কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফ থেকে সম্প্রতি একটি নোটিশ পাঠানো হয়েছে বাকি মন্ত্রকগুলিতে। উদ্দেশ্য একটাই। লোকজনদের স্বাস্থ্য নিয়ে আরও বেশি সচেতন করা। শোনা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রকাশ্য স্থানে, যেখানে সাধারণ মানুষের যাতায়াত বেশি, সেখানে টাঙানো হবে পোস্টার। আর এই পোস্টারে লেখা থাকবে শিঙাড়া, জিলিপিতে ক্যালোরির পরিমাণ। সঙ্গে থাকবে সতর্কীকরণ। এই ঘোষণাটি হওয়ার পরেই ঘুম উড়েছে শিঙাড়া-জিলিপির দোকানের মালিকদের। ভয় পেয়েছেন তাঁরা, আগামী দিনে ব্যবসার পড়ে যাওয়ার কথা ভেবে। সেই ভয়েরই প্রাথমিক বহিঃপ্রকাশ হল খরিদ্দারদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার। দেশের কোথাও এখনও পর্যন্ত একটিও এমন পোস্টার পড়েছে বলে জানা নেই!
পাড়ার কমলিকা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কর্মচারীদের ব্যবহার দুম করে বদলে গিয়েছে মাসখানেক হল।
দোকানের ভিতরের দেওয়ালে বিরাট ঘড়িটার পাশে ঝুলে থাকা বোর্ডে লেখা, ‘আপনার ব্যবহারই আপনার পরিচয়।’– এই বোর্ড বরাবরই ছিল। ভালো মিষ্টির সঙ্গে ভালো ব্যবহারের জন্যও পরিচিত ছিল যে দোকান, সেখানে ছন্দপতন চোখে পড়েছে সবার। ব্যবহারের বিষয়টি সকালবেলায় দোকান খোলার পরে মোটামুটি ঠিকঠাক থাকলেও বাদল ঘনায় বিকেল সাড়ে চারটে-পাঁচটা নাগাদ। দোকানের সামনে পাশাপাশি নেমে যায় দুটো বিশালাকৃতি কড়াই। একটাতে ভাজা হতে থাকে শিঙাড়া। অন্যটায় জিলিপি। দুটো কড়াইয়ের দায়িত্বে দু’জন। আর দু’জনের মুখেই ঘন কালো মেঘ। হঠাৎ গজিয়ে ওঠে অজস্র বলিরেখা। মুখে রাজত্ব করে একরাশ বিরক্তি। যে কোনও খরিদ্দারের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে মোটামুটি এরকম।
–দাদা, শিঙাড়াটা ভালো হবে তো?
–বেশি খবরের কাগজ পড়া শুরু করে দিয়েছেন আজকাল? নাকি সারাদিন পায়ের ওপর পা তুলে বসে খবরের চ্যানেল গিলছেন?
–এভাবে বলছেন কেন?
–বেশ করেছি বলেছি! লোকে যা খুশি খেয়ে যাচ্ছে চারদিকে, শুধু নজর পড়ল শিঙাড়া-জিলিপিতে। আমার সঙ্গে ফ্যাট নিয়ে ফটর ফটর করতে আসবেন না মশাই। ফুটিয়ে দেব কিন্তু।
–প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি উত্তেজিত হচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না?
–ফুটন্ত তেলের মধ্যে আপনি যদি জলের ছিটে দিতে থাকেন, তাহলে এমনই তো হবে। সরকারকে কে বলেছিল এত ঘ্যানঘ্যান করতে? আগে লোকে কড়াইতে গরম তেলে শিঙাড়া, জিলিপির ছোটাছুটি দেখত পরম তৃপ্তি নিয়ে। এখন কেমন যেন আড়চোখে দেখে। সবাই অবশ্য নয়। যেগুলো বেশি খবর গেলে, তারাই এমন করে। আমরা মুখ দেখলেই বুঝে যাই।
–ইদানীং লোকজন কি বেশি প্রশ্ন করছে আপনাদের?
–সরকার এমন ঘোষণা করলে করবে না? আগে লোকের প্রশ্নগুলো মোটামুটি দু’ধরনের ছিল। গরম হবে তো? ম্যাক্সিমাম বলত, তেলটা ফ্রেশ তো? কালকের তেলে ভাজছেন না তো? এখন বলে, আপনার দোকানের শিঙাড়ায় গড়ে কত ক্যালোরি থাকে? স্যাচুরেটেড ফ্যাট কতটা আইডিয়া আছে? জিলিপিগুলো একটু কম ক্যালোরির করতে পারেন না? একজন সেদিন বলল, দাম বাড়ান। কিন্তু লো ক্যালোরি শিঙাড়ার কথাও ভাবুন। না হলে সন্ধেবেলায় এই শিঙাড়া-জিলিপির ব্যবসা আর চালাতে পারবেন না বেশিদিন। শুনে মনে হচ্ছিল, দু’হাতা ফুটন্ত তেল ওই লোকটার মুখে ছুড়ে মারি। যত্তসব!
একটু বিশদে বলা যাক এবারে। খবরে জানতে পারা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফ থেকে সম্প্রতি একটি নোটিশ পাঠানো হয়েছে বাকি মন্ত্রকগুলিতে। উদ্দেশ্য একটাই। লোকজনদের স্বাস্থ্য নিয়ে আরও বেশি সচেতন করা। শোনা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রকাশ্য স্থানে, যেখানে সাধারণ মানুষের যাতায়াত বেশি, সেখানে টাঙানো হবে পোস্টার। আর এই পোস্টারে লেখা থাকবে শিঙাড়া, জিলিপিতে ক্যালোরির পরিমাণ। সঙ্গে থাকবে সতর্কীকরণ। সরকারের আশা, এই মুখরোচক খাবারের অন্তরে লুকিয়ে থাকা বিপুল ক্যালোরি সম্পর্কে জানতে পেরে আমআদমি ঘন ঘন এসব খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। এর ফলে সার্বিকভাবে ভালো থাকবেন তাঁরা। একই বন্ধনীর মধ্যে আসতে চলেছে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পাও ভাজির মতো ফ্রায়েড খাবারও।
এই ঘোষণাটি হওয়ার পরেই ঘুম উড়েছে শিঙাড়া-জিলিপির দোকানের মালিকদের। ভয় পেয়েছেন তাঁরা, আগামী দিনে ব্যবসার পড়ে যাওয়ার কথা ভেবে। সেই ভয়েরই প্রাথমিক বহিঃপ্রকাশ হল খরিদ্দারদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার। দেশের কোথাও এখনও পর্যন্ত একটিও এমন পোস্টার পড়েছে বলে জানা নেই! কিন্তু খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পরেই সামাজিক মাধ্যমে তৈরি হওয়া অজস্র রিল এই ব্যবসার কারবারীদের চিন্তা বাড়াচ্ছে ক্রমশ। খবরে কাগজ ঠোঙা হয়। কিন্তু রিল জীবিত থাকে জিওল মাছের মতো!
কান পেতে থাকলে বুঝতে পারি, এমন ঘোষণা নিয়ে সাধারণ মানুষ কার্যত দু’ভাগ। একদলের বক্তব্য, এমন বাণী কত এল, কত গেল! কিচ্ছুটি হবে না। প্রাণের খাবার জিলিপি-শিঙাড়া– যুগ যুগ জিও। আর অন্য দল বলছেন, ভেজালসর্বস্ব দুনিয়ায় নিজেদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। জেনে শুনে গরল গ্রহণ করার মধ্যে কোনও যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। শিঙাড়া-জিলিপিতে ক্যালোরির পরিমাণ জেনে টনক নড়েছে তাঁদের। শপথ করছেন, অনেক হয়েছে, আর নয়। এই লড়াইয়ে কারা জিতবেন, কারাই বা হারবেন, তার উত্তর আপাতত সময়ের গর্ভে।
এক পরিচিত ডাক্তারবাবু এ প্রসঙ্গে ভারি মজার কিছু কথা বললেন। তাঁর কথায়, “সবচেয়ে অবাক হই লোকের ক্যালোরি সচেতনতা দেখে। এক রোগীকে পাঁচটার বদলে তিনটে রুটি খেতে বলেছিলাম ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য। উনি মাসখানেক পরে এসে একগাল হেসে বললেন, ‘রুটির পরিমাণ একেবারে কমিয়ে দুটো করে দিয়েছি ডাক্তারবাবু। আমার ভয়ংকর মনের জোর।’ দেখলাম, ওজন কমার বদলে বেড়েছে তিন কেজি। জানতে পারলাম, মাত্র দুটো রুটি খাচ্ছেন বলে ওই রুটির দু’ধারে ভাল করে মাখন লাগাতে শুরু করেছেন। এমন উদাহরণ দিতে পারি শয়ে শয়ে। হাই ক্যালোরি খাবার কমাতে বলি। বুদ্ধিমান রোগী তার লো ক্যালোরি ভার্সান খুঁজে নিয়ে খাওয়া দ্বিগুণ করে দেন। বিকেলে শুধু মুড়ি খেয়েছেন বলে রাত্রে আইসক্রিম খেয়ে ফেলেন। খাবারের ক্যালোরির মাপ যে খাদ্যের পরিমাণের সঙ্গে সমানুপাতিক সম্পর্কে বাড়ে কমে না, একথা আমি বুঝিয়ে বুঝিয়ে ব্যর্থ! শিঙাড়া-জিলিপির পোস্টার কী করবে, সেটাই এখন দেখার।”
ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়ে দেখেছি, প্রক্রিয়াজাত খাবার কেনার সময় অনেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লেবেলগুলো পড়েন। হাল আমলে, লেবেলের গায়ে বেশ কিছু তথ্যের উল্লেখ করতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে। খাবারটি খেলে সর্বমোট কত ক্যালোরি শরীরে ঢুকবে, এর মধ্যে প্রোটিন, স্নেহপদার্থ, শর্করার পরিমাণ কতটা রয়েছে, কোনও কৃত্রিম রং কিংবা গন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে কি না, এসব লেখা থাকতেই হয়। বিভিন্ন সংস্থার সামগ্রীর এমন লেবেল পড়ে, অনেক ভেবেচিন্তে ক্রেতারা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। ক্রেতাদের একটা বড় অংশ চিরাচরিত খাবারের থেকে ধীরে ধীরে সরে গিয়ে অর্গানিক খাবারে মন দিচ্ছেন। এর ফলে তাঁদের খরচ বাড়ছে। কিন্তু এই বাড়তি অর্থব্যয় শুধুমাত্র স্বাস্থ্যের কথা ভেবেই। অবাক হয়ে দেখি, খাবারের গুণাগুণ বিচার করে, হাজার সমীকরণ খাটিয়ে, ‘সুষম’ বাজার করে হাসিমুখে যে লোকটি বের হচ্ছেন কোনও শপিং মল থেকে, তিনিই পলক ফেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন কোনও রোল কর্নারের সামনে। হাঁকছেন, ‘একটা ডবল চিকেন, ডবল এগরোল দাও। বেশি করে সস্ দিও।’ খেতে খেতে হয়তো আত্মদংশনে ভুগছেন। তারপরে, প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য অর্ডার দিচ্ছেন জিরো ক্যালোরি ঠান্ডা পানীয়র ক্যান। পান করার সময় মনের মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে অনাবিল আনন্দ। ভাগ্যিস নর্মাল কোল্ড ড্রিঙ্ক খাইনি! ১৪০ ক্যালোরি কী সুন্দরভাবে বাঁচিয়ে ফেললাম।
এরকম একটা সত্তা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই বেঁচে থাকে। আমরা তাকে লালন করি। জানতে পারলাম, একটা শিঙাড়ায় গড়ে ২৬০-২৭০ ক্যালোরি থাকে। আর এই পরিমাণ ক্যালোরি পোড়াতে যা লাগে তা হল, কম করে আধ ঘণ্টা হনহন করে হাঁটা। সমস্যাটা এখানে বহুমাত্রিক। একটা শিঙাড়ায় থামতে পারেন ক’জন লোক? এর থেকেও বড় সমস্যা হল, দিনে আধ ঘণ্টা হাঁটেন ক’জন মানুষ? আরও একটি বিঘ্ন সগর্বে বর্তমান। দুটো শিঙাড়া তো হল। একটা গরম গরম জিলিপি না হলে জমে নাকি? আরে ছাড়ুন তো মশাই!
২০২১-এর কেন্দ্রীয় সমীক্ষা বলছে, দেশের শহরাঞ্চলে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে এক জন পৃথুল। আর স্থূলত্ব কী কী রোগ ডেকে আনে, তার তালিকা অন্তহীন। ওই চিকিৎসকের কথায়, ‘কোন কোন অসুখ ডেকে আনে না, তার লিস্ট বানাতে বলুন। আমায় কিন্তু এই বুড়ো বয়সেও বাচ্চা ছেলেদের মতো কলম কামড়াতে হবে। মোটা হওয়া মানে নিজের ধ্বংস ডেকে আনা।’
খাদ্যাভাস গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। ক্যালোরির বোমা হলেও কোনও খাবারকে নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা সরকারের নেই। জনমত তৈরি করা, অধিক ক্যালোরির খাবার খেলে কী কী অসুবিধা হতে পারে তা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা– সরকারের ক্ষমতা এটুকুই। এর নির্যাসটুকু নিয়ে যদি আমরা তুলনামূলকভাবে ভালো থাকতে পারি, তাতে ক্ষতি কী!
আবার ফিরে আসি কমলিকা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। মাসচারেক আগের কথা। তখনও নির্দেশিকা আসেনি। বিকেল পাঁচটা। কড়াইয়ে ফুটন্ত তেলে নাচানাচি করছে কম করে ৫০টি শিঙাড়া।
–দাদা আপনার কী মজা বলুন তো। একেবারে শিঙাড়ার সঙ্গে সংসার।
–হুম।
–বলছি, আপনি দিনে ক’টা করে শিঙাড়া খান?
–ধুস! এটা আবার একটা খাওয়ার জিনিস হল নাকি!
………………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
………………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved