এই লেখাটা রাজনৈতিক মিছিলের পুরোটা নিয়ে নয়। মিছিলের শিল্প নিয়ে। রাজনৈতিক মিছিলের শিল্প কাজ এক, দুই করে বলে গেলে– হাতে ধরা পোস্টার, সামনে ধরা ব্যানার, বুকে ঝোলানো পোস্টার, ছবি আঁকা, কথা আঁকা। পোস্টার ছাপাখানায় তৈরি হয়, ব্যানার দোকানে লেখা হয়– এই লেখাটিতে তারা নেই। যাতে হাতে আঁকা অক্ষর, হাতে আঁকা ছবি থাকে– সেই ব্যানার, পোস্টার নিয়ে লেখাটা।
এই লেখাটা শুধুই রাজনৈতিক মিছিল নিয়ে। লেখার পরিসর ছোট। বিষয়ের চারপাশটা ছোট করে নেওয়া। নিজে অন্য মিছিলে হাঁটলেও, বেশিটা ‘রাজনৈতিক’ মিছিলেই।
এই লেখাটা রাজনৈতিক মিছিলের পুরোটা নিয়ে নয়। মিছিলের শিল্প নিয়ে। রাজনৈতিক মিছিলের শিল্প কাজ এক, দুই করে বলে গেলে– হাতে ধরা পোস্টার, সামনে ধরা ব্যানার, বুকে ঝোলানো পোস্টার, ছবি আঁকা, কথা আঁকা। পোস্টার ছাপাখানায় তৈরি হয়, ব্যানার দোকানে লেখা হয়– এই লেখাটিতে তারা নেই। যাতে হাতে আঁকা অক্ষর, হাতে আঁকা ছবি থাকে– সেই ব্যানার, পোস্টার নিয়ে লেখাটা।
এই অক্ষর থাকা, ছবি থাকার একটা ইতিহাস আছে। তার আগে ভূগোলটা ঘুরে আসি।
রাজনৈতিক মিছিল গ্রামে, মফস্সলে, ছোট শহরে, বড় শহর কলকাতায়। ভূগোলের এই ভাগ অনুসারে মিছিলে থাকা ছবি বদলে যায়। পরিমাণে, ধরনে।
মাঝপথে অন্য একটা কথা বলে ফেলি, বারবার এই ‘রাজনৈতিক মিছিল’ কথাটা লেখার দরকার নেই। যাঁরা পড়ছেন, জেনে নিন– এই লেখাটিতে ‘মিছিল’ মানেই রাজনৈতিক মিছিল।
এই লেখাতে ‘মিছিল’ শুধুই কলকাতা শহরের মিছিল। আমার হাঁটা মিছিল।
এই লেখাতে কথার সঙ্গে ছবি থাকছে। মিছিলে থাকা ছবি আর সেই ছবি নিয়ে কথা। এখানে যা যা ছবি দেখানো হবে, তা আমার বন্ধুদের তোলা ছবি। তারা রাজনীতিক, রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য। সব ছবি দেখানো হবে না, এই ছোট লেখাটাতে তা ঠিক হবে না।
মিছিলে হাঁটা শুরু ষাট-সত্তরের সময় থেকে, কলেজে পড়া থেকে। এই লেখাতে যা লিখব, তা নিজের জানা, করা, দেখা দিয়েই। মিছিল বানালে মিছিলকে জমকালো করতে হয়, যারা রাস্তার দু’পাশে রয়েছে, তারা যাতে দেখে, মিছিলে তোলা স্লোগান শোনে, বোঝে, নিজেরা হাঁটলাম– শুধুই তা নয়, অন্যদের জানালাম, শোনালাম, বোঝাতে চাইলাম, ভাবতে বললাম, আমাদের পাশে চাইলাম। মিছিল মদত বানাতেই, নিছক নিজেদের দেখাতে নয়।
মদত বানানোর নানা উপায়– একটা হল স্লোগান দেওয়া। স্লোগানের নানা উপায়। স্লোগান বানানো। এমনভাবে কথা সাজানো, যাতে ছন্দ থাকে। হাততালি দিয়ে তাল তৈরি করা যায়। সবাই স্লোগান শুরু করতে পারে না। গলায় জোর আছে। জোরে বললেও শুনতে ভালো লাগবে। পরিষ্কার উচ্চারণ। তাল দিয়ে বলা। এরা মিছিলের মাঝখানে।
মিছিল ছোট হলে ১ জন, বড় হলে ২ বা বেশি। খেয়াল রাখতে হবে, যারা স্লোগান তুলছে, তারা একসঙ্গে তুলবে। নয়তো তাল কেটে যাবে। তাল রাখার উপায় হাততালি দেওয়া, হাত উপরে তোলা, নামানো। হাতের চেটো খোলা রেখে, মুঠো করে। মুঠো করলে মুঠো উপরে উঠবে, নিচে নামবে। ওঠার সময় মুঠো বন্ধ, নামার সময় মুঠো খোলা। এদের সঙ্গে গলা মেলাবে যারা হাঁটছে। তাদের কথা ছোট। একটা উদাহরণ: যারা স্লোগান তুলবে তারা বলল, ‘সরকার আমরা তোমার কথা মানছি না, মানব না।’ এবার মিছিল সায় দেবে– ‘মানছি না, মানব না’। এই ‘মানছি না, মানব না’ বলার সময় তালুতে তালু লাগিয়ে শব্দ করা হয়, আবার তাল মেলানোও হয়। কোনও একসময় তাল মেলাতে মেলাতে চলার পা, আওয়াজের গলা, ওঠা-নামার হাত, শরীরের দোলা তাল বানিয়ে ফেলে অজান্তেই! ইচ্ছে তৈরি হয়ে যায়– দু’পাশের রাস্তায় যারা দাঁড়িয়ে দেখছে, শুনছে, সেই তালে নিজেদের জড়িয়ে নিক। মিছিল তো শুধু নিজেদের জন্য নয়।
এই তালে তালে চেরা বাঁশ দিয়ে বানানো চাটাইয়ের উপর আঠা দিয়ে সাঁটা পোস্টার, তা ধরে থাকার জন্য বাঁধা কঞ্চি উপরে উঠবে নামবে, বাঁদিকে, ডানদিকে ঘুরে মাঝখানে ফিরে আসবে। মিছিলের সামনে ধরা ব্যানার নিয়ে তা করা যাবে না, টানটান করে ধরে রাখতে হবে, দু’দিকে ২ জন, মাঝখানে ১ বা ২ জন।
ব্যানার দোকানে লেখানো যায়, ব্যানার লেখার আলাদা দোকান আছে, সাধারণত, যেখানে দোকানের সাইনবোর্ড লেখানো হয়, সেখানে। বয়ান বলে দিতে হবে। কাপড় ওঁরা দেবেন, না-হলে কিনে দিতে হবে। রং বলে দিতে হবে, সাদা, কালো, ঘন নীল। হয় কাপড়ের মাপ অনুযায়ী বয়ান, নয়তো বয়ানের কথা অনুযায়ী মাপ। কাপড়ের রং অনুযায়ী কথার রং। কাপড় সাধারণত– সাদা, কালো, লাল। বয়ানের রং যারা আঁকতে গেছে তাদের মতে, নয়তো দোকানদারকে ছেড়ে দেওয়া– ‘আপনার যেটা ভালো মনে হয়।’
পরের দিকে বদলে গেল। শিল্পীরা এল দলে, তারা বানিয়ে দিল। দলের ক্যাডাররা শিখে নিল, তাদের শিখিয়ে দেওয়া হল। পোস্টারও তাই। ছাপার বদলে হাতে লেখা। অক্ষরের সঙ্গে আঁকা ছবি। ব্যানার একটা নয়। সামনে একটা বড়, ভিতরে ছোট ছোট কথা লেখা। কথারা দোকানদারের আঁকা প্রচলিত ধরনই শুধু না, অক্ষর নিয়ে পরীক্ষা, অক্ষর তখন ছবি।
যারা সামনে ব্যানার ধরে থাকে, তারা গুরুত্ব পায়। গুরুত্বটা ছড়িয়ে পড়ল মাঝে চলা ব্যানার ধরায়। ব্যানার মাঝখানে আসায় একটু উপরে তুলে ধরতে হল রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনকে দেখাতে, পড়াতে।
সামনে ধরে থাকা ব্যানারে দু’পাশে লাঠি গোঁজা থাকা পারে টানটান করার জন্য। আবার কাপড়ে বানানো কান থাকতে পারে আঙুল দিয়ে ধরার জন্য। মাঝখানের ব্যানারে শুধুই কান।
মিছিলের দলে শিল্পীরা চলে আসায় পোস্টার আর ব্যানারে অক্ষর ও ছবি আঁকা শেখা, শেখানো চালু হল। অক্ষরের ছাপ, মাপ, রং, সঙ্গে ছবি। শেখানো, কথা বলা দফতরে, দফতরের সামনে, খোলা জায়গায়, বিড়ি, সিগারেট যার যা চলে– লাল চা, সাদা চা, যার যা অভ্যেস, লেড়ো, খাস্তা– যা যখন পাওয়া বিস্কুট।
একটা টান, বুঝলি তো, এইভাবে, রংটা কেন দিলাম ধরতে পারলি? কবজি ছেড়ে দে, শক্ত করলে তুলি চলবে না, বুড়ো আর তার পাশের আঙুল দুটো তুলি ধরার সময় শক্ত, বাকি তোর কথা শুনে নড়বে চড়বে। ছড়ানোর সময় মনে রাখবি কতটা জায়গা পাবি। মুখ চলতে থাকবে, কান শুনতে থাকবে, আঙুল নড়তে থাকবে।
কখনও ইচ্ছে হলে, জানা-বোঝা করিয়ে লোক থাকলে মিছিলে ট্যাবলো রাখা। ভ্যান রিকশা, অটো, ছোট লরি, লেখা, আঁকা দিয়ে সাজিয়ে মিছিলের সঙ্গে চলা। চারপাশ সাজানো, সবদিক থেকে দেখা।
আমার বন্ধু সৃজন আর একভাবে মিছিল সাজাত। বড় বড় পুতুল বানিয়ে, যেমন সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক, তা নিয়ে মিছিলের সঙ্গে চলা। মিছিল শেষে প্রতিবাদে আগুন লাগিয়ে দেওয়া। খবরের কাগজের ভাষায়– ‘কুশপুত্তলিকা দাহ’।
সবশেষে বলার, মিছিলের গান। গানের তালে তালে হাততালি দেওয়া, হাতে ধরা পোস্টার ওঠানো, নামানো। শেষ হয়েও শেষ হয় না। মিছিলের শেষে পথনাটক। যারা মিছিলে হাঁটল, পোস্টার, ব্যানার এদিক-ওদিকে টাঙিয়ে রেখে একটা জায়গা গোল করে বানিয়ে পথনাটক। নাটকও তখন ছবি। ছবির মতো!
নাটক হওয়ার সময় মিছিলের পোস্টার, ব্যানার সব গুছিয়ে রাখা, নিয়ে যাওয়া, আবার লাগতে পারে।
এবার শেষ করি।
যাঁরা পড়ে চলেছেন তাঁরা এতটা পথ হেঁটে ক্লান্ত। আমরা যেমন হতাম। জানতাম কাছে-পিঠে কোথায় ভাঁড়ের চা। চায়ের ভাঁড় ধরে উত্তেজনায় হাত কাঁপত। কীসের জন্য উত্তেজনা– প্রশ্ন তখনও করিনি।
এখনও না।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশ্রমবিদ্যালয়ের আশ্রমকন্যাদের অগাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সেখানে আলাদা করে কোনও প্রহরী রাখতেও দেননি। মেয়েদের স্বাধীন সত্তাকে এতটাই মূল্য দিতেন তিনি। তাই চিত্রনিভার স্কেচ করতে যাওয়ার জন্য তিনি কোনও সীমানা নির্দেশ করেননি, ছবি আঁকার জন্য তিনি যতদূর খুশি যেতে পারতেন।