পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে প্রায় ১৭ লাখ মানুষ ফুটপাতে বসবাস করেন। ফুটপাতেই তাঁদের গোটা জীবন অতিক্রান্ত হয়। ফুটপাতকেই সম্বল করে তাঁরা বেঁচে থাকে বারোমাস। রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে দিব্যি টিকে থাকার লড়াই চালান অগণন ফুটপাতবাসী। এই টাঁয়েটুঁয়ে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হল পথকুকুরা। পথকুকুরা তাঁদের ভরসা এবং আশ্রয়স্থল। তাঁদের বন্ধু। যে মানুষগুলো সারাটা জীবন সড়কের পাশের রাস্তাটাকে নিজেদের বাসস্থান ভেবেছে, তাঁদের কাছে পথকুকুররা তো পোষ্য। সেই পোষ্যকে যদি আইন করে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়, তাহলে কি ফুটপাথবাসীদের পোষ্যের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে না?
চিত্রঋণ: মায়াঙ্ক অস্টেন সুফি
দিল্লির পথকুকুরদের সরিয়ে দিতে হবে– এই রায়ে আপাতত হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছে। পথকুকুরদের নিয়ে চর্চা, ইদানীং চোখে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে। অনেক মানুষই পথের কুকুর বাড়িতে নিয়ে আসেন, যত্ন নেন, আদর-বকা-স্নেহ দিয়ে গড়ে তোলেন পোষ্যটিকে। তা অনেকেই ভ্লগের মাধ্যমে দেখান। ইউটিউব বা রিলে, সেসব ভিডিওতে লাখ লাখ ‘ভিউ’। উল্টোদিকে, এ-ও সত্যি, অনেক সময়ই পথকুকুরের প্রতি অত্যাচারের ভিডিও-ও চোখে পড়ে। দিল্লি হাইকোর্টের রায়ে, সবার প্রথমেই মনে পড়ে মতি নন্দীর লেখা গল্প। গল্পের নাম ‘জালি’। বিদেশি কুকুর ‘লিজা’ সন্তান প্রসব করতে গিয়ে যখন ঝাঁ-চকচকে বিত্তঘরে মারা যায় তখন রাস্তায় সদ্যপ্রসব করা নেড়ি কুকুরকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আনা হয় বাড়িতে। নাম দেওয়া হয়, লিজার উল্টো– ‘জালি’। এবং লিজার সন্তানরা এই নেড়ি কুকুরের স্তন্যপান করেই দিন সাতেকে টগবগিয়ে ওঠে। তারপর জালির ঠিকানা ফের ফুটপাত। তার সন্তানদের গতি? আবর্জনায়, কাক-চিলের ঠোক্করে। এরকমটা নেড়িদের সঙ্গে বিত্তবানরাই হয়তো করতে পারেন, পারেন না তাঁরাই, যাঁরা থাকেন পথে। পথই যাদের একমাত্র আশ্রয়।
পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে প্রায় ১৭ লাখ মানুষ ফুটপাতে বসবাস করেন। ফুটপাতেই তাঁদের গোটা জীবন অতিক্রান্ত হয়। ফুটপাতকেই সম্বল করে তাঁরা বেঁচে থাকে বারোমাস। রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে দিব্যি টিকে থাকার লড়াই চালান অগণন ফুটপাতবাসী। এই টাঁয়েটুঁয়ে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হল পথকুকুরা। পথকুকুরা তাঁদের ভরসা এবং আশ্রয়স্থল। তাঁদের বন্ধু। যে মানুষগুলো সারাটা জীবন সড়কের পাশের রাস্তাটাকে নিজেদের বাসস্থান ভেবেছে, তাঁদের কাছে পথকুকুররা তো পোষ্য। সেই পোষ্যকে যদি আইন করে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়, তাহলে কি ফুটপাথবাসীদের পোষ্যের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে না?
ভারত জুড়ে প্রায় ৫-৬ কোটি পথকুকুর। অধিকাংশই সম্পূর্ণভাবে রাস্তায় বসবাস করে এবং অল্পসংখ্যক কুকুরের আবাস আশ্রয়কেন্দ্রে। ফুটপাতবাসী ও পথকুকুরের সহাবস্থান কেবল মানবিক টানাপোড়েনের গল্প নয়, বরং এক জটিল সামাজিক ও পরিবেশগত সমীকরণ, যাকে সমাজতত্ত্বে বলা যায় ‘স্ট্রিট ইকোলজি’। ফুটপাতবাসীদের দারিদ্রের ক্লান্তি, একাকিত্বের যন্ত্রণা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ক্ষত কিছুটা হলেও সারিয়ে তোলে এই পথকুকুর। মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে এই সম্পর্কের একটি জৈবিক ভিত্তি রয়েছে। মানুষ ও কুকুরের এই সম্পর্ক ‘অক্সিটোসিন’ হরমোনের মাত্রা বাড়ায় যা আস্থাবোধ, সংযুক্তি, উদ্বেগ ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। গবেষণা বলছে, পোষ্য প্রাণীর উপস্থিতি হৃদ্গতি, রক্তচাপ ও কর্টিসলের মাত্রা কমাতে পারে এবং মানসিক চাপের সময় এক ধরনের সুরক্ষাবলয় তৈরি করে। নিজের পোষ্য হলে এই প্রভাব আরও তীব্র হয়। শীতের রাতে কুকুরের গা লাগিয়ে উষ্ণতা নেওয়া কিংবা দিনের বেলায় হোটেল ও বাজারের উচ্ছিষ্ট ভাগ করে নেওয়া, রাস্তার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও কুকুরের অবদান রয়েছে। ফলে হঠাৎ করে পথকুকুর অপসারণ মানে নিরাপত্তা, মানসিক ভরসা ও বেঁচে থাকার যৌথ কৌশলকে ভেঙে দেওয়া। এ শুধুই পথকুকুরের নয়, সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষের মানবাধিকার ও জনকল্যাণের প্রশ্নও।
ভারতীয় সিনেমায় পথকুকুর ও প্রান্তিক মানুষের সম্পর্কের যে মর্মস্পর্শী চিত্রায়ণ পাওয়া যায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ‘চিল্লার পার্টি’ (২০১১)। নীতেশ তিওয়ারি ও বিকাশ বাহল পরিচালিত এই জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিতে ফুটপাতের শিশু ফাটকা ও তার একমাত্র বন্ধু পথকুকুর ভিডু-র গল্প উঠে এসেছে– যেখানে কুকুরকে সরিয়ে দেওয়ার প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত শিশুর জীবনে নিরাপত্তা, সঙ্গ ও আবেগের ভরসা ছিনিয়ে নেওয়ার সমান। শিশুদের তীব্র প্রতিবাদ ও ঐক্য এই সহাবস্থানের সামাজিক গুরুত্বকে আলোকপাত করে, যা আসলে ‘স্ট্রিট ইকোলজি’-র বাস্তব প্রতিফলন। ‘রোডসাইড রোমিও’ (২০০৮), যশ রাজ ফিল্মস ও ওয়াল্ট ডিজনির যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত একটি অ্যানিমেটেড কৌতুকধর্মী ছবি, যেখানে গৃহপালিত কুকুর রোমিও মালিকের পরিত্যাগের পর মুম্বইয়ের রাস্তায় নতুন জীবন শুরু করে। শুরুতে অপরিচিত এই কঠিন বাস্তবতায় টিকে থাকার জন্য সে অন্যান্য পথকুকুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবিলা করে এবং রাস্তার নিয়ম শিখে নেয়। যদিও ছবিটি মূলত বিনোদনমূলক, তবুও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে সহাবস্থান, অভিযোজন এবং প্রান্তিক জীবনের সামাজিক বন্ধনের বার্তা যা ফুটপাতবাসী মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গেও মিল খুঁজে পায়। ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’-এ মুম্বইয়ের ঘনবসতি ও রাস্তার জীবনের প্রান্তিক পরিস্থিতি দর্শকের সামনে আসে, যেখানে শিশু জামালের জীবন একেবারে কষ্টসাধ্য হলেও সে রাস্তার পরিবেশে অভিযোজিত হয়ে নিজের মানসিক স্থিতি বজায় রাখে। যদিও কুকুর সরাসরি গল্পের অংশ নয়, তথাপি রাস্তার মানুষের জীবনের সহাবস্থানের প্রেক্ষাপট এবং ছোট ছোট প্রাণীর সঙ্গে সংযোগের সম্ভাবনা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
এসবের পাশাপাশি, এও সত্যি যে, ভারতে কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হওয়া একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা। ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৩৭.১৭ লক্ষ মানুষ কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছেন যা গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি। এই কামড় থেকে সৃষ্ট র্যাবিসে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ’-এর সাম্প্রতিক গবেষণায় বছরে প্রায় ৫,৭২৬ জনের মৃত্যু (প্রতিদিন গড়ে ১৫-১৬ জন) ধরা হলেও WHO-এর অনুমান অনুযায়ী তা বছরে ১৮-২০ হাজার (প্রতিদিন প্রায় ৫০ জন পর্যন্ত) হতে পারে। মৃত্যুহারের এই পার্থক্যের মূল কারণ আন্ডার-রিপোর্টিং, প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং সময়মতো সম্পূর্ণ চিকিৎসা না পাওয়া। নগরায়নের ফলে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা বৃদ্ধি, আবর্জনা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও পশু জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অপ্রতুলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। প্রসঙ্গত দিল্লিতে পথকুকুরদের কামড়ে জলাতঙ্ক এবং তার জেরে আমজনতার মৃত্যু– দুটোই উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, এই সংক্রান্ত রিপোর্টের ভিত্তিতেই শুনানি শুরু হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। দিল্লি-এনসিআর এলাকার সমস্ত পথকুকুরকে অবিলম্বে ধরে তাদের নির্বীজকরণ করিয়ে পাঠাতে হবে নিরাপদ আশ্রয়ে। প্রয়োজন বলপ্রয়োগ করে পথকুকুরদের ধরতে হবে। এই ঘটনার পরেই একের পর এক আন্দোলন শুরু হয়েছে। পশুপ্রেমীরা পথে নেমেছেন কিন্তু ফুটপাতবাসীদের যে শূন্যস্থল তৈরি হচ্ছে, সেটা কি পূর্ণ হবে? ইতিমধ্যে প্রায় ৭০০ পথকুকুরকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের পরে কি তাদের আবার পুরনো ডেরায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে?
প্রায় প্রতি পাড়াতেই থাকেন এমন কিছু মানুষ, যাঁরা প্রতিদিন নিজেদের এলাকার পথকুকুরদের নিয়ম করে খাবার খাওয়ান। হাইকোর্টের রায় বহাল হলে তাঁদের অভ্যাসে একটা পরিবর্তন ঘটবে তো বটেই। কিন্তু যে-মানুষগুলো একটামাত্র কুকুরকে আশ্রয় করে বেঁচে ছিল চিরকাল, একই জমিনে বসত-ঘুমত, এমনকী, পাশাপাশি বসে খেতও– তাদের কী হবে?
যাঁরা আশ্রয়হীন, তাঁদের আরও নিরাশ্রয় করার সুচতুর কোনও পদ্ধতি বলেই কি ধরে নেব সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে?