ব্রিটিশ সার্জেন নিক মেনার্ড– যিনি বেশ কয়েকবার দফায় দফায় গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে কাজ করেছেন, বলেছেন, শেষবার গাজায় গিয়ে বন্দুকের গুলিতে আহত যে কিশোরদের শরীরে তাঁরা সার্জারি করেছেন, তাঁরা সবাই ত্রাণ কেন্দ্রে খাবার নিতে এসেছিল। সেটাই এখন প্যাটার্ন হয়ে গিয়েছে। খাবার নিতে আসা মানুষদের শরীরে টার্গেট প্র্যাকটিসের মতো গুলি চালানো। তিনি এটাও বলেন যে, বাচ্চারা শুধু না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে, তাদের শুধু ‘চামড়া আর হাড়সর্বস্ব’ বলেও আর বর্ণনা করা যায় না। একটা গোটা প্রজন্মকে না-খেতে দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। অথচ কিছুদিন আগে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন যে, ইজরায়েলের ওপর গাজায় সাহায্য বন্ধ করার যে অভিযোগ এসেছে– তা সম্পূর্ণ মিথ্যে।
আমেরিকান সৈন্যবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের একজন প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষ অ্যান্টনি অ্যাগুলার ‘গাজা হিউম্যানেটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের’ কর্মী হিসাবে খাদ্য বিতরণের জন্য কাজ করছিলেন। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে প্যালেস্টাইনের অবস্থা কেমন? যুদ্ধবিদ্ধস্ত গাজা প্রায় সম্পূর্ণ অনাহারে। ‘ইন্ট্রিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন’-এর তথ্য অনুযায়ী, গাজায় প্রতি তিনজনের একজন খেতে পাচ্ছে না, ২০২৫ সালের মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে চূড়ান্ত খাদ্যহীনতার এই সংকট পরিবার পিছু বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। উত্তর গাজায় এর পরিমাণ ৩৩ থেকে ৮১ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে, মাত্র তিনমাসের মধ্যে! আর দশের মধ্যে ন’টা পরিবার চেষ্টা করছে খাবার খুঁজে পাওয়ার নিত্যনতুন উপায়– যার মধ্যে আছে জঞ্জাল ঘেঁটে খাবার বের করা। এরকম অবস্থায় গাজায় খাদ্য বিতরণের ব্যবস্থা গাজা হিউম্যানেটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের হাতে, যার নিয়ন্ত্রণে ইজরায়েল সেনা আর আমেরিকার একটি প্রাইভেট কন্ট্রাক্টিং সংস্থা, যার হয়ে কাজ করছিলেন অ্যাগুলার। আর তার কাছ থেকেই পৃথিবী শুনতে পায় আমিরের গল্প।
অ্যাগুলারের খাদ্য বিতরণের দ্বিতীয় দিন। একটি ছোট ছেলে আসে খাবার নিতে। একা, তার পরিবারে জন্য। সে আসে ১০-১২ কিলোমিটার হেঁটে। তার পরনে নোংরা জামা, ঢলঢলে প্যান্ট কোনওরকমে দড়ি দিয়ে তার শীর্ণ কোমরে বাঁধা। পায়ে নেই কোনও জুতো। সে মাটি থেকেই কুড়িয়ে নেয় একটা ডাল, চাল আর ময়দার একটা প্যাকেট। এই ডিস্ট্রিবিউশন সংস্থাগুলো জল দেয় না। কারণ জলের দাম খুব বেশি আর জল ওজনে খুব ভারী। তাই আবার জলহীন দীর্ঘ বিধ্ধস্ত রাস্তা পেরিয়ে, নিজের আশ্রয়ে ফিরে গিয়ে মানুষ কীভাবে রান্না করে, তা কেউ জানে না।
সেই ছোট ছেলেটি, আমির, হঠাৎ এগিয়ে আসে অ্যাগুলার আর পাশে দাঁড়ানো তাঁর সহকর্মীর দিকে। তাঁরা বুঝতে পারেন না কী হয়েছে, তাঁরা ভাবেন ছেলেটির কি আরও খাবার লাগবে বা ও কি আহত? কিন্তু না, এগিয়ে এসে ‘আমির’ নামের ওই ছেলেটি প্রথমে অ্যাগুলারের সহকর্মীর এবং তার হাত নিজের হাতে নেয়, চুম্বন করে যা আরব সংস্কৃতিতে বিনম্র সম্মান জ্ঞাপন আর তার মূল্য কতটা এই দুই প্রাক্তন সেনা, যারা দীর্ঘদিন ইরাক, আফগানিস্তানে ছিলেন, দু’জনেই তাঁদের অভিজ্ঞতায় বোঝেন। ইন্টারভিউতে এ-পর্যন্ত বলতে গিয়ে অ্যাগুলারের চোখ সজল হয়ে ওঠে কারণ তখন তিনি ওই নিষ্পাপ বালকের মধ্যে নিজের সন্তানের মুখ দেখতে পাচ্ছেন। প্রাক্তন ওই সেনা হাঁটু গেঁড়ে আমিরের সামনে বসেন এবং ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘পৃথিবীর মানুষ তোমাদের কথা ভুলে যায়নি। তারা তোমাদের কথা চিন্তা করে। আমেরিকার মানুষরা চিন্তা করে।’ এর পর আমির তার প্যাকেটগুলো পাশে রেখে তার অসম্ভব রোগা ছোট হাত দুটো দিয়ে ওঁকে জড়িয়ে ধরে, চুম্বন করে এবং পরে ইংরেজিতে বলে, ‘থ্যাংকিউ’।
তারপর, সে ফিরে যায় তার মূল দলে, যাদের সঙ্গে সে খাবার নিতে এসেছে। অ্যাগুলার বর্ণনা করেন– যেখান দিয়ে ক্যাম্পে মানুষ ঢোকে এবং যেখান দিয়ে বের হয় সেটি দু’টি আলাদা আলাদা পথ, প্রচুর মানুষ আসে, ত্রাণ নেয় এবং বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তার ধারে ছিল উঁচু টিলা, তার পিছনে থাকে সশস্ত্র ইজরায়েলি মিলিটারি। তারা স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান থেকে যখন তখন এই মানুষগুলির পায়ের কাছের মাটিতে বা শূন্যে গুলি চালায়, যাতে খাবার পাওয়া মানুষগুলো শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে তাড়াতাড়ি হেঁটে চলে যায়। অ্যাগুলার বলেন যে, যেক্ষেত্রে ত্রাণ নিতে আসা মানুষদের জন্য, আরবি ভাষায় লেখা নির্দেশচিহ্ন বা লাউডস্পিকারে ঘোষণা করা যায়– সেখানে কেন গুলি চলছে, তিনি ওইদিন বুঝেই উঠতে পারেননি। মেশিনগানের গুলির আওয়াজে তিনি ভাবেন তাঁদের উদ্দেশ্যে আক্রমণ আসছে, তাঁরা লুকিয়ে পড়েন। পরে বেরিয়ে দেখেন, মানুষদের শৃঙ্খলা শেখানোর, সতর্ক করার গুলি মোটেই মাটিতে বা শূন্যে চলেনি, চলেছে মানুষের শরীরে। আর মেশিনগানের গুলিতে হত মৃতদের মধ্যে আছে খালি পায়ে, দশ-বারো কিলোমিটার পায়ে হেঁটে আসা বালক আমিরও। এই ঘটনার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন অ্যাগুলার কতৃপক্ষের কাছে, মিডিয়ার কাছে। উত্তর আসে যে, তার অভিযোগ মিথ্যে, কারণ সতর্ক করার জন্য গুলি শুধুমাত্র মাটিতে চালানো হয় এবং আমিরের মৃত্যুকেও মিথ্যে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। তাকে ‘দেশদ্রোহী’ও বলা হয়, কিন্তু তিনি তার প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন নিরস্ত্র ক্ষুধার্ত মানুষদের হত্যার বিরুদ্ধে।
ব্রিটিশ সার্জেন নিক মেনার্ড– যিনি বেশ কয়েকবার দফায় দফায় গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে কাজ করেছেন, বলেছেন, শেষবার গাজায় গিয়ে বন্দুকের গুলিতে আহত যে কিশোরদের শরীরে তাঁরা সার্জারি করেছেন, তাঁরা সবাই ত্রাণ কেন্দ্রে খাবার নিতে এসেছিল। সেটাই এখন প্যাটার্ন হয়ে গিয়েছে। খাবার নিতে আসা মানুষদের শরীরে টার্গেট প্র্যাকটিসের মতো গুলি চালানো। তিনি এটাও বলেন যে, বাচ্চারা শুধু না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে, তাদের শুধু ‘চামড়া আর হাড়সর্বস্ব’ বলেও আর বর্ণনা করা যায় না। একটা গোটা প্রজন্মকে না-খেতে দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। অথচ কিছুদিন আগে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন যে, ইজরায়েলের ওপর গাজায় সাহায্য বন্ধ করার যে অভিযোগ এসেছে– তা সম্পূর্ণ মিথ্যে। তিনি বলেন, তাঁদের পলিসি যদি ত্রাণ বন্ধ করার হত, তাহলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় কোনও মানুষ জীবিত থাকত না। তিনি হামাস বাহিনীকে ত্রাণ চুরি এবং লুঠের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। তিনি বলেন, এই দুর্ভিক্ষের এ খবর সম্পূর্ণ ‘বানানো’। আর ঠিক সেই সময়ে গাজার নাসের হাসপাতালে শিশুবিভাগে ভর্তি কঙ্কালসার ১২ বছরের কিশোরি হুদা তার ইন্টারভিউতে বলে, তার প্রায় শুকিয়ে আসা শরীরে চলার শক্তিটুকু নেই, বলে আর কাঁদে। মেয়েটার কান্না থেকে বোঝা যায় না, এভাবে মরে যাওয়া তার পছন্দ নয় একেবারে। ওই হাসপাতালের শিশু চিকিৎসক ডক্টর আহমেদ বলেন, বাচ্চাগুলোর জন্য কোনও প্রোটিন নেই– কোথাও মাছ, মাংস নেই, একফোঁটা দুধ নেই, দই নেই। আবু সালেম নামের একটি ছ’মাসে বাচ্চা মারা গেল লিভারজনিত অসুখে– তার মা বলেন বাচ্চাকে খাওয়ার মতো কোনও দুধ, কোনও প্রোটিন জোগাড় করতে পারেননি তিনি। অনেক লড়াই করে শেষে হার মানলেন। নাসের হাসপাতালের আমেরিকান এবং ব্রিটিশ ডাক্তাররা বলেছেন কোনওভাবেই হাসপাতালে তাঁরা ক্ষুধার্ত সদ্যোজাত বা একদম ছোট শিশুদের জন্য বেবি ফরমুলা ঢোকাতে পারছেন না। বেবি ফরমুলা ইজরায়েলি সৈন্যরা কেড়ে নিচ্ছে। এপ্রিল থেকে মধ্য জুলাইয়ের মধ্যে ২০ হাজারেরও বেশি বাচ্চারা অপুষ্টিজনিত কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হয়েছে, তার মধ্যে ৩ হাজার চূড়ান্ত অপুষ্টির শিকার। পাঁচ বছর বয়সের নীচে শিশুদের অপুষ্টির কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে দ্রুত, জুলাইয়ের ১৭ তারিখের পর থেকে অগাস্টের ১৭, অর্থাৎ একমাসে হাসপাতাল রেকর্ড অনুযায়ী মৃত্যু হয়েছে ১৬টি শিশুর। শুধু হাসপাতালের রেকর্ডে।
‘ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্ক এজেন্সি’– বিশ্বের সবচেয়ে বড় ত্রাণ সংস্থা বারবার আবেদন করছে একুশ শতকে মানুষের বানানো দুর্ভিক্ষে কেন শিশুরা মারা যাবে? ৬ হাজার ট্রাক ভর্তি খাবার, স্বাস্থ্য সামগ্রী, ওষুধ নিয়ে তারা অপেক্ষা করছে বর্ডারের ওই পারে– দরজা খুলছে না। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প বহুদিনের বন্ধু এবং সহযোগী নেতানিয়াহুর এই ‘দুর্ভিক্ষ মিথ্যে’ কথাটি বিশ্বাস করেননি এবং একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন তদন্ত করার জন্য। গাজায় কর্মরত ডাক্তার, নার্সরা বিবৃতি দিয়েছেন ট্রাম্পের প্রতিনিধি মিস্টার উইটকফ যেন নাসের হাসপাতালে এসে, না-খেয়ে কঙ্কালসার এই শিশুদের দেখে যান, হাসপাতালের বাকি রোগীদের দেখুন যে কীভাবে মানুষ জোর করে না খেতে দিয়ে একটা জাতিকে এবং তাঁদের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে ফেলছে! কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, মানুষই তৈরি করেছে এই পরিস্থিতি। এইরকম হাসপাতালগুলোতে এসে না দেখলে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা না বললে এ পরিস্থিতি বোঝা সম্ভব নয়। ট্রাম্পের প্রতিনিধিরা ঘুরে গিয়েছেন, রিপোর্ট করেছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনও পরিবর্তন দেখা যায়নি। গাজার থেকে অনেক হাজার মাইলের নিরাপদ দূরত্বে বসে আমিরের গল্প বা এই না-খেয়ে প্রায় মৃত বাচ্চাদের ছবি দেখি, কিন্তু আসলে কল্পনাও করতে পারি না কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এরা আর এদের মা-বাবারা, যদি তাঁরা বেঁচে থাকেন। চ্যানেল পাল্টে দিই, এই দুর্বিসহ খবর পড়া বন্ধ করে দিই, নিজের জীবনযাপন করি, নিজেদের সমস্যায়, নিজেদের সুখশান্তির আশায়। কিন্তু মাঝে মাঝেই মনে হয়, আমাদের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষেরা, যাঁরা সবাই আজকের পৃথিবীর জনগণ হয়ে, এটার সাক্ষী হয়ে থাকছি প্রতিক্রিয়াহীন।
ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে কি?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved