আমার মাকে আমি আঁকি আঁচলে হলুদ, কপালে ঘাম, কয়লার উনুনের গনগনে তাপে লাল হয়ে যাওয়া মুখে বসে আছেন হেঁশেলে। ভাত ফুটছে, তিনি সবজি কুটছেন। ধুম জ্বর, জলপট্টি দিচ্ছেন মা। মা আছেন জ্বরতপ্ত সন্তানের কপালে হাত রেখে। সারা রাত জেগে আছেন মা। ছেলে কিংবা মেয়ের জ্বর দেখছেন। আগে তো বাঁচা, তারপর তো ধর্ম, স্বর্গ, তপস্যা এবং দেবতাদের সন্তুষ্টিবিধান। দেবতারা সন্তুষ্ট হলে সব হল, কিন্তু মায়ের চেয়ে কি দেবতার আসর বড়? দেবতারা বাঁচাতে আসেন না।
এই জীবনে এক জাদু আছে, জীবনের সেই জাদুতে কতবার মুগ্ধ হয়েছি, আনন্দে কতবার অশ্রুপাত করেছি, সেই জাদুর কথা জেনেছিলাম মাতৃক্রোড়ে শুয়ে। মায়ের কথাই তো লিখব, লিখতে বসেছি। অতি প্রত্যুষে এই পেনসিলিয়া খবরিয়ার নিদ্রা ভাঙে। মা এসেছিলেন সেই কতকাল বাদে ঘুমের ভিতর। ২০০৪-এর জুনের ২৪-এ আমাদের শেষ দ্যাখা। কিন্তু দ্যাখা কি হয় না? ঘুমের ভিতর তিনি আসেন, যখন আমি ভয় পাই, দুঃস্বপ্নে কুঁকড়ে যাই। অব্যক্ত কণ্ঠে মা বলিয়া ডাক দিই। মা আমার কপালে হাত রাখেন। এই তো আমি। এই ইনি পেনসিলে ছবি আঁকেন। অংবংচং লেখেন। সেই অংবংচং খবর হল মায়ের কথা। আচমকা ঘুম যখন ভেঙে যায়, জানালার বাইরে অন্ধকার। কাকও ডাকেনি। দূর-অদূর নভোমণ্ডল তখন হিম নীলাভ, চারদিকে অসীম স্তব্ধতা, সেই নীরবতার ভিতরেই সে জীবনের আরম্ভে পৌঁছে যেতে চায়, এক বছর, দুই বছর, সামান্য ক’টি বছর, মহাবিশ্বের আয়ুর কাছে তা তো ধূলিকণামাত্র। এই সেদিন ছিলাম আমি অন্ধকার মাতৃগর্ভে, জননী সমুদ্রে। পেনসিলিয়া খবরিয়া মাতৃগর্ভের স্মৃতির কাছে ফিরে যেতে চায়। সেই যে অনন্তবিস্তারী সমুদ্রজলে ভেসে থাকা, সেই যে আধো ঘুম আধো জাগরণে অপেক্ষা করা কবে আলো-বাতাসের পৃথিবীতে সে ভূমিষ্ঠ হবে। অপেক্ষার আর শেষ নেই। ন’টি মাস। কত শব্দে চঞ্চল হয়েছে। পাশ ফিরে শুয়েছে। তারপর একদিন সে এল। প্রথম আলো পড়ল চোখে। সূর্যের কাজই তার আলো দিয়ে জীবজগতের প্রাণ তাপিত করা। অন্ধকার থেকে প্রাণকে আলোয় নিয়ে আসা। আমি মায়ের মুখ দেখলাম। মায়ের মূর্তি দেখতে শিখলাম, হাসিমুখখানি দেখলাম আমি। মা রাধারানি আমাকে দোল দিচ্ছেন কোলে শুইয়ে। মায়ের কোলে শুয়ে কাত হয়ে দেখলাম পাখি উড়ে গেল। মেঘের ছায়া এল। রোদ মুছে গেল, আবার ফিরেও এল। উড়ো মেঘে বৃষ্টি এল। ভাদ্র মাসে জন্ম আমার। হেমন্ত এল, শীত এল । ঋতুবদল হতে লাগল। হারিয়ে যাওয়া ঋতু আবার ফিরে এল। মায়ের কোলে শুয়ে মাকে চিনতে লাগলাম। মায়ের মূর্তি সেই তো চেনা আরম্ভ। সেই তো পেনসিলে ফুটিয়ে তোলা আরম্ভ। সেই আমার মায়ের মূর্তি গড়া আরম্ভ। মনের ভ্রমে মাটি দিয়ে মায়ের মূর্তি গড়তে গিয়েছিলেন কবি রামপ্রসাদ সেন। ‘মা বেটি কি মাটির মেয়ে, মিছে খাটি মাটি নিয়ে।’ মাতৃরূপ কি গড়ে তোলা যায়, সে থাকে মনের ভিতরে যতই অবয়ব দিই আমি, সে থাকে অসম্পূর্ণ।
মা বলতে আমি যে ছবি আঁকতে পারি পেনসিলে, তা কার সঙ্গে মিলবে, কার সঙ্গে মিলবে না– জানি না। শাস্ত্রসম্মত হবে কি না তা, তাও জানি না। এই যে দেবীপক্ষ শুরু হবে, মাতৃ আরাধনা শুরু হবে, সেই আরাধনায় কি আমার আরাধনা মিলবে? পৃথিবীর নানা ধর্মে ঈশ্বর তো মা নন, বাবা। ‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিত্য হি পরমা তপাঃ।’ পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই শ্রেষ্ঠ তপস্যা। পিতা সন্তুষ্ট হলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হন। মা কই সেখানে? আমার মাকে আমি আঁকি আঁচলে হলুদ, কপালে ঘাম, কয়লার উনুনের গনগনে তাপে লাল হয়ে যাওয়া মুখে বসে আছেন হেঁশেলে। ভাত ফুটছে, তিনি সবজি কুটছেন। ধুম জ্বর, জলপট্টি দিচ্ছেন মা। মা আছেন জ্বরতপ্ত সন্তানের কপালে হাত রেখে। সারা রাত জেগে আছেন মা। ছেলে কিংবা মেয়ের জ্বর দেখছেন। আগে তো বাঁচা, তারপর তো ধর্ম, স্বর্গ, তপস্যা এবং দেবতাদের সন্তুষ্টিবিধান। দেবতারা সন্তুষ্ট হলে সব হল, কিন্তু মায়ের চেয়ে কি দেবতার আসর বড়? দেবতারা বাঁচাতে আসেন না। মা জননী জন্ম দিয়েছেন। তিনি বাঁচিয়ে রাখবেন। আমি যদি যন্ত্রণায় কষ্ট পাই, আমার ব্যথা উপশম করবেন না। আমাদের ধর্মে মাতৃরূপ আছে। সেই দেবীর দশ হাত। দশ হাতে দশ অস্ত্র। মহিষাসুর বধ করেছিলেন তিনি।
স্বর্গের দেবতারা এক-একজন এক-এক অস্ত্র দিয়েছিলেন। তাঁকে তিলোত্তমারূপে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি মহিষাসুরমর্দিনী হয়ে উঠেছিলেন। আমার মা যে নাইওরে আসেন। তিনি তার সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়ি আসেন। বছরে একবার। তিলোত্তমা নন। সাধারণ। অতি সাধারণ হয়ে অসাধারণ। সারা বছর তিনি সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখেন। মনে মনে প্রার্থনা করেন, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। সন্তানের জন্য তিনি উপবাসে থাকেন। সন্তান ভাল কাজে জড়ালে, মানুষের মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত হলে, তার পাশে থাকেন। গত শতকের সাতের দশকে জেলবন্দি সন্তান, মায়ের প্রত্যয় আমি দেখেছি। সেই মা আমার প্রতিবেশী। ওপার বাংলার মুক্তিযুদ্ধেও তা হয়েছিল, এমন কাহিনি জানা আছে কম না।
সক্কালে হেঁশেলে যাওয়ার আগে মা জননী বাড়ির গাছগাছালির গায়ে জল দেন। গাছগাছালি তাঁর সন্তান। ফ্ল্যাটবাড়িতে বাগান নেই। জানালায় টব আছে। সেই টবে যে ফুলের গাছগুলি আছে, সেই গাছ তাঁর সন্তান, তাদের স্নিগ্ধ করে তবে স্নানে যাওয়া। স্নান সেরে হেঁশেলে ঢোকা। মনে আছে, তখন কত মানুষ আমাদের তিনঘরের ফ্ল্যাটে। সব পূর্ববঙ্গ থেকে আসা। তারা রানিদির বাসায় কিছুদিন থেকে, নিজেদের বাসা খুঁজে চলে যাবে। রানিদি একা বিশটা লোকের মুখে দু’বেলা অন্ন জুগিয়েছেন। হাসিমুখে। খাইয়ে আনন্দ। সকলের শেষে তাঁর খেতে বসা। ভাতের পাতের পাশে একটা কাসার ঘটি থাকত। আলগোছে সেই ঘটি থেকে জল খাওয়াতেই তাঁর যত সুখ। দুপুরে কাঁথায় ফোঁড় দেওয়া, ছেলেমেয়েদের ছেঁড়া জামা ছেঁড়া প্যান্ট রিফু করা। এই মায়ের সঙ্গে নানা অলংকারে ভূষিতা দেবতাদের দেওয়া শক্তিতে শক্তিরূপেণ মায়ের একবিন্দু মিলও নেই। গয়না তাঁর নেই। কান-গলা খালি। হাতে রুলি আর শাঁখা, আর ব্রোঞ্জের ওপর সোনার প্রলেপ লাগানো দু’গাছা চুড়ি। গয়না গিয়েছে একান্নবর্তী সংসারে। গিয়েছে গিয়েছে। গয়না যদি হয়, আবার হবে, নাহলে হবে না। আমার মায়েরও মা ছিল। সেই মা আশালতা কলমিলতা অকালে চলে গেলেন যখন, দেশটি দু’খণ্ড হয়নি। রানি, রাধারানি জ্যেষ্ঠা কন্যা। বিবাহ হয়েছে বছর তিন। রানির বাবা চলে গিয়েছেন দু’বছর আগে। মা তার পরপর। কপোতাক্ষ তীরে শ্মশান। সেই শ্মশানের দিকে ছোট ভাই, বছর চারের শিশু ছুটে ছুটে যেত। মাকে পাবে সেখানে। রাধারানিই হলেন তার মা। মা আমার কাছে তার মায়ের কথা বলতেন। বাবার কথা বলতেন। বাবার মৃত্যু, মায়ের মৃত্যু, আর সেই ছেড়ে আসা কপোতাক্ষ নদ, স্টিমারের ভোঁ। রানির পরের বোন মনু মারা গেলে মা চিঠি লিখেছিলেন তাঁর মা আশালতাকে– ‘মনু কষ্ট পেয়েছিল শেষদানিতে।’
এখন তোমার কাছে গিয়েছে। মা। তুমি মনুকে কোল দিও। কপালে হাত বুলিয়ে দিও। এই দেখুন কী বলতে কী বলছি। কথা না লতা। রানির কথা বলতে গিয়ে আশালতার কথা কেন? রানি, রাধারানির ছেলে গিয়েছে দূর মফস্সলে চাকরি করতে। তখন যা দিন, মোবাইল ফোন কেন, সেই মফস্সলে ইলেকট্রিকের আলো ছিল না, পোস্ট অফিস ছিল না।। চিঠি ফেলতে ভিনগাঁয়ে যেতে হত। চিঠি দিলে একমাস আগে কলকাতা পৌঁছত না। বাস থেকে নেমে একঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটতে হত অফিস, মানে, হলকা ক্যাম্পে পৌঁছাতে, এমনই সে জায়গা। ছোটনাগপুরের মালভূমির লেজা সেই অঞ্চল। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের একটি কন্যা। বয়স তার আড়াই-তিন। সে তার ঠাকমাকে বলল, ‘ছেলেধরা নিয়ে গেছে বাবুজিকাকাকে। হারিয়ে গেছে, আর ফিরবে না।’ শিশু যা শোনে, তাই বলে। তাকে যা বলে ভয় দ্যাখানো হয়, সেও তাই বলে ভয় দ্যাখায় ঠাকমাকে। মা তখন পিতামহী। মায়ের ঘুম আসে না। ছুটিতে বাড়ি এলে জিজ্ঞেস করে মা রাধারানি, কী খাই, কেমন জায়গা। ডাল, আলুসেদ্ধ আর কুঁদরি পোস্ত? মাছ হয় না? মাংস? সকাল-বিকেল মুড়ি, কেন পরোটা-লুচি করে দিতে পারে না? জানেই না মা ওসব। আমাদের দেশটা আসলে খুব গরিব।’ গ্রামটা আরও গরিব। শুনতে শুনতে মা অশ্রুময়ী। ধরা গলায় বললেন, ‘তুই বরং চাকরি ছেড়ে দিয়ে আয়, অন্য কিছু দ্যাখ।’
মা, আমার জ্বর হয়েছিল খুব, তাই আসতে এবার দেরি হল। জ্বরের ঘোরে আমি দেখেছিলাম তুমি বসে আছ শিয়রে। আমার অফিসের ডি-গ্রুপ স্টাফ মুচিরাম মূর্মূ খুব সেবা করেছে। মা বললেন, ‘তাকে একবার নিয়ে আসিস, দেখব। তাকে পুজোয় জামা দিস একটা। বিয়ে করেছে, করেনি, তাহলে তার মায়ের জন্য একটা ভাল তাঁতের শাড়ি নিয়ে যা।’ নিয়ে গিয়েছিলাম, মা কিনে দিয়েছিলেন। ধনেখালির সেই তাঁতি মানুষটির কাছ থেকে। ধারে শাড়ি নিতেন। ধীরে ধীরে শোধ করতেন। মুচিরামের মায়ের শাড়ির দাম মা-ই শোধ করেছিলেন। তাঁর সন্তানের সেবা করেছে মুচিরাম, দেবেন না? মায়ের মূর্তি এমনই। মা দাদার বাড়ি সল্টলেকে। ফোন করলেন আচমকা – ‘আয় না, কতদিন আসিসনি তুই!’ আমি তখন কলকাতার বাইরে বাঁকুড়ায়। পনেরো দিনে একবার কলকাতায় আসি। দু’দিন থেকে ফিরে যাই। খুব অভিমান হত তখন। আবার গেলে গলে জল। একগাল হাসি। ‘হ্যাঁ রে, সেদিন একটা মেয়ে এসেছিল, তার বাবা বড়দল স্টিমারঘাটার মাস্টারবাবু ছিল। পাইকগাছা বাড়ি।’ পূর্ববঙ্গ পেলে আর কিছু চাই না। লেবুপাতা আর নুন-শুকনো লঙ্কা বুঝি তা। একথালা পান্তা ভাত শেষ। মায়ের মুখে তাঁর ছেলেবেলার গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। সেই গল্পের কতটা ব্যক্ত, কতটা অব্যক্ত তার হিসেব আমি করতে পারব না। পারব না তাই, মায়ের মূর্তি পেনসিলে সবটা আঁকতেও পারব না। এবারের দুর্গোৎসবে অশ্রুময়ী মা আসছেন। কত মানুষের কাজ নেই, ভাত নেই। মা রাধারানি দেখেছিলেন তেতাল্লিশের মন্বন্তর। সেও মহামারী। সেইকথাও শুনেছি আমি মায়েরই মুখে। এখন আরেক মা দেখছেন আরেক মহামারী। মা শোনাবেন এই মহামারীর কথা তাঁর অনাগত সন্তানদের অনেক বছর বাদে। চক-খড়ি আর পেনসিল হাতে ধরিয়ে অক্ষর লিখতে শিখিয়েছিলেন তিনি। তাই পেনসিলেই এই মাতৃরূপ অঙ্কন।
(২০২০-র ১৮ অক্টোবরের ‘রোরবার’-এর ‘মা’ সংখ্যা থেকে লেখাটি পুনর্মুদ্রিত)
শীর্ষে ব্যবহৃত ছবিটি নন্দলাল বসু-র ‘মহিষাসুরমর্দিনী’