অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা নিয়ে গবেষণার প্রথম কৃতিত্ব ক্লডিয়া ডেল গোল্ডিন-এর। তিনি অগ্রদূতী। আমেরিকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশমানতার দু’-শতক ধরে তথ্য বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা এমনকী, গাণিতিক বিচারের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন, উনিশ শতকের গোড়ায়, যখন শিল্পায়ন ঘটছে, সেই সময় থেকে বিশ শতকের গোড়া পর্যন্ত, যখন বিশ্বের বহু দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটে গেছে, ঘটে চলেছে, নারী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাড়ছে নারীর অবদান ও উপার্জন, সেই সময় কতক সমস্যা লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে।
অর্থনীতিতে এ বছরের নোবেল মেমোরিয়াল পুরস্কার পেলেন, ক্লডিয়া ডেল গোল্ডিন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপিকা তিনি। তবে তাঁর বিষয় শুধুই তাত্ত্বিক অর্থনীতি নয়। অর্থনীতির ঐতিহাসিক তিনি, সেইসঙ্গে শ্রম ও অর্থনীতির নিবিড় ও জটিল সম্পর্ক তাঁর গবেষণার অন্তর্ভুক্ত।
অর্থনীতিতে নোবেল জয়ের কৃতিত্বে, নারী হিসেবে গোল্ডিন তৃতীয়। ২০০৯ সালে অলিভার ই উইলিয়ামসনের সঙ্গে এই পুরস্কারের অংশীদার ছিলেন এলিনর অস্ট্রম। দশ বছর পার করে, ২০১৯ -এ অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাইকেল ক্রেমার ও এস্থার ডুফলো। এবার গোল্ডিন তৃতীয় প্রাপক হলেও, এই সম্মানের বিজয়িনী এককভাবে তিনিই।
মূলত যে-গবেষণা অধ্যাপিকা গোল্ডিনকে এই সম্মান ও খ্যাতির মঞ্চে নিয়ে এসেছে, তা হল, ‘অর্থনীতি এবং বাস্তব ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ।’
আপাতভাবে বিষয়টি অভিনব মনে না হলেও, অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রায়োগিকতার চেয়ে জটিল ও কঠিন আর কিছুই হতে পারে না। তাই বার বার, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে না দেখলে অর্থনীতির গবেষণা ও মানবসমাজে তার উপযোগিতা অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ অর্থনীতি বিজ্ঞান হয়েও অব্যর্থ বিজ্ঞান নয়।
বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রে গোল্ডিনের অবদান দীর্ঘপ্রসারী। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব যে কাজটির, তা হল, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা নিয়ে গবেষণা। এই বিষয়ে তিনি প্রথম কৃতিত্বের অধিকারিণী। তিনি অগ্রদূতী।
অর্থনীতির ইতিহাস যেহেতু তাঁকে চিন্তার বিশেষ ধারায় পরিচালিত করেছে, সেহেতু তিনি নারীশ্রমের অবদান, ইতিহাস, পরিবর্তন, পরিবর্তনের কারণসমূহ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করেছেন কালানুক্রমের সচেতন প্রেক্ষিতে। নারীশ্রম বিষয়ে, আমেরিকার বিগত দুশো বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি বর্তমান সময় পর্যন্ত নারীর অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। বিশ্বের বাজারে, আজও নারীশ্রম ও নারীর উপার্জনের অবদান অতিমাত্রায় অনালোচিত ও অনুল্লিখিত।
দুশো বা তারও বেশি বছর আগে, সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা নগণ্য হিসেবেই দেখা হতো। গৃহস্থালীর বাইরে নারীর কাজের অধিকার ছিল কৃষিক্ষেত্রে এবং কুটিরশিল্পগুলিতে। ক্রমে মানবসমাজের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতির সমন্বয়ে, শিল্পের বিকাশ ঘটে এবং খুব ধীরগতিতে, শিল্পায়নের শ্রমের বাজারে নারীর প্রবেশ লক্ষ করা যায়। পুরুষ কর্মীর তুলনায় এই অংশগ্রহণ ছিল অতি অল্প। কারণ, ঘরের কাজ ফেলে দূরে, দিনের অনেকটা সময়ে বাঁধা কাজের সুযোগ নারী পায়নি। শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণে নারীর অধিকার এবং সুযোগ ছিল না বললেই চলে। ক্রমে বাস্তব চাহিদার ভিত্তিতে, সমাজমানসের পরিবর্তন, নারীস্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাবে, সামাজিক রীতিনীতি নারীর পক্ষে প্রতিকূলতা হ্রাস করতে থাকে এবং নারীর পক্ষে দক্ষতা বৃদ্ধি, কাজের পরিসর বাড়িয়ে তোলা ও উপার্জন সমানুপাতে বিস্তারের পথ পায়।
গোল্ডিন আমেরিকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশমানতার দু’-শতক ধরে তথ্য বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা এমনকী, গাণিতিক বিচারের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন, উনিশ শতকের গোড়ায়, যখন শিল্পায়ন ঘটছে, সেই সময় থেকে বিশ শতকের গোড়া পর্যন্ত, যখন বিশ্বের বহু দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটে গেছে, ঘটে চলেছে, নারী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাড়ছে নারীর অবদান ও উপার্জন, সেই সময় কতক সমস্যা লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে। এক, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী-পুরুষের সমান পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হয়। দুই, বিবাহ ও মাতৃত্ব নারীর কাজের ক্ষেত্র ব্যাহত করে, তার উপার্জন শূন্যে এসে ঠেকে। তিন, সমাজে মেয়েদের গুরুত্ব কম থাকায় তারা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুবিধায় পুরুষের সমান অধিকার পায় না, যা তাদের দক্ষতা আয়ত্ত করার প্রতিকূল।
ইতিহাসের বিচারে এই পরিস্থিতিও পরিবর্তিত হতে থাকল। বিশ শতকে নারী শিক্ষার অধিকার পেল অনেক বেশি, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে কাজের ক্ষেত্র প্রশস্ত হল, শুধুমাত্র কারখানা, উৎপাদন ইত্যাদির মধ্যে শ্রমদান আবদ্ধ না থেকে, গড়ে উঠল মেধা ও শ্রমভিত্তিক কর্মাঞ্চল। নারীর কর্মাঙ্গন প্রশস্ত হল, বেড়ে উঠল নারীর উপার্জন, শ্রমের বাজারে নারীর চাহিদা ও মর্যাদা। বাজারে এল গর্ভনিরোধক বড়ি। নারীজীবনে নতুন দিগন্ত খুলে দিল এই বস্তু। অনাকাঙ্ক্ষিত মাতৃত্ব, একেবারে বালিকা বয়সের মাতৃত্ব সম্ভাবনা থেকে অনেকখানি মুক্তি পেল মেয়েরা। শিক্ষাক্ষেত্রে নারী নিজের বুদ্ধি, মেধা, শক্তি ও সৃজনশীলতার প্রমাণ রাখতে শুরু করল সাফল্যের সঙ্গে। নারীকে খাটো করে দেখা, বা, একই কাজের জন্য নারী ও পুরুষের পারিশ্রমিকের বৈষম্যমূলক সমাজমানস অনেকখানি অবসৃত হল ঠিকই, কিন্তু, গোল্ডিন বলছেন, এতদ্সত্ত্বেও নারী ও পুরুষের উপার্জন অনুপাত সমান হতে পারছে না।