একসময়ে VHS ক্যাসেটে কিছু ‘প্রোপাগান্ডা ডকুমেন্টারাইজড ফুটেজ’ ঘুরতে শুরু করে সারা দেশ জুড়ে। প্রচুর প্রচুর বাবরি মসজিদ ভাঙার পক্ষে উস্কানিমূলক ভিডিও ক্যাসেট বিলি শুরু হয়। পদ্ধতি সেই রেপ্লিকা। একটা ক্যাসেট বানিয়ে সেখান থেকে হাজার হাজার কপি। লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রায়, বাবরি মসজিদের পটভূমিতে হিন্দুত্ব প্রচারের অংশ হিসেবে VHS ক্যাসেট ব্যবহার হয়েছিল। সম্ভবত সেই প্রথম, ভারতে, বিনোদন মাধ্যমকে ব্যবহার করে ধর্মীয় উস্কানিমূলক প্রচার চালানো হয়। এই ধরনের ধর্মীয় প্রচারের ফলে ভারতের বিভিন্ন সংবেদনশীল অঞ্চলে দাঙ্গা পরিস্থিতি অবধি তৈরি হয়।
কালো বাক্সে ভর্তি কালো টেপ প্যাঁচানো। কাচের অর্ধস্বচ্ছ দুটো চ্যাপটা ঢাকনার মতো, আর কোনায় স্প্রিং লাগানো একটা কালো লম্বাটে প্লাস্টিকের বার। এই আমাদের ওয়ার্ল্ড সিনেমার দরজা। ভিডিও ক্যাসেট। নয়ের দশকের চিঠি-চাপাটির প্রেমের মতোই নরম আলোয় ভরা অর্কেস্ট্রা বাজানো ঝংকার বিটসের এ-সাইড, বি-সাইডের অডিও ক্যাসেট; আর সঙ্গে এই ভাড়া করা ভিডিও ক্যাসেট।
আটের দশকের মাঝামাঝি ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক এবং বড় শহরগুলিতে বিদেশ ফেরত বাঙালি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি পরিবারের হাত ধরে ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার ও ক্যাসেট আসে অল্প সংখ্যক মানুষের ঘরে। সে ছিল এক দেখার মতো জিনিস। সিনেমাহলে না গিয়ে ঘরে বসে সিনেমা দেখা যায়, তাও আবার ইচ্ছেমতো!
পাড়ায় বা কমপ্লেক্সে কারও ঘরে ভিসিআর (VCR) আসা মানে লোকে ভিড় করে দেখতে আসত। এই ভিডিও ক্যাসেট ধীরে ধীরে প্রবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ভারতে। আটের দশকের শেষদিক থেকেই মুম্বই, দিল্লি, কলকাতার মতো শহরে ভিডিও লাইব্রেরি তৈরি শুরু হয়। নয়ের দশকের মুখে এই ভিডিও ক্যাসেট কালচারাল রেভলিউশনের অংশ হয়ে ওঠে। মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে রঙিন বাক্স টিভির পাশে সহচরীর মতো লাল-হলুদ কেবল ঝুলতে দেখা যায়। দূরদর্শনের ঘেরাটোপ কাটিয়ে বিশ্বায়নের আলো দেখানো ’৯০-’৯১ সালের ওয়ান্ডার বক্স ভিডিও ক্যাসেট। তার হাত ধরেই এল ঢাউস ক্যামকর্ডার।
বিয়েবাড়ি, পৈতে, অন্নপ্রাশন-বাড়ি ছেয়ে গেল ক্যাসেটে ক্যাসেটে। আর সেই ক্যাসেট মিক্সিং হয়ে এল। সন্ধেবেলা ঘর আলো করে সারা পাড়া বসে দেখা হত হোম মেড সিনেমা। আমেরিকায় ততদিনে সুপার ১৬-এর যুগ প্রায় শেষ। ডিজিটাল রেভলিউশন আসছে। সামাজিক অনুষ্ঠানের ভিডিও ২০০০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্যাসেট আর মিনি ডিভিডিতেই হত।
এরপর ভারতে আস্তে আস্তে এল পাইরেসির বাজার! পার্সোনালাইজড ভিডিও ক্যাসেট ছাড়া, বিনোদন মাধ্যমে এল হোম এন্টারটেনমেন্ট। ভিডিও ক্যামকর্ডারে সিনেমাহল থেকে রেকর্ড করে নিয়ে সেই ক্যাসেট চড়া দামে রেপ্লিকা করে বাজারে ছাড়া শুরু হল। আর সেই শুরু হল রিলিজের পরপরই বাড়িতে বসে সিনেমা দেখার স্বাদ। মধ্যবিত্তের হল-বিমুখ হবার সূত্রপাত সেই সময় থেকেই।
ক্যাসেট ও ভিসিআর ভাড়া নিয়ে সিনেমা দেখার চল হয় সেই আটের শেষ, নয়ের দশকের শুরু থেকে। বিশেষ করে দেখা যায়, গ্রামে-মফস্সলের প্রচুর মানুষ একসঙ্গে কোথাও জড়ো হয়ে ভিডিও পার্টি বা নাইট শো-র আয়োজন করতে। পরবর্তীতে সেখানে নামী কোম্পানির ভিডিও ক্যাসেটের পাশাপাশি দেখা হত পাইরেটেড ভিডিও।
শহরেও শুরু হল ঠাকুমা থেকে পিসির আবদারে ‘পথে হল দেরী’ থেকে ‘আশিকি’; বন্ধুবান্ধবী থেকে মা-বাবার জন্য ‘টারমিনেটর’ থেকে ‘শোলে’।এবং সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’, ‘দিল’-ও চলে এল ঘরে ঘরে।
বিশ্বায়নের প্রথম ধাপ। বিনোদনের বিশ্ব ঘরের কোনে।
আমার আবছা মনে আছে, আমাদের বাড়িতে রাতের খাওয়ার পর বাবা-মা মিলে দেখতে বসলেন ‘এক ডক্টর কি মৌত’।
আমার মুম্বইয়ের কাকা সেবার আমাদের বাড়ি এসে ভিডিও ক্যাসেট লাইব্রেরিতে গিয়ে নিয়ে এলেন বার্তোলুচ্চির ‘লিটল বুদ্ধা’, ফ্র্যাঙ্কলিন শ্যাফনারের ‘প্যাপিলন’, ‘২০০১ আ স্পেস ওডিসি’ এবং আমার জন্য এক অবাক পৃথিবীর গল্প, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’।
এভাবে আমাদের মফস্সলে ঢুকে গেল বিশ্ব চলচ্চিত্র। টেলিভিশন কন্টেন্টের সীমা ছাড়িয়ে, ‘দূরদর্শন’, ‘ভারত এক খোঁজ’, ‘তমস’, ‘মালগুডি ডেজ’ কিংবা বাংলাদেশ টেলিভিশনের শুক্রবারের ‘ম্যাক গাইভার’ কিংবা ‘নাইট রাইডার্স’-এর বাইরে, পছন্দের নতুন মুক্তি পাওয়া ছবির সঙ্গে পরিচিতির এক সুবর্ণ সুযোগ করে দিল ভিসিয়ার।
ক্যাসেট লাইব্রেরিগুলোতে ঢুকলে, মাথা গুলিয়ে যেত। তাকের পর তাক, থাক থাক সিনেমার সাম্রাজ্য। এক একটা তাক এক একটা জগতের দরজা, এক সাম্রাজ্য। ক্যাসেটের দোকানের মালিকরাও এই সূত্রে জেনে ফেলতেন বিশ্ব সিনেমার হাল-হকিকত।
তাঁরা রেফার করতেন, স্পিলবার্গ থেকে জর্জ লুকাস, অমিতাভ থেকে গোবিন্দ নিহালনি।
তবে এই ঝাঁকেই ঢুকে পড়ত তারকভস্কি থেকে ফেলিনি। হঠাৎ কোনও এক তাকে চোখে পড়ত মণি কাউল কিংবা আইজেনস্টাইন। কিন্তু সে ছবি রেফার করার খুব একটা কেউ থাকত না। তাই হঠাৎ একদিন বাড়ি নিয়ে এসে দেখে ফেললে আবিষ্কার হত এক অজানা পৃথিবী।
এক সমান্তরাল পৃথিবী। সমান্তরাল সিনেমা।
ভারতে ভিডিও ক্যাসেটের আগমন শুধু একটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, এটি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা বলে ধরা হয়। এই বিপ্লব-বহির্ভূত কিছু অন্যান্য দিকও জন্ম নেয়, যেভাবে আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে হচ্ছে। যে কোনও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মানুষ তাঁর নিজস্ব ভাবনাকে প্রকাশ করবে, এটা আদিকাল থেকেই হয়ে আসছে। সেই সময়ের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো VHS ক্যাসেটকে তাদের প্রচারের ও পার্টির বক্তব্য মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেবার প্রধান মাধ্যম করে ফেলে।
১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধির হত্যাকাণ্ডের পর VHS-ক্যাসেটে তাঁর জীবন ও বিগত সময়ে ভারতের সামগ্রিক উন্নতিতে তাঁর অবদানের উপর নির্মিত ভিডিও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়।জাতীয় কংগ্রেস এই ভিডিও প্রচারের ওপর জোর দেয়।
এর পরবর্তীতে রাজীব গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস VHS ক্যাসেটে তথ্যচিত্রের মতো করে ফিল্ম বানিয়ে তাঁর ‘মডার্ন ইন্ডিয়া’ ভাবমূর্তি সারা ভারতে ছড়িয়ে দেয়। কম্পিউটার, কমিউনিকেশন, সায়েন্স, শিক্ষানীতি ইত্যাদি নানা বিষয়ের ওপর ভিডিও তৈরি করে গ্রাম-শহরে ভিডিও ক্যাসেটে চালিয়ে দেখানো হত। সেটা কোনও সময় পার্সোনাল ভিডিও কালেকশনের মাধ্যমে কিংবা পাড়ার ক্লাবে, রাস্তায় কিংবা গাছের তলায় টিভি, ভিসিআর লাগিয়ে।
এছাড়া কংগ্রেসের প্রচার মাধ্যমে থাকত ভারতের ইতিহাস, পুরাণ, কৃষি, টেকনোলজি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির বিভিন্ন ভিডিও ফিল্ম।
তো, এই হেন সময়ে এল বিখ্যাত ’৯২ সাল। ডিসেম্বর মাস। বাবরি মসজিদ ভাঙছে, আমরা কোথাও লাইভ দেখিনি। সেসময় রাষ্ট্রীয় মিডিয়া অশান্তি ছড়াবার ভয়ে স্বভাবতই সংযতভাবে খবরটি দেখায়। বিকেলের পর থেকে BBC, CNN ইত্যাদি সব আন্তর্জাতিক মিডিয়া গ্রাউন্ড ফুটেজ দেখানো শুরু করে।
বাবরি ধ্বংসের পর দেশজুড়ে দাঙ্গা ছড়ায় (মুম্বই দাঙ্গা তাঁর মধ্যে অন্যতম), যেখানে ধর্মীয় উত্তেজনার সামাজিক কাঠামো আগে থেকেই তৈরি ছিল। যার একটি অংশ ছিল হিন্দু জাগরণ মঞ্চ-এর মতো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর প্রচার। যার একটি প্রধান অস্ত্র ছিল ভিডিও রথ।
VHS প্লেয়ার ও টিভি-সহ গাড়িতে করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ধর্মীয় উস্কানিমূলক ভিডিও দেখানো শুরু হয়। ভিডিও ক্লাব বা পার্টির কর্মীদের মাধ্যমে VHS ক্যাসেট ছড়িয়ে দেওয়া হত। প্রতিটি সমর্থকের বাড়িতে ক্যাসেট পাঠানো হত।
এইবার এই VHS ক্যাসেটে কিছু ‘প্রোপাগান্ডা ডকুমেন্টারাইজড ফুটেজ’ ঘুরতে শুরু করে সারা দেশ জুড়ে। প্রচুর প্রচুর বাবরি মসজিদ ভাঙার পক্ষে উস্কানিমূলক ভিডিও ক্যাসেট বিলি শুরু হয়। পদ্ধতি সেই রেপ্লিকা। একটা ক্যাসেট বানিয়ে সেখান থেকে হাজার হাজার কপি। লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রায়, বাবরি মসজিদের পটভূমিতে হিন্দুত্ব প্রচারের অংশ হিসেবে VHS ক্যাসেট ব্যবহার হয়েছিল।
সম্ভবত সেই প্রথম, ভারতে, বিনোদন মাধ্যমকে ব্যবহার করে ধর্মীয় উস্কানিমূলক প্রচার চালানো হয়। এই ধরনের ধর্মীয় প্রচারের ফলে ভারতের বিভিন্ন সংবেদনশীল অঞ্চলে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয়।
১৯৯৩ সালে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় কিছু ক্যাসেট ও প্যাম্ফলেটের ওপর। কিন্তু তবুও ১৯৯৩-’৯৮ সাল পর্যন্ত এই ক্যাসেটগুলো অনেক নির্বাচনী প্রচারে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ব্যবহার করা হয়।
এরপর থেকে বিভিন্ন কারণেই ভিডিও ক্যাসেটের ওপর ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। শুধুমাত্র প্রচার বা রাজনৈতিক কারণে নয়, লিগাল ইস্যুতেও ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে ভিডিও ক্যাসেট ইন্ডাস্ট্রি এবং তারই সঙ্গে ক্যাসেট-পার্লারগুলি।
চলে আসে মিলেনিয়াম। আর ২০০০ সাল আসার সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসে সিডি-র যুগ। সিডি এবং ডিভিডি আসার পর থেকেই ভারতে VHS-এর বাজার এক ধাক্কায় একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। সেন্সর বোর্ড কড়াকড়ি এবং পাইরেসির নিষেধাজ্ঞার ফলে মুখ থুবড়ে পড়ে গ্রাম্য থেকে শহরের হাজার হাজার ভিডিও হল।
রাজনৈতিক প্রচার মাধ্যমেও ধীরে ধীরে চলে আসে বিরাট বদল। দেশে প্রবেশ করে ইন্টারনেট। তৈরি হয় আইটি সেল। তথ্য প্রযুক্তির সংজ্ঞাটাই বদলে যায় ধীরে ধীরে। আর এরই সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যায় ২০ বছরের বৃদ্ধ এক প্রযুক্তিগত শিল্পবিপ্লব।
VHS– যা ভারতের আপামর জনতাকে প্রথম বিশ্বায়নের স্বাদ এনে দিয়েছিল।
১৯২৫ সালের মে মাসে ফরিদপুরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সে সভাপতির ভাষণে চিত্তরঞ্জন দাশ ঘোষণা করলেন যে, সরকারের সঙ্গে সম্মানজনক সহযোগ করতে তিনি প্রস্তুত। নেতৃত্বের মোহ যখন মানুষকে আচ্ছন্ন করে তখন মহৎ মানুষের অবদান বা তাঁর থেকে দেশের আরও প্রাপ্তি আমরা বিস্মৃত হই না কি?