Robbar

জাকির হুসেনের ছায়া থেকে আমায় বের করে এনেছিলেন জাকির হুসেন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 20, 2025 6:55 pm
  • Updated:September 20, 2025 6:56 pm  

আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে আমি জাকির ভাইয়ের মতো অগ্রপথিক পেয়েছি। মানুষের জীবন যখন একটা মোড়ে এসে থমকে দাঁড়ায়, তখন এগিয়ে দেওয়ার জন্য কখনও কখনও একটু অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন পড়ে। একটা হাত, হাতটা চেপে ধরার জন্য। জাকির ভাই আমার জীবনের সেই অমূল্য অনুঘটক। সেই মানুষ, যিনি আমাকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন যদি উনি ওই কথাগুলো না বলতেন, হয়তো আমার কখনও সাহসই হত না কিছু করার। আমি ওঁর কাছে কৃতজ্ঞ। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞ।

বিক্রম ঘোষ

হিন্দু শাস্ত্রে পিতৃ-মাতৃতর্পণের পাশাপাশি দেবতর্পণ, ঋষিতর্পণ ইত্যাদির চল রয়েছে। ওস্তাদ জাকির হুসেন আমার পিতামাতা, গুরু কিংবা দেবতা না-হয়েও, তিনি আমার জীবনে এই সবক’টি ভূমিকাই পালন করেছেন কোনও-না-কোনও ভাবে। সাংগীতিক এবং অসাংগীতিক– দুই ভিন্ন জীবনেই তাঁর সঙ্গে আমার অঙ্গাঙ্গি যোগ। জন্মের অল্প ক’ বছর পরেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল। তার পর থেকে, সারাটা জীবন ধরেই তাঁকে দেখে চলেছি। তাঁর সঙ্গে আমার শৈশব কেটেছে; আমার সংগীত জীবনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে নাটকীয়ভাবে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাই এই স্মৃতিতর্পণ আমার কাছে যেমন আনন্দের, তেমনই দুঃসহ।

ভারতীয় সংগীতের দরবারে একেবারে ধূমকেতুর মতো এসে পড়েছিলেন জাকির ভাই। অমন অপ্রত্যাশিত আড়ম্বরময় প্রবেশ আমাদের এখনও বিস্মিত করে। একটা মানুষ, যিনি, রবিশঙ্করজি কিংবা আরও অনেকের সঙ্গে মিলে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে একটা বিরাট সর্বদেশীয় মঞ্চে পৌঁছে দিচ্ছেন। অমন প্রতিভা, অমন ব্যক্তিত্ব– আমাদের প্রজন্মের প্রায় সমস্ত তরুণ শিল্পীই ওঁর মতো হতে চাইত। আমিও চেয়েছি। বারবার। জাকির হুসেন হয়ে উঠতে। ওঁর পোশাকআশাক, চলনবলন, ওঁর বাজনা– যেভাবে মহিলারা ওঁর দিকে নিজেদের ছুড়ে দিতেন– তাছাড়া ওরকম দুনিয়া ঘুরে বেড়ানো বোহেমিয়ান যাযাবরের জীবনযাত্রা– কীভাবে যে একসঙ্গে এত কিছু করতেন! আশ্চর্য হয়ে যেতাম। ওঁর চেহারায়, উপস্থিতিতে, একটা আলাদা আবেদন ছিল। আমি সেটা নকল করতে চেয়েছি বহুবার– নিজস্ব স্বকীয়তাগুলো নিয়েই নকল করতে চেয়েছি। চেয়েছি, ঠিক ওঁর মতো করে সাউন্ড প্রোডাকশন করতে, ওঁর মতো মিউজিক বানাতে। সমস্ত দিক থেকেই আমার কাছে একটা বিরাট অনুপ্রেরণা ছিলেন জাকির ভাই। অল্প বয়সে যেমন হয়, বহিরঙ্গটা সবার আগে মনে ছাপ ফেলে, সেটাই সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করা হয়ে যায়। তবে ওঁর অন্তরঙ্গ, অর্থাৎ ওই অসামান্য সাংগীতিক বোধ– সেটা আত্মস্থ করতে আমার অনেকটা সময় লেগেছিল। 

আমাদের সম্পর্কের প্রথম পর্বটা খুব অন্যরকম। জন্মের এক বছরের মধ্যেই মা-বাবা আমাকে নিয়ে আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন। ওঁরা তখন ক্যালিফোর্নিয়ার ‘আলি আকবর কলেজ অফ মিউজিক’-এ শেখাতে শুরু করেছেন। সেসময় কলেজের একেবারে কাছেই সান রাফায়েলে একটা দোতলা বাড়িতে আমরা থাকতাম। জাকির ভাই তখন সদ্য ভারত থেকে গিয়েছেন, আমেরিকার সাংগীতিক পরিসরের সঙ্গে সবে সবে সম্পৃক্ত হতে শুরু করেছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, জাকির ভাই আর পণ্ডিত চিত্রেশ দাস সেসময় আমাদের বাড়ির নিচের তলাতেই থাকতেন। জাকির ভাইয়ের বয়স তখন হয়তো ১৮-১৯, আর আমি সবে তিন। আমার বাবা, পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ, তখন প্রায় সারা বছরই আলি আকবর খানের সঙ্গে টুরে ব্যস্ত থাকতেন। আর মা ক্লাস নিতেন। তাই হত কী, অনেক সময়ই আমাকে ওঁরা জাকির ভাইয়ের কাছেই রেখে চলে যেতেন। সেদিক থেকে বলতে গেলে, বাচ্চাবেলায় আমায় সামলানোর কাজটা অনেকটাই করেছিলেন জাকির ভাই। এ নিয়ে আমরা পরে নিজেদের মধ্যে অনেক হাসাহাসি করেছি।

Image

কয়েক বছর আগেও, টাটা স্টিল কালাম-এ ওঁর বই প্রকাশের সময় আমরা আড্ডায় বসেছিলাম। সেদিন মজা করে উনি সবাইকে বলেছিলেন– ‘এই যে এখন বিক্রম অনেক বড় বড় কথা বলছে; আপনারা জানেন না, আমি কিন্তু একসময় ওকে বেবিসিট করিয়েছি! ও এতটাই ছোট ছিল যে ওকে কাঁধে চাপিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। সেই বিক্রম এখন আমাকে এত বড় বড় প্রশ্ন করছে– বেশ মজা লাগছে, মাঝেমাঝে মনে মনে হেসেও ফেলছি।’ বলে, মঞ্চে বসেই আমার গালে চুমু খেয়ে নিলেন। আমাদের সম্পর্কটাই এমন। স্নেহের, ছেলেমানুষির। যখনই দেখা হত, উনি আমার চুল ধরে টানতেন, কিংবা দাড়ি ধরে মজা করতেন। আমার যখন ৫৫ বছর বয়স, তখনও উনি মজা করে আমার গাল টিপে দিয়েছেন। আমার এখনও মনে আছে, ছেলেবেলায় আমাকে একটা ‘গুফি’ টি-শার্ট কিনে দিয়েছিলেন।

একটা সময়ের পর আমাদের দু’জনেরই ভারতে ফিরে আসা। জীবনের উত্থানপতনের পথে চলতে শুরু করা। পরবর্তী সময়ের দেখাসাক্ষাতের যে ইতিহাস তার বেশিটুকুই কনসার্টে। আমি ওঁর বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি; আবার অনেকসময় এমনও হয়েছে যে আমরা দু’জনেই একই অনুষ্ঠানে বাজিয়েছি– আমি হয়তো আগে বাজাতাম, আর উনি সবশেষে মঞ্চে উঠতেন। তবে যখনই আমাদের দেখা হত, কথা হত– তখন একটা বিষয় সবসময়ই আমাদের মধ্যবর্তী আলাপ-আলোচনার সূচনা-সূত্র হয়ে উঠত– ‘শঙ্করদা’, আমার বাবা। ওঁর খুব কাছের মানুষ ছিলেন। একই বাড়িতে থাকতাম বলে ওঁদের মধ্যে চমৎকার একটা বন্ধুতা গড়ে উঠেছিল। বাবা যখন রেওয়াজ করতেন, অনেক সময়ই জাকির ভাই এসে চুপচাপ বসে শুনতেন। আমার পরিবারের প্রতি ওঁর এই টানটা, এই চমৎকার মিষ্টি সম্পর্কটা সারাজীবন ধরেই অটুট ছিল। 

১৯৯১ নাগাদ, আমায় যখন লোকে শিল্পী হিসেবে একটু একটু করে চিনতে শুরু করেছে, গড়িয়ায় একটা সারারাতের অনুষ্ঠান ছিল। সেই অনুষ্ঠানের শুরুর দিকে, আমি আর আমার গুরুজি পণ্ডিত এস. শেখর– দু’জনে মিলে একটা যুগলবন্দি করেছিলাম। উত্তর আর দক্ষিণের যুগলবন্দি। তখন কিন্তু এই ব্যাপারটা একেবারেই নতুন, এরকম যুগলবন্দি তেমন হত না। আমাদের বাজনা দিয়েই অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা, আর শেষে বাজানোর কথা জাকির ভাইয়ের। আমাদের বাজানোর সময় ছিল রাত ন’টা, আর উনি উঠবেন ভোর পাঁচটায়। আমরা সবে বাজানো শুরু করেছি, হঠাৎ দেখি উইংস-এর ধারে পর্দার আড়ালে জাকির ভাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আশ্চর্য হয়েছিলাম! ওঁর তো বাজানোর কথা ভোরবেলা, তবু অত তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলেন আমাদের বাজনা শোনার জন্য। এটাই ওঁর স্বভাব। এই চেষ্টাটা উনি সবসময় করতেন– সময় বের করে অন্যের বাজনা শুনতেন। মানুষের জীবনে, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে ভীষণ ‘ইনভেস্টেড’ একজন মানুষ।

পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ

১৯৯৯ সালে আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল, যেটা আমি কোনও দিন ভুলতে পারব না। তখন আমি রবিশঙ্করজির সঙ্গে ওয়ার্ল্ড টুরে বেরিয়েছি। লস অ্যাঞ্জেলসে থাকাকালীন জাকির ভাই আর এল. শংকরের একটা কনসার্ট দেখতে গিয়েছিলাম। মঞ্চের পিছনে কথাবার্তা চলাকালীন হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, পরের দিন কী করছি। তারপর পরদিন দুপুরে ওঁর হোটেলে খাওয়ার জন্য যেতে বললেন আমাকে। গেলাম। এবং সেই মধ্যাহ্নভোজন হয়ে দাঁড়াল চার ঘণ্টার দীর্ঘ এক আহার-আলোচনার সেশন। এবং আমার ধারণা, সেই চার ঘণ্টার কথাবার্তায় জাকির ভাই আমার অন্তর পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখে যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন।

মনে আছে, খেতে বসেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করছিস?’, বললাম, ‘রবিজির সঙ্গে বাজাচ্ছি, অনেক ক্লাসিক্যাল কনসার্ট করছি…’ আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘ওসব তো জানি, কিন্তু আনন্দ পাচ্ছিস?’ এই প্রশ্নটার উচ্চারণে, ওঁর দৃষ্টিতে এমন একটা অন্তর্ভেদী কুহক ছিল যে,  আমি সত্যি বলে ফেললাম। বললাম, ‘খুব একটা না’। আমার এখনও মনে হয়, উনি আগে থেকেই উত্তরটা জানতেন। কেবল আমার মুখ থেকে শুনতে চাইছিলেন। আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, “বুঝতে পারছি। তুই এত প্রতিভাবান– এমনটা হবারই কথা। তোকে ‘ডাইভার্সিফাই’ করতে হবে। কাজের মধ্যে, বাজনার মধ্যে বৈচিত্র আনতে না পারলে কিছুতেই বাঁচতে পারবি না।” 

জাকির ভাই আমার বড়বেলাটা খুব বেশি দেখেননি, কিন্তু ওইটুকু সামান্য দেখাতেই আমায় আগাগোড়া বুঝেছিলেন। আমি কেমন মানুষ, আমার ভেতরে ঠিক কী ধরনের দ্বন্দ্ব চলছিল– সে সবই তিনি ধরে ফেলেছিলেন। ওঁর মতোই, আমিও সারাজীবন ধরে তবলাকে মঞ্চের মধ্যমণি করে তুলতে চেয়েছি। তবলাবাদকরা তো বরাবরই মূল গায়ক বা বাদকের একপাশে বসা সঙ্গতকার, অনুসারী শিল্পী; সবসময়ই দ্বিতীয় স্থানে তাঁদেরকে দেখা হয়। এবং এই বিষয়টা আমার কোনও দিনই পছন্দ হত না। সঙ্গত করা আমার অপছন্দ ছিল না, কিন্তু সঙ্গতকারীদের প্রাপ্য সম্মান তো এখনও সর্বত্র দেওয়া হয় না। মূল শিল্প আর অনুসারী শিল্প– এই দ্বন্দ্বটা চিরকাল আমায় দুঃখ দিয়েছে। জাকির ভাই সেটা বুঝতেন। ভীষণ তীক্ষ্ণদর্শী মানুষ ছিলেন তো! উনি বুঝতেন, আমার ভেতরে অন্যরকম কিছু করার সাধ এবং সাধ্য দুইই আছে। শুধুমাত্র ‘সঙ্গতকার’-এর কাঠামোর ভেতর আটকে থাকলে আমি নিজের প্রতিভার সঙ্গে ন্যায়বিচার করতে পারব না। এবং আনন্দও পাব না। তাই সেদিন সরাসরি মুখের ওপর বলেছিলেন ‘ডাইভার্সিফাই’ করার কথা। 

সত্যি বলতে কী, ততদিনে আমিও এই বৈচিত্রের দিকটা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলাম। একটা ব্যান্ড তৈরি করতে চাইছিলাম। চাইছিলাম, একটা অ্যালবাম বানাতে। কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না। এবং আমার এই চিন্তাগুলোকে চিহ্নিত করে সাহস দেওয়ার মতো মানুষ তখন কেউ ছিল না। সেইদিন জাকির ভাই আমাকে বসিয়ে এমন কতগুলো কথা বলে দিলেন: আমার এই ভাবনা, আত্মপ্রত্যয়ের অভাব– এসবের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ যদি বলে, ‘না’ বলে কোনও অপশনই নেই– তাহলে যা হয় আর কী! আমি সবকিছু ছেড়ে অ্যালবামের পিছনে লেগে পড়লাম। কিছুটা সময়ের জন্য ক্লাসিক্যাল থেকে সরে এসে একটা ব্যান্ড বানালাম, একটা অডিও বানালাম– পুরো ব্যাপারটার ভেতর ঢুকে গেলাম। আমার জীবনটাই বদলে গেল।

আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে আমি জাকির ভাইয়ের মতো অগ্রপথিক পেয়েছি। মানুষের জীবন যখন একটা মোড়ে এসে থমকে দাঁড়ায়, তখন এগিয়ে দেওয়ার জন্য কখনও কখনও একটু অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন পড়ে। একটা হাত, হাতটা চেপে ধরার জন্য। জাকির ভাই আমার জীবনের সেই অমূল্য অনুঘটক। সেই মানুষ, যিনি আমাকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন যদি উনি ওই কথাগুলো না বলতেন, হয়তো আমার কখনও সাহসই হত না কিছু করার। আমি ওঁর কাছে কৃতজ্ঞ। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞ।

কয়েক বছরের মধ্যে আমার দল ‘রিদমস্কেপ’-এর খানিক পরিচিতি তৈরি হল। আনন্দ করে, নিজের মতো করে বাজনাটাকে নিয়ে ভাবতে পারছিলাম। কাজ করতে পারছিলাম। প্রচুর শো করতাম। নিজের দল নিয়ে প্রায় সারা পৃথিবী ঘুরে ফেললাম। ২০০৩ সালে সায়েন্স সিটিতে একটা ‘শক্তি কনসার্ট’-এ ওঁর সঙ্গে আবার দেখা। দেখা হতেই মজা করে বললেন– ‘আরে! আমি যা বলেছিলাম, তুই তো একেবারে সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছিস।’ তারপর শিশুর মতো হা হা করে হেসে উঠলেন।

২০০৪ নাগাদ, একবার ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। স্বভাবমতো উনি আবার আমায় একই প্রশ্ন করলেন– ‘কী খবর?’ আমি জানতাম, উনি আগে থেকেই জানেন আমি কী কাজকর্ম করছি। সেকথা উনি জানতে চাননি। বললাম, ‘আমি এখন আমার সাংগীতিক জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পর্যায়ে রয়েছি।’ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন পর্যায়?’ বললাম– ‘আমি এখন চেষ্টা করছি আপনাকে আমার ভেতর থেকে বের করে দিতে। নইলে আমি কখনও বিক্রম ঘোষ হয়ে উঠতে পারব না। আমি আরেকটা জাকির হুসেনের ছায়া হয়ে থেকে যাব।’ প্রথমে খানিক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এভাবে ভাবছিস কেন?’ বললাম– ‘এতদিন ধরে তো চেষ্টা করেছি আপনার মতো হতে। এবার চেষ্টা করব আমার মতো হতে। তার জন্য আপনাকে আমার সিস্টেম থেকে বের করতেই হবে।’ চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওঁর। উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘একদম ঠিক! খুব মূল্যবান কথা!’ আশ্চর্য যে, সামান্য এইটুকু অনুমোদন। সেটুকুই আমায় ওঁর ছায়া থেকে বের করে ‘বিক্রম ঘোষ’ করে তুলল।

নিজের মতো করে মানুষকে সাহায্য করার একটা পদ্ধতি ছিল ওঁর। আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন না, সবসময় নম্র। মনে আছে, আমরা বেঙ্গালুরু বিমানবন্দরের লাগেজ ক্যারোসেল-এ ছিলাম। জাকির ভাইয়ের তবলা এল। আমি বেল্ট থেকে তোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি বাধা দিলেন। বললেন, ‘আজ তুই আছিস। কাল যদি না থাকিস, আমাকেই তো করতে হবে। কেন আমার অভ্যাস নষ্ট করছিস?’

আমি এখনও ওঁর মৃত্যুর নির্মম সত্যটা মেনে নিতে পারি না। মাত্র ৭৩-এ মারা যাওয়া ওঁকে মানায় না। ওঁর যে স্পিরিট, তাতে আরও অনেক দিন, অন্তত ৯০ বছর বাঁচা উচিত ছিল ওঁর। আমার মনে পড়ে, ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর আমরা গোয়ায় ছিলাম। সেদিন রাতে সেরেন্ডিপিটি-তে জাকির ভাইয়ের অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানের পরে আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিয়েছি, হেসেখেলে গল্প করেছি। উনি আমার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলেন, ঠিক যেমন আমাকে নিয়ে বসে থাকতেন ছোটবেলায়। মজা করছিলেন ছেলের সঙ্গে। আমাকে দেখিয়ে ছেলেকে বলছিলেন– ‘ওর কথা শুনবি না। ও কিছুই জানে না।’ আমার ছেলেও খুব মজা পাচ্ছিল। সে-রাতে আমি ওঁকে মনে করালাম– ২৫ বছর আগে উনি আমাকে কী বলেছিলেন! উনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন– ‘ঠিকই বলেছিলাম, কি না?’ বললেন, ‘দেখ, কী চমৎকার একটা সাংগীতিক ভবিষ্যৎ তৈরি করেছিস! সিনেমা, ফিউশন মিউজিক করার পরেও এখন এত ক্লাসিক্যাল, তবলা একক বাজাচ্ছিস; মিউজিক কম্পোজিশন থেকে কিউরেশন করছিস– সবটা মিলিয়ে এক সমৃদ্ধ জীবন। আমি ভীষণ খুশি, ভীষণ গর্বিত তোকে নিয়ে।’ এখনও বিশ্বাস করতে পারি না, সেদিনের ঠিক এক বছর পর, ওই একই তারিখে উনি চলে যাবেন। ঈশ্বরকে স্পর্শ করা যায় না। আমি জাকির হুসেনকে স্পর্শ করেছি। উনি আমার ঈশ্বর নন। পিতা, মাতা, গুরু কেউ নন– ‘হিরো’। ‘হিরো’দের কখনও মৃত্যু হয় না।