ক্রিকেট এমনিতেই সাদা জার্সি আর লাল বলের খেলা। বাকি যা, তা আসলে উত্তেজনা দেওয়া-নেওয়া। টেস্ট ক্রিকেট আসলেই অপেক্ষার খেলা। নীরবতার খেলা। ওই যে বোলার ছুটে আসছেন, ব্যাটসম্যানের অপেক্ষার চোখ। চুপ। সব চুপ। আউটসুইং। ব্যাটসম্যান ছেড়ে দিলেন বল। এই অপেক্ষার মাঝে ক্রিকেট বেঁচে আছে। কথায় নয়। নীরবতায়। স্টাম্প মাইক কথা শোনে, শব্দ শোনে। নৈঃশব্দ্য শোনে না। ধরে রাখে না নীরবতা। তাই স্টাম্প মাইক কন্টেন্ট দিতে পারে। গ্রেট তৈরি হয় তার নিজের খেয়ালে। রিলে নয়।
প্রচ্ছদ শিল্পী দীপঙ্কর ভৌমিক
‘ম্যানবিয়াইন’ একটি আশ্চর্য জাদুকরী শব্দ। এই শব্দটি বাংলা না উর্দু– তা বেড়ে ওঠার কালে জানা ছিল না। কিন্তু এর প্রয়োগ ছিল বিবিধ। অর্থও ছিল ব্যাপক। টসে জিতে পাড়ার খেলায় কেউ ফিল্ডিং নিল। প্রথম বল করার আগে ডিপ এক্সট্রা কভারের ফিল্ডার চেঁচিয়ে হাততালি দিচ্ছে। কী বলছে সে? এক টাকার বিগ বাবুল চিবতে চিবতে সে বলছে, ‘ম্যানবিয়াইন, ম্যানবিয়াইন’! অর্থাৎ, উত্তেজনা। হবে, হবে! বোধ করি, ফুটবল থেকেই এর উৎপত্তি। কিন্তু আমাদের পাড়ায় এই শব্দের প্রয়োগ ছিল ফুটবল থেকে পিট্টু– সব খেলায়। ‘ম্যানবিয়াইন’-এর প্রয়োগ অনুপাতে তার অর্থ বুঝে নিতে হত।
এঙ্গাসের সঙ্গে আমাদের দল অর্থাৎ সিঙ্গেল কোয়ার্টারের ফুটবল ম্যাচ। মহাদেবদার সঙ্গে এক বেঁটে, গাঁট্টাগোঁট্টা নেপালি যুবকের বল কাড়াকাড়ি চলছে। ট্রয়ের যুদ্ধের মতো রুদ্ধশ্বাস সেই লড়াই। পাশ থেকে সন্তোষদা বলছে, ‘ম্যানবিয়াইন, ম্যানবিয়াইন’! আরে কী মুশকিল! প্রকৃত অর্থে ‘Man Behind’ বলেই তো এত যুদ্ধ। না হলে তো বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যেত।
বড় হয়ে দেখেছি, মাঠের গণ্ডি ছাড়িয়েও ম্যানবিয়াইন চলেছে। ধরা যাক, চায়ের দোকানে আপনি পরনিন্দা করছেন কারও, গোরামামা পাশ থেকে বলল, ‘ম্যানবিয়াইন’! অথবা বলল, ‘এখন বোলো না, ম্যানবিয়াইন আছে।’ তরুণ নায়ক কোনও তরুণীর সঙ্গে কফি ডেটে গেছে। টুকুস করে পাপারাৎজি ছবি তুলে বাজারে ছেড়ে দিল। ম্যানবিয়াইন! আপনার আমার সমস্ত তথ্য বাজারে পাওয়া যাবে। ম্যানবিয়াইন! এই আপনি ভালো জুতো কেনার কথা বন্ধুকে বলছিলেন, তারপরই ফেসবুক খুলে দেখলেন সস্তায় পুষ্টিকর জুতোর রিল। নাও ঠ্যালা! বিরাট ম্যানবিয়াইন! এখন ক্রিকেটেও একটি ম্যানবিয়াইন রয়েছে। যাকে বলে ‘স্টাম্প মাইক’। সে সমস্ত কথা, যা ক্রিকেটার একে-অপরকে বলছে, তা স্পষ্ট শুনিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। এই হল অত্যাধুনিক ম্যানবিয়াইন।
ক্যারি পেকার নামে একজন দাপুটে অস্ট্রেলিয়ান ছিলেন। যাকে বলে, ‘বিজনেস টাইকুন’। টিভি নাইনের স্বত্ব নিয়ে কী একটা খিটিমিটির জেরে, পৃথিবীর সব তাবড় প্লেয়ারদের তুলে নিয়ে একটি সিরিজ চালু করেন। সম্ভবত বছর দুয়েক চলেছিল সেই সিরিজ। সাতের দশক তখন। যাবতীয় রোমাঞ্চকর ঘটনা নিয়ে গোটা পৃথিবীর পট পরিবর্তনের দশক। সেই সিরিজের নাম ছিল ক্যারি পেকার ওয়ার্ল্ড সিরিজ। ক্রিকেটের আমূল বদলে যাওয়া সিরিজ ছিল সেটা। আজকের এই সাদা বলের ক্রিকেট। রঙিন জার্সি। ৫০ ওভারের একদিনের ম্যাচ। দিন-রাতের খেলা। সব সেখানেই শুরু। ইমরান খানের সেই বিখ্যাত টি-শার্ট ‘Big boy play at night’– সেটাও সেই সিরিজের সময়। সেই সিরিজে ভিভ রিচার্ডসের গড় ছিল ৫৫। ওই সিরিজে জীবনের অন্যতম সেরা ফর্মে ছিলেন ভিভ।
সে যা হোক, কথা হচ্ছিল স্টাম্প মাইক নিয়ে। তা এই স্টাম্প মাইকও ওই সিরিজে প্রথম ব্যবহার হয়। যাতে ব্যাটসম্যানের ব্যাট ঠোকার আওয়াজ বা স্টাম্প ছিটকে যাওয়ার আওয়াজ টিভির দর্শকরা পেতে পারেন। খেলাটাকে যতটা জীবন্ত করে দেওয়া যায় আর কী! ভাবখানা এমন যেন ভিভের সঙ্গে আপনিও স্টান্স নিচ্ছেন। বা এইমাত্র আপনি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বোল্ড করলেন। কারণ স্টাম্প মাইক জানান দিচ্ছে, সশব্দে স্টাম্প ছিটকে গেল।
এখন এই ‘স্টাম্প মাইক’ বিষয়টা হচ্ছে, উইকেটের গায়ে বা মাটিতে একটি ছোট্ট ক্ষমতাশালী মাইক লাগানো থাকে। এর গুরুত্ব বিবিধ। এই যে টুক করে ব্যাটসম্যান খোঁচা দিলেন এবং বল উইকেটরক্ষকের তালুবন্দি হল। জোরদার চিৎকার ‘হাউজ দ্যাট’! ব্যাটসম্যান নির্বিকার। কই ব্যাটে লাগল, এ তো হওয়ার শব্দ! তারপরও নিস্তার নেই। থার্ড আম্পায়ার আছে। আছে স্নিকোমিটার। ভূমিকম্পের তীব্রতা মাপার মতো গ্রাফ উঠে নেমে বলে দিচ্ছে, ব্যাট ছুঁয়েছে বল। অত নির্বিকার থেকে লাভ নেই বাপু, তুমি আউট। সৌজন্যে স্টাম্প মাইক! খেলাটাকে যতটা পারা যায় আধুনিক করা। আম্পায়ারকে দেখলে মনে হয় রোবট বুঝি। বুক পিঠ দিয়ে তার নেমে গেছে। টুপির মধ্যে ক্যামেরা। বেলের মধ্যে টুনি লাইটের মতো কী যেন লাগানো। সে লজ্জাবতীর মতো সংবেদনশীল। একটু কিছু হলেই অকাল কালীপুজোর তারাবাতির ন্যায় জ্বলছে নিভছে। ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধনে এসে দাঁড়িয়েছে ক্রিকেট।
এখন স্ট্যাম্প মাইক কেবল আউট বা নট আউট ধরে দেওয়ার জন্যই বিখ্যাত নয়। যত দিন যাচ্ছে আরও শক্তিশালী হচ্ছে স্টাম্প মাইক। যাতে ভেসে আসছে ক্রিকেটারদের মধ্যেকার কথা। ভেসে আসছে স্লেজিং। তাতে হাসির রোল উঠছে ধারাভাষ্যকারদের মধ্যে। সেসব কথা নিয়ে তৈরি হচ্ছে রিল। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ভেসে যাচ্ছে । লাখ লাখ ভিউজ। নেটিজেনদের মধ্যে তার চাহিদাও বাড়ছে। যাদের টিভি-স্বত্ব তারাই তাদের পেজে এগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে ক্রিকেটাররা তাঁদের খেলার সঙ্গে কথার জোরেও জনপ্রিয় হচ্ছেন। হয়তো তাঁরা আমার আপনার মতোই আম আদমি হিসেবে প্রতিপন্ন হচ্ছেন। আবার তাঁদের ভর্ৎসনাও একেবারেই আমাদের মতো রকের ভাষায়। তাতে খেউড় আছে। এ-ও উল্লাসের কারণ হয়তো।
এই স্টাম্প মাইক শক্তিশালী হওয়ার আগের সব গল্প আমাদের কাছে আসত ইন্টারভিউ-এর মাধ্যমে। কিন্তু এখন একেবারে হাতে গরম। টাটকা। এক টুকরো ২২ গজ চলে আসছে ড্রয়িংরুমে। গাভাসকরের ইন্টারভিউ-তে মিঁয়াদাদ এবং ভিভের কথা এসেছে অনেকবার। এই রিল যুগে তাঁরা থাকলে যে বিপুল খ্যাতি পেতেন, তা তাঁদের গল্পে বোঝা যায়। মিঁয়াদাদের একটি গল্প বলতে খুব লোভ হচ্ছে। হয়তো অনেকেই শুনে থাকবেন।
মিঁয়াদাদ ব্যাট করছেন আর প্রতি বলে বোলারকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘তেলা লুম নাম্বার ক্যায় হে?’ গাভাসকর স্লিপে দাঁড়িয়ে শুনছেন। মিঁয়াদাদের উচ্চারণের অস্পষ্টতায় ‘রুম’-কে ‘লুম’ শোনাচ্ছে। বোধ করি, বাংলা থিয়েটার না করার জন্যই তাঁর এই উচ্চারণ দোষ। বোলার একসময় তিতিবিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, রুম নম্বরে কাজ কী? মিঁয়াদাদ বললেন, ‘মুঝে তেলেকো তেরে লুম ম্যায় সিক্স মারনা হ্যায়।’ আর ভিভের সেই বিখ্যাত উক্তি তো সকলেই জানেন, ‘No matter what position you Bat man, the score is still zero.’ চার নম্বরে গাভাসকর যখন ব্যাট করতে নামছেন, স্কোরবোর্ডে তখন শূন্য রানে দু’ উইকেট। স্ট্যাম্প মাইক সে যুগে থাকলে ইন্টারনেট যে ভেঙে পড়ত, তা বলাই যায়।
পাকিস্তানের ভারত সফর চলছে, তখন সৌরভ ক্যাপ্টেন। সেসময় আমাদের স্কুলছুটি পেলেই নিজেদের ম্যাচ চলছে, সে যতই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ থাকুক। একদিন সকালে নিজেদের খেলা সবে শুরু হয়েছে, কিন্তু তিন-চার ওভার পর বন্ধ হয়ে গেল! কারণ এক লম্বা চুলের ঝাড়খণ্ডী যুবক ব্যাট করছেন। কেবল ব্যাট করছেন না, ঠাকুমার ভাষায়, ‘মাইরা ছাতু করতাসে!’
ভারতের ক্রিকেট মানচিত্র বদলে দেওয়া সে যুবক সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহেন্দ্র সিং ধোনি হয়েছেন। নিজের নিয়তি জানা গ্রিক ট্রাজেডির নায়কের মতো শান্ত থেকেছেন। কোনও কিছুতেই উত্তেজনা নেই। কমেন্টেটররা প্রায় বলে বসেন, ‘তেরা খুন কাব খোলেগা রে?’ ধোনি অবিচল। ডিআরএস অনুসরণে ফ্যানেরা বলল তার পুরো কথা– ‘Dhoni review system’। কারণ,ধোনি নির্ভুল। তাঁর স্টাম্প মাইকের অনুমোদন দরকার নেই। তিনি নিবিড়ভাবে খেলার মধ্যে রয়েছেন।
কোনও এক ওয়ানডে ম্যাচে সম্ভবত ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে, যুবরাজ স্ট্রাইকে। অফস্টাম্পের বাইরে বল, যুবরাজ ব্যাট চালালেন। ব্যাটে বল লাগার আওয়াজ। আম্পায়ার আউট দিলেন। ধোনি ছিলেন নন-স্ট্রাইকার এন্ডে। কোনও দিকে না তাকিয়ে, এমনকী, যুবরাজকেও প্রায় অস্বীকার করে রিভিউ নিলেন। দেখা গেল বল ব্যাটে নয়, ব্যাট মাটিতে ঘষে সে আওয়াজ হয়েছে। ফলে এই যে ঘরে বসে আপনি ভাবছেন ‘এ হে! আউট! আওয়াজ হল তো!’ না, মশাই স্টাম্প মাইক আওয়াজ দেবে, তার উৎস সন্ধানে পৌঁছতে হবে আমাদেরই। তার জন্য একটা ধোনি লাগে।
ধোনির ক্ষুরধার ক্রিকেটীয় মস্তিষ্ক স্টাম্প মাইকে ভেসে এসেছে বহুবার। কখনও ক্যাপ্টেন, কখনও কেবল সিনিয়র প্লেয়ার হিসেবে। চাহালকে ধোনি বলছেন, ‘আগে ডাল, স্লো ডাল।’ অর্থাৎ, ফুল লেন্থে বল না করতে। একেবারে অব্যর্থ। হলও তাই। লং-অনে ক্যাচ। কোহলিকে পরামর্শ দিচ্ছেন, ‘চিকু, অউর এক ওভার রাখ সাকতা হ্যায়।’ মারাঠি তরুণ কেদার যাদব মার খাওয়ার ভয়ে বল করছেন। অফস্টাম্পের বাইরে বল চলে যাচ্ছে। ধোনি বলছেন, ‘অ্যায়সা ডালেগা তো রাখলে।’ ফিল্ডার প্রোটেকশন নিয়ে নে বাবা তুই। খামোখা মার খাস না! এসব কথা টাই পরা ধারাভাষ্যকার ব্যাখ্যা করছেন না। স্বদেশি ভাষায় আমরা শুনে নিচ্ছি মাঠ থেকেই। প্রতি ক্ষেত্রে ধোনি ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো সঠিক।
আরেকজন আশ্চর্য ছিলেন। শেন ওয়ার্ন। গিলক্রিস্ট উইকেটের পিছন থেকে বলতেন, ‘বোলিং ওয়ার্নি।’ ওয়ার্ন আসলেই জাদুকর। ভোজবাজি জানতেন। বিগ ব্যাস লিগ চলছে। তখন ওয়ার্নের ম্যাজিক শো প্রায় শেষ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন। তা সেই বিগ ব্যাসে স্টাম্প মাইক খেলোয়াড়ের গায়ে জড়িয়ে যেত। মানে একটা মাইক মুখে নিয়ে সে খেলছে। কমেন্টেটর তার সঙ্গে কথা বলছে। সে উত্তর দিচ্ছে এবং ফিল্ডিং করছে। সাবেক ক্রিকেট ফ্যানেরা আঁতকে উঠেছিলেন নিশ্চয়ই এসব দেখে। তা ওয়ার্ন, সে তার জড়ানো অবস্থায় বল করছেন। এবং রান আপ নেওয়ার আগে বললেন, পরের বলটা কী করবেন। ম্যাককলাম, মানে অধুনা ইংল্যান্ড কোচ ব্যাট করছেন। ওয়ার্ন বলে দিলেন, ম্যাককুলাম সুইপ করবে। বলটা যদি ফুল লেন্থে একটু স্কিড করে ঢোকে আউটের সম্ভাবনা আছে। একেবারে তাই হল। সুইপের চেষ্টা তার সঙ্গে সঙ্গে লেগ স্টাম্প উড়ে গেল। আবার এই তার জড়ানো অবস্থায় ওয়ার্নের সঙ্গে মার্লন স্যামুয়েলসের ঝগড়া। সঙ্গে সঙ্গে মাইক বন্ধ করে কমপ্ল্যান বয়ের বিজ্ঞাপন চালাতে হয়েছিল। ক্রিকেট তৎক্ষণাৎ হয়ে উঠেছিল প্রাপ্তবয়স্কের খেলা।
শিল্পীদের নামের পাশে ব্রাকেটে ‘বম্বে’ লেখা থাকলে তাঁর দর বাড়ত। অর্থাৎ, তিনি বম্বে-ফেরত। সেখানেও তাঁর কদর হয়েছে। রোহিত শর্মার নামের পাশে ব্রাকেটে ‘স্টাম্প মাইক’ লেখা থাকলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। তাঁর ডাকাবুকো ব্যাটিংয়ের সঙ্গে একেবারে রকের ভাষা স্টাম্প মাইকে উঠে এসে ছেলেপুলের নয়নের মণি হয়েছে। এমনিতেই রোহিত ভুলোমনা। ডাকাবুকো বম্বের যুবক এমন ভুলে যেতে পারে, তা আগে জানা ছিল না। রোহিত নিজেই ইন্টারভিউ-তে বলছেন, টসে জিতে ফিল্ডিং নেওয়ার কথা। ভুলে গিয়ে ব্যাটিং নিয়ে নিয়েছেন। আশ্চর্য এই, সে ম্যাচ ভারত জিতেওছে। এমন ভুল আমার মায়ের পর রোহিতকে করতে দেখেছি। মায়ের চশমা হারিয়ে গেছে। সারা বাড়ি তোলপাড়! অবশেষে ঠিক হল, পাওয়াই যখন গেল না সন্ধেতে চশমা বানাতে হবে। তাই হোক। তা চটি বের করতে গিয়ে দেখা গেল মায়ের চটির পাশে পোষ্যর মতো চশমাটিও আছে। ওখানে চশমা গেল কী করে, একমাত্র রোহিত বলতে পারেন।
রোহিত বিদেশে খেলতে গিয়ে পাসপোর্ট খুইয়ে আসছেন। টস করতে গিয়ে কয়েন খুঁজছেন। তার সঙ্গেই তেড়ে গাল পাড়ছেন। খুচরো হাসির পায়রা ওড়াচ্ছেন। তার কথায় কথায় বোনের প্রতি যে বিশেষ সম্মান ঝরে পড়ে, তা কমন নিয়ে বাকি কথা লেখা যায়। সিলি পয়েন্টে জয়সওয়াল ফিল্ডিং করছেন। বল আসার আগেই লাফ। স্লিপ থেকে রোহিত রেগে গেলেন। ‘আরে! এটা কি গলি ক্রিকেট। যতক্ষণ না বল আসছে বসে থাক!’ ওয়াশিংটন সুন্দর রিভিউয়ের জন্য কাতর নয়নে রোহিতের দিকে চেয়ে। রোহিত বলছেন, ‘ইউ টেল মি। সাব ম্যায় হি বলু ক্যায়!’ বলে নিজেই হাসছেন। যেন এই পাড়ায় রবিবারের খেলা চলছে। এসব দেদার ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটে।
………………………………………..
ওয়ার্ন আসলেই জাদুকর। ভোজবাজি জানতেন। বিগ ব্যাস লিগ চলছে। তা সেই বিগ ব্যাসে স্টাম্প মাইক খেলোয়াড়ের গায়ে জড়িয়ে যেত। মানে একটা মাইক মুখে নিয়ে সে খেলছে। কমেন্টেটর তার সঙ্গে কথা বলছে। সে উত্তর দিচ্ছে এবং ফিল্ডিং করছে। সাবেক ক্রিকেট ফ্যানেরা আঁতকে উঠেছিলেন নিশ্চয়ই এসব দেখে। তা ওয়ার্ন, সে তার জড়ানো অবস্থায় বল করছেন। ম্যাককলাম, মানে অধুনা ইংল্যান্ড কোচ ব্যাট করছেন। ওয়ার্ন বলে দিলেন, ম্যাককুলাম সুইপ করবে। একেবারে তাই হল। সুইপের চেষ্টা তার সঙ্গে সঙ্গে লেগ স্টাম্প উড়ে গেল। আবার এই তার জড়ানো অবস্থায় ওয়ার্নের সঙ্গে মার্লন স্যামুয়েলসের ঝগড়া। সঙ্গে সঙ্গে মাইক বন্ধ করে কমপ্ল্যান বয়ের বিজ্ঞাপন চালাতে হয়েছিল। ক্রিকেট তৎক্ষণাৎ হয়ে উঠেছিল প্রাপ্তবয়স্কের খেলা।
………………………………………..
রোহিতের কথা বললে অবধারিতভাবে কোহলির কথা এসে পড়ে। আমাদের স্বপ্নতরীর নাম ‘রো-কো’। কোহলি যে বারুদ ইন্ডিয়ান ক্রিকেটে ছড়িয়েছেন, তা বয়ে চলেছে। এই মুহূর্তের ইংল্যান্ড সিরিজেও তার গন্ধ আছে। সে কথায় আসছি পরে। কোহলি এবং অস্ট্রেলিয়ার লড়াই কিংবদন্তি। তার প্রথম অস্ট্রেলিয়া ট্যুর থেকেই। প্রেস কনফারেন্সে বলে এসেছিলেন, সম্মান না করলে সম্মান পাওয়া যাবে না। যেন ব্রাত্য বসুর ‘জতুগৃহ’ নাটকের দুর্যোধনের কণ্ঠ– ‘আমাকে অপমান করলে তার দশগুণ অপমান আমি আপনাকে করব।’
মিচেল জনসনের সঙ্গে লড়াই থেকে তাঁর শেষ টেস্ট সিরিজে কন্সটাসের সঙ্গে লড়াই। স্টাম্প মাইক ধরে রেখেছে সব। সতীর্থ ঝামেলায় জড়ালেই কোহলি এগিয়ে গেছেন। সে নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। কিন্তু স্টাম্প মাইককে একেবারে অ্যানাউন্সের মাইকের মতো ব্যবহারের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ কোহলি। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে টেস্ট। অশ্বিন বল করছেন। ডিন এলগারের এলবিডবলিউ রিভিউ করেছেন ক্যাপ্টেন কোহলি। ডিআরএস বলছে, আনইভেন বাউন্স, উইকেট মিসিং। কোহলি চটে গেলেন। একেবারে স্টাম্প মাইকে এসে বললেন পক্ষপাতিত্বের কথা। সে কথা থার্ড আম্পায়ার এবং ম্যাচ রেফারিকে উদ্দেশ্য করে বলা। অশ্বিন সেই আগুনে হাওয়া দিলেন। স্টাম্প মাইকের এ হেন ব্যবহার ক্রিকেট ইতিহাসে আর ঘটবে কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
এসব গপ্প একদিকে। তার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের গপ্পের নায়ক। এই সময়ের মতো খামখেয়ালি এবং দোদুল্যমান তাঁর অবস্থান। দ্য গ্রেট ঋষভ পন্থ! সে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের মতো রঙিন। প্রাণচঞ্চল। কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের প্রকৃত কন্টেন্ট। এই একটা টেস্ট ম্যাচের চারদিনের মধ্যে সে যা-যা বলেছে, তা নিয়ে প্রবন্ধ লেখা যায়। আমার বিশ্বাস তাঁর কেরিয়ার শেষে পন্থ এবং স্টাম্প মাইক সম্বন্ধীয় একটি সুবৃহৎ বই লিখিত হতে পারে।
এমনিতেই সে ছেলে ঠোঁটকাটা এবং কাছাখোলা। কাছাখোলা প্রকৃত অর্থেই। জামা খুলে যাচ্ছে, প্যান্ট নেমে যাচ্ছে। রান নিতে গিয়ে একপায়ের জুতো খুলে যাচ্ছে। ব্যাট হামেশাই হাত থেকে উড়ে যাচ্ছে। স্কুপ করতে গিয়ে গড়াগড়ি। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। এরপরও নামের পাশে ৮ খানা সেঞ্চুরি! এই টেস্টে দু’ইনিংসে দুটো। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের পর এ রেকর্ড কারও নেই। আর ৭ বার ৯০-এর ঘরে আউট। সে কোনও ‘নার্ভাস নাইন্টি’ নয়। এমনিই খেলাচ্ছলে আউট। শুধু গাভাসকর কেন, আমাদের প্রাচীন শিক্ষকরা থাকলে কান ধরে ‘ইস্টুপিড’ বলতেন। কিন্তু এসব নিয়েই পন্থ। যার জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকি।
গিল জাদেজাকে বলছেন, এই ব্যাটার বল বুঝতে পারছে না। আমরা ভাবছি, এখন পন্থ কী বলছেন? পন্থ সর্বক্ষণই বলছেন। কিছু না কিছু বলছেনই। অচিরেই টিভি সেটে কেবল স্টাম্প মাইক শোনার অপশন থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ধারাভাষ্যকার চুপ থাকবেন। আমরা কেবল পন্থের কথা শুনব। এমনিতে অপেক্ষা বিষয়টা তাঁর নেই। নেই মানে নেই-ই। ধরে খেলতে গিয়ে বল থাই গার্ডে লাগল। রাহুলকে বলছেন, ছাতার সম্মান করতে গিয়ে এই অবস্থা হচ্ছে। তারপরই স্টেপ আউট করে চার। ভাবখানা এই, এবার ঠিক আছে। গত ইংল্যান্ড ট্যুরে অ্যান্ডারসনকে এমন স্টেপ আউট করেছিলেন পন্থ, এজবাস্টন টেস্টে। লং অন দিয়ে চার। অ্যান্ডারসন হতবাক। যেন মনে মনে বলছেন, আমি অ্যান্ডারসন! এ কী ব্যবহার, মূঢ়! পন্থের তাতে বয়ে গেছে।
আচ্ছা, মানুষ মনে মনে কথা কীভাবে বলে? মনে মনে। তাই তো? পন্থ বলেন সজোরে। অনেকে বলেন, স্টাম্প মাইক সচেতন। তিনি যে কন্টেন্ট, তা পন্থ জানেন। হলই বা। লিডসেও তো যথারীতি শট নিতে গিয়ে পড়ে-টড়ে গিয়েছেন। উঠে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে বলছেন, ‘কী দরকার পন্থ! সোজা বল সোজা খেল।’ এ যে কী অদ্ভুতুড়ে ঘটনা, যারা দেখেছেন জানেন।
উঁচু তারে বাঁধা পন্থের রসবোধ। কেবল কথা নয়, বলার ঢঙে হরির লুটের মতো মজা। প্যাট কামিন্সকে বলছেন, খেলা অত সোজা নয়। স্বীকার করো বাপু। এই সাধারণ স্লেজিং বলছেন এমন করে যেন ক্রিকেট নয়, স্লেজিং-এর তালিম নিয়েছেন! টিম পেইনের সঙ্গে তাঁর স্লেজিং যুদ্ধ সর্বজনবিদিত। পেইন তাঁকে উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘Do you baby-sit?’ বোঝো! সিরিজ শেষে পন্থ আবার পেইনের বাড়ি গিয়ে তাঁর বাচ্চা কোলে ছবিও তুলছেন। আবার পন্থ পেইনকে ‘Temporary captain’ বলে খোঁচাও দিচ্ছেন। অক্ষয় কুমার যখন ইংলিশ স্পিনার মন্টি পানেসরকে ছাড়েননি, আমার ধারণা পন্থের বায়োপিক হলে তিনিই পন্থ সাজবেন। সে সাজুন, আমি শুধু দাবি জানাই– তাঁর নাম এই বলে খ্যাত হোক, Pant- the real entertainer.
স্টাম্প মাইকে যাদের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকি, তারা হল বাংলাদেশি ক্রিকেট দল। কারণ সহজ, তারা স্পষ্ট বাংলা বলেন। মনে হয়, বুঝি আমিই বলে উঠলাম! সেখানে আছেন আবার মুশফিকুর রহিম। সে-ও অবিচল। সে কিছুই দেখে না এবং শোনে না। উইকেটরক্ষকের বিরাট ভূমিকা ডিআরএস নেওয়ার ক্ষেত্রে। রহিম সেখানে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। সাকিব জানতে চাইছেন, ‘কী রে ব্যাটে লাগসে নাকি?’ রহিম বলে, ‘দেখি নাই ভাই। শুনি নাই ভাই। বুঝতে পারতাসি না।’ আরে ঝামেলা! মনে হয় রহিম আর আমি একসঙ্গে বাড়ি বসে খেলা দেখি। তখন নিশ্চয় রহিম স্টাম্প মাইক শুনে বলে উঠবে, ‘রিভিউ নে, আমি শুনসি ব্যাটে লাগসে।’ আবার এ-ও ভাবি, সত্যি যদি স্টাম্প মাইক এত শক্তিশালী না হত, যদি রিল কন্টেন্ট না পাওয়া যেত, কী হত? যাকে বলে ‘Beauty of the game’, তার কোনও পরিবর্তন হত? না হত না। কারণ, স্টাম্প মাইক কথা শোনে, শব্দ শোনে। নৈঃশব্দ্য শোনে না। ধরে রাখে না নীরবতা।
ক্রিকেট এমনিতেই সাদা জার্সি আর লাল বলের খেলা। বাকি যা, তা আসলে উত্তেজনা দেওয়া-নেওয়া। টেস্ট ক্রিকেট আসলেই অপেক্ষার খেলা। নীরবতার খেলা। ওই যে বোলার ছুটে আসছেন, ব্যাটসম্যানের অপেক্ষার চোখ। চুপ। সব চুপ। আউটসুইং। ব্যাটসম্যান ছেড়ে দিলেন বল। এই অপেক্ষার মাঝে ক্রিকেট বেঁচে আছে। কথায় নয়। নীরবতায়। তাই স্টাম্প মাইক কন্টেন্ট দিতে পারে। ‘গ্রেট’ তৈরি হয় তার নিজের খেয়ালে। রিল-এ নয়। স্টাম্প মাইক আমাদের আশ্চর্য জানলা, যা দিয়ে আমরা মাঠে ঢুকে পড়ছি। হিচককের ছবি ‘Rear window’-র মতো। কেবল লুকিয়ে পড়শিকে জানলা দিয়ে দেখে নেওয়া। এতে এক গোপন আনন্দ আছে।
এর বাইরে আছে মাঠ। স্ট্যান্ডে বসে খেলা দেখার উত্তেজনা। ওই লাল বল উইলো কাঠে লাগলে যে শব্দের মূর্চ্ছনা, তাতে আমার প্রাণ রাখা আছে। ক্রিকেট প্রযুক্তিতে আরও আধুনিক হোক। কিন্তু তার শরীর যেন ধরে রাখে অপেক্ষাদের। চাওয়া বলতে এটুকুই।
……………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………………..