হোটেলে গিয়েই পাওয়া যাবে নুডলস, চিলি চিকেন, মোমো, কাবাব– এই জানা ছিল একসময়। অবসরের ছুটির দিন বাইরে গিয়ে রাতের খাওয়া মানে একবেলা মায়ের রান্নাঘর থেকে ছুটি। ঢাকাই পরোটা, মেটে চচ্চড়ি, ফাউল কাটলেট, কবিরাজি মানে বাড়ির বাইরের খাবার– এই ভেবে অভ্যস্ত ছিলাম আমরা মধ্যবিত্তরা। বাড়িতে ধোঁকার ডালনা, পটলের দোরমা, এঁচোড়ের কোর্মা পর্যন্ত চলত। তাও রোজ রোজ নয়, বিশেষ অতিথি এলে। রোজের খাবার মানে স্বাস্থ্যকর, পরিমিত, সহজে রান্না অর্থাৎ যেখানে তেলমশলা কষা-ভাজা কম। তখনও জানতাম না, এই হালকা কালো জিরে কাঁচালঙ্কার ঝোলের খাদ্যগুণ কত।
শৈশবে আত্মীয়-স্বজনের বিয়েতে দেখতাম উপহার হিসেবে একটি করে বেলা দে-র ‘গৃহিণীর অভিধান’ এসে যাচ্ছে। বিয়ের পর যদি দেখা যেত সেটি কেউ পায়নি, তাহলে শুভানুধ্যায়ী বা আত্মীয়রা সযত্নে কিনে এনে কনেকে উপহার দিতেন। আমার মায়ের ছিল হৃষ্টপুষ্ট এক গৃহিণী অভিধান। শৈশবে মাতৃহীন, সাত বছরের সরকারি চাকরি ছেড়ে গৃহবধূ হয়ে যাওয়া মা, ওই অভিধান দেখে কিছুই যে শেখেনি বা বানায়নি তা হলফ করে বলতে পারি।
আমাদের স্কুলে নবম শ্রেণিতে অঙ্ক, বায়োলজি ও হোম সায়েন্সের যে কোনও একটি অপশন ছিল। অঙ্কে আতঙ্ক! বায়োলজি নিতে চাইলেও বিজ্ঞান নিয়ে পড়ব না বলে শিক্ষিকার প্রবল আপত্তি। ফলে হারায় তারায় কাশ্যপ গোত্র, ওই হোম সায়েন্স নিতে হল। পাশেই ছেলেদের স্কুলে এই বিষয়টি যে ছিল না, তা বলা বাহুল্য। স্কুলের পাঠ্যবইয়ের চেয়েও বেলা দে-র এই বই কাজে লাগল বেশি। বাড়ি কীভাবে সাজাব, পর্দার চাদরে মিলবেশ থাকবে কি না– এর চেয়েও চোখ গেল অরেঞ্জ মার্মালেড, ক্যারামেল কাস্টার্ড, চকলেট পুডিং-এ। মা বানায় পুডিং, কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারের সবাইকে সমচক্ষে দেখার জন্য বাসী পাউরুটির গোঁজামিল দেয়। ওদিকে বেলা দে-র বর্ণনায় কমলার খোসা কুচি দেওয়া মারমালেডের সুগন্ধ যেন বইয়ের পাতা ভেদ করে উড়ে আসত। মাকে যে বলব, বই দেখে দেখে কিমার কাটলেট বা রসগোল্লার পায়েস বানিয়ে দাও– তা কল্পনাতেও আসেনি। সে সময়টা দৈনন্দিন কাজ সহজ করার একটা চেষ্টা চলছিল। তোলা উনুন ছেড়ে গ্যাস এল। প্রেসার কুকারের ব্যবহার শুরু হল বেশি বেশি করে। গ্যাস বাঁচানো এবং সময় সংক্ষেপের দিকে নজর পড়ল গৃহস্থের। বাড়ির কাজকর্ম যথেষ্ট সরল। রোজ সকালে রুটি-ঝোলা গুড়, ছুটির দিনে লুচি আর সাদা আলুর তরকারি। দুপুরে ডাল, শুক্তো, কোনও একটা তরকারি বা ভাজা আর মাছের ঝোল। বিকেলে মুড়িমাখা। রাতে ওই দিনের খাবারের খানিকটা রিপিট।
কিন্তু ওই যে দশভুজার ধারণায় তাক লেগে গেল শিক্ষিত আর হদ্দ বোকা মেয়েদের; ওই যে বিজ্ঞাপনের আলোয় মুখ ঢেকে গেল তাদের; বাণিজ্য পত্রিকায় থরে থরে গ্যাজেট সম্ভার হাতছানি দিল আর ধরে নিল, এক চুটকিতে গৃহকন্না সুচারু ও মনোলোভা হয়ে উঠবে– সেদিন থেকে সর্বনাশের শুরু। এই অলীক হাতছানিতে সে হয়ে উঠল ১৮ ঘণ্টার কর্মময়ী। হারকিউলিসের মতো একার ঘাড়ে তুলে নিল চমকপ্রদ ভার। হোটেলে গিয়েই পাওয়া যাবে নুডলস, চিলি চিকেন, মোমো, কাবাব– এই জানা ছিল একসময়। অবসরের ছুটির দিন বাইরে গিয়ে রাতের খাওয়া মানে একবেলা মায়ের রান্নাঘর থেকে ছুটি। ঢাকাই পরোটা, মেটে চচ্চড়ি, ফাউল কাটলেট, কবিরাজি মানে বাড়ির বাইরের খাবার– এই ভেবে অভ্যস্ত ছিলাম আমরা মধ্যবিত্তরা। বাড়িতে ধোঁকার ডালনা, পটলের দোরমা, এঁচোড়ের কোর্মা পর্যন্ত চলত। তাও রোজ রোজ নয়, বিশেষ অতিথি এলে। রোজের খাবার মানে স্বাস্থ্যকর, পরিমিত, সহজে রান্না অর্থাৎ যেখানে তেলমশলা কষা-ভাজা কম। তখনও জানতাম না, এই হালকা কালো জিরে কাঁচালঙ্কার ঝোলের খাদ্যগুণ কত।
এরপরের প্রজন্মের মানবীর স্বাধীনতা এল দু’-হাত ভরে। একান্নবর্তী পরিবারের লেপ্টেজুপ্টে স্বামী-সহ এক ঘরে সংসার করার কালা দিবস ফুরল। যৌথ পরিবারে আলাদা খাবার ঘর থাকলেও ড্রয়িং রুম বলে কিছু ছিল না। বাড়ি ভরা লোক, সেখানে একটা আস্ত ঘর শুধুমাত্র সাজিয়ে-গুছিয়ে খালি ছেড়ে রাখা হবে– এমনটা মধ্যবিত্তের কল্পনায়ও ছিল না। ফলে নিত্যনতুন পর্দা বদলানো, শো-পিস চকচকে করা, ঝাড়বাতির কাচ চমকানো সাজসজ্জা, ইঞ্চি-ইঞ্চি ধুলো মোছা– এসব করতে হত না বাড়ির মেয়েদের। কেউ কেউ কাউকে দেওয়ালের ছবি নামিয়ে রোজ মুছতেন, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা কম ছিল। গৃহের পরিচ্ছন্নতা, পারিপাট্য বাদ দিয়ে বলতে গেলে গৃহসজ্জার বিষয়টিই ছিল না। সবার বাড়িতে উঠোন, এক চিলতে হলেও ফাঁকা জমি ছিল। সেখানে ফুল ও সবজি বাগান করা হত। আবার এমন ফুল যার তেমন পরিচর্যার দরকার হত না। দেশি তাগড়াই ফুল, লঙ্কা জবা, রক্ত জবা, স্থলপদ্ম, অতসী, বেলফুল, অপরাজিতা, সন্ধ্যামণি, সুগন্ধি গোলাপ বা চাঁপা, গুলঞ্চ, মাধবীলতা। এদের পিছনে বিরাট কোনও পরিশ্রম ছিল না।
সর্বোপরি সংখ্যাগুরু মেয়েরা বাড়ির কাজ করতেন, বাড়িতে থাকতেন। তাঁরা প্রত্যেকে যে একেবারে বঞ্চিত, নিপীড়িত ছিলেন এমনটাও নয়। যাঁরা একান্নবর্তী থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং চাকরিতে ঢুকলেন, তাঁরাই প্রথম স্বাধীনতার দাম উপলব্ধি করতে শুরু করলেন। লোকে জানল বউয়ের পরামর্শে কর্তামশাই আলাদা হতে বাধ্য হলেন। কিন্তু টোনাটুনির সংসারে এসে তিনি তাঁর আগের স্বভাব মোটেই বদলালেন না। কাকভোরে উঠে ঠিকে মেয়েটির জন্য দরজা খুলে দিতে হল মেয়েটিকে। কর্তা তখন আরামের পাশবালিশে শেষ ঘুমের পা তুলে রাখছেন। এবারে দৌড়বাজ গিন্নি নিয়ে এসে টকাস করে চা-বিস্কিট নামিয়ে রাখলেন। বাথরুমটা উঠোন পেরিয়ে নয়, একেবারে ঘর লাগোয়া। কর্তা আরও আয়েসি। শুধু বাজারটি তিনি মনমতো করে আনবেন। গিন্নি এবারে চরকি পাক। সকালের খাবার, টিফিন, জামাকাপড় হয় ঠিকে, নয় ওয়াশিং মেশিন, বাচ্চার ওয়াটার বটল, শেষ মুহূর্তের হোমওয়ার্ক, রান্নার মেয়েটি এলে রাত অবধি খাবারের নির্দেশ। ফ্রিজ পরিষ্কার, ওভেন, মিক্সি, ফুড প্রসেসার, ইনডাকশন, ইলেকট্রিক কেটল, টোস্টার, স্যান্ডুইচ মেকার, গিজার, এসি– যন্ত্রের মাঝে এক যন্ত্রমানবী দৌড়াতে থাকে।
……………………………
কাকভোরে উঠে ঠিকে মেয়েটির জন্য দরজা খুলে দিতে হল মেয়েটিকে। কর্তা তখন আরামের পাশবালিশে শেষ ঘুমের পা তুলে রাখছেন। এবারে দৌড়বাজ গিন্নি নিয়ে এসে টকাস করে চা-বিস্কিট নামিয়ে রাখলেন। বাথরুমটা উঠোন পেরিয়ে নয়, একেবারে ঘর লাগোয়া। কর্তা আরও আয়েসি। শুধু বাজারটি তিনি মনমতো করে আনবেন। গিন্নি এবারে চরকি পাক। সকালের খাবার, টিফিন, জামাকাপড় হয় ঠিকে, নয় ওয়াশিং মেশিন, বাচ্চার ওয়াটার বটল, শেষ মুহূর্তের হোমওয়ার্ক, রান্নার মেয়েটি এলে রাত অবধি খাবারের নির্দেশ। ফ্রিজ পরিষ্কার, ওভেন, মিক্সি, ফুড প্রসেসার, ইনডাকশন, ইলেকট্রিক কেটল, টোস্টার, স্যান্ডুইচ মেকার, গিজার, এসি– যন্ত্রের মাঝে এক যন্ত্রমানবী দৌড়াতে থাকে।
……………………………
তারপরে এসে যায় ফুড ভ্লগার। আর এক অতলান্তিক জাল ছড়ানো খাদ্য-পৃথিবীর রেসিপি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার আপনার শিশু, বালক, কিশোর ছেলেমেয়ের মাথায়। এইবার আপনার ঘর হয়ে ওঠে অর্ডারের রেস্তরাঁ, আর আপনি তার বিনি মাইনের শেফ। বিজ্ঞাপনের লোভ-জাগানো খাবার ছবিগুলি অনেকসময়ই কিন্তু খাওয়ার নয়। কৃত্রিমভাবে সাজানো, মুখে তুললে তৎক্ষণাৎ বাইরে বেরিয়ে আসবে– জানেন এখন অনেকেই। তবু ওই লোভ-জাগানিয়া খাদ্য-কৌশলের জন্য বাড়ির লোকজন ইউটিউব সংরক্ষিত করে আপনার অবসরের সময় হাতের সামনে বাড়িয়ে দেবে। আপনিও জাপান, পাপুয়া নিউ গিনি, একদা আন্দামানের বন্দিদের নিজেদের জন্য বানানো কোনও এক খাদ্যের রেসিপি দেখে পুলকিত হবেন। কোমর বেঁধে লেগে পড়বেন। তার আগে চলবে অথেনটিক মশলা সংগ্রহ। অনলাইনে সেসব চলে আসবে। কিন্তু ব্যাপারটা যত সহজে ম্যানেজ করতে পারবেন ভেবেছিলেন ততটা হবে না। বাড়ির লোক, ছবিতে যেমনটি দেখায় বা অমুক রেস্তোরাঁয় যেমন খেয়েছিলাম, তেমনটি হয়নি বলে মুখ বেজার করবে। আপনি হারবেন না মোটেই। যখন বাড়িতে কেউ নেই, এমন ব্রাহ্মমুহূর্তে মাধ্যমিক পরীক্ষার মনোযোগে পুনর্বার সেটিকে যথাযথ ভাবে পেশ করার চেষ্টা করবেন। অবশ্য একেবারেই যে কেউ নিরুৎসাহিত করবে এমন নয়, বাড়ির লোক হাত লাগাতেও পারে। কিন্তু ওই অবধি। যেভাবে আপনি সকাল থেকে নিখুঁত ‘সানি সাইড আপ’-এর চক্করে পড়েছেন, ফ্রথ ওঠা ক্রিমে ঠাসা কফি ঘুঁটে চলেছেন, তাতে আর আপনার নিস্তার নেই। যে কোনও ছুটির দিনে চলবে নিরীক্ষামূলক খাঁটি জাভাদেশীয় রান্না পদ্ধতি!
দশভুজার বদলে শতভুজা হয়ে ওঠার চেষ্টায় কোথা থেকে যেন হারিয়ে যাবে নিজস্ব সময়। যে সময়টা একান্নবর্তী পরিবারে পাওয়া যেত। বহু চাকরি-করা মেয়েকে কর্মক্ষেত্রে তার সহকর্মী বন্ধুদের বলতে শোনা যায়, ছুটির দিনটা আর বাড়িতে ভালো লাগে না। এত এত কাজ! বাড়ির সবাই ভাবে এই তো মেয়েটির আজ ছুটির দিন, সে-ই আজ বাড়ির দায়িত্ব নেবে।
মানুষ দলবদ্ধ হয়েছিল নিজের প্রয়োজনে, ফলে কমিউন বা একান্নবর্তী যে শুধুমাত্র নারী নিষ্পেষণের কারখানা ছিল না, সেটাও ভেবে দেখার। মা অসুস্থ হলে বাচ্চারা ঠিক সময়ে কাকিমার, জেঠিমার কাছে খাবার পেত। সাংসারিক কূটকচালি থাকলেও পালা করে কাজ করার একটা সুবিধা ছিল। বাচ্চার অসুস্থতায় রাত জেগে আবার পরদিন চাকরির দৌড়, বাড়ির জন্য উৎকণ্ঠা আর অন্তহীন বাড়ির কাজ ক্লান্ত করে দিতে থাকে এখনকার মেয়েদের। সঙ্গী বঙ্গ-পুরুষ কি আর বদলায়নি? খানিক বাধ্য হয়েছে নিজেকে বদলাতে, কিন্তু তা এখনও যৎসামান্য। জীবন হল ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’। হয়তো একটা কোনও স্বস্তিদায়ক সমাধান আগামী নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে খুঁজে বের করবে।
……………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved