আফ্রিকার সিংহের আদলে সিংহ বানাতে পালমশাইয়েরা নির্ভর করেছিলেন ব্রিটিশদের বানানো সিংহের ওপর। বনেদি বাড়ির দরজায়, লাটসাহেবের মূল ফটকের ওপরে ফুটবলের মতো পৃথিবীটাকে পায়ের নিচে নেওয়া সিংহরাই ছিল পালমশাইদের সোর্স। শন পাকিয়ে তার কেশর বানানো হল। প্রথমে একটা খড়খড়ে ইটের ঢেলা, গায়ের নরম মাটির ওপর ঠুকে ঠুকে তার লোমশ ভাবটা আনা হত। পরে রোঁয়া ওঠা তোয়ালে জড়িয়ে দেওয়া হতে লাগল সিংহের শরীরে। আর হলুদ রঙের মার্বল দিয়ে বানানো হল চোখের মণি, ঝাঁটার কাঠি দিয়ে গোঁফ। ব্যস!
১২.
দুর্গা সিংহবাহিনী। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র প্রতি বছর মনে করিয়ে দেন ‘হিমালয় দিল সিংহবাহন’। রচনা: বাণীকুমার। সোর্স ‘শ্রী শ্রী চণ্ডী’।
ছোটবেলা থেকে আমরা জেনেছি যে, ‘সিংহ রাগে কেশর নাড়ে’। মানে সিংহ বেশ একটা রাগী জানোয়ার! সিংহীর কেশর নেই। রেগে গেলে কী করে, জানা নেই। এরা দল বেঁধে থাকে, আর সিংহের ডাক প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার দূর থেকে শোনা যায়।
সিংহ দুর্গার ডান পায়ের নিচে থাকে। বাংলার সরাচিত্রে আর ট্রাডিশনাল বা একচালার মূর্তিতেও ডান পায়ের নিচেই সিংহ থাকে। ডানদিকের থেকে বাঁ-দিকে মুখ ফেরানো, অর্থাৎ অসুরের দিকে। পিছনের পা টানটান করা আর সামনের থাবার আঘাত অসুরের হাঁটুতে।
অসুরকেও হাঁটু গেঁড়ে প্রায় সিংহের ভঙ্গিতেই বানানো হয়। এর ফলে যেটা ঘটে, তা হল একটা কৌণিক বা পিরামিডের আকারের কম্পোজিশন, যার শীর্ষে দুর্গা অবস্থান করেন। তিনি ডানহাতের ত্রিশূলে অসুরকে বিদ্ধ করছেন। দশ হাত থাকলেও তিনি ডানহাতি বলেই মনে হয়।
পালমশাইদের সমস্যা অনেক। প্রতিমার নির্মাণ পুরোটাই পুরাণ ও লোককথা নির্ভর। বংশপরম্পরায় অর্জিত স্কিল দিয়ে তৈজসপত্র বানানো একরকম আর প্রতিমা বানানো অন্যরকম। প্রতিমা নির্মাণের জন্য গল্পগাথার দ্বারস্থ হতে হয় প্রথমে, তারপর আসে নৈপুণ্য অর্জন। আর সেইসব পুরাণাশ্রিত শ্রুতি, স্মৃতি হয়ে বিচরণ করে মস্তিষ্কে।
যার ফলে ঘোড়া আর পাখি মেশানো, সিংহের মতো এক অদ্ভুত জানোয়ারের অবতারণা। তার রং সাদা। ওই যে বলা আছে, ‘হিমালয় দিল সিংহবাহন’। পাহাড়ি মতে বাহারি সিংহ। তবে বেশ ছন্দোময় তার গড়ন। হিংস্র ভাবটা একটু কম। গোঁফের জন্য একটু রাগী মনে হয় শুধু।
শশীবাবু জানতেন না যে, আফ্রিকার রাজার মুখগহ্বরের নিশ্চিত আশ্রয়ে আছে বহুমূল্য গণেশের মূর্তি। শুধু পালমশাইয়ের গড়া বেলেমাটির সিংহ আর চুইংগামের আঠার রসায়নটা ঠিকঠাক না মেলায় সিংহ, বিকাশ সিংহের হাতে চলে যায়। যার ফল শশী পালের খুন হওয়া।
এসবই সিনেমার কথা, কিন্তু আফ্রিকার সিংহের আদলে সিংহ বানাতে পালমশাইয়েরা নির্ভর করেছিলেন ব্রিটিশদের বানানো সিংহের ওপর। বনেদি বাড়ির দরজায়, লাটসাহেবের মূল ফটকের ওপরে ফুটবলের মতো পৃথিবীটাকে পায়ের নিচে নেওয়া সিংহরাই ছিল পালমশাইদের সোর্স। শন পাকিয়ে তার কেশর বানানো হল। প্রথমে একটা খড়খড়ে ইটের ঢেলা, গায়ের নরম মাটির ওপর ঠুকে ঠুকে তার লোমশ ভাবটা আনা হত। পরে রোঁয়া ওঠা তোয়ালে জড়িয়ে দেওয়া হতে লাগল সিংহের শরীরে। আর হলুদ রঙের মার্বল দিয়ে বানানো হল চোখের মণি, ঝাঁটার কাঠি দিয়ে গোঁফ। ব্যস! তাতেই কাত দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহিষাসুর।
নন্দলাল বসুর ছবিতে অধিকাংশ দুর্গা বেগবতী। তাদের ডানদিকে ফেরানো সিংহের মাথা আর তারা সেই গতিমুখেই যুদ্ধে রত। বাংলার সরাচিত্রের মতো কম্পোজিশন নয়। সেখানে দুর্গা অনেক স্থির। নন্দবাবুর ছবিতে দুর্গা, সিংহ, অসুর– সবেরই খুব ছটফটানি।
নন্দবাবুর ছবি থেকে কুমারটুলির শিল্পী জিতেন পালের গড়া ২৩ পল্লির দুর্গার কথা আমরা জানি। পাশাপাশি সেখানকার শিল্পী রাখাল পালের বানানো প্রতিমায় সিংহের অবস্থান লক্ষ করুন পাঠক। টানটান শরীরটাকে এক কাঠামোর ওপরে কী অসাধারণ দক্ষতায় সংস্থাপিত, তা বলার নয়।
সিংহ আসলে প্রতীক। শৌর্যের, বীররসের, রাজকীয় মহিমার। তাকে নিয়ে পৌরাণিক এবং সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে লেখা ফুরবে না। এই দুটোই আমার বিচরণক্ষেত্র নয়। আমি এক অতি সাধারণ শিল্পচর্চাকার মাত্র। সেই সূত্রেই এক অসাধারণ গল্প বলে এই সিংহবাহন লেখায় ইতি টানি।
গল্পটা প্রখ্যাত শিল্প-ঐতিহাসিক প্রশান্ত দাঁ-র কাছে শোনা। প্রখ্যাত ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী তখন কলকাতায় স্থিত। বাড়িতে বিভিন্ন শিল্পী, সাহিত্যিকের আনাগোনা। গল্প করতেন, শিল্প-পরামর্শ দিতেন, চারমিনার খেতেন। ছাত্রবৎ শিল্পী কালীকিঙ্কর ঘোষদস্তিদার একবার একগোছা নিউজ প্রিন্টে সিংহের স্কেচ করে নিয়ে গেছেন তাঁকে দেখাতে। আঁকার পরিমাণ দেখে প্রমাদ গুনলেন দেবীবাবু। বললেন সেগুলো রেখে যেতে, আর দিন ২০-২২ বাদে আসতে, তখন ছবি নিয়ে কথা হবে। তারপর মাসখানেক কেটে গেল। হঠাৎ করেই দেবীবাবু কালীকিঙ্করের খোঁজ শুরু করেন এবং আরেক ছাত্রকে ট্যাক্সিভাড়া দিয়ে তাঁকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে নিয়ে আসতে পাঠান। হন্তদন্ত কালীকিঙ্করের আঁকা ছবি শুধরে দিতে দিতে বলেন– ‘কালী, তোকে দিন ২০-২২ বাদে আসতে বলার কারণ আর কিছুই নয়। আগে আমি বিশেষ কিছু সিংহের ছবি আঁকিনি তো, তাই তোকে দেখানোর আগে এ কদিন চিড়িয়াখানায় সিংহ স্টাডি করে আসলাম।’ কালীকিঙ্কর তখন কেঁদে ভাসাচ্ছেন।
মাস্টারমশাই দেবীপ্রসাদের এই সিংহহৃদয় আমাদের যদি আদর্শ হয়ে থাকত!
… পড়ুন বাহনকাহন-এর অন্যান্য পর্ব …
১১. কার্তিক ময়ূরের পিঠে বসলেও তা সিংহাসনের মর্যাদা পায় শাহজাহানের পৃষ্ঠপোষকতায়
১০. সন্ত্রাসেও আছি, সিদ্ধিতেও আছি
৯. শনির চেয়েও ভয়ংকর তার বাহনের দৃষ্টি
৮. জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে যে বাহনের অবাধ বিচরণ
৭. দেবতার চেয়ে মানুষের বাহন হিসেবেই কুকুর বেশি জনপ্রিয়
৬. বিশ্বকর্মার বাহন, রাজারও বাহন
৩. বাহন বিড়ালের ভার লাঘব করতে হয়েছিল স্বয়ং ঠাকুরকেই
১. মন্দিরের লাগোয়া তার আসন, তার কানে মনের বাসনা জানালে সরাসরি পৌঁছে যায় বাবার কাছে
স্পেশাল ইভেন্টগুলো খুব উপভোগ করতাম, যেমন, নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে সেকেন্ড চ্যানেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, দিনটি ছিল ১৯ নভেম্বর, ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন। সেবারের অনুষ্ঠানে কলকাতার বহু নামী শিল্পী যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন বম্বের অনেক নামজাদা সঙ্গীতশিল্পী।
ভবিষ্য-পুরাণের শ্লোক থেকে বোঝা যায়, আধুনিক কুম্ভমেলার জন-সমাগমের ভিত্তি তৈরি হয়েছে এইসব সময় থেকেই। তবে এখানে মনে রাখতে হবে– ভবিষ্য-পুরাণের অনেক অংশই এই সেদিন লেখা হয়েছে, এতটাই সেদিন যে, এখানে ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে ইলায়জা ইম্পে এমনকী কুইন ভিক্টোরিয়ারও বর্ণনা আছে!