Robbar

যে অমল দেশে দেশে ঘুরে বেরিয়েছে থিয়েটারের ডাকহরকরা হয়ে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 20, 2025 8:26 pm
  • Updated:September 20, 2025 8:26 pm  

কোরাস রেপার্টরি থিয়েটারের বাকি নাটকের হিসাব কিংবা সফলতা-অসফলতার খতিয়ান দেবে অন্যরা। কিন্তু একবুক জলে দাঁড়িয়ে তর্পণের রাত ভোরে– আমি মনে করতে পারছি না– এই বেঙ্গলি থিয়েটারের দেশে, এই ‘কলিকাতা’ নামক গণ্ডগ্রামে– আর কি কোনও গুরু পেরেছেন– থিয়েটারের, সর্বক্ষণের নাট‌্যকর্মীদের জন‌্য তেমন একটা কোরাস রেপার্টরি জন্ম দিতে। যেখানে একইসঙ্গে নাট‌্যকর্মীরা বেঁচে থাকা আর সৃজনে থাকার রসদ পাবেন। শিল্প আর জীবিকাকে– একসূত্রে গেঁথে নিতে পারবেন। নিজস্ব থিয়েটারের ভিলেজে।

শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

১.

একটি বালিকা গান গাইছে, ‘ওরে গৃহবাসী– খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল…।’
বৃদ্ধ রতন থিয়াম শুনছেন। আর একটু পরেই তিনি মারা যাবেন।
কবিরা বলেছেন, গুরু রতন থিয়ামের মৃত্যুপূর্বের এই দৃশ‌্যটি– ‘সিনেমার মতো’। সিনেমার লোকেরা বলছেন, এই অন্তিম ছবি– ‘কবিতার মতো’।
২.

কিন্তু রতন থিয়াম কে!
(গুগল-কাকু কিংবা ইউটিউবের মেসো-মাসিরা এই প্রশ্নের অনেকরকম কালারফুল উত্তর দিতে পারেন, দিচ্ছেনও, সুতরাং আমি আজ এইখানে– ‘তর্পণে: মানুষ রতন’ প্রসঙ্গে শুধু সেটুকুই বলব, যা আমার ব‌্যক্তিগত…)
তাছাড়া কে না জানেন: ‘যা কিছু ব‌্যক্তিগত তাই পবিত্র।’

৩.

গত শতকের শেষটায়– যখন কলকাতার শীত-কুয়াশার সন্ধেগুলো, একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে– লম্বা লাইন দিয়ে থাকত গুরু রতন থিয়ামের থিয়েটার দেখার জন‌্য অথবা হয়তো তার মধ্যে অনেকেই– গুরু রতনকে একবার চোখে দেখার জন‌্য। আমি সেইসব মণিপুরী-দিনের কথা বলছি। মনে পড়ে, সেসব দিনে নান্দীকারের সেট লাইটের টেকনিশিয়ানরা কিংবা সামান‌্য অতিতুচ্ছ নাট‌্যকর্মীরাও, সেই ‘গুরু’ সম্পর্কে সহজেই বলতে পারতেন, বলতেনও হামেশাই, ‘রতনদা, খুব মাই ডিয়ার লোক।’
অর্থাৎ সাধারণ-অসাধারণ– প্রত্যেকের কাছেই– এই ‘গুরু’, যে একটু পরে মারা যাবেন, তিনি ছিলেন জলের মতো সহজ-স্বচ্ছন্দ এক মানুষ।

……………………………

ভয় লাগবে তাকিয়ে থাকতে বেশিক্ষণ ওঁর দিকে। তবুও না-তাকিয়েও থাকা কঠিন। এমনই তাঁর রূপ, ব‌্যক্তিত্ব, সম্মোহন। আমাদের মধ্যে অনেকেই অনেক রাত তর্ক করেছেন, ওঁর নাটকগুলি দেখার পর, ওঁর দীর্ঘ কথা শোনার পর– কেন গুরু রতন থিয়াম, নিজেই হিরো বা নায়ক হলেন না? নাটকের, সিনেমার। অথচ কম বয়সেই থিয়াম– মণিপুরী থিয়েটারের শুধু নয়, ভারতের থিয়েটার-সংস্কৃতির আশ্চর্য এক নায়ক!

…………………………….

৪.

ভয় লাগবে তাকিয়ে থাকতে বেশিক্ষণ ওঁর দিকে। তবুও না-তাকিয়েও থাকা কঠিন। এমনই তাঁর রূপ, ব‌্যক্তিত্ব, সম্মোহন। আমাদের মধ্যে অনেকেই অনেক রাত তর্ক করেছেন, ওঁর নাটকগুলি দেখার পর, ওঁর দীর্ঘ কথা শোনার পর– কেন গুরু রতন থিয়াম, নিজেই হিরো বা নায়ক হলেন না? নাটকের, সিনেমার। অথচ কম বয়সেই থিয়াম– মণিপুরী থিয়েটারের শুধু নয়, ভারতের থিয়েটার-সংস্কৃতির আশ্চর্য এক নায়ক!

যে মানুষটা নাকি সব কাজ পারেন। থিয়েটারের। নাচ-গান-পদ‌্য-ছবি আঁকা-লেখা-অভিনয়-পরিচালনা-মঞ্চ-আলো, মেকআপ, সর্বত্র তিনিই শিক্ষক। তিনিই কর্মী। ‘তিনিই প্রভু তিনিই দাস’– তাঁকে অস্বীকার করা কঠিন।

৫.

আমাদের যৌবন সেই মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকত– যেমন করে মানুষ কম বয়সে হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। অথবা অচেনা সমুদ্রের দিকে উড়ে যাওয়া কোনও অ‌্যালবাট্রস পাখিদের দিকে বিস্ময়ে। একটু পরেই তিনি মারা যাবেন। কিন্তু আপনাদের জানলে ভালো লাগবে যে, মেয়েটি গুরু রতন থিয়ামকে এখন রবীন্দ্রনাথের গান শোনাচ্ছেন– সে জন্মসূত্রে মণিপুরী। আর রতন থিয়াম, যিনি শুনছেন, তিনি জন্মেছেন নবদ্বীপে। স্বভাবতই বাংলার সঙ্গে তাঁর যোগ নাড়ির, শুধুই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগ নয়। যদিও পৃথিবীর থিয়েটারের বারান্দায় তিনি ঘুরেছেন অনেক যুগ। গড়েছেন ‘কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার’। ওঁর স্বপ্নের দল। নাটকের দল।

৬.

একটা বাসে চড়ে ওই দল আসত। একাডেমিতে। থিয়েটার করতে। যেদিন ‘চক্রব্যূহ’ নাটকটা, গুরু রতন থিয়ামের কোরাস রেপার্টরি দল, একাডেমিতে অভিনয় করল– সেই রাতে নাটক শেষ হল যখন, ওরা সেই বাসে চড়ে সকলে চলে যাচ্ছিল– সেই রাতে একটি ছেলে, ভেবেছিল– ওই দলের সঙ্গে চলে যাবে জন্মের মতো, এই দেশ ছেড়ে– সেই দেশে, যে-দেশে ওই স্বপ্নের নাট‌্যদলটি থাকে। যাওয়া হয়নি। না-যাওয়া রয়ে গেল– তাই মনে মনে মনে জীবনভর। কিন্তু কী ছিল সেই ‘চক্রব্যূহ’ নাটকে?

কোরাস রেপার্টারি থিয়েটারের ‘উত্তর প্রিয়দর্শী’ নাটক

৭.

ছিল অনেক কিছুই। অসম্ভব কল্পনার। আমার শুধু মনে পড়ছে– অভিমন‌্যুর সেই গর্ভদশার কথা। যখন সে শুনতে পাচ্ছিল, পাচ্ছিল, তারপর পেল না– অর্জুনের শুভদ্রাকে বলে যাওয়া, চক্রব্যূহে প্রবেশ ও প্রস্থানের রূপকথা। সেই অসমাপ্ত প্রতিভার-যন্ত্রণা। গুরু রতন থিয়াম– মঞ্চের ওপর সেই গর্ভের অভিমন্যুর চক্রব্যূহে প্রবেশের– এবং না শুনতে পাওয়া প্রস্থানের– দৃশ‌্যটি সৃষ্টি করেছিলেন। কেমন করে?

বলছি শুনুন, অর্জুন-সুভদ্রা ছিলেন মঞ্চের একটা পৃথক জোনে। যেখানে অর্জুনের কথা শুনতে শুনতে সুভদ্রা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আর সম্পূর্ণ দৃশ্যের একটা মঞ্চের কোণে– একা অভিমন্যু চরিত্রটি, কিছুটা মাইমে আর মণিপুরী লোক-নৃত‌্যকে আশ্রয় করে নির্বাক-অভিনয়ের মাধ‌্যমে– বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন– অভিমন্যুর গর্ভদশায় থাকা আর না-শুনতে পাওয়ার যন্ত্রণা। জন্মাতে না-পারার, না-হয়ে উঠতে পারা এক প্রতিভার আর্তনাদ। খুবই সরল-সহজ কিন্তু কল্পনাতীত সেই দৃশ‌্য-কল্পনার আবহ, পরিবেশ-উপস্থাপনা।

প্রায় ৪০ বছর পরেও আমি দেখতে পাই, সেই দৃশ্যটিকে আজ সকালের আলোর মতো, বিশ্বাসযোগ‌্য ভাবে। একে বলি, মাস্টারি!

৮.

কোরাস রেপার্টরি থিয়েটারের বাকি নাটকের হিসাব কিংবা সফলতা-অসফলতার খতিয়ান দেবে অন্যরা। কিন্তু একবুক জলে দাঁড়িয়ে তর্পণের রাতভোরে– আমি মনে করতে পারছি না– এই বেঙ্গলি থিয়েটারের দেশে, এই ‘কলিকাতা’ নামক গণ্ডগ্রামে– আর কি কোনও গুরু পেরেছেন– থিয়েটারের, সর্বক্ষণের নাট‌্যকর্মীদের জন‌্য তেমন একটা কোরাস রেপার্টরি জন্ম দিতে। যেখানে একইসঙ্গে নাট‌্যকর্মীরা বেঁচে থাকা আর সৃজনে থাকার রসদ পাবেন। শিল্প আর জীবিকাকে– একসূত্রে গেঁথে নিতে পারবেন। নিজস্ব থিয়েটারের ভিলেজে।

সকাল থেকে রাত্রি। মাসের পর বছর। বছরের পর মাস। মানব-প্রকৃতি-নাট‌্যকলা একত্রে এক জীবনের কালচারে বাঁধা রইবে, এমন কোনও সংগঠনের কথা, গুরু রতন থিয়ামের কোরাস রেপার্টরির মতো? হতে পারে– না-ও হতে পারে– কেউ ভেবেছেন অথবা কেউ ভাবেননি। আমাদের মতো কলিকাতাজীবী পাঠ‌্যকর্মীরা জানতেন– তখন কেবল গুরু হাবিব তনভীর আর গুরু থিয়ামের দলটির কথা।

তবু, এরই মধ্যে মানুষ রতনের দিকেই আমাদের ঝোঁক ছিল বেশি। কেন? কেননা তিনি– নবদ্বীপের। কেননা তিনি বৈষ্ণব আর বার্লিন, মণিপুরী লোক-সংস্কৃতি আর মেরিকার আধুনিকতা– অথবা গ্রামীণ এবং আন্তর্জাতিক শিকড়ের এবং ডানার– দুই বিরল অথচ ভিন্ন সংস্কৃতিকে বাঁধার চেষ্টা করছিলেন এমন একটি সূত্রে– যার মধ্যে রয়েছে সনাতন ভারতের ধর্ম। দয়া। দয়ার ঐশ্বর্য। ডানার শিকড়। অথবা ভাবা যাক– গুরু রতনের সামগ্রিক জীবনের নাট‌্যকর্মের একটা বড় অংশ যদি হয় ‘যুদ্ধ’, তবে সেই যুদ্ধের পরিণতি অবশ‌্যই হয়– এক ধর্মীয় আত্মিক শান্তির পারাবত উড়িয়ে। একেবারে ইন্ডিয়ান স্টাইলে। অহিংসার মাটির পাত্রে ভরে ওঠে শেষমেশ যুদ্ধের শান্ত রক্ত আর ঘৃণার ফুল।

কোরাস রেপার্টারি থিয়েটারের ‘ম্যাকবেথ’

৯.

অজিতেশ– এই বাংলায় সর্বক্ষণের নাট‌্যকর্মীদের চেয়েছেন। বাদল সরকার বলেছেন– দারিদ্রের থিয়েটারের কথা অথবা থিয়েটারের দারিদ্র প্রসঙ্গে– কিন্তু কেউ-ই, গুরু রতনের মতো আমাদের কাছে কোনও নির্দিষ্ট পথ দেখাতে পারেননি। এ-ও সত‌্য। কোরাস রেপার্টরি সেই যুগের সেই সময়ের সর্বক্ষণের নাট‌্যকর্মীদের কাছে বেঁচেবর্তে থাকার এবং সংস্কৃতি চর্চার এক সেতুপথ ছিল, একথা আজ বলতে দ্বিধা হওয়ার কথা নয়।

এও বলা ভালো– বাংলার মুনিঋষিরা সে পথে হাঁটেননি, যে পথে নাট‌্যকর্মীদের মুক্তির পথ আছে। আজ বহু বহু যুগ বাদে– এই শতাব্দীতে তবু যেন দেখি কেউ কেউ গ্রামে মফস্সলে নগরে সেইসব পথের ইশারার দিকে যেতে চাইছেন। যে পথে আমাদের গুরু রতন থিয়াম গিয়েছিলেন একদিন।

১০.

মেয়েটি গেয়েই চলেছে। ‘ওরে গৃহবাসী, খোল, দ্বার খোল…।’
গুরু রতন এতক্ষণে বুঝি ঘুমের মধ্যে, গাঢ়, আরও ঘুমিয়ে পড়েছেন। বালক অমলের মতো। আর তাঁরই নিকটে বসে– রাজকবিরাজ নাকি ঠাকুরদার বদলে, আজ সুধাই গান গেয়ে চলেছে একা একা, বৃদ্ধ অমলের শিয়রে বসে–
‘স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল, দ্বার খোল।’

ছবিটা কেবল পাল্টে উল্টে গেছে। বাকি সব একরকম। একটি অন‌্যরকম অমলের গল্প। ডাকঘরের গল্প। যে অমল দেশে দেশে, ঘরে ঘরে, ঘুরে বেরিয়েছে থিয়েটারের ডাকহরকরা হয়ে। শুধু মণিপুরের, শুধু বাংলার, শুধু ভারতের হয়েই নয়, পৃথিবীর থিয়েটার তাই তাকে মনে রাখে বুঝি!

১১.

তর্পণ কেবল শুনেছি মর্ত মানুষের জন‌্যই করা হয়। কিন্তু শিল্পীর তো কোনও তর্পণ হয় না। হতে নেইও। যদি সেই শিল্পী– গুরু রতন থিয়ামের মতো কেউ হন। তাই এইসব কথার তর্পণ সেই মানুষ রতনের উদ্দেশে– যার পায়ের কাছে এসে একদিন নতজানু হয়ে আর্শীবাদ ভিক্ষা করে, মঞ্চে নামত মণিপুরী নাট‌্যসমাজ কিংবা অভিমন্যু, দুর্যোধন, অশ্বত্থমার মতো পৃথিবীর মহাকাব্যিক চরিত্রেরা। না, আজ কোনও পরাজিত ভালো কথা নয়। এসো, জল থেকে উঠে এসো– কবি।

১১.

বিষ্ণু দে হলে বলতেন,

‘নরকের দাহ দাহ, নরকের আত্মগ্লানি, হে যমজীবন!’
আমরাও সে কথা বলতে পারতাম আজ– আমরাও সে কথা বলতে পারতাম তখন– গুরু রতন থিয়ামের মৃত্যুর পাড়ে দাঁড়িয়ে– কিন্তু– তা আর পারছি কই– তাই লিখছি– ‘জীবন-মৃত্যুর এ গোধূলিই স্বচ্ছতা পাক।’

……………………………………………..

বি.দ্র. ‘মানুষ-রতন’ গল্পটি সমরেশ বসুর লেখা। একথা সকলেই জানেন। তাছাড়া ‘নান্দীকার’-এর এক ব‌্যাক স্টেজের বয়স্ক কর্মী ছিলেন সেদিন, তাঁকেও আমরা ‘রতনদা’ নামে ডাকতাম। আজ বোধহয় তিনি বেঁচে নেই। তিনিও গুরু রতন থিয়ামকে প্রণাম করে বলতেন: উনি হলেন খাঁটি রতন। আমরা হলাম নিকেল। রতনা, নানা, রদ্‌না। কথাটা কেন যে এই বয়সে এসে নতুন রকম শোনায়।