তারপর রাতের ট্রেনে একা সঙ্গীহীন ফেরার সময়ে এমন উচ্চবিত্ত বিষমকামী মানুষদের শ্লাঘায় ভরা তাচ্ছিল্যের চাহনি যেন বুঝিয়ে দেয়– আমরা কতটা অপদার্থ, অসহনীয়, অকৃতকার্য এবং অস্বীকৃত!
কিন্তু এর পরের ঘটনাক্রম আমার চোখ খুলে দিয়েছিল অনেক দিক থেকে। গুমরে মরতে মরতেও বাঁচার যে কয়েকটা চিরন্তন রসদ আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করি, তার মধ্যে এটা একটা। পরের অংশটি এরকম–
দরজার পাশে একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবার বসেছিল। আমি উঠে গিয়ে দরজার পাশে দাঁড়াই এবং তারা নিজে থেকেই আমার সঙ্গে কথা শুরু করে এবং অদ্ভুত এক স্নেহ-ভালোবাসা ও সম্প্রীতির আদানপ্রদান হয়। এ সুখ-দুঃখ বিনিময় আসলে দুই প্রান্তিকায়িত জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার বিনিময়। আসলে এই দরিদ্র মুসলিম মানুষগুলোও লক্ষ করেছিল ওই উচ্চবিত্ত পরিবারটির ভ্রুকুঞ্চিত চাহনি। তারা নিজেদের জীবনের প্রান্তিক অবস্থান ও অবদমন দিয়ে আমার প্রান্তিক অস্তিত্বকে চিহ্নিত করতে পেরেছিল। আপন করে নেওয়ার এমন অভিজ্ঞতা খুব কমই হয়। তাই গভীর দাগ কেটেছিল মনে। স্পর্শ করেছিল আমার অস্তিত্ব ও অন্তরাত্মাকে। জানি না, এ যাত্রাপথে ওদের সঙ্গে দেখা হবে কি না আর, তবে আমি নিশ্চিত এমন চিরন্তন মানবিকতার সঙ্গে আবারও দেখা হবে, হতে থাকবে, নিশ্চয়ই নতুন কোনও সমাজ অপেক্ষা করে আছে আবিষ্কার হওয়ার, যেখানে এমন মানবিক স্পর্শ প্রকৃত ভালোবাসারই এক রূপ। কোনও অনভিপ্রেত স্পর্শ নয়…।
যাই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি। এইরূপ পরিস্থিতিতে রেলের তরফে নারী নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য আলাদা পরিকাঠামো দেওয়া খানিক স্বস্তি তো বটেই। কোনও ভিড়ঠাসা ‘সাধারণ’ কামরায় ওপরের ঘটনার মতো ইতিবাচক অভিজ্ঞতা কি হতে পারত আমার? প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের কাছেও এই স্পেশাল ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়া ও দৃষ্টি এড়িয়ে একটু শান্তি ও সুরাহা নিয়ে ট্রেনযাত্রার সুযোগ।
এই অবস্থায় যখন মহিলা ও প্রান্তিক লিঙ্গের নিত্যযাত্রীর সংখ্যাই ক্রমবর্ধমান, তখন মহিলা স্পেশাল ট্রেনে সাধারণ যাত্রীদের সংরক্ষণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যেন উল্টোপুরাণ। পাশাপাশি আরও যা দুশ্চিন্তা ও পরিতাপের বিষয়, তা হল– সাধারণ লোকাল ট্রেনে মহিলা-কামরার সংখ্যা দুই থেকে তিন করায় (এরকম ঘটনা মহিলা স্পেশাল ট্রেন শুরুর সময়েও ঘটেছিল) বিক্ষোভ দেখালেন বিশেষত পুরুষ যাত্রীরা। যুক্তি– পুরুষ-যাত্রীদের পরিসর কমছে, ভিড়ে ভোগান্তি বাড়ছে!
অভিজ্ঞতা বলে– লোকালে ভিড়ের সময়ে সাধারণ কামরার চেয়েও মহিলা কামরায় ভিড় অনেক সময়েই বেশি হয়। সহ-নাগরিকদের বলব, গত কয়েক বছরে রেলের অব্যবস্থা, ব্যস্ত সময়ে অতিরিক্ত বিলম্ব হওয়া বা ট্রেন বাতিল হওয়ার সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই সমস্ত যাত্রীরই ভোগান্তি বেড়েছে। সেখানে, বিশেষত পুরুষ-যাত্রীদের– ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো, ভিড় সময়ে আরও ঘনঘন ট্রেন চালু করাটাই দাবি হওয়া উচিত ছিল নাকি? কিন্তু তা না হয়ে মহিলা কামরার ওপর পুরুষদের ক্ষোভ এসে পড়ল কেন? মহিলা কামরা কি কোনও বাড়তি সুবিধা? নাকি প্রতিনিয়ত কিছু পুরুষের কুদৃষ্টি-কুস্পর্শ এড়ানোর জন্য সামান্য মুক্ত একটা পরিসর? নিরাপত্তার যৎকিঞ্চিৎ একটি ব্যবস্থা? সেটুকুও কেড়ে নেবেন? কবে বুঝবেন– এই লিঙ্গ-হিংসাদীর্ণ, ধর্ষকাম মনোবৃত্তিপূর্ণ সমাজে আপনাদের কাছে যা ‘মুক্ত’ (free) হওয়া– মহিলা কামরাকে পুরুষের জন্য খুলে দেওয়া বা ‘জেনারেল’ করে দেওয়া, আমাদের কাছে তা আসলে ‘বন্দি’ হওয়ার নামান্তর?
……………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………..
যেদিন সমাজ লিঙ্গ-হিংসাশূন্য হয়ে উঠবে, মহিলা ও প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষের শরীর ‘যৌনবস্তু’ হয়ে থাকবে না, সবার চোখে আমরা ‘মানুষ’ হয়ে উঠব, প্রকৃত মুক্ত সমাজ গঠন করতে পারব, কথা দিলাম, নিশ্চয়ই সেদিন আলাদা করে ‘মহিলা কামরা’র দরকার পড়বে না। আমরা সকলে মিলে সমস্ত কামরা ‘সাধারণ’ করে নিয়ে একসঙ্গে যাত্রায় শামিল হতে পারব।
পড়ুন লেডিস স্পেশাল-এর অন্যান্য লেখা
মৌমিতা আলম-এর লেখা: আমরা ক’জন একই ট্রেনে থাকি, সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ
রণিতা চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: আপন ভিড়ের মাঝে অপূর্ব একা
দরজার সামনে শম্ভু মিত্র, রেকর্ডিং শেষ করে সবে ফ্লোর থেকে বেরিয়েছেন। গম্ভীর মানুষ, সাহস সঞ্চয় করে কাছে গিয়ে প্রণাম করি, মাথায় হাত রাখলেন। পাশে ছিল চৈতি ঘোষাল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বাড়ির টিভিতে আমাকে দেখতে পায় তাই এই বিস্ময়, নিচু গলায় জানাল ডাকঘরের অমল।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved