জমদগ্নি বলছে, এক ফুটিফাটা সকালের কথা। তীর ছোড়া প্র্যাকটিস করছিল। একটা করে তীর ছোড়ে, মুনিপত্নী রেণুকা কুড়িয়ে কুড়িয়ে আনে। জৈষ্ঠ। গরম হাওয়ার হল্কা। তীর আনতে আনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে রেণুকা। ভাবে গাছের তলায় খানিক জিরিয়ে নেবে। তাকে দেখতে না পেয়ে জমদগ্নি মারাত্মক রেগে যায়। সূর্যর উপরই রাগটা গিয়ে পড়ে। ব্যাটা তোর জন্য, আমার বউটা হাঁপিয়ে উঠল। ‘দাঁড়া আজই তোকে মেরে ফেলব।’ সূর্যর দিকে তীর তাক করছে। সূর্য আতঙ্কিত। সঙ্গে সঙ্গে একটা ছাতা নিয়ে রেখে দিচ্ছে জমদগ্নির পায়ে। পিতামহর ঠোঁটে মিচকি হাসি, ‘চিয়াই ভাই, এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ ছাতা কোন দেশে প্রথম তৈরি হয়েছিল।’
প্রচ্ছদ চিত্র: সত্যজিৎ রায়ের ছাতুবাবুর ছাতা-র প্রচ্ছদ থেকে
খাটায় খাটায় লাভের গাঁতি।
তার অর্দ্ধেক কাঁধে ছাতি॥
ঘরে বসে পুছে বাত।
তার ভাগ্যে হা ভাত॥
খনার এই বচন প্রথম শুনেছিলাম উৎপলের কাছে। সম্পর্কে সে আমার শ্যালকের শ্যালক। মুর্শিদাবাদের হরিশ্চন্দ্রপুরে বাড়ি। বাপ-ঠাকুরদার যজমানি পেশা আঁকড়ে আজ ৩০-৩৫ বছর দিব্যি আছে। বড় ছেলেকে বাইক কিনে দিয়েছে। ছোটটা হাজরায় থাকে, উকিল হওয়ার তোড়জোড় চালাচ্ছে। উৎপল সেই বচনের অর্থও আমাকে বুঝিয়েছিল। সত্যিকারের খাটতে পারা মানুষ প্রচুর আয় করে। যে মাথায় ছাতা নিয়ে অন্যে কে কী করছে দেখে বেড়ায় (তদারকি?) তার উপার্জন তুলনায় কম। ঘরে শুয়ে শুয়ে যে শুধুই দুনিয়ার খোঁজ নেয়, তার ভাত জোটে না।
উৎপল যখন শুনেছিল, কর্মস্থলে আমার কাজ হল তদারকি আর খবরদারি করা, তখন আমাকে ওই দ্বিতীয় শ্রেণিতে রেখেছিল। যার কাঁধে ছাতা। ঘুরে ঘুরে লোকের কাজ দেখে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। তুলনাটা বেশ। বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকে মাঝেমাঝেই আমাকে সে ছাতা এনে দিত। ছাতা হারানো নিয়ে কোনও টেনশন থাকত না। জানতাম, ওর শ্রাদ্ধ বা অন্নপ্রাশনের মতো কাজ এসে গেলেই নতুন একটা পেয়ে যাব। শুধু ফোন করতে হবে, ‘উৎপল, তোমার মহেন্দ্র দত্তটা হারিয়েছি।’ ওই প্রান্ত থেকে পেতাম আরও ভালো এনে দেওয়ার আশ্বাস। কে সি পাল।
সবাই জানেন, হিন্দু ধর্মে ছাতা দান মহাপুণ্যের কাজ। উৎপলের কাছে বিশ্বাসী মানুষের এই দান আশীর্বাদের মতো হয়ে উঠেছিল। ওই রকম পাওয়া কত ছাতা সে বিক্রি করেছে– ইয়ত্তা নেই! ছেলেদের মানুষ করা, দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত মায়ের চিকিৎসার কঠিন সন্ধিক্ষণে সত্যিই কাজে আসত ছাতা বিক্রির উপার্জন। আমি মজা করে বলতাম, তুমি যা ছাতা বিক্রি করেছ, তা মহেন্দ্র দত্তর পাঁচ জেনারেশনও পারেনি। শুনে পইতে বের করে দৃষ্টিকটু ভাবে পিঠ চুলকোতে চুলকোতে সে হেসে গড়িয়ে পড়ত।
এখন ভরা বর্ষা। ছাতা নিয়ে দু’-চার কথা বলার ইচ্ছে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কোনও ফিচার-লেখকের পক্ষেই এই প্রসঙ্গে নতুন কিছু জানানো কঠিন। যা-ই লেখার কথা ভাবা হবে, দেখা যাবে, বেশিরভাগ পাঠকের কাছেই তা অতিশ্রুতির নামান্তর।
কী লেখা হবে?
মহেন্দ্র দত্তকে দিয়ে শুরু করা হবে? বর্ধমানে রাজার দরবারে পাখোয়াজবাজ ছিলেন? একবার রাজার বিলিতি ছাতা সারিয়ে চমকে দেন! উল্লসিত রাজার বকশিসের টাকাতেই ব্যবসা খুলে ফেলেছিলেন?
এই রকম নানা কথা হাওয়ায় ভাসতে থাকবেই। পুরাণ থেকে হাল আমলের হালখাতার এমন অসংখ্য কাহিনি আবার বলা মানেই পুনরাবৃত্তি। অথচ একেবারেই কিছু না-বললে চলে না। গৌরাঙ্গর বন্দনা না করে যেমন কীর্তন হয় না, তেমনই যে কোনও প্রসঙ্গের একটা গৌরচন্দ্রিকা রাখতে হয়। এই আলোচনায় সেই মুখপাত হল একটি স্বপ্ন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি ছোটদের বলতেন, আগের রাতে দেখা স্বপ্নটা ঘুম ভাঙলেই লিখে ফেলতে। এখানেও ঠিক তেমন কিছু চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও লিখতে বসে দেখা যাচ্ছে, সব কিছু মনে পড়ছে না। হয়তো সে সময় ঘুমটা গভীর ছিল।
লম্বা স্বপ্নটা মোটামুটি এ রকম।
উৎপল আমায় একটা আমন্ত্রণপত্র দেখাচ্ছে। যেখানে রয়েছে ছাতা নিয়ে অনুষ্ঠিতব্য কোনও মহাসম্মেলনের খবর। তিনদিন ধরে চলবে কেরলের কুদাকাল্লুতে। হুবহু ছাতার মতো দেখতে একটা পাথরের ছায়ায় মঞ্চ করা হয়েছে। আমন্ত্রণপত্রে দেখলাম, ছাতা নিয়ে বক্তব্য রাখবেন কিংবদন্তি ‘ছত্রপতিরা’। যাদের কেউ কেউ স্বর্গ থেকে নিশ্চয়ই রথে চড়ে নেমে আসবেন। মহেন্দ্র দত্তও আসবেন। বলবেন, তিনি ভাবতেই পারেন না, তাঁর ব্যবসা এখনও টিকে রয়েছে। ভদ্রলোক আলাদা করে ধন্যবাদ জানাবেন নিজের কোনও এক পক্ষের স্ত্রী রাধারাণী দেবীকে। যিনি তাঁর অকালপ্রয়াত স্বামীর অন্য পক্ষের দুই সন্তানের ব্যবসা বিক্রি বন্ধ করতে প্রাণপাত করেছিলেন।
বক্তাদের একজন পরশুরামের বাবা জমদগ্নি। যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে পিতামহ ভীষ্ম এসেছেন। চিনের সং জিউ থেকে চিয়াই লাই শেক। লন্ডনের জোনাস হ্যানওয়ে। মালব্যের রাজা ভোজ। সর্বোপরি মহামতি বুদ্ধদেবও বক্তা।
বক্তাদের তালিকা দেখে সত্যজিৎ রায়ের ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ সিনেমার কথা মনে পড়া স্বাভাবিক। বা, রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরাম বর্ণিত ‘মহাপুরুষ’ বিরিঞ্চিবাবাকে। যিনি রামায়ণ লেখা শেষ হতেই তুলসীদাসকে করে দিচ্ছেন মানসিংহ। মানবজাতি সৃষ্টি করে মহাবিপদে পড়েছেন বৈবস্বত। গোটা পৃথিবীতে তখন জল থই থই। মানুষ দাঁড়াবে কোথায়? বিরিঞ্চবাবা সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের তেজ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাতে চোঁ করে জল শুকিয়ে গেল।
স্বপ্ন দেখলাম কেট্টুভল্লমে (কেরলের নৌকা) কুদাকাল্লুতে পৌঁছলাম। সম্মেলনে শ্রোতা আমি। গলায় ব্যাজ ঝুলিয়েছি। যে দু’জনের পাশে বসেছি, তাদের একজন মোটাসোটা। চাপা রং। আলাপ হল। রসিক। ছাতার ব্যাপারে আগ্রহের কারণ জানতে চাইলাম। বললেন, আগ্রহ-টাগ্রহ না, তিনি একটা অদ্ভুত চিঠি পেয়েছেন, সভায় পড়ে শোনাতে এসেছেন। উনি মঞ্চে উঠে পড়ার আগেই শুনতে ইচ্ছে করল। রাজি হননি। পরে পাথরের ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে পড়লেন–
‘প্রিয় মেঘনাথবাবু,
গত শনিবার রাতে খুব বৃষ্টির সময় আমার বাড়ি থেকে ফিরে যাবার জন্যে আমাদের চাকর পাশের বাড়ি থেকে যে ছাতাটি আপনাকে এনে দিয়েছিল সেই ছাতাটি পাশের বাড়ির ভদ্রলোক আজ চাইতে এসেছিলেন। ভদ্রলোক বললেন, ছাতাটি তিনি তাঁর অফিসের বড়বাবুর কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছিলেন, বড়বাবুকে বড়বাবুর ভায়রাভাই খুব চাপ দিচ্ছেন ছাতাটির জন্যে, কারণ বড়বাবুর ভায়রাভাই যে বন্ধুর থেকে ছাতাটি আনেন সেই বন্ধুর মামা তাঁর ছাতাটি ফেরত চাইছেন। শুনলাম ছাতাটি নাকি মামাবাবুরও নিজের নয়, শ্বশুরের।’
এই পেপারের শিরোনাম, ‘দা লস্ট আম্ব্রেলাজ অভ ক্যালকাটান্স’। চমৎকার লাগল। পেপার পড়তেই আমার মতো নৌকাতে ভাসতে ভাসতে কুদাকাল্লু এসেছেন। লিটল রাসেল স্ট্রিটের কাঠের মেঝের পুরনো বাড়িতে বিড়ালদের একা রেখে।
ডান পাশের সোনালি ফ্রেমের চশমা পরা সুদর্শন প্রবীণ সম্বরে ব্যাঙের ছাতার ফ্রাই চুবিয়ে খেতে খেতে বললেন, ‘জানো, তারাবাবু কবিতাও লেখেন।’ জানলাম কবিবাবুর পুরো নাম তারাপদ রায়।
দ্বিতীয় প্রবীণের সঙ্গেই আমি সম্মেলনমঞ্চ লাগোয়া প্রদর্শনী ঘুরে ঘুরে দেখছি। একটা ছাতার উপর সোনার ঘড়া। মুক্তা, হীরে গাঁথা শিবাজীর ছাতা। মাথায় ছোট পতাকা। দ্বিতীয় প্রবীণ বললেন, কোথায় একটা পড়েছিলেন, ওই পতাকা থাকা মানে রাজা দ্বিগবিজয়ে বেরিয়েছেন।
প্রদর্শনীতে রাখা হাজার বছর আগের প্রাচীন একটি ছাতার কাপড় লাল কেন?
ডেমনস্ট্রেটর জানালেন, কোনও কোনও রাজার ছাতা ওইরকম হতো। এ ছাড়াও থাকত নানা বৈশিষ্ট্য। চাষাভুষোর ছাতার মতো নয়। রাজার ছাতা বিশাল সাইজের। চাষার ছাতা নির্দণ্ড। রাজার সদণ্ড।
দণ্ডহীন ছাতা? তামিল অথচ বাংলাতেই কথা বলছে। স্বপ্নে কী না হয়! জানাচ্ছে, নির্দণ্ড মানে লাঠি না থাকা নয়। ছাতা বন্ধ করা যায় না যে ছাতা। টোকা যেমন।
রাজা ভোজের বক্তৃতা থেকে জানলাম ছাতার ছ’টি অঙ্গ। দণ্ড, কন্দ, শলাকা, রজ্জু, বস্ত্র, কীলক। তার গবেষণার বিষয় ছাতার অ্যানাটমি। দেখেছি থিসিসগুলো খুব কঠিন করে লেখা হয়। নিরস। সব বুঝতেও পারছিলাম না। ‘কন্দ’ মানে জানতাম লাল আলুর মতো কিছু। ছাতার কোন জায়গাটা ‘কন্দ’ বলা হচ্ছে?
মাঝেমাঝেই রাজামশাই মাপজোকের কথা বলার সময় ‘বিতস্তি’ শব্দটা ব্যবহার করছিলেন। ওই দ্বিতীয় ভদ্রলোক বললেন, ‘বিতস্তি’ হল বিঘত। কীলক কোনও কিছু আটকে রাখতে সাহায্য করে। এখনকার ছাতার স্প্রিংয়ের মতো?
ভালোই লাগছে শুনতে।
জোনাস হ্যানওয়ে বলবেন। শুনতেই হবে। কলার খোসা ফেলতে গিয়েও ছুটতে ছুটতে ফিরে এলাম। তাঁর পেপার ‘সোশ্যাল প্রেসার অ্যান্ড অবস্ট্র্যাকল টু আমব্রেলা ইউজ’। তিনি যখন বলছিলেন, একবার ম্যাঞ্চেস্টারের রাস্তায় তাঁকে দেখে বখাটেরা পচা ডিম ছুড়েছিল, কোথায় একটা তাঁকে বৃহন্নলতা ভেবে ভুল করেছিল কোনও পথচারী, তখন খারাপই লাগছিল।
তারাপদবাবুকে দেখে মনে হল, সাহেবের কথাবার্তা হজম করতে পারছেন না। স্বগতোক্তি শুনলাম, ‘হুঁ!! কিছুই জানে না। আথেন্সেও কোনওদিন যায়নি। ওখানে তো বড় বাড়ির মেয়েরা ছাড়া কেউ ছাতাই নিতে পারত না…পড়াশুনোই করেনি।’
দ্বিতীয় ভদ্রলোক সায় দিলেন। ফ্রান্সেও নাকি ওই রকম ছিল। ছাতার মালিক নেই। মালকিন। মাদমোয়েজেল। অবিবাহিতা। বিবাহিতারাও অবশ্য ছাতা মাথায় পার্কে বেড়াত।
বিতর্কে ঢুকলাম না। জানিই না তো ঢুকব কী!
আঁকা ছবিতে একবার দেখেছিলাম, হ্যানওয়ের ট্র্যাডিশনাল ব্রিটিশ পোশাক। মাথায় লর্ড ক্লাইভের মতো টুপি। মেমসাহেব দরজা থেকে উঁকি মারছে। একজন মই বেয়ে উঠেছিল। সেও থমকে দেখছে। আমি ভাবছি এত শ’ বছর পরে তিনি কবর থেকে বেরিয়ে কুদাকাল্লুতে এসেছেন, চেহারা একইরকম, ভুঁড়ির কোথাও মাটি লেগে নেই।
উদ্ভট সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে। শ্মশ্রুময় পিতামহ পাশে দাঁড়ানো জেষ্ঠ পাণ্ডবকে দেখিয়ে বলছে, ‘পাণ্ডুর এই পুত্রই প্রথম জানতে চেয়েছিল কে প্রথম ছাতার প্রবর্তন করেন।’
সেটা শুনেই লাফিয়ে উঠছে সং জিউ থেকে আসা চিয়াই। আঙুল তুলে বলে যাচ্ছে, মিথ্যে, নির্জলা বাজে কথা। চিনারাই প্রথম ছাতা বানায়। সেই ছাতা ইয়ামাতো হয়ে হিন্দুস্তানে। সেখান থেকে বোম্বেটেরা নিয়ে যায় লিসবন।
তা শুনে ক্রুদ্ধ পিতামহ। দল ভারী করতে ডেকে নিল পরশুরামের বাবাকে। জমদগ্নি। ‘লোকটার তিড়িংবিড়িং বন্ধ করুন তো।’
জমদগ্নি বলছে, এক ফুটিফাটা সকালের কথা। তীর ছোড়া প্র্যাকটিস করছিল। একটা করে তীর ছোড়ে, মুনিপত্নী রেণুকা কুড়িয়ে কুড়িয়ে আনে। জৈষ্ঠ। গরম হাওয়ার হল্কা। তীর আনতে আনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে রেণুকা। ভাবে গাছের তলায় খানিক জিরিয়ে নেবে।
তাকে দেখতে না পেয়ে জমদগ্নি মারাত্মক রেগে যায়। সূর্যর উপরই রাগটা গিয়ে পড়ে। ব্যাটা তোর জন্য, আমার বউটা হাঁপিয়ে উঠল। ‘দাঁড়া আজই তোকে মেরে ফেলব।’ সূর্যর দিকে তীর তাক করছে। সূর্য আতঙ্কিত। সঙ্গে সঙ্গে একটা ছাতা নিয়ে রেখে দিচ্ছে জমদগ্নির পায়ে।
পিতামহর ঠোঁটে মিচকি হাসি, ‘চিয়াই ভাই, এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ ছাতা কোন দেশে প্রথম তৈরি হয়েছিল।’ কিন্তু অজ-শ্মশ্রু চিনা আঙুল তুলে যাচ্ছে। পিতামহকে খণ্ডন করবেই। প্রায় ঘণ্টা তিনেক ধরে তর্কাতর্কি চলল।
চেঁচামেচি ভালো লাগছিল না। আসন থেকে উঠে মিক্সডজোনে আড্ডা মারছি। আল-কাহিরার আব্বাসের মুখে শুনলাম ওদের ওখানে শোভাযাত্রার সময় কত রকমের ছাতা দেখা যায়। মিশর। কায়রোকে ওরা বলত আল-কাহিরা।
এক মেক্সিকান, কঙ্গোর মুটাম্বো এবং খর্বকায় বার্মিজও ছিল। হুরুন।
মেক্সিকানটা বলছে ওদের দেশে শুধু পুরোহিতরা ছাতা মাথায় দিত। কঙ্গোর মুটাম্বোর সংযোজন, তার দেশে বিয়ের সময় ছাতা মাথায় দেওয়ার চল ছিল।
রেঙ্গুনের বোটাটং পাজুন্ড থেকে আসা লোকটার মুখে শুনলাম, ব্রহ্মদেশে শ্বেতছত্র মানে রাজকীয় প্রতীক। সে বৌদ্ধ। চোখ ঠিকরে অনুষ্ঠানসূচি দেখছে। ভগবান বুদ্ধ কখন তাঁর পেপার পড়বেন। দেরি আছে। বিকেল সাড়ে তিনটে।
ভক্তি কাকে বলে হুরুনকে দেখে শিখতে হয়। বোঝাচ্ছিল, বৌদ্ধ ধর্মে আটটি শুভ প্রতীকের একটি কেন ছাতা। বুদ্ধের মাথার উপরও ছাতা। ছাতা থাকলে অসুখ করে না। গায়ে জল নেই। তাপও না। সুরক্ষা! এইসব। বুদ্ধর ছাতার কথা বলতে বলতে কেঁদেই ফেলছিল হুরুন। জাতকের গল্পও জানে। রাজপুত্র রাজত্ব ফিরে পেয়েছে। শুধু রাজত্ব হলে চলবে না। রাজার ছাতাটিও ফেরত চায়।
পিতামহর থিসিস পড়া শেষ। দশ মিনিটের বিরতি। মাইকে জিঙ্গল বাজছে– মাঝা মাঝা, কুদা কুদা, মাঝা ভানাল পপি কুদা। বাংলা– ‘বৃষ্টি বৃষ্টি, ছাতা ছাতা। যখন বৃষ্টি পড়ে পপি ছাতা খুলে ফেলতে হয়।’ আর একটা ছোট জিঙ্গল, ‘এন্তে মাঝাহাকু এন্তে পপি।’ ‘বৃষ্টির দিনে আমার পপি’। আমাদের মতোই কেরলের বর্ষাকাল। সেখানে পপি-ছাতা বিরাট জনপ্রিয়। আকচাআকচি জন্স ছাতার সঙ্গে। কুদাকাল্লুর সম্মেলনে স্পনসর পপি। তাদের জিঙ্গলই বাজানো হচ্ছে।
‘মাঝাহাকু-মাঝাহাকু’ শুনতে শুনতেই স্বপ্নের সুর কাটল। দেখি কুদাকাল্লু থেকে এক ঝটকায় আমি মহাত্মা গান্ধী রোডে। গুপী-বাঘার মতো। মন খারাপ। ছাতা নিয়ে আমারও বলার ছিল।
শ্যামলবাবুর ছাতা। বায়োলজি স্যার। দারুণ ব্যাঙ কাটতেন। হাতে সর্বক্ষণ দাদুর ছাতা। মনে হত, রোদ-বৃষ্টি-বর্ষা-শ্যামলবাবুই ভরসা। মনে হত, ছাতা যখন আছে, মুষলধারাতেও তিনি স্কুলে এসে ক্লাসটি নেবেন। অথচ উল্টোটা। ব্যাঙের ডাক কানে এলে জামা ধুতি পরে বিছানায় শুয়ে পড়তেন। ছাতাই কোলবালিশ।
লালবাসের গল্প বলা যেত। আমার বন্ধু, তার প্রেমিকা বাসযাত্রী। আমিও আছি। হঠাৎ বন্ধু আবিষ্কার করেছে, কোনও প্রবীণ তার প্রেমিকার স্পর্শলাভে মরিয়া। ব্যাস, বন্ধুর মাথা গরম। কাঁধের শান্তিনিকতনী ব্যাগ থেকে ফোল্ডিং ছাতা বার করে লোকটার মাথায় বাড়ি। রক্তারক্তি। স্বচক্ষে দেখা।
কফিহাউজের এক বিকেলের কথা বলা যেত। সবাই আড্ডা মারছি। হন্তদন্ত হয়ে জুটে গেল এক হবু কবি। কাঁচুমাচু মুখ।
কী হয়েছে?
তেমন কিছু নয়, পুলিশ তার ছাতাটি কেড়ে নিয়েছে। বনবিতানে ছাতার আড়ালে নারীসঙ্গ করার অপরাধে। বোঝালাম ‘ছত্রদান’ পুন্যি। মুখে হাসি ফিরল না তার। আমদের পেট ফেটে যায় যায়।
আমার পেপারও হয়ে যেত। ‘দ্য আদার সাইড অভ আম্ব্রেলা।’
কী সুযোগ হারালাম!
আফসোস আরও আছে। চাকোলতোড়ের বিশ্বরূপ মান্নার ফোন নম্বরটা নেওয়া হয়নি। পুরুলিয়ার ছেলে। গলায় ব্যাজ ঝুলিয়ে ঘুরছিল। ওই বলল, চাকোলতোড়ে ছাতার পরব হয়। মানভূমের রাজাদের সময় থেকে চলছে। কবে যেন হয় একটা বলল। সময়টা জানতে পারলেই পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে উঠে পড়ব। উলুবেড়িয়াও যাব। কী লজ্জা, কেরলে পৌঁছে জানলাম সেখানে ছাতা-গ্রাম আছে। ছেলে-বুড়ো-বুড়ি-মেয়ে-বউমারা দিনরাত ছাতা বানিয়ে যাচ্ছে।
স্বপ্নেরও বাস্তব থাকে। হ্যারিসন রোডে হেঁটে মরছি। ভ্যাপসা গরম। পকেটে চিরকুট। একটা দোকানের নাম লেখা। এধার-ওধার খুঁজতে বাকি রাখছি না। ঘাড় ব্যথা হয়ে গেল। হিমানীশ গোস্বামীর ছাতার দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়ার সিজন। মনসুন। ভরা বর্ষায় দোকানটাই কি ডুবে গেল? না ব্যবসাই লাটে উঠেছে?
কোথায় ‘মিত্র ছত্র কোম্পানী’? কুদাকাল্লুর পাশে বসা দ্বিতীয় লোকটা ঠিকানাটা লিখে দিয়েছেন। বলেছেন আস্ত একটা গল্পও।
তাঁর স্কুলের প্রবীণ মাস্টারমশাই রামলোচনবাবু। একদিন হঠাৎ ছাতা মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে দ্বিতীয় লোকটার (তখন স্কুল পড়ুয়া) বাড়ির বারান্দায়। মাস্টারের ‘শুভ্র জামার চারিদিকে কালো দাগ’। একটু আগেই মাস্টার নতুন ছাতা কিনেছে। কিন্তু জল পড়তেই রঙ উঠছে। কিনেছে ভুনিবাবুর দোকান থেকে। যে বড় ব্যবসায়ী হতে লজেন্স বিক্রি ছেড়ে ছাতার দোকান দিয়েছে।
‘শুধু ছাতা বিক্রি করেন না। ছাতি তৈরি করেন। ছোট ফ্যাকটরি করেছেন।’
বাজারে দত্ত, পালদের দোকান থাকতে থাকতে কেন ভুনিবাবুর দোকানের ছাতা কিনলেন?
খুলে বলবে রামলোচনবাবু। তার আগে শুধু ছাতাটা মুড়ে বারান্দার এক ধারে রেখে আসছে। কী কাণ্ড, ছাতা বন্ধই তো হচ্ছে না। অগত্যা খোলা ছাতাই নামিয়ে রাখা।
“পরীক্ষায় ‘বর্ষা’ বিষয়ে একটা রচনা লিখতে দিয়েছিলাম। নানারকম ছেলে নানারকম লিখেছে দেখলাম। কেউ বর্ষা নিয়ে কাব্য করেছে, কেউ মেঘদূত, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনা করেছে, কেউ বা বর্ষায় গ্রামের শোভা বর্ণনা করেছে, কেউ বা গ্রামের দুর্দশা বর্ণনা করেছে, কলকাতার মতো শহরে বর্ষাকালে কী কাণ্ড হয় তাও লিখেছে অনেকে। বড়লোকদের বর্ষা আর গরীবদের বর্ষার কথাও লিখেছে কেউ কেউ। কিন্তু একটা রচনা পড়ে আমার তাক লেগে গেল। সে একটি ছোট্ট কবিতা লিখেছে, আর কিছু লেখেনি। লিখেছে–
‘বর্ষাকালে যাহার মাথায় নাই ছাতি।
তাহার মুখে মার দু’তিন লাথি।’
ডাকলাম ছেলেটিকে। এল। বললাম এ কী লিখেছ? সে বললে, বর্ষা সম্বন্ধে আসল কথাটাই তো লিখেছি সার। বর্ষাকালে জল পড়ে, কাদা হয়, আকাশে মেঘ, বিদ্যুৎ হয়, ব্যাঙ ডাকে এ সব তো সবাই জানে। আমি ছাতির বিজ্ঞাপন দিয়েছি একটু। মুখ নীচু করে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। বললাম, ছাতির বিজ্ঞাপন দিয়ে তোমার লাভ? বলল, আমার বাবা যে ছাতি তৈরি করছেন আজকাল। মিত্র ছত্র কোম্পানি, দেখেননি? খুব ভালো ছাতি হচ্ছে সার।”
রামলোচবাবু তাকে পাস মার্ক দিতে পারেনি। ছেলেটা যদিও ফ্রি-তে ছাতা অফার করেছিল। ‘দিয়ে দিন সার, ভালো ছাতা আপনাকে এনে দেব।’ মাস্টাররা অনৈতিক কাজ করেন না। তা ছাড়া এ কি ঘুষ দেওয়া হচ্ছে? অবশ্য ছেলেটির বাবার নামটা জেনে নিল মাস্টার। ভুনিবাবু। গন্ধরাজ মিত্র।
যেদিনের স্মৃতিচারণ করেছেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, সেদিন জোরে বৃষ্টি পড়ছিল। ছাতা না নিয়ে বেরিয়েছিল তাঁর সার। তখনই ছেলেটির কথা ভেবে খারাপ লেগেছিল। ভাবল, মিত্র-ছত্র কোম্পানি থেকেই একটা ছাতা কিনে নেবে। নিলও। বাঙালি ভদ্রলোক ব্যবসা করছেন, তাঁকে ব্যাক করাটা কর্তব্য মনে হল।
পরিণতির কথা তো শুনলেনই। দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রস্তাব দেন, ছাতাটা ফেরত দিয়ে আসবেন। মাস্টার রাজি হন না। ‘হাজার হোক বাঙালির দোকান।’
মাস্টারের মায়া হয়েছিল। ভেবেছিল ছাতার কাঁচা রঙ একদিন পাকা হবে। স্প্রিংও ভালো হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। বনফুল। তিনি প্রচুর বাঙালিকে শুনিয়েছেন গল্পটা। ভুল বললাম। পড়িয়েছেন। মুখে শুনেছি আমি একা। সাজানো গল্প বুঝিনি। তাই পকেটে চিরকুট নিয়ে কলেজ স্ট্রিট চষে বেড়াচ্ছি।
আমার তো রাগই হয়েছে। বাঙালি ছাতা ব্যবসায়ীদের জন্য মোটেই ভালো বিজ্ঞাপন ছিল না গল্পটা। আমারও দোকান খুঁজতে গিয়ে কম কষ্ট হল না। হলেই বা স্বপ্ন!
স্বপ্ন তো নয়।
গৌরচন্দ্রিকা। আসলে কয়েক দিন ধরেই অপেক্ষায় আছি ‘নুতন-পুরাতন ছাতাই সারাই’ ডাকটা শুনব। শুনলেই ঘরে নিয়ে আসব হামাদকে। একবার আলাপ হয়েছিল। বাগানানে বাড়ি। এমন কিছু বয়স না। বিদ্যে বলতে ক্লাস এইট। পুরো নাম সৈয়দ হামাদ মেহরাজ। দেখবেন, সেও একদিন মহেন্দ্র দত্ত হবে। অথবা কার্তিক চন্দ্র পাল। হবেই। আমার, আমার মতো লেখকদের কাজ, তার বাড়ির চাল থেকে জল পড়ে কি না জেনে রাখা! জীবনী তো আমাদেরই লিখতে হয়।
আমরা যারা প্রায়ই সিনেমাকে ঘিরে বাঁচতে বাঁচতে দূরে সরে যাই সিনেমার থেকে, সিনেমা আমাদের কাছে অনেক সময়ই ‘হিট’, ‘ফ্লপ’, ‘লাইন’ আর ‘ইন্ডাস্ট্রি’র দাঁড়িপাল্লায় ওঠানামা করে, সিনেমা যখন আমাদের কাছে অনেকটা অভিমান আর লড়াইও, তখন বসন্তের উদাসী সন্ধ্যায়, দীর্ঘদেহী, আশির দোরগোড়ায় দাঁড়ানো মায়েস্ত্র বলে ওঠেন ‘সিনেমা পবিত্র’।