প্রথম বাংলা রান্নার বই ‘পাকরাজেশ্বর’-এর ‘অথান্নপাকঃ’ বিভাগে চার প্রকার অন্য রান্নার রেসিপির মধ্যে একটির নাম ছিল বাজরার অন্ন। বাজরা, দই, ঘি আর লবণ দিয়ে তৈরি রান্নাটিকে খিচুড়ির দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলাই যায়। বাংলায় দ্বিতীয় যে রান্নার বইটি, ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’, সেখানে পলান্নের পরেই খেচরান্নের স্থান। কট খেচরান্ন, দাউদখানি খেচড়ান্ন, মোকম্বর খেচরান্ন, গুজরাতি খেচরান্ন, জাহাঙ্গিরী খেচরান্ন এবং জাহাঙ্গিরী নির্জল খেচরান্ন– মোট ছ’রকম খিচুড়ির বর্ণনা রয়েছে। সবক’টা খিচুড়িই মাংস দিয়ে রান্না। এগুলোকে আর যাই বলি না কেন, মোটেই ‘বাঙালি খিচুড়ি’ নয়।
‘তেল তামাক তপন তুলা তপ্তভাতে ঘি/ পাছুরি খিচুড়ি আর শাশুড়ির ঝি।’ এই হচ্ছে হেমন্তের উপাদেয় বস্তু বিশেষ। শুধু হেমন্তের নয়, খিচুড়ি বর্ষাকালে আরও উপাদেয়। ফেলুদার তো বটেই, টেনিদারও বর্ষাকালের প্রিয় খাবার ছিল খিচুড়ি (Khichdi) আর ডিম ভাজা। বাঙালির জনপ্রিয় খাদ্য ভাত-ডাল। একত্রে ভাত ডাল রান্নাই খিচুড়ি। খিচুড়ি কি সময় বাঁচানোর পন্থা? অনেকটা বিদেশি স্যানডুইচের মতো? না হঠাৎই ভাত-ডাল মিলে ভোজন রসিকদের কাছে এক বিচিত্র স্বাদের বস্তুর জন্ম নিয়েছিল? তবে যাই হোক, আবিষ্কারটি বেশ প্রাচীনকালের।
সংস্কৃতে খিচুড়িকে বলা হয় ‘কৃশর’। ইবনেবতুতা ভারতে এসেছিলেন চতুর্দশ শতকে, তাঁর ভ্রমণের বইতে ‘খিসড়ি’র কথা লিখে গিয়েছেন। ইংরেজি বানানে kishri। তাতে যে মুগ ডাল এবং গব্য ঘি দেওয়া হত, সে কথাও উল্লেখ করেছেন। সেকালে ইংরেজদের প্রিয় খাদ্য তালিকাতেও খিচুড়ি জায়গা পেয়ে গিয়েছিল। তবে বিকৃত উচ্চারণে তারা বলত ‘কেজিরি’ পরে সেটি দাঁড়ায়, ‘কিচেরি’তে ( kitchery)। অক্সফোর্ডে এমন বানানই আছে।
সপ্তদশ শতকে ইংরেজ ভ্রামণিক ফেয়ার প্রশংসা করে লিখেছিলেন, খিচুড়ি হচ্ছে ‘ডিলাইটফুলেস্ট ফুড’। তবে খিচুড়ি নিয়ে ওদের মধ্যে প্রচুর ভুল ধারণাও ছিল। ওরা খিচুড়ি বলতে বুঝত মাছের খিচুড়ি। ওরা নামটা শুনেছিল কিন্তু পদটির ‘নো-হাউ’-টা জানত না। ফলে ব্রেকফাস্ট টেবিলে ওরা যে খিচুড়ি খেত– তাতে না ছিল চাল, না ছিল ডাল, না আদা, না ঘি! সেটা ছিল এক ধরনের মাছের ঝুরি। ছোট মাছ ঝুরঝুরে করে ভাজা।
বিজ্ঞজনের মতে, মানুষ যে খাদ্যটিকে পাখির মতো খুঁটে খুঁটে খায় অর্থাৎ বড় বড় গ্রাসে খায় না, তাকে বলে ‘খেচরান্ন’। বাংলায় খিচুড়ি, রাঢ় বাংলায় খিচুড়ি। চাল-ডাল সমান মাপে বা ডাল একটু বেশি দিয়ে ঘি, হলুদ এবং তৎসহ লবঙ্গ, দারচিনি, ছোট এলাচ, জৈত্রী, তেজপাতা, আদা, পেঁয়াজ, হিং ইত্যাদি মশলা ও নানান তরকারি দিয়ে খিচুড়ি রান্না হয়। ঠান্ডা এবং গরম– দু’রকম খিচুড়ির দু’রকম স্বাদ। বাসি খিচুড়িও স্বাদে অপূর্ব।
তবে চালটাও একটু উৎকৃষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। রন্ধনশিল্পীদের মতে কামিনী আতপ, বাসমতী বা চিনিশর্কর জাতীয় চালে খিচুড়ির স্বাদটা জমে ভালো। ডালের রকমফেরে, ডালিয়া বা সুজি দিয়ে প্রায় ২০-২৫ রকমের ভিন্ন স্বাদের খিচুড়ি রান্না করা যায়। খিচুড়ির উত্তম সংস্করণের নাম ‘ভুনি খিচুড়ি’। ‘ভুনি’ মানে ভাজা। চাল আর মুগ ডালটা আগে একটু বেশি মাত্রায় ভেজে নিয়ে ‘ভুনি খিচুড়ি’ রাঁধতে হয়। যে কোনও রকম ভাজা ছাড়াও ‘ধান শাকের টক চাটন’ দিয়ে দারুণ লাগে।
একটা প্রশ্ন আমার মতো পাঠকেরও মাথায় আসতে পারে, বাঙালির খিচুড়ি আর বাংলার বাইরে অন্য রাজ্যের খিচুড়ি কি একইরকম? সে প্রশ্নে ঢোকার আগে আমরা বাংলা রন্ধনশিল্পের বইতে কী ধরনের খিচুড়ির কথা উল্লেখ আছে, সেটা একবার দেখে নিই।
প্রথম বাংলা রান্নার বই ‘পাকরাজেশ্বর’। প্রকাশ পেয়েছিল ১৮৩১ সালে। প্রকাশিত হয়েছিল বর্ধমানরাজ মহতাবচন্দ বাহাদুরের আদেশানুসারে এবং তাঁরই অর্থে। খুব স্বাভাবিক কারণে তাঁর প্রিয় খাবারের তালিকাই ছিল এই বইয়ে। অনেক খুঁজেও সে বইয়ে খেচরান্নের কোনও উল্লেখ পাইনি। তবে ‘অথান্নপাকঃ’ বিভাগে চার প্রকার অন্য রান্নার রেসিপির মধ্যে একটির নাম ছিল বাজরার অন্ন। বাজরা, দই, ঘি আর লবণ দিয়ে তৈরি রান্নাটিকে খিচুড়ির দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলাই যায়। এই বই প্রকাশের ২৫ বছর পর বাংলায় যে দ্বিতীয় রান্নার বইটি ছাপা হয়, তার নাম ‘ব্যঞ্জন রত্নাকর’। এটিও বর্ধমান রাজের অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত। এই বইটিতে পলান্নের পরেই খেচরান্নের স্থান। আমার মনে হয়, প্রথম বইটি থেকেই তাঁরা ভুলটি বুঝতে পারেন। বাংলা রান্নার বইতে খিচুড়ি না থাকা ঘোর অন্যায়। কট খেচরান্ন, দাউদখানি খেচড়ান্ন, মোকম্বর খেচরান্ন, গুজরাতি খেচরান্ন, জাহাঙ্গিরী খেচরান্ন এবং জাহাঙ্গিরী নির্জল খেচরান্ন– মোট ছ’রকম খিচুড়ির বর্ণনা রয়েছে। সবক’টা খিচুড়িই মাংস দিয়ে রান্না। এগুলোকে আর যাই বলি না কেন, মোটেই ‘বাঙালি খিচুড়ি’ নয়।
এরপর যে বইটি থেকে খিচুড়ির খোঁজ নেব, সেটা হচ্ছে বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘পাকপ্রণালী’। ১৮৮৪ সালে ছাপা এই পাকপ্রণালীতে মোগলাই খিচুড়ি থেকে আলুর খিচুড়ি, গুজরাটি খিচুড়ি থেকে সহজ খিচুড়ি, মোট ১৭ রকম খিচুড়ির উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সাতটি মাংসের খিচুড়ি, একটি ডিমের খিচুড়ি ও ন’টি নিরামিষ খিচুড়ি। তবে বাঙালি, যত দিন যাচ্ছে মানসিকতায় নিম্নগামী হচ্ছে, তার প্রমাণ বিপ্রদাসের এই সহজ খিচুড়ির উপদানের সঙ্গে আমাদের এখনকার গিন্নিদের তৈরি খিচুড়ির তুলনা করলেই বোধগম্য হবে। সহজ খিচুড়ির জন্যে লাগবে পেস্তা এক তোলা, বাদাম এক তোলা, কিসমিস এক তোলা আর জাফরান দুই আনার। এখনকার ওজনে ‘এক তোলা’ মানে ১২ গ্রাম। বুঝতেই পারছেন, বাঙালিদের রান্নায় কী ছিল আর কী দাঁড়িয়েছে!
প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর মতে, সবচেয়ে ভালো লাগে দই দিয়ে খিচুড়ি। এ শুধু বইতেই পড়েছি, কখনও চেখে দেখিনি। খিচুড়ি শুধু গুরুপাকই নয়, ধাতু পুষ্টিকর, বলকর, পিত্ত ও কফজনক এবং মলমূত্রকর। এর অন্যতম কারণ ভাতের মতো খিচুড়িতে ফ্যান ফেলে দেওয়া হয় না। চাল এবং ডালের সমস্ত খাদ্যপ্রাণটাই খিচুড়িতে বর্তমান। গন্ধের নির্যাসটুকুও খিচুড়িতে জমাট বেঁধে থাকে। গোটা ভারতের নিরামিষভোজীরা খিচুড়ির ভক্ত। একটু খেয়াল করে দেখবেন, দেবতারা প্রায় সবাই খিচুড়ি খেতে খুবই পছন্দ করেন। প্রায় সব দেবদেবীর ভোগে নানা পদের সঙ্গে খিচুড়ি থাকবেই। এমনিতে তাঁদের মধ্যে নানা বায়নাক্কা। কেউ মাছ-মাংস খান না। কেউ শুধুই মাংস পছন্দ করলেও মাটন ছাড়া রোচে না। দেখবেন বলিতে শুধুই পাঁঠা। অর্থাৎ নো চিকেন। রান্নাতেও অনেক বিধি নিষেধ। ঘুণাক্ষরেও যেন রান্নায় পেঁয়াজ-রসুন না দেওয়া হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। কিন্তু খিচুড়ির বেলায় কোনও আপত্তি নেই। সে দেবী সরস্বতী থেকে মা দুগ্গা– খিচুড়ি মাস্ট! কেষ্ট ঠাকুরই বা বাদ যান কেন! তাঁরও পছন্দের তালিকায় খিচুড়ি অবশ্যই থাকে। তবে এই কথা অনস্বীকার্য, আমি যত রকমের দেবদেবীর ভোগের খিচুড়ি গ্রহণ করে দেখেছি, সেরার সেরা পুরীর জগন্নাথ দেবের খিচুড়ি ভোগ।
দিনের পাঁচ প্রহরে পাঁচবার ভোগ দেওয়া হয় পুরীতে। তার মধ্যে সকাল-ধূপ ভোগের জন্য ২১টি নানা ধরনের খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে ব্যবস্থা আছে মহাদেয়ী খেচুড়ি আর কাচি খেচুড়ির। এই কাচি খিচুড়ি হয় চার রকমের– থালি, নুথরা, ওলি আর সানা ওলি খেচুড়ি। রান্না নয়, এই তফাতগুলি করা হয় পরিবেশন পদ্ধতির কারণে। কোনওটা থালায়, কোনওটা ছোট হাড়ি বা মাঝারি হাড়িতে। চাল, সবুজ মুগডাল, আদা, নুন, হিং আর ঘি দিয়ে তৈরি হয় জগন্নাথের খিচুড়ি।
প্রতিদিন সাধারণত ১৪-১৫ মণ চালের রান্না হয় পুরীর মন্দিরে। রান্নাঘরে উনুনের সংখ্যা কমবেশি ৭৫০। এর মধ্যে খিচুড়ি হয় ৪ থেকে ৫ মণ চালের। শুধু স্বাদের কারণেই ভক্তদের কাছে এই খিচুড়ির আদর করে নামকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘জগাখিচুড়ি’।