আধুনিক যুগে খোলা চুলের ফোবিয়া ইন্টারনেটে কন্সপিরেসি থিওরির পেজ আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন বয়োঃজ্যেষ্ঠদের জন্য বেঁচে আছে। রাতে চুল বাঁধার এই বিশ্বব্যাপী আবেশ তো কেবল কুসংস্কার নয়! বরং মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রাখার এক আদিম ষড়যন্ত্র। প্রাচীন পুরোহিত, মধ্যযুগীয় ডাইনি ও আধুনিক প্রভাবকরা সবাই মিলে যুগ যুগ ধরে মেয়েদের চুলের যৌন আবেদনকে রাখতে চেয়েছেন কবজায় । মিশর থেকে জাপান পর্যন্ত প্রতিটি সংস্কৃতি শুধু মগজ ধোলাই করে বলতে চেয়েছে– ‘চুল বেঁধে রাখুন, বা হিজাব দিয়ে ঢেকে রাখুন কারণ আপনার যৌনস্বাধীনতা আমাদের অনুগত দাস। এটি খোলা রাখা মানে আপনি একজন বিদ্রোহী, দুর্ভাগ্য ও জিনদের প্রলোভিত করা পাপী।’
১৬.
সভ্যতার ঠিক কোন শুভলগ্নে ছেলেরা অভ্যস্ত হল বয়কাট ছাঁটে আর মেয়েদের চুল হয়ে উঠল কবেকার বিদিশার নিশায় বিখ্যাত– বলা মুশকিল। কিন্তু যেভাবেই হোক না কেন, মেয়েদের চুল, বিশেষ করে যদি সেটা বাঁধা না হয়ে খোলা থাকে, তবে তা কবিদের কাব্যরচনার খোরাকি রূপে কিন্তু অমর হয়েছে ইতিহাসে। বেদব্যাস থেকে রবীন্দ্রনাথ– কেউই এড়িয়ে যেতে পারেননি নারীদের এলোচুলের মহিমা। প্রতিশোধের স্পৃহায় দ্রৌপদী যেমন পণ করছিলেন চুল না বাঁধার, তেমনই রোম্যান্টিক বর্ষার মেঘ দেখে রবীন্দ্রনাথের মনে সন্দেহ হয়েছিল ‘প্রাসাদের শিখরে আজিকে কে দিয়েছে কেশ এলায়ে, কবরী এলায়ে’।
মোদ্দা কথা, সাধারণ মানুষের তখন ঘাড়ে দুটো মাথা গজায়নি যে, ‘স্টলওয়ার্ট’ কবিদের গিয়ে বলবে ব্যাপারটা অপয়া! এলোকেশী মেয়েরা যে সততই অমঙ্গল ডেকে আনে এটা প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বাস করে এসেছে মানুষ। এই তত্ত্ব জোরদার করতে মানুষের জ্ঞাত যত অশরীরী নারী বা বলা ভালো মেয়ে-ভূতের ধারণা ছিল, তাদের কল্পনা করা হয়েছে খোলা চুলের অবয়বে। তাই বাড়ির মেয়েরা যে সন্ধেবেলা হতে না হতেই পড়ি কি মরি তৎপরতায় চুল বাঁধতে ছুটত, তা অনেকটা নিজেদের পেতনি বা শাঁকচুন্নি ইমেজ থেকে রক্ষা করার জন্যই। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, বাড়ির এই লক্ষ্মী মেয়েরা একবারও প্রশ্ন করল না কেন লক্ষ্মী ঠাকুরের চুলও বাঁধা নেই? শুধু লক্ষ্মী, সরস্বতী কেন? আমাদের হিন্দুধর্মে কোনও দেবীরই চুল বাঁধা নেই! তার কারণ, প্রকৃতির যে নিরন্তর বহমানতা, তা এলোচুলের মধ্য দিয়েই বোঝাতে চেয়েছিলেন প্রাচীন শিল্পীরা। ঝামেলাটা হল মধ্যযুগে, যখন খোলাচুলের সঙ্গে পরমা প্রকৃতির গহীন সম্পর্কের কথা একেবারে ভুলে বসল ভারতীয় মন। আর তার ফলে এলোচুল, সবার অলক্ষে হয়ে উঠল কুচকুচে অমঙ্গলের প্রতীক, পতপতে অপয়ার নিশান।
প্রাচীন মিশরে, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে, যখন নীল নদের জল ঝকঝক করছে, চারদিকে পিরামিড উঠছে হাইরাইজের মতো এবং সবাই তাদের চুলের স্টাইল নিয়ে রয়েছে মগ্ন, তখন দেবতাদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগের জন্য চুলই ছিল শরীরের কসমিক রাউটার। পুরোহিত ও অভিজাতরা আবার এই ঐশ্বরিক ওয়াই-ফাই নিরাপদ রাখার জন্য পরচুলা পরতেন, কারণ পূর্ণিমার নিচে এলোচুলের চেয়ে বড় অভিশাপ আর কিছুই ছিল না। সম্ভবত মৃত্যুর বইয়ে একটি গোপন ধারা ছিল: ‘তুমি খোলা চুলে ঘুমোবে না, নইলে আনুবিস তোমাকে বিপথগামী বিড়াল ভেবে ভুল করবে।’ তাই কেউ শুতে যাওয়ার আগে চুল বাঁধতে ভুলে গেলে দেবতারা তাদের শয়ন শিয়রে হানা দিয়ে উপহার দাবি করতেন বলেও বিশ্বাস করত মিশরীয়রা। বার্তা ছিল খুব স্পষ্ট– রাতে খোলা চুল মানে ঐশ্বরিক দুঃস্বপ্ন, দেবতার অভিশাপ!
মধ্যযুগীয় স্লাভিক ভূমিতেও খোলা চুল ছিল সরাসরি বিপদের বিজ্ঞাপন। ‘রুসালকা’ বলে একটি জলের আত্মা, যিনি চাঁদের আলোয় চুল আঁচড়াতে ভালোবাসতেন, ছিলেন খোলা চুলের অশুভ লক্ষণের প্রতীক। জলের এই ভিজে আত্মা, তার খোলা চুল নিয়ে আবাহন করত অপয়ার সংকেত। স্লাভিক লোককথায় সতর্ক করা হত যে, রাতে খোলা চুলের নারী মানেই অবচেতনে সে আমন্ত্রণ চাইছে রুসালকার। পরবর্তীকালে জনগণ এটিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল। বলল, খোলা চুল বন এবং জলের দেবীদেরও চোখের বলি। যারা ‘সন্ধ্যার পর কোনও খোঁপা নয়’ নীতি পালন করবে, তাদের কান খুলে শুনে নেওয়া প্রয়োজন একটাই কথা– পবিত্র আচারের বাইরে খোলা চুলে থাকলে বিবেক যেন অন্তত এটুকু স্বীকার করে নেয়, ‘আমি দেবীদের রাগিয়েছি’। এর পরেও ঘেটি-শক্ত মেয়েদের রাতে চুল খুলে রাখার জেদ ছিল এসব চুল-পুলিশের বিরুদ্ধে নীরব বিদ্রোহ।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে খ্রিস্টানদের উৎসাহ চুল-সম্পর্কিত উন্মাদনাকে এক মজার ককটেলে রূপান্তরিত করেছিল। রাতের খোলা চুল ছিল ডাইনিদের খেলার মাঠ এবং প্রতিটি গ্রামে এমন গল্পও ছিল যে, কারও খোলা চুল ডেকে এনেছিল অভিশাপের বৃষ্টি। পূর্ণিমার আলোয় চুল আঁচড়ানো মানেই ছিল শয়তানকে রাতের জন্য আমন্ত্রণ জানানো। কী সীমাহীন ইনফিডিলিটির অভিযোগ! মানে একজন নারীর আর পরপুরুষেও মন ভরছে না। তাই শয়তানকে ‘সিডিউস’ করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অমনই কোনও রোম্যান্টিক রাতে খোলা চুলের স্ত্রীকে দেখে যদি তার স্বামীর কামনা জাগে, তবে সমাজ সেই স্বামীকে ‘শয়তান’ ভেবে ওঝা-পেটা করত কি না, অবশ্য জানা নেই। আয়ারল্যান্ডে আবার নারীরা গুড ফ্রাইডের রাতে শোকের জন্য চুল খুলে রাখতেন, কিন্তু এটি ছিল অনুমোদিত বিশৃঙ্খলা। মানে পাদ্রিরা বললে স্ত্রীরা চুল খুলবে, স্বামী বললে নয়। তাই ব্যাপারটা অন্য রাতে হলেই ডাইনি বলে অভিযুক্ত করা হত সেসব মেয়েদের। অর্থাৎ কি না জমি, জমা, ফসলের মতোই পরস্ত্রীর ওপরেও চার্চের পাদ্রিদের অধিকার ছিল গৃহকর্তার চেয়ে ঢের বেশি। ইতালীয়রা আবার এতটাই ভয় পেত যে, চুল আঁচড়ানোর পরে মহিলারা চুলের টুকরো পুড়িয়ে ফেলত, যাতে কোন ডাইনিবুড়ি ‘ভুডু পুতুল’ তৈরি করতে না পারে। তাই একজন মধ্যযুগীয় গৃহবধূ মধ্যরাতে হঠাৎ তার চুলের টুকরো দেখতে পেয়ে, সটান সেটা ঝাড়ু দিয়ে তুলে, আগুনে পুড়িয়ে গোটা ঘর দুর্গন্ধময় করলেও স্বামীর নাক সিঁটকানোর উপায় ছিল না। বরং বমি চেপে বলতে হত ‘হালেলুইয়া’!
চিনা ভাষায় চুলের অক্ষরটি সমৃদ্ধির অক্ষরের মতো দেখতে বলে প্রাচীন চিনে, খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ সালের দিকে, রাতে এটি খোলা রাখার অর্থ ছিল জীবনের সঞ্চয় রাতের অন্ধকারে অসুরক্ষিত ফেলার মতো। রাত ছিল অপয়া শক্তিতে ভরা, যখন ভূত ও দুর্ভাগ্য টহল দেয়। সেখানে খোলা চুল মানেই ‘ভূত আপনি স্বাগতম’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে পিঠের পরে মেলে ধরা। জাপানের হেইয়ান যুগে (৭৯৪-১১৮৫ খ্রিস্টাব্দ) রাতে খোলা চুল নারীদের ‘ইউরেই’ নামের এক ভয়ংকর ভূতদের লক্ষ্যবস্তু করত। এবং এদের প্রভাব এতটাই বিস্তৃত যে, আধুনিক যুগের জাপানি হরর ফিল্মকেও তারা অনুপ্রাণিত করেছিল। অবশ্য শুধু মহিলারাই নয় জাপানের সামুরাইরাও তাদের টপনট শক্ত রাখত, কারণ খোলা চুল তাদের পরাজয়ের অসম্মান এবং অশুভ হামলার সংকেত দিত।
ঔপনিবেশিক যুগে এই চুলের উন্মাদনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকার আদিবাসী উপজাতিরা তাদের আত্মার ভারসাম্য রাখতে চুলে বিনুনি করত, কারণ তাদের কাছে রাতে খোলা চুল ছিল খারাপ জুজুকে আমন্ত্রণ জানানোর শামিল। ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনে এই আবেশ বিচিত্র সব কুসংস্কারের স্তরে পৌঁছেছিল। রাতে একটি ববি পিন পড়ে যাওয়া মানে ছিল প্রিয় বন্ধুর শেষকৃত্যের বুকিং। অন্ধকারে চুল আঁচড়ানোও ছিল আত্মহত্যার শামিল, কারণ প্রতিটি আয়না ছিল ক্ষোভপ্রবণ আত্মাদের পোর্টাল। আর তা যদি কোনও কোনায় এক চিলতেও ভাঙা থাকে, তাহলে সর্বনাশের মাথায় বাড়ি। ভিক্টোরিয়ান মেয়েরা তাই সম্ভবত তাদের রাতের আড্ডায় সময় কাটাত মূলত একে-অপরের চুলে বিনুনি করে। সে যুগের গথিক নাটক এই ভয়কে আরও একটু বাড়িয়ে রটিয়ে দিয়েছিল, রাতের খোলা চুল আসলে ধ্বংসাত্মক ভবিষ্যতের নন-রিফান্ডেবল টিকিট।
আধুনিক যুগে খোলা চুলের ফোবিয়া ইন্টারনেটে কন্সপিরেসি থিওরির পেজ আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন বয়োঃজ্যেষ্ঠদের জন্য বেঁচে আছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে জিনের আতঙ্ক এখনও এতটা রয়েছে যে, ঘুমের সময় চুল খুলে রাখার অর্থ হল ঘুম ভাঙার পর জিনের সঙ্গে জেগে ওঠা। ইরান, পাকিস্তান-সহ ইসলাম প্রধান দেশে ছোট মেয়েরা হিজাব না-পরার বায়না ধরলে বাড়ির বড়রা আজও জিনের ভয় দেখিয়ে খোলা চুলের বিপদের কথা মনে করিয়ে দেন। স্লাভিক কিছু টিকটকাররা এখনও রাতে চুল আঁচড়ানোর বিরুদ্ধে সতর্ক করে রুসালকার কথা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর।
…………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
…………………………..
কিন্তু আসল সত্যটা কী? রাতে চুল বাঁধার এই বিশ্বব্যাপী আবেশ তো কেবল কুসংস্কার নয়! বরং মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রাখার এক আদিম ষড়যন্ত্র। প্রাচীন পুরোহিত, মধ্যযুগীয় ডাইনি ও আধুনিক প্রভাবকরা সবাই মিলে যুগ যুগ ধরে মেয়েদের চুলের যৌন আবেদনকে রাখতে চেয়েছেন কবজায় । মিশর থেকে জাপান পর্যন্ত প্রতিটি সংস্কৃতি শুধু মগজ ধোলাই করে বলতে চেয়েছে– ‘চুল বেঁধে রাখুন, বা হিজাব দিয়ে ঢেকে রাখুন কারণ আপনার যৌনস্বাধীনতা আমাদের অনুগত দাস। এটি খোলা রাখা মানে আপনি একজন বিদ্রোহী, দুর্ভাগ্য ও জিনদের প্রলোভিত করা পাপী।’
শুধু ভীষণ প্রেমে যে কবিমন এককালে ভেবেছিল– ‘স্নানের পরে চুল ঝাঁকালে মুখ ধোবো’, সে বেচারা জানতই না, এলোচুলের ইতিহাসে সে আসলে নিষ্পাপ প্রেমিক নয়, খাঁটি শয়তান!
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ১৫। যে আত্মীয়তার ডাককে অপয়া বলে বিকৃত করেছে মানুষ
পর্ব ১৪। অকারণে খোলা ছাতায় ভেঙে পড়েছে পাবলিক প্লেসে চুমু না-খাওয়ার অলিখিত আইন
পর্ব ১৩। দলবদলু নেতার মতো ধূমকেতু ছুটে চলে অনবরত
পর্ব ১২। কখনও ভয়ংকর, কখনও পবিত্র: দাঁড়কাক নিয়ে দোদুল্যমান চিন্তা!
পর্ব ১১। শুধু একটা হ্যাঁচ্চো– বলে দেবে কীভাবে বাঁচছ
পর্ব ১০। অপয়ার ছেলে কাঁচকলা পেলে
পর্ব ৯। চোখের নাচন– কখনও কমেডি, কখনও ট্র্যাজেডি!
পর্ব ৮। জুতো উল্টো অবস্থায় আবিষ্কার হলে অনেক বাড়িতেই রক্ষে নেই!
পর্ব ৭। জগৎ-সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক অপয়া কেন হবে!
পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
পর্ব ১। পান্নার মতো চোখ, কান্নার মতো নরম, একা