শহরের মানচিত্র জুড়ে বহু কমিউনিটি স্কুল, অর্থাৎ বিকল্প পাঠশালা– যেগুলো জন্ম নিয়েছিল কোভিডের সময়, এখনও রয়ে গেছে এক বিকল্প আশ্রয়ের মতো। ভয়, অনিশ্চয়তা ও দায়বোধের আবর্ত থেকে মুখ ফেরাতে পারেনি সাধারণ কিছু মানুষ। তাই অতিমারীর থাবায় একটা দীর্ঘকাল ধরে স্কুল বন্ধ হচ্ছে জেনে তাঁরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়েছিলেন। যাতে পড়াশোনার অভ্যাস বন্ধ না হয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল, তারপর সরকারি ও বেসরকারি স্কুল খুলেছে অনেক দিন। পড়ুয়ারা নিয়মিত ক্লাসে ফিরেছে। মিড ডে মিল ফিরেছে থালায়। এরপরও কেন এখনও প্রয়োজন এইসব কমিউনিটি স্কুলের? ঠিক কী হচ্ছে এই স্কুলগুলিতে? কীভাবে টিকে রয়েছে স্কুলগুলো? এইসব প্রশ্নের উত্তরে হাল-হাকিকত খতিয়ে দেখতে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বেশ কিছু কমিউনিটি স্কুলে ঢুঁ মারলাম। আর তাতে টুকরো-টুকরো ছবিজুড়ে বেশ কিছু কাঠামোভিত্তিক প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ালাম।
কলকাতার অলিগলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কোনও বাড়ি, কোনও উঠোন, কোনও ছাদ, কোনও বারান্দা থেকে যদি শোনেন ভেসে আসে কচিকাঁচাদের হইহল্লা, রং-পেনসিলের ঘসঘস শব্দ, কেউ নিচু স্বরে পড়া ধরছে, কোথাও আবার স্পিকারে বেজে উঠছে সলিল চৌধুরীর ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, আলো ফুটছে, প্রাণ জাগছে’, আর সঙ্গে সঙ্গে কচিদের পায়ের তালে যেন মাটি কেঁপে উঠছে– তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই শহরের মানচিত্রে ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে এমনই কিছু কমিউনিটি স্কুল– যেগুলো জন্ম নিয়েছিল কোভিডের ভয়াল থাবার সময়, যেগুলো এখনও রয়ে গেছে এক বিকল্প আশ্রয়ের মতো।
কোভিড অতিমারীকালীন সময় থেকে এখন আবার কোভিডের জুজু। এ যেন এক বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার গল্প। ভয়, অনিশ্চয়তা ও দায়বোধের আবর্ত। তবে এই ঘূর্ণিপথেই অনেকগুলো অদেখা দিক আমাদের চোখের সামনে তার হাড়গিলে চেহারাটা নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে। যেখান থেকে মুখ ফেরাতে পারেনি আপাত সাধারণ কিছু মানুষ। তাই অতিমারীর থাবায় একটা দীর্ঘকাল ধরে স্কুল বন্ধ হচ্ছে জেনে তাঁরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়েছিলেন। যাতে পড়াশোনার অভ্যাস বন্ধ না হয়ে যায়। পাটুলির রোকেয়া শিক্ষা কেন্দ্রের কস্তুরী বসু বললেন, ‘প্রাথমিক উদ্দেশ্যই ছিল যেন স্কুলছুট না হয়ে পড়ে কেউ।’ আবার কালীঘাটের বাতিঘর পাঠশালার স্মৃতিপর্ণা সেনগুপ্ত বললেন, ‘নিজেদের ছাত্র ভাবা। দল বেঁধে নিয়ম করে পড়তে যাওয়া, সেই দৈনন্দিনতা জিইয়ে রাখাই ছিল প্রথম কাজ।’ চারু মার্কেটের প্রীতিলতার পাঠশালার ঝিলম রায় বলেছেন, ‘বাচ্চাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ ডিজিটাল এডুকেশনের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস আমাদের দেশে সম্ভব নয়। সরকার থেকে যে ডেটা প্যাক দেওয়া হয়েছিল, তাতে গোটা একটা ক্লাস তাদের পক্ষে করা সম্ভব হত না। সেখান থেকেই পাঠশালা শুরু হয়।’
স্কুল খুলেছে, ক্লাস চলছে– তবু রয়ে গেছে পাঠশালা
কিন্তু প্রশ্ন হল, তারপর সরকারি ও বেসরকারি স্কুল খুলেছে অনেক দিন। পড়ুয়ারা নিয়মিত ক্লাসে ফিরেছে। মিড ডে মিল ফিরেছে থালায়। এরপরও কেন এখনও প্রয়োজন এইসব কমিউনিটি স্কুলের? ঠিক কী হচ্ছে এই স্কুলগুলিতে? কীভাবে টিকে রয়েছে স্কুলগুলো? নিজেদের হাজার ব্যস্ততার ভিড়েও কেন তাঁরা এখনও এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন? এইসব প্রশ্নের উত্তরে হাল-হাকিকত খতিয়ে দেখতে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বেশ কিছু কমিউনিটি স্কুলে ঢুঁ মারলাম। আর তাতে টুকরো-টুকরো ছবিজুড়ে বেশ কিছু কাঠামোভিত্তিক প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ালাম।
প্রশ্নগুলো এখন গলার কাছ ঘেঁষে
তাহলে এই কমিউনিটি স্কুলগুলো কি শুধুই জরুরি অবস্থার জঞ্জাল থেকে উঠে আসা বিকল্প? নাকি এই পাঠশালাগুলোই আসল শিক্ষা কাঠামোর কিছু অভাব সামনে নিয়ে এসেছে?
তবে একটা জিনিস স্পষ্ট– এই স্কুলগুলো ‘সমাধান’ নয়, বরং একটি প্রশ্নের খোঁজ। প্রশ্নটা হল– যদি এইসব সাধারণ মানুষের তৈরি পাঠশালাই শিক্ষার মান তৈরি করে, তবে তথাকথিত মূলধারার শিক্ষার ভবিষ্যৎ কোথায়?
ভাষার অ-আ-ক-খ বনাম ক্লাসে প্রমোশন
কথা বলতে গিয়ে দেখা গেল, এই সকল কমিউনিটি স্কুলের সকলেই প্রায় প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। ফলে কোভিডে স্কুল বন্ধ থাকা তাদের কাছে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শামিল। রোকেয়া শিক্ষাকেন্দ্র, বাতিঘর পাঠশালা, প্রীতিলতার পাঠশালা বা যাদবপুরের আশু-তিমিরের পাঠশালা– এরা প্রত্যেকেই বলছে, কোভিডের সময় মূলধারার সরকারি স্কুলগুলি যেভাবে চলত তার ছবিটা হল– মাসে একদিন করে অভিভাবক স্কুলে যাচ্ছেন, তাঁকে দু’-তিনটে ওয়ার্কশিট ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই ওয়ার্কশিট করে আবার তুমি জমা দিয়ে যাও, যাতে স্কুল দেখাতে পারে খাতায়-কলমে যে তাদের শিক্ষার্থী ছিল এবং সে স্কুলে নিয়মিত। যাতে তাকে প্রমোট করা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো অনেক স্কুলই বলে দিয়েছে ইন্টারনেট ঘেঁটে ওয়ার্কশিট করে জমা দিতে। আর বাকি রইল অনলাইন ক্লাস। যে প্রান্তিক জায়গা থেকে এই সকল পড়ুয়ারা আসে, সেখানে তাদের মাথা গোঁজার জায়গা নেই, এরকম ক্ষেত্রে তো অনলাইন ক্লাস এক অলীক কল্পনা মাত্র। তাই কিছু মানুষের উদ্যোগে এই কমিউনিটি স্কুলগুলি গড়ে ওঠে। কিন্তু পড়ানো শুরু করতে গিয়েই এক চরম বিভীষিকার ছবি সামনে আসে। বাতিঘরের স্মৃতিপর্ণা বলছেন, ‘অষ্টম-নবম শ্রেণির বাচ্চাদের ক্লাস শুরু করতে গিয়ে দেখি, কেউ কেউ নিজের নামটুকু লিখতে পারছে না। তাই একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হয়েছে। অনেকে হয়তো শুনে বুঝতে পারছে, কিন্তু কিছুতেই আর সেটা নিজের ভাষায় লিখে উঠতে পারছে না। অথচ বোর্ডের পরীক্ষার আগে হাতে সময় কম। যত দেখেছি অবাক হয়েছি যে কোভিড তো এই কয়েক দিন হল এসেছে। কিন্তু তার আগে স্কুলগুলো ঠিক কী করেছে! কী করে এই পড়ুয়ারা ওপরের ক্লাসে প্রমোশন পেল!’ রোকেয়ার কস্তুরীও এখানে তুলেছেন, ভাষা শেখার কথা। বললেন, ‘একটা জিনিস প্রথমেই দেখা গেল। ভাষার সমস্যা। বাংলা গড়গড় করে পড়তে না-পারা, লিখতে না-পারা। ইংরেজি গড়গড় করে পড়তে না-পারা ও শুনে বুঝতে পারা বা লিখতে না-পারা। এই একটা সমস্যার সমাধান হলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। তখন দেখা যাবে সব বই-ই সে গড়গড় করে পড়তে পারছে।’ মহেশতলায় সংখ্যালখু সম্প্রদায় এলাকায় ময়নার পাঠশালা, তারা কাজ শুরু করেছে কোভিডের বহু পরে, ২০২৪ সালে। কিন্তু ছবিটা সেই একই। ময়নার সুমিতা রায় বললেন, ‘আমাদেরও একই অভিজ্ঞতা। সপ্তম শ্রেণিতেও যখন অ-আ-ক-খ শেখাতে হচ্ছে, তখন কমিউনিটিও প্রশ্ন তোলে। তবে ধীরে ধীরে বিশ্বাস অর্জন করতে হয়েছে অভিভাবকদের। বোঝাতে হয়েছে আদতে কোথায় রয়েছে তাঁদের সন্তানরা।’
ঠিক এখানেই উঠেছে সোশ্যাল ক্যাপিটালের কথা। কস্তুরী বলেছেন, ‘কোনও শিশু জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখে বাড়ি ভর্তি বই। ছোটবেলা থেকে তাকে মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাকে ভালো নাটক দেখাচ্ছে, তাকে ভালো গান শোনাচ্ছে, তাকে সুন্দর ছবি দেখাচ্ছে। একটা দুনিয়া তার সামনে খুলে যাচ্ছে। আর কোনও কোনও শিশু এইটা থেকেই বঞ্ছিত, তাকে বাড়ির পাশের তিনটে গলির মধ্যে আটকে রাখা হচ্ছে, তার স্কুলে, তার বাড়িতে, চারপাশে যে চার-পাঁচজনকে দেখছ ওটুকুই মাত্র দেখা তার। যেন সামান্য স্বপ্ন দেখাই তার অধিকার। এই প্যাটার্নটা ব্রেক করাই এখন আমাদের পাঠশালার উদ্দেশ্য।’ বাতিঘরের খুশি শিকারি এই প্রশ্নেই এক কদম এগিয়ে এসে বলেছেন, ‘আমরা যে অঞ্চলে থাকি সেখানে সকলে আমাদের করুণার চোখে দেখে। এমনকী, আমাদের স্কুলও। আমি ইতিহাস নিয়ে পড়তে চাই। অধ্যাপক হতে চাই। কিন্তু আমাদের স্কুলের শিক্ষিকদের আমাদের সম্পর্কে মন্তব্য শুনলে বুঝবেন, ওঁরা আমাদের ওই শপিংমলে হাউজ কিপিং বা কারও বাড়িতে দেখাশোনা বা রান্নার কাজের বেশি এগোতে দিতে চান না। আমি বাতিঘরে এসে সেই অক্সিজেন পেয়েছি, স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়েছি।’ রোকেয়ার ছাত্র রুদ্র আবার বলেছেন, ‘আমি যদি রোকেয়ায় না আসতাম এই মুক্ত চিন্তার অবকাশ পেতাম না। নিজেকে চিনতে শিখেছি এখানে এসে।’ আশু-তিমিরের নবম শ্রেণির পড়ুয়া বিদিশা (নাম পরিবর্তিত) বলছে, ‘এখানে সবাইকে বিশ্বাস করে অনেক কথা বলতে পারি। যদি কখনও মন খারাপ হয় সে কথাও বলতে পারি। সেই সাপোর্ট পাই। আমার নাচ করতে খুব ভালো লাগে।’
এসব দেখে-শুনে একটা ছবি অন্তত পরিষ্কার হয়, এই কমিউনিটি স্কুলগুলোতে আসা ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ স্কুলে যায় ঠিকই, কিন্তু সেখানে তাদের উপস্থিতি খাতায় নাম লেখানোয় সীমাবদ্ধ। পড়া বোঝা, বা মানসিক বিকাশ– সেসব দিশা পায় এই বিকল্প পাঠশালাতেই। তাই হাজারও ঝঞ্ঝা সয়ে, শুধু ক্রাউড ফান্ডিংয়ের ওপর নির্ভর করে এই পাঠশালাগুলো টিকে আছে! আসলে সরকারি স্কুলের ক্লাসরুমে এখনও একটা দূরত্ব আছে। শিক্ষক-ছাত্র সমীকরণ সেখানে একপাক্ষিক। সেটা এই কমিউনিটি স্কুলগুলোতে ভাঙা হয়েছে। কারণ এই মূলধারার স্কুলগুলোর পাঠ্যতালিকায় আছে ভরসা, বন্ধুত্ব, নিরাপত্তা– যেগুলো সব স্কুলে মেলে না।
স্বপ্ন, সাহস আর দায়বোধের পাঠশালা– এক নীরব বিপ্লব
বারবার স্বপ্নের মধ্যেও সেই এক ছবি ঘুরে-ফিরে আসে। একদল শিক্ষক ব্ল্যাকবোর্ড কাঁধে পাহাড় ডিঙিয়ে যাচ্ছেন। গোটা দেশে কোনও পড়ুয়া নেই। হতাশায় ডুবে এক শিক্ষক বলছেন, ‘আমি আমার বাবার কথা না শুনে খুব ভুল করেছি। বাবা আমাকে মেষপালক হতে বলেছিলেন, আর আমি শিক্ষক হয়েছি।’ ২০০০ সালে সমিরা মখমলবাফের ছবি, ‘ব্ল্যাকবোর্ডস’। কমিউনিটি স্কুলগুলোর উদ্দেশ্য় সেই দিন যেন না আসে আমাদের দেশে। শিক্ষা ও স্বপ্নের প্রয়োজন যেন ফুরিয়ে না যায়। ‘এখানে কেউ যেন কোনও স্বপ্ন দেখতে ভয় না পায়, যে যা স্বপ্ন দেখছে তা যেন সে ভালোভাবে করতে পারে। তাকে দেখে যেন বাকিরাও সাহসী হয়।’ কথা বলতে বলতে এসবই ঘুরে-ফিরে আসছিল রোকেয়া শিক্ষাকেন্দ্রে। তারপর আশু-তিমিরে গিয়ে দেখা হল তপন কুইরি-র সঙ্গে। তপন এখানে স্বেচ্ছাশিক্ষক। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন। তপনের পড়াতে ভালো লাগে। পড়তে ভালো লাগে। তাই গোটা পরিবারে কেউ পড়াশোনা না করলেও ওঁর স্বপ্ন ছিল অটুট। সেখান থেকেই এই পথচলার সাহস অর্জন করেছেন তপন। আর সেই সাহস আশু-তিমিরের মতো পাঠশালায় ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করছেন তিনি। তপন বললেন, ‘স্কুলে সিলেবাস শেষ হলে দায়িত্ব শেষ। কিন্তু পড়াশোনার সঙ্গে বাকি জীবনের সব কিছু যে খুব সংযুক্ত, সেটা জানা দরকার আমরা সেটা করার চেষ্টা করছি। এই কমিউনিটি স্কুলগুলির সবটাই চলছে প্রায় স্বেচ্ছাশ্রমের ওপরে নির্ভর করে। সেখানেই ব্যবহারিক উপায়ে বিজ্ঞান শেখার কথা শোনা গেল প্রীতিলতার পাঠশালার ঝিলম রায়ের কথাতেও। আশু-তিমিরের পাঠশালা হোক বা রোকেয়া শিক্ষাকেন্দ্র বা বাতিঘর পাঠশালা বা প্রীতিলতার পাঠশালা– সব জায়গাতেই এই স্বপ্ন দেখার দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। যেন এক স্বপ্নের অবিরাম যাপন চলছে। বড় পড়ুয়ারা নিজেরাই ছোটদের পড়াচ্ছেন। বাতিঘর পাঠশালার চন্দনা মণ্ডল বললেন, ‘আমাদের এখানে একেবারে দুই, আড়াই বছর থেকে বাচ্চারা আসে। আমরাই এখন ছোটদের হাত ধরে শেখাই। তবে একটা শুধু শেখানো নয়। আমাদেরও শেখা হয়ে যায়। কত কিছু নতুন ভাবনা আসে ওদের থেকেই।’ রোকেয়ার কস্তুরীও বললেন, ‘এখন আমাদের অনেক কিছু করতে হয় না। যারা স্কুল পাশ করে কলেজে পড়ছে তারা নিজেরাই অনেক দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিয়েছে।’ বাতিঘরে স্মৃতিপর্ণা বললেন, ‘এটা ওদের স্পেস। ওরা নিজেদের মতো করে পুরোটা গুছিয়ে নিয়েছে। যারা একদম প্রথম থেকে আছে তাঁরা খুব স্বাভাবিকভাবেই বেশি দায়িত্ব নিচ্ছে।’
যেখানে স্কুল মানে শুধু বই নয়, এক ছাতার নিচে সারাদিনের জগৎ
কমিউনিটি স্কুল মানেই কি শুধু পড়ানো? স্কুল মানেই কি সিলেবাস?
এই স্কুলগুলো তো চলছে ৩৬৫ দিন। সকাল থেকে রাত। তাই একটা প্রশ্ন প্রায় সব জায়গাতেই করেছি– পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আর কী কী কাজ এসে পড়েছে! রোকেয়ায় কস্তুরী বললেন, ‘সেই সবই যা আপনার-আমার ঘরে বাচ্চা থাকলে আনুষঙ্গিক ভাবে এসে পড়ে, তার সবটাই।’ সেটা কোনও শিশুর নিউট্রিশনের সাপোর্ট দরকার। কেউ বাড়ি ছাড়ছে ফর গুড। তাদের শেল্টার দিতে হয়েছে। কেউ সকাল থেকে রাত সাড়ে ন’টা-দশটা পর্যন্ত থাকছে। কিচেন শুরু করতে হয়েছে। এছাড়া খাতা-বইয়ের জোগান ইত্যাদি তো রয়েছেই।’ কিন্তু স্কুলে তো মিড ডে মিল দেওয়া হচ্ছে! প্রশ্ন উঠতেই সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন বাতিঘর পাঠশালার স্মৃতিপর্ণা। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি মিড ডে মিলের স্যাম্পল দেখেছেন! ঘুগনি ভাত খেয়েছেন কখনও?’ উত্তর দিতে পারলাম না। ছবিটা ভাবার চেষ্টা করলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম কেন, ঠিক কী কারণে কোথাও বিস্তর বাড়ি ভাড়া দিয়ে, কোথাও কমিউনিটির সঙ্গে দর কষাকষি করে একটা ছোট ঘর নিয়েছেন, সারাদিন-রাত লেগে পড়ে রয়েছেন এই মানুষগুলো! কেনই বা কী দেখে এত এত মানুষ এদের নিয়ম করে সাহায্য পাঠাচ্ছেন! উত্তর লুকিয়ে ছিল কস্তুরীর কথায়, কালীঘাটের কমিউনিটির ছবি তুলে ধরে তা আরও স্পষ্ট করলেন স্মৃতিপর্ণা। বললেন, ‘আমরা যে পড়ুয়াদের অঞ্চলে কাজ করি তাঁদের পরিবারের মায়েরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রমজীবী। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের পড়ুয়ারা অনেকেরই স্কুলে ভর্তির বয়স হয়নি। আবার যাদের হয়েছে, তারা হয় সকালে বা দুপুরে পাঠশালায় ক্লাস করে স্কুলে যায়। স্কুল ছুটির পর এখানেই ফেরে। কারণ ওই সময়টা তারা কোথায় যাবে! তাদের মায়েদের কাজ শেষ হতে সন্ধে গড়িয়ে যায়। তার আগে এখানেই তাদের বিকেলের ক্লাস করে। তাই সকাল থেকে রাত তারা আমাদের কমিউনিটি স্কুলে থাকে। ফলে সেখানে ডে-কেয়ারের যাবতীয় ব্যবস্থা রাখতে হয়। সেখানে চারবেলা খাওয়া থেকে, স্নান– সবই। এর জন্য আমাদের একজন কেয়ার গিভার, একজন রান্নার মানুষ রাখতে হয়েছে। এমনকী যাদের প্রয়োজন রয়েছে এমন কিছু পড়ুয়া রাতেও এখানেই থাকে।’ হয়তো এই যত্ন, এই আত্মীয়তা, এই বন্ধুত্বের, এই দায়িত্বের কোথাও অভাব ছিল, যা কাজ করতে এসে চোখে পড়ল কমিউনিটি স্কুলগুলোর। তাই কোমর বেঁধে নামলেন তাঁরা। না এর মধ্যে কোনও পরোপকারের সুর নেই। আছে এক অভিভাবকসুলভ দায়বোধ।
ওই স্কুলে গেলেই মেয়েরা বেশি কথা বলছে
এই ছবিটা মূল কলকাতার বাইরে যেমন, তেমন খাস কলকাতাতেও। তা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে যেমন, সংখ্যাগুরুতেও তাই। এখানেই উৎপল দত্তের কণ্ঠে ‘ওরা যত বেশি পড়ে ,তত বেশি জানে, তত কম মানে’ এই কালজয়ী সংলাপ যেন কানে বাজে। বিশেষত যখন তা বিশেষ লিঙ্গযৌন পরিচয়ের মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। তা মহেশতলার ময়নার পাঠশালা হোক, বন্ধু কালেকটিভের বাতিঘর পাঠশালা হোক বা প্রীতিলতার পাঠশালা। এইসব স্কুলে এসে গার্হস্থ হিংসাকে চিনতে শেখা ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখলেই বিপদ। ময়নার পাঠশালার সুমিতা রায় বলেন, ‘আমাদের এক মেয়ে বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে চলা গার্হস্থ হিংসার প্রতিবাদ করায় তিন মাসের জন্য আমাদের স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছিল। অবশেষে অনেক দর কষাকষি করে স্কুল চালু হয়েছে।’ স্মৃতিপর্ণা বলেন, ‘কালীঘাটে এমন বহুবার হয়েছে। এমনকী গায়ে হাত তুলতেও বাকি রাখেনি কমিউনিটি। তবু মাটি আঁকড়ে পড়ে থেকেছি। আগে একসময় হত, এমন ঝামেলা হলেই পরের দিন পড়ুয়া সংখ্যায় একটা প্রভাব পড়ত। আমরা খারাপ জিনিস শেখাচ্ছি মেয়েদের– এই অজুহাতে। বিশ্বাস অর্জন করতে সময় লেগেছে, আমাদের কাজের অঞ্চলের পরিধি বেড়েছে। তাই এখন আর পড়ুয়া সংখ্যায় কোনও প্রভাব পড়ে না। আর আমরা আইনিভাবে ঠিক পথে চলছি। আর যে কাজ স্কুল ও স্থানীয় প্রশাসনের করার কথা তা আমরা করেছি। কিছু ভুল করিনি।’ বিকল্প শিক্ষা যে সমস্যা কিছু নির্দিষ্ট মানুষের কাছে সেই আভাস পাওয়া গেছে চারু মার্কেট-এর প্রীতিলতার পাঠশালা থেকেও। ঝিলম বলেছেন, ‘আমরা কাজ শুরু করার পড়েই পাশেই একটি ধর্মীয় নাম নিয়ে কোচিং সেন্টার চালু হয়। সেখানে কিছু পড়ুয়া চলে যায়। তাতে আমাদের কাজ থেমে থাকেনি।’
এইসব অলিগলির পাঠশালা হয়তো বিরাট কোনও পরিসরে কাজ করে না। কিন্তু শিক্ষা মানে শুধু পাঠ্যক্রম নয়–ভরসা, সাহস, বন্ধুত্ব আর বিকাশের সম্ভাবনার নাম। এইসব পাঠশালার প্রেক্ষিতে আমাদের জিজ্ঞাসা হওয়া দরকার: ‘আমাদের মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা কোথায়, ঠিক কোন দিকে যেতে চায়?’ আসলে তো এই পাঠশালাগুলো শুধু পাঠ নয়, এক সামাজিক চেতনার বীজতলা। যদি আগামী দিনের শিক্ষানীতিতে এসব অভিজ্ঞতা ধরা না পড়ে, তবে আরেকটা অতিমারীর মুখে ফের নতুন করে পথ খুঁজতেই হবে।
‘দৃষ্টিপাত’ অমন সাফল্যের পরও আর ওইরকম লেখা লেখেননি। আমার ধারণা এই অর্থেও তাঁর যাযাবর নাম সার্থক। নিজের লেখালিখি নিয়ে তিনি বলতেন– ‘আমার কোনো নেশা নেই। শখ আছে। সাহিত্য তার মধ্যে একটি। আমার লেখার পেছনে কোনো নেশা নেই। আছে তুষ্টি। নিজের খুশিতে লিখি। মাঠে রাখাল ছেলে যেমন বাঁশি বাজায়।’