ঠাকুরবাড়ির বিপ্লবী ছেলে সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন সমাজের কাজে। ত্যাগ করেছিলেন ঠাকুরবাড়ির গরিমা। কমিউনিস্ট পার্টি করার স্বপ্নে থাকা এই যুবকের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, অধিকাংশ দিন দু’বেলা ভরপেট খাওয়া জুটত না। কমিউনিস্ট রাজনীতি করতে এসে ঠাকুরবাড়ির ছেলেকেও আধপেটা খেয়েই থাকতে হত, পারিবারিক পয়সায় ফুটানি করে সেকথা উচ্চকণ্ঠে কাস্তে হাতুড়িওলা লাল পতাকাকে পিছনে রেখে বলার চিন্তা তাঁদের স্বপ্নেও উঁকি দিত না।
১৯৩৩-এর ২৩ এপ্রিল। ইতালির মেরানা শহর থেকে জার্মানির মিউনিখে যাচ্ছিলেন এক ত্রিশোর্ধ বাঙালি যুবক এবং তাঁর এক বন্ধু, বন্ধুপত্নী এবং তাঁদের দু’টি সন্তান। কিফারফেলসেনের কাছে অস্ট্রিও-জার্মান বর্ডারে গাড়ি থামতে শুরু হল পাসপোর্ট পরীক্ষা। সকলের পাসপোর্ট দেখে তা ফেরত দিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু আমাদের ত্রিশোর্ধ যুবকের পাসপোর্টটা হাতে নেওয়া মাত্রই জার্মান পুলিশের চোখ ছানাবড়া! খবর পেয়ে ছুটে এলেন একজন গেস্টাপো অফিসার, সরাসরি প্রশ্ন করলেন— ‘তুমি কি টেগোর? জন্ম ১৯০১ সালে?’
এই ঘটনার অব্যবহিত পরেই, ইংরেজ গোয়েন্দাদের তরফে ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে চিঠি এল, উপরোক্ত যুবক জার্মান পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং তার দু’দিন পর জানতে পেরেছেন যে তাঁর গ্রেপ্তারির কারণ এই যে, ‘he had planned an attempt to assassinate the Chancellor of the Republic of Germany.’ অর্থাৎ হিটলারকে খুনের চেষ্টার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত!
‘টেগোর’ উপাধিযুক্ত কোনও লোকের এমন উদ্ভট অভিযোগের ভিত্তিতে সুদূর অস্ট্রিও-জার্মান সীমান্তে গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা আজকের প্রজন্মের কাছে কিছুটা হলেও আশ্চর্য ঠেকতে পারে। রবীন্দ্র ভ্রাতুষ্পৌত্র ‘কমরেড’ সৌম্যেন্দ্রনাথের ঘটনাবহুল জীবনের এ এক বিস্মৃতপ্রায়, বা বলা ভালো, ভুলিয়ে দেওয়ায় অধ্যায়, বাদল সরকারের ভাষায় ‘বাকি ইতিহাস’।
আসলে, সৌম্যেন্দ্রনাথের গোটা জীবনটাই এই ‘বাকি ইতিহাস’-এ ওতপ্রোত, যায় সবটুকু এই ক্ষুদ্র পরিসরে বলা সম্ভব নয়। তাই তাঁর কমিউনিস্ট হয়ে ওঠার প্রথম পর্বের কাহিনিটুকুই বলতে চেষ্টা করব। ‘বাকি ইতিহাস’-এর বাকিটুকু না হয় এখন বাকি থাক, পরে কখনও হবে।
২.
১৯০১ সালের ৮ অক্টোবর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ সন্তান দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুধীন্দ্রনাথ এবং তাঁর স্ত্রী চারুবালা দেবীর সন্তান সৌম্যেন্দ্রনাথ। প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতির ছাত্র থাকাকালীন তিনি জড়িয়ে পড়েন দেশের মুক্তি সংগ্রামে, গান্ধীজির পদাঙ্ক অনুসরণ করে হয়ে ওঠেন অহিংস নৈরাষ্ট্রবাদে বিশ্বাসী।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট, একের পর এক ঘটে যাওয়া মহামারী, খাদ্যাভাব এবং অবশেষে রাওলাট আইনের মতো কালাকানুনের জাতাকলে পড়ে ভারতের মানুষ যখন গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেন, তখন তার সামনের সারির কর্মী হিসেবে উঠে এলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ। কিন্তু মানুষের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে পদে পদে তিনি উপলব্ধি করছিলেন বাস্তবতার নিরিখে গান্ধীবাদের অকার্যকারিতা ঠিক কতটা।
এই সময়ে সোশ্যালিজমেরর প্রতি আকৃষ্ট হলেন তিনি। গ্রন্থাগারের পর গ্রন্থাগার ঘেঁটে পড়াশোনা শুরু করলেন সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ সম্পর্কে, পরিচিত হলেন শ্রমিকশ্রেণির নবগঠিত স্বপ্নরাজ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে। এই কাজে তাঁর মার্গদর্শন করলেন সদ্য রুশ-প্রত্যাগত শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
এরই মধ্যে ১৯২৫ নাগাদ হেমন্ত কুমার সরকার, মুজফ্ফর আহমদ, কুতুবউদ্দিন আহমেদ, আব্দুল হালিম, কাজী নজরুল ইসলাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’ ও তার মুখপত্র ‘লাঙল’ হাতে পেয়ে তিনি আকৃষ্ট হলেন প্রত্যক্ষ বামপন্থী রাজনীতির প্রতি, গান্ধীবাদকে পরিত্যাগ করে যোগদান করলেন নতুন দলে, ‘লাঙল’-এর জন্য জোগাড় করলেন রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ-বাণী: ‘জাগো, জাগো বলরাম, ধরো তব মরু-ভাঙ্গা হল, / প্রাণ দাও, শক্তি দাও, স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল।’
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নজর কাড়লেন সৌম্যেন্দ্রনাথ। তাঁর অসামান্য বাগ্মীতা, নিপীড়িত শ্রেণির মানুষের মধ্যে কাজ করার ক্ষমতা তাঁকে অতি দ্রুত সংগঠনের নেতৃস্থানীয় হয়ে উঠতে সহায়তা করল।
১৯২৬ সালে কৃষ্ণনগরে পার্টির প্রথম সম্মেলন হল, যেখানে ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’ নাম বদলে হল ‘ওয়ার্কার্স প্রেজেন্টস পার্টি’ বা ‘শ্রমিক-কৃষক দল’। ততদিনে দলের মুখপত্রের নামও পরিবর্তিত হয়েছে, নতুন নাম ‘গণবাণী’, সম্পাদক মুজফফর আহমদ।
৩.
দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা হিসেবে সৌম্যেন্দ্রনাথ তখন কাজ করতেন বদরতলা এবং ভাটপাড়ার পাটকলগুলোতে। সেই সময়ই শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্পাদক করে তৈরি হয় ‘বেঙ্গল জুট ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন’। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কুতুবউদ্দিন আহমেদ প্রমুখদের শ্রমিক এলাকায় লেগে-পড়ে থাকার দরুণ দলের সাংগঠনিক অবস্থা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। কিন্তু আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, অধিকাংশ দিন তাঁদের দু’বেলা ভরপেট খাওয়া জুটত না। কমিউনিস্ট রাজনীতি করতে এসে ঠাকুরবাড়ির ছেলেকেও আধপেটা খেয়েই থাকতে হত, পারিবারিক পয়সায় ফুটানি করে সেকথা উচ্চকণ্ঠে কাস্তে হাতুড়িওলা লাল পতাকাকে পিছনে রেখে বলার চিন্তা তাঁদের স্বপ্নেও উঁকি দিত না।
ওদিকে, ১৯২৫ সালের শেষের দিকে, কানপুর শহরে গঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯২৬ সালের ১ এপ্রিল এক গোপন সভা ডাকা হয় কলকাতায়। এই সভায় সৌম্যেন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং বলা হয় ভারতের মাটিতে সদ্যগঠিত সিপিআই-এর সভ্যপদ গ্রহণ করার কথা, যা তিনি হৃষ্টমনে গ্রহণ করেন।
৪.
ইতিমধ্যে শ্রমিক কৃষক দল কার্যত পরিণত হয়েছে গুপ্ত কমিউনিস্ট পার্টির ফ্রন্টাল অর্গানাইজেশন হিসাবে। ১৯২৬ সাল থেকেই সৌম্যেন্দ্রনাথের অনুবাদে ‘গণবাণী’-তে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-র বাংলা তরজমা। কিন্তু নানাবিধ কারণে সে অনুবাদের কাজ তখন তিনি শেষ করতে পারেননি। ভাষাও ছিল অত্যন্ত জটিল এবং দুরূহ। শ্রমিক কৃষক দলের কমিউনিস্ট যোগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে দলের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে (ফেব্রুয়ারি ১৯২৭)। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট এম.পি. শাপুরজি সাখলতওয়ালা সেখানে বক্তৃতা দেন। এখান থেকেই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শ্রমিক কৃষক দলকে সামনে রেখে কমিউনিস্টদের এই ক্ষমতা বৃদ্ধির কৌশল সাম্রাজ্যিক প্রশাসনকে অতিমাত্রায় সতর্ক করে তোলে। উপরন্তু, সশস্ত্র বিপ্লবী অ্যানার্কিস্টদের সঙ্গে সৌম্যেন্দ্রনাথের যোগাযোগের বিষয়টা নিয়েও ছিল তাদের যথেষ্ট মাথাব্যথা।
সৌম্যেন্দ্রনাথ নিজে সন্ত্রাসবাদী না হলেও তার সঙ্গে বাংলার অ্যানার্কিস্ট বিপ্লবীদের যোগাযোগ এতটাই নিবিড় ছিল যে তাঁরা পুলিশের নজর এড়িয়ে কখনও কখনও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেও আশ্রয় নিতেন, এমনকী সেখানে বোমা পর্যন্ত তৈরি করতেন!
স্বাভাবিক ভাবেই, এই বিষয়টাকে সামনে এনে তাঁকে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ পুলিশ। কিন্তু তৎকালীন পুলিশকর্তা চার্লস টেগার্ট ঠাকুরবাড়ির মতো প্রভাবশালী পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে গ্রেপ্তার করার হ্যাপা সামলাতে রাজি ছিলেন না। তিনি তাঁর বন্ধু প্রদ্যুৎকুমার ঠাকুরের মাধ্যমে খবর পাঠান, যদি সৌম্যেন্দ্রনাথ দেশের বাইরে চলে যান, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করার কোনও সুযোগ থাকবে না। কিন্তু দেশে থাকলে, তাঁর বিরুদ্ধে যে কোনও ধরনের ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হতে পারে। যদিও পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরদের সঙ্গে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের খুব একটা মাখামাখি ছিল না, কিন্তু খবরটা পাওয়া মাত্রই প্রদ্যুৎকুমার উজিয়ে এসে জোড়াসাঁকোতে তা পৌঁছে দেন, হয়তো জ্ঞাতিত্ব বোধের জায়গা থেকেই।
খবর পেয়ে পুরো বিষয়টাই সৌম্যেন্দ্রনাথ আলোচনা করেন তাঁর দুই সাথী মুজফফর আহমদ এবং নলিনী গুপ্তর সঙ্গে। সিদ্ধান্ত হয়, ব্রিটিশের জেলে কালাতিপাত করার চেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যাওয়া অধিকতর লাভজনক। তাতে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সঙ্গে সরাসরি যোগ স্থাপন করা যাবে, এবং সম্ভব হবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে বিকশিত করার মতাদর্শগত ও বস্তুগত রসদ সংগ্রহ করা।
৫.
প্যারিস ও বার্লিন হয়ে ১৯২৭ সালে জুন মাসে মস্কোয়ে পৌঁছন সৌম্যেন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁর এই মস্কো যাত্রার ইতিবৃত্ত যাতে পাসপোর্টে না ধরা পড়ে, সেজন্য সেদিন বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিল সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ। নিজের আত্মজীবনীতে সৌম্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন— ‘আমার পাসপোর্টে যাতে সোভিয়েট রাশিয়া যাওয়ার কোনো প্রমাণ না থাকে, তার জন্য বার্লিনের সোভিয়েট এমব্যাসি একটা সম্পূর্ণ আলাদা কাগজে আমাকে ভিসা দিয়েছিল।’
যে সময় সৌম্যেন্দ্রনাথ মস্কোয় পৌঁছলেন, তার বছর খানেক পরে শুরু হয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেস। এই কংগ্রেসে ভারত থেকে প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন শওকত ওসমানী, ক্লিমেন্স পাম দত্ত, জি এ লোহানি, মহম্মদ শফিক সিদ্দিকী এবং অবশ্যই সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে এই মহাসম্মেলনে সৌম্যেন্দ্রনাথ পরিচিত ছিলেন দুটো ভিন্ন নামে: বিশ্ব কংগ্রেসের মঞ্চে ফিনিশ কমিউনিস্ট নেতা অটো ভিল কুজিনিনেরর ঔপনিবেশিকতা সংক্রান্ত সন্দর্ভের বিপরীতে যে বক্তব্য তিনি রাখেন, তা উপস্থিত করেন ‘নারায়ণ’ নামে, এবং সাধারণভাবে পরিচিত ছিলেন ‘কমরেড স্পেনসর’ হিসেবে।
যে আমলে তিনি মস্কোয় গিয়ে পৌঁছন, তখন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে স্তালিন এবং ট্রটস্কির মধ্যকার বিতর্ক তুঙ্গে পৌঁছেছে। মস্কোর আন্তর্জাতিক লেনিন স্কুল, যেখানে ছাত্র হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ, সেখানকার ছাত্রদের মধ্যেও এই নিয়ে তুমুল তর্কাতর্কি চলত। সৌম্যেন্দ্রনাথ তখন মনে করতেন ট্রটস্কি পার্টির ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করেছেন, কিন্তু কোনওভাবেই তিনি তাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল বলতে রাজি ছিলেন না। এই কারণে, লেনিন স্কুলে যখন প্রস্তাব পেশ করা হয় ট্রটস্কিকে একজন প্রতিক্রিয়াশীল গুপ্তচর হিসেবে চিহ্নিত করার, তখন বিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্র হিসাবে তিনি তার বিরোধীতা করেন— একবার নয়, পরপর দু’বার।
তাঁর এই আচরণের জন্য কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কন্ট্রোল কমিশনের সামনে সৌম্যেন্দ্রনাথকে বেশ ভালো রকম চমকানোও হয়। কিন্তু বুখারিনের স্নেহাদ্র প্রশ্রয়ের ফলে তিনি পার পেয়ে যান এবং আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ বিশ্ব মহাসম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
রাশিয়াতে বসবাসকালেই সৌম্যেন্দ্রনাথের স্তালিনের প্রতি একপ্রকার ক্রোধ জন্ম নেয়, এবং তা একেবারেই রাজনৈতিক কারণে। তাঁর গোটা জীবন ছিল স্তালিন বিরোধিতায় ওতপ্রোত।
যাই হোক, ষষ্ঠ বিশ্ব কংগ্রেসে অংশগ্রহণের পরে পরেই সৌম্যেন্দ্রনাথ যক্ষা রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কৃষ্ণ সমুদ্রের তীরবর্তী এক ছোট্ট গ্রামে। সেখানে তিনি দুটো পুস্তিকা লেখেন— ‘বিপ্লবী রাশিয়া’ এবং ‘সোভিয়েট রিপাবলিক’। এই দুটো পুস্তিকার বিশেষত্ব হল এই যে, রুশ জনগণ ও সোভিয়েত রাষ্ট্রের চূড়ান্ত উন্নতির কথা যেমন তাতে আছে, তেমনই আছে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা এক যুক্তি ও ধী সম্পন্ন মানুষের মতামত। লেনিনকে প্রায় দেবতা বানিয়ে পুজো করার মানসিকতা, সোভিয়েতের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের অভাব, পার্টির ভেতরে এবং আন্তর্জাতিকের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশের চ্যুতি— এসব সম্পর্কে সেদিন স্পষ্ট বক্তব্য রেখেছিলেন ২৮ বছরের যুবক সৌম্যেন্দ্রনাথ। ১৯৩০ সালে বার্লিন শহরে যখন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সৌম্যেন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়, তখন তিনি এই দুই পুস্তিকার পান্ডুলিপি কবির হাতে দেন। রবীন্দ্রনাথ তা দেশে নিয়ে আসেন এবং এর চার বছর পরে, ১৯৩৪-এ, ‘বর্মন পাবলিশিং হাউজ’ থেকে তা প্রকাশিত হয়।
৬.
১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে সুস্থ হয়ে মস্কো থেকে বার্লিন চলে যান সৌম্যেন্দ্রনাথ।
জার্মানি পৌঁছে ১৯২৬ সালে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টর যে বাংলা অনুবাদ তিনি ‘গণবাণী’-তে প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন, তা এবার শেষ করার দিকে হাত লাগান। ম্যানিফেস্টোর প্রথম দিককার অনুবাদের ভাষা ছিল অত্যন্ত জটিল। তা সংশোধন করে তিনি নতুনভাবে তরজমা করেন এবং পার্টির কাছে গোপনে পাঠিয়ে দেন। ১৯২৯-এর অক্টোবর মাসে শ্রমিক কৃষক দলের বঙ্গীয় প্রাদেশিক শাখা থেকে ‘সাধারণ সত্ত্ববাদীর ইস্তাহার’ শিরোনামে আব্দুল হালিম কর্তৃক এই বই প্রকাশিত হয়।
৭.
ইউরোপে সৌম্যেন্দ্রনাথের কাজ মোটামুটি হয়ে গিয়েছিল। জার্মানিতে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় (সরোজিনী নাইডুর বরদা)-এর সঙ্গে যোগ স্থাপন করে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সঙ্গেও সম্পর্ক নিয়মিত রাখার ব্যবস্থা তিনি করে ফেলেছিলেন। আর দেরি করতে তিনি চাইছিলেন না, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশে ফিরে যাওয়ার। কিন্তু ১৯২৯-এর ২০ মার্চ সারা ভারত জুড়ে কমিউনিস্ট ও ট্রেড ইউিয়ন সংগঠকদের গ্রেপ্তারি শুরু হয়, এবং তাদের বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযোগ রুজু হয় যে তাঁরা ইংল্যান্ডের রানির শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। পরবর্তীকালে এটা মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা নামে খ্যাতি লাভ করে। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাঁদের অন্যতম ছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ।
দেশে ফিরে হাজতবাস করতে হবে জেনে সৌম্যেন্দ্রনাথ ইউরোপেই থেকে যান। তিনি সেখানে মিরাট বন্দিদের মুক্তির জন্য জনমত গঠন ও তহবিল করতে থাকেন এবং পাশাপাশি মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে যান।
১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে বার্লিনে আসেন। সৌম্যেন্দ্রনাথ কবির মস্কো যাত্রার ব্যবস্থা করেন রুশ শিক্ষামন্ত্রী লুনাচারস্কির সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাঁর দোভাষী হিসাবে কবির সফরসঙ্গী হন। কিন্তু অমানুষিক পরিশ্রম এবং সম্পূর্ণভাবে যক্ষা থেকে সুস্থ না হওয়ার কারণে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। মস্কোতে একপক্ষ কাল থাকার পর সৌম্যেন্দ্রনাথ চলে যান রাশিয়ার কাপরিতে, স্বাস্থ্য ফেরাতে। বেশ কিছু মাস তিনি সেখানে অতিবাহিত করেন। কাপরিতে থাকাকালীন সৌম্যেন্দ্রনাথ লেনিন, রোজা লুক্সেমবুর্গ এবং কাল লিবনেখ্টের জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা কমিটির পরিচালনাধীন ‘গণবাণী পাবলিশিং হাউজ’-এর তরফে আব্দুল হালিম এই তিন পুস্তিকা যথাক্রমে ১৯৩৩ এবং ১৯৩৪ সালে প্রকাশ করেন।
স্বাস্থ্য ফেরাতে কাপরিতে গিয়ে সৌম্যেন্দ্রনাথে লাভই হয়েছিল সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় বিখ্যাত লেখক এবং ঔপন্যাসিক ম্যাক্সিম গোর্কির। একজন ভারতীয় যুবক, যিনি প্রায় দুই বৎসর কাল সোভিয়েত ইউনিয়নে অতিবাহিত করেছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে খুবই আগ্রহী ছিলেন গোর্কি। সেই আলাপের বিবরণ সৌম্যেন্দ্রনাথের ‘ত্রয়ী’ পুস্তিকাতে পাওয়া যায়।
৮.
সুস্থ হতে হতে সৌম্যেন্দ্রনাথের লেগে গেল প্রায় দু’বছর। ১৯৩২-এর শেষের দিকে তিনি রাশিয়া ছেড়ে চলে গেলেন ইতালি। সেখানেই তিনি সরাসরি প্রত্যক্ষ করলেন মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের স্বরূপ। ১৯৩৪ সালে ফ্যাসিজম নামে গণবাণী পাবলিশিং হাউজ থেকে তাঁর যে বই প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে এই অভিজ্ঞতার ছাপ পড়েছিল স্পষ্ট। ১৯৩৩ সালে তিনি যখন ইতালি থেকে জার্মানি ফিরছিলেন, সেই সময় হিটলারকে খুন করতে চেষ্টা করার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করে গেস্টাপো। এই পর্বে সৌম্যেন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখপত্র এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকার নিরিখেই এই চক্রান্ত সংগঠিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। একটানা চার দিন তাঁকে জেরা করে জার্মান পুলিশ। কিন্তু কোনও প্রমাণ হাজির করতে পারে না। অবশেষে তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তারা।
জার্মান গেস্টাপোর হাত থেকে সৌম্যেন্দ্রনাথের নিষ্কৃতি পাওয়ার ঘটনাকে পরবর্তীকালে তাঁর একসময়কার সাথী মুজফফর আহমেদ বলেছেন ঠাকুর বাড়ির আন্তর্জাতিক প্রভাবের ফসল। কিন্তু তা আদৌ ঠিক নয়। জার্মান পুলিশ সেদিন ধৃত সৌম্যেন্দ্রনাথকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় কারণ তাদের আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছিল।
৯.
সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে ফ্যাসিবাদের চরিত্রাবলী অধ্যায়ন করেছিলেন। তিনি মনে করতেন জার্মানিতে নাৎসিবাদ ক্ষমতা দখল করতে পেরেছিল শুধুমাত্র সমাজ গণতান্ত্রিক দলের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নয়, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির ভ্রান্ত নীতি অনুসরণের কারণেও।
কিন্তু যেহেতু এই বক্তব্যের শেষাংশ তৃতীয় আন্তর্জাতিক এবং স্তালিন কখনও অনুমোদন করেননি, সেহেতু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা কমিটির তরফে দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে আব্দুল হালিম সৌমেন্দ্রনাথ ফিরে এলে তাঁর ‘হিটলারিজম অর এরিয়ান রুল ইন জার্মানি’ শীর্ষক গ্রন্থ ছাপতে অস্বীকার করেন।
১৯৩৪ সালে দেশে ফিরে সৌম্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পুরনো কমরেডদের বিতণ্ডা শুরু হয় স্তালিন এবং তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মূল্যায়ন নিয়ে। এর পরিণতিতেই তিনি সিপিআই ত্যাগ করেন এবং গড়ে তোলেন কমিউনিস্ট লিগ, যা চারের দশকের প্রথম দিকে নাম বদলে হয় ‘ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি’।
১০.
কোনও গুরুঠাকুরের পায়ে মাথা বিকিয়ে না দেওয়া কমিউনিস্ট ছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ। অনেকের মতো ভুলভ্রান্তি তিনিও করেছেন, রাজনৈতিক জীবনে খুব যে সফল হয়েছিলেন তাও নয়; স্বাধীনতা উত্তর পর্বে তার প্রভাব ক্রমশ নিম্নগামী হয়েছে। কিন্তু অগ্নিশিখার উত্তাপ কমে এলেও অগ্নিশিখা তো অগ্নিশিখাই থাকে, তাই না?
১৯৩৭ সালে পিল কমিশন প্যালেস্তাইনে ধর্মের ভিত্তিতে ভূখণ্ড ভাগের প্রস্তাব দেয়। এটাও ভারতের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গান্ধীজির পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। কারণ এদেশেও তখন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ অর্থাৎ ‘টু নেশন’ তত্ত্ব ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে।